#এক_আকাশ_দূরত্ব (২২)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
হাসিব উত্তরের আশায় নাজিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। নাজিয়া নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে কিন্তু ততবারই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
– “কি হলো নাজিয়া উত্তরটা দাও।”
নাজিয়া কাঁপা গলায় বলল,
– “আমি রাজি।”
হাসিবের মুখে হাসির রেখা দেখা গেল, নাজিয়ার দমবন্ধ লাগছে। মিথ্যা নাটক করে হোক আর যে কারনেই হোক আবরার ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের সাথে প্রেমের নাটক করতে হবে এইটা ভাবতেই একটা বাজে অনুভুতি হচ্ছে। নাজিয়ার জীবনে আবরার ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের স্থান আগেও ছিল না, আর কোনোদিন হবেও না। নাজিয়া শুধু এবং শুধুমাত্র আবরারের।
হাসিব খুশি হয়ে বলল,
– “আমি জানতাম তুমি আমাকে ফেরাতে পারবে না। থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ এন্ড লাভ ইউ। আমি তোমাকে রানি করে রাখব আই প্রমিস।”
নাজিয়ার গা রাগে, ঘৃনায় রি রি করে উঠল। অন্য পুরুষের কাছ থেকে এইসমস্ত শুনে নিজের উপরেই ঘৃনা হচ্ছে, ইচ্ছা করছে হাসিবকে ঠাটিয়ে দুটো চড় দিতে কিন্তু নিরুপায়। শ্রেয়াকে কথা দিয়েছে, ওর সম্মানহানী হতে দেবে না, অপরাধীকে শাস্তি দেবে। নিজের ওয়াদা রাখতে এইসব কিছু সহ্য করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
নাজিয়া হাসিবের দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে বলল,
– “স্যার আমি কি এখন বাড়ি যেতে পারি?”
– “কেন?”
– “আসলে একটু শরীরটা খারাপ লাগছে।”
– “খুব খারাপ লাগছে? আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
– “নাহ্ স্যার তার কোনো দরকার নেই, আমি একাই যেতে পারব।”
– “ওকে বাট সাবধানে যাবে।”
– “ওকে।”
নাজিয়া নিজের ডেস্কে থেকে ব্যাগ নিয়ে বের হতে হতে আবরারকে কল লাগল। ফোনটা বাজার সাথে সাথেই রিসিভ হলো।
– “হ্যালো বলো।”
– “কোথায় আছো তুমি?”
– “এই তো বাড়িতেই আছি।”
– “একটু আসতে পারবে!”
আবরারের কপালে ভাঁজ পড়ল। চিন্তিত গলায় বলল,
– “তুমি ঠিক আছো তো?”
– “হুমম। একটু আসো প্লিজ।”
আবরার বিছানা ছেড়ে উঠে শার্ট পড়তে পড়তে বলল,
– “আচ্ছা কোথায় আসব বলো।”
নাজিয়া ঠিকানা’টা দিয়ে রাস্তার ধারে ফুটপাতে বসে পড়ল। সবকিছু বড্ড এলোমেলো লাগছে ওর কাছে, এতদিন সবটা ঠিক ছিল কিন্তু এখন! হাসিব যদি ওর ক্লোজ হতে চাই তো! তখন নাজিয়া কি করবে? সবকিছুর চিন্তায় মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে আবরার’কে ঠকানো হচ্ছে না তো!
আবরার যতটা তাড়াতাড়ি পেরেছে নাজিয়ার দেওয়া ঠিকানায় উপস্থিত হয়েছে। প্রিয়তমা’কে রাস্তার পাশে ফুটপাতে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখে আবরারের চিন্তা আরো বাড়ল। এক ছুটে নাজিয়ার সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
– “এই নাজু আর ইউ ওকে!”
নাজিয়া সামনে তাকিয়ে নিজের ভালোবাসার মানুষ, নিজের অর্ধাঙ্গকে দেখে যেন দেহে প্রান ফিরে পেল। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল আবরারকে, যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। আবরার নাজিয়াকে নিজের বুকের সাথে আগলে সবটা স্বাভাবিক হবার সময় দিল।
ভালোবাসার মানুষের সংস্পর্শে আসলে অশান্ত মনটা নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। নাজিয়ার অশান্ত মনটাও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসল, আবরার সেটা বুঝে বলল,
– “চলো।”
– “কোথায়?”
– “গেলেই দেখতে পাবে। চলো তো।”
নাজিয়ার বর্তমান অফিস ও ফ্ল্যাটের মধ্যে একটা পার্ক পড়ে। আবরার নাজিয়াকে নিয়ে সেইখানেই আসলো। পার্কের মধ্যে থাকা লেকের পাশে বসল দুজন। নাজিয়া আবরারের কাঁধে মাথা রেখে সময়টাকে উপভোগ করতে লাগল। দুজন ভালোবাসার মানুষ পাশাপাশি বসে আছে অথচ তাদের মুখে কোনো কথা নেয়, দুজন দুজনকে অনুভব করে সময়টাকে উপভোগ করতে ব্যস্ত।
এইভাবে বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যায়। আবরার নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখল, নাজিয়া উদাসীন মনে লেকের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে নামমাত্র তাকিয়ে আছে, মাথায় অন্য কিছু ঘোরাঘুরি করছে।
– “নাজু।”
অনেকদিন পর আবরার নাজিয়াকে নাজু বলে ডাকল। একদিন নাজিয়া নিজেই এই ডাকে ডাকার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল কিন্তু আজ আর কোনো অধিকার আলাদা করে দিতে হয়নি। যেখানে পুরো মানুষটাই তার নিজস্ব সেখানে ডাকনাম বলাতে অধিকার দেওয়া লাগে কি!
– “হু বলো।”
– “কি হয়েছে? মনখারাপ কেন! হাসিব কি কিছু বলেছে?”
– “নাহ্। তবে আমার বড্ড ভয় লাগছে, মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হচ্ছে না কারোর মন নিয়ে খেলার অধিকার আমার নেই।”
– “মনখারাপ করো না। জানি আমাদের পথটা সঠিক না, কিন্তু এটা ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। তোমাকে নিয়ে আমার কত চিন্তা হয়, অফিসে ঠিকমতো কাজ করতে পারি না। ওই লোকটার সাথে তোমাকে রাখতে আমারও যে বড্ড ভয় করে।”
নাজিয়া আবরারকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তারপর মলিন গলায় বলল,
– “ভয় লাগে যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি তো!”
আবরার নাজিয়ার হাতকে নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,
– “কিছু হবে না। মৃত্যু ব্যতিত আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না।”
নাজিয়া ঘাড় নাড়ল। মুখে আশ্বাস দিচ্ছে ঠিকই কিন্তু ভয় দুজনের মনেই আছে।
—-
১সপ্তাহ কেটে যায়।
হাসিব আর নাজিয়ার সম্পর্ক আগের থেকে স্বাভাবিক। হাসিব নাজিয়াকে ফোন করে খোঁজখবর নেয়, গল্প করে। এইসব দেখে আবরার সামনে চুপচাপ থাকলেও মনে মনে ফুলছে। আর রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক নিজের বউয়ের সাথে অন্যের প্রেমালাপ কার ভালো লাগে ভাই!
নাজিয়া আবরারকে একটু রাগিয়ে দেবার জন্য ফোনটা স্পিকারে দিয়ে বলল,
– “কি করছেন আপনি?”
– “এই তো বসে বসে তোমার কথা ভাবছি।”
– “পাম দেবার আর জায়গা পাননি! বেকার কেন মিথ্যা বলছেন?”
– “আরে না গো সত্যি বলছি।”
– “আচ্ছা বিশ্বাস করলাম। তবে একটা কথা জানার ছিল।”
– “কি বলো।”
– “আমাকে কবে থেকে পছন্দ করেন?”
– “প্রথমদিন থেকে। যেদিন তোমাকে প্রথম দেখি সেইদিন থেকে তোমাকে আমার ভালো লাগে।”
আবরার আর সহ্য করতে না পেরে নাজিয়াকে দাঁড়ানো থেকে হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কোলের উপর বসিয়ে দেয়। আচমকা এইরকম হওয়াতে নাজিয়া আহ্ বলে চেঁচিয়ে উঠে।
হাসিব জিজ্ঞেস করল
– “কি হলো নাজিয়া? তুমি ঠিক আছো তো!”
– “হ্যাঁ। আপনি বলুন।”
হাসিব গল্প করতে শুরু করল, নাজিয়া একটা কথে উত্তর দিচ্ছে। আর ওইদিকে আবরারের দুষ্টুমির মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে। নাজিয়ার পেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে সাইড করতে লাগল, নাজিয়া ছাড়ার জন্য খোঁচা দিয়ে চলেছে কিন্তু আবরার তো ছাড়ার পাত্র না। নাজিয়ার পিঠ থেকে চুলগুলো সরিয়ে পিঠে ঠোঁটের পরশে দিতে লাগল। নাজিয়া পরেছে ফ্যাসাদে, না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে।
আবরারের দুষ্টুমির সাথে না পেরে বলল,
– “হাসিব আমি আপনার সাথে পড়ে কথা বলব কেমন।”
– “এনি প্রবলেম?”
নাজিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
– “একটা বাচ্চা অনেকক্ষন ধরে জ্বালাচ্ছে, তাকে একটু সামলাতে হবে।”
– “বাচ্চা! বাচ্চা কোথা থেকে আসলো?”
– “আমাদের বাড়ির বাচ্চা। আচ্ছা তাহলে রাখছি বাই।”
নাজিয়া ফোনটা কেটে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। আবরার নাজিয়াকে বিছানায় ফেলে মুখে ভালোবাসার পরশ দিতে লাগল।
– “এইগুলো কি হচ্ছে?”
– “আদর হচ্ছে, তুমি বুঝবে না।”
– ‘তাই!!”
– “হুমম। এখন চুপ করে থাকে, আমাকে আদর করতে দাও।”
দুজন ভালোবাসার আদর-চাদরে ভেসে গেল।
—–
পরেরদিন সকালটা স্বাভাবিক ভাবে হলেও অফিসের জার্নিটা স্বাভাবিক হলো না নাজিয়ার জন্য। আজ ওহ একা নয় শ্রেয়াও অফিসে যাবে। তাই আবরার আজ বের হতে পারবে না, প্রানকে সামলাবে।
প্রান প্রথম প্রথম কান্নাকাটি করলেও এখন গুড বয় হয়ে গেছে, আগের মতো বেশি আর কান্নাকাটি করে না একটু খাইয়ে দিলে চুপচাপ নিজের মতো খেলতে থাকে। তবে যখন ঝোঁক ধরে থামাতে গেলে পাগল হয়ে যেতে হয়, তখন নাজিয়া ছাড়া কেউ সামলাতে পারে না।
নাজিয়া আর শ্রেয়া একসাথে বাড়ি থেকে বের হলেও অফিসে কিন্তু একসাথে ঢুকল না। নাজিয়া ঢোকার ঠিক ৩০মিনিট পর শ্রেয়া অফিসে ঢুকল। এতগুলো দিন পর শ্রেয়াকে দেখে সবাই খুব অবাক হলো। শ্রেয়া কাউকে কিছু না বলে সোজা হাসিবের কেবিনের দিকে পা বাড়াল। নাজিয়ার প্রচন্ড টেনশান হচ্ছে, এরপর কি হবে!
#চলবে…..
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।