#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৮)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
নাজিয়া আবরারকে সবকিছু খুলে বলল, সবটা শুনে আবরার প্রচন্ড রেগে যায়। শ্রেয়াকে সববসময়ে বোনের নজরে দেখেই বড়ো হয়েছে, শুধুমাত্র মাঝের কয়েকটা বছর বিয়ের কথা উঠাতে আবরার শ্রেয়াকে এড়িয়ে চলত।
আবরারকে উত্তেজিত হয়ে পড়তে দেখে নাজিয়া বলল,
– “মাথা গরম করলে কিছুই হবে না। আমাদেরকে খুব শান্ত মাথাতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
– “কিন্তু আমি যে শান্ত হতে পারছি না। একটা মানুষ এতটা নীচ কিভাবে হয়?”
– “দুনিয়ার সবার মানসিকতা এক হলে তো হয়েই যেত। বাদ দাও সে তার হিসাব দেবে, এখন আমাদেরকে ভাবতে হবে কিভাবে শ্রেয়া’দির ভিডিওটা ডিলিট করা যায়।”
– “দাদাকে সবটা বলি, তারপর সবাই মিলে একসাথে বসে আলোচনা করব।”
– “হুমম সেটাই ভালো হবে।আর শোন তোমাকে আর একটা কাজ করতে হবে।”
– “কি কাজ?”
– “শ্রেয়া’দির বয়ফ্রেন্ড শান্তের সাথে মিট করতে হবে, আমার মনে হয় ওর সবটা জানা জরুরী।”
– “হুমম, আমারও তাই মনে হয়। তবে সেইসব হবে তার আগে দাদাকে সবটা বলতে হবে।”
– “হুমম।”
***
নাজিয়া প্রানকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আবিরের রুমের দিকে পা বাড়াল। আবরার সেখানেই আছে, দুই ভাইয়ে আলোচনা করছে কিভাবে কি করা যায়।
– “আসবো?”
– “আয়।” (আবির)
– “কি সিদ্ধান্ত হলো? কিভাবে অই করবে?”
– “সেটাই তো বুঝতে পারছি না, একজন এতবড়ো বিজনেসের সাথে আমরা সাধারন মানুষ পেরে উঠব কিভাবে?”
– “সবটা বুঝতে পারছি কিন্তু কিছু না করলে তো শ্রেয়া’দির জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।”
আবির -আবরার প্রচন্ড চিন্তিত। কিভাবে কি করা যায় সেটাই ভেবে পাচ্ছে না।আইনি ব্যবস্থা নিয়েও কোন লাভ নেয়, ওদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমানে কোনো প্রমান নেয় আর বিষয়টা জানাজানি হলে শ্রেয়ার নামে বদনাম রটে যাবে তাই বিষযটাকে কোনো ভাবেই আইনি আওতায় আনা যাবে না। নাজিয়া ওদের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল,
– “আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে।”
– “কি প্ল্যান?”
– “শ্রেয়া’দি লোকটার সাথে ক্লোজড হয়ে যদি ভিডিওগুলো ডিলিট করে দেয় তো।ক্লোজড মানে বলতে চাইছি, রিলেশনশিপে গিয়ে।”
– “সেটা মনে হয় না হবে, এমনিতেই শ্রেয়া যে পরিমান ভেঙে পড়েছে তাতে কিছুতেই এতটা নাটক করতে পারবে না। আর লোকটা শ্রেয়ার সাথে রুমডেট করতে চাইছে, শ্রেয়া ওর ক্লোজ হওয়া মানে সে রুমডেট করতে চাইবে।”
আবার সমস্যা! কিছুতেই মাথা থেকে বের হচ্ছে না উপায়গুলো।
নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “একটার পর একটা সমস্যা এসেই চলেছে, কিভাবে কি করব বলো তো! আচ্ছা শান্ত’দার সাথে যোগাযোগ করার কথা কি ভাবলে?”
– “নাজু তুই যেভাবেই হোক শ্রেয়ার ফোন থেকে শান্তর নম্বরটা জোগাড় কর, তারপর আমরা ওর সাথে বলছি।ওহ জানুক সবটা, তারপর কি করবে সেটা ওর ব্যাপার।”
– “ছেলেটা যদি সত্যি শ্রেয়াকে ভালোবেসে থাকে, তাহলে ওর বিপদে হাতটা ঠিকই ধরবে।” (আবরার)
—
২দিন কেটে যায়, এখনো কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। একটার পর একটা প্ল্যান করছে কিন্তু সেখানে যেকোন একটা সমস্যা হাজির হয়ে যাচ্ছে। আজ শান্তের সাথে মিট করার কথা, নাজিয়া শপিং করতে যাবার নাম করে আবরারের সাথে বেরিয়েছে, আবির অফিস থেকে আসবে। আর প্রান বাড়িতেই আছে শ্রেয়ার কাছে।
– “কি হলো এতো টেনশান করছ কেন?”
– “শান্ত বলে ছেলেটা যদি সবটা জানার পর শ্রেয়াকে ভুল বোঝে?”
– “এত টেনশান করার কিছু নেয়, এতে কিছু খারাপ হবে না উল্টো ভালো হবে। শ্রেয়ার জন্য ছেলেটা কতটুকু যোগ্য সেটা আমরা বুঝতে পারব,বুঝলে।”
– “হু।”
আবরার নাজিয়া কফিশপে এসে দেখল শান্ত অলরেডি চলে এসেছে। নাজিয়া শান্তকে না চিনলেও আবরার কোনো ভাবে চিনত, তাই ওর কোনো অসুবিধা হয়নি।
– “এক্সকিউজ মি।”
চেনা কন্ঠস্বর শুনে শান্ত মাথা তুলে তাকাল। সামনের মানুষটিকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না, বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরল।
– “হোয়াটস এ সারপ্রাইজ ব্রো। কতদিন পর তোর সাথে দেখা হলো, কেমন আছিস?”
আবরার হেসে ফেলল শান্তর উত্তেজনা দেখে।
– “আরে ভাই আসতে। এত তাড়াতাড়ি বললে উত্তর দেব কিভাবে?”
– “তোকে এতদিন পর দেখলাম, কি যে আনন্দ লাগছে বোঝাতে পারব না।”
আবরার শয়তানি হেসে বলল,
– “মেয়েদের মতো আচরন করছিস কেন? আবার…
শান্ত আবরারের পিঠে দুটো কিল বসিয়ে দিল। তারপর দুই বন্ধু মিলে হেসে উঠল, নাজিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কান্ড দেখে চলেছে ছেলেটা কে সেটা এখনো বুঝতে পারছে না।
শান্তর চোখ পড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নাজিয়ার দিকে। বন্ধুকে খোঁচা দিয়ে বলল,
– “কিরে গার্লফ্রেন্ড নাকি?”
আবরার নাজিয়ার দিএক তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল,
– “নাহ আমার বিয়ে করা একমাত্র বউ নাজিয়া।
– “তুই বিয়েও করে নিলি?”
– “হুমম। তোর তো পাত্তাই নেয়, সেই যে উচ্চমাধ্যমিকের পর হারালি কত খুঁজলাম তবুও তোকে পেলাম না।”
– “বাবা বদলি হয়ে চলে গেলেন, সেখানে গিয়ে নতুন পরিবেশ, সবকিছুর সাথে মানিয়ে নিতে নিতেই বছর কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না।”
– “বাড়ির সব কেমন আছে?”
– “মা মোটামুটি ভালোই আছে, আর বাবা ২বছর আগে মারা গেছেন। এখন সব দায়িত্ব আমার উপরে, সবকিছুর মধ্যে পুরানো আমিটাকে আর খুঁজে পাইনা।”
বাবার মৃত্যুর খবর শুনে আবরারের মনটা খারাপ হয়ে যায়,
– “সরি ভাই, আমি বুঝতে পারিনি।”
– “আরে কিছু না বাদ দে তো। তোর খবর বল কেমন আছে সব।”
– “চলছে আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।”
– “আচ্ছা তোরা একটু বস, আমি একজনকে কল করে মিটিং-টা ক্যানসিল করে দিচ্ছি। তারপর তোদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেব।”
– “ওকে।”
শান্ত ফোনটা নিয়ে সাইডে চলে গেল, নাজিয়া আবরারকে জিজ্ঞেস করল,
– “কে ছেলেটা?”
– “শান্ত।”
– “কে শান্ত?
হঠাৎ করেই নাজিয়ার মনে পড়ে যায় শ্রেয়ার বয়ফ্রেন্ডের নামও শান্ত তারমানে কি এই সে? নাজিয়া আবরারের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতে ওহ ইশারা করে বোঝাল ওর আন্দাজটাই সঠিক।
– “তুমি আগে থেকে জানতে?”
– “আমাদের বিয়ের কিছুদিন আগেই জেনেছিলাম সবটা। শান্তর সাথে যোগাযোগ করার আগেই সবটা এলোমেলো হয়ে যায়।”
নাজিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগে শান্ত সেখানে চলে আসে।
– “তো কি খাবি বল?”
– “কফি ঠিক আছে।”
– “আর কিছু!”
– “নাহ।”
– “আর ভাবি?”
– “আমার কোল্ড কফি।”
– “ওকে।”
শান্ত ওয়েটারকে ডেকে দুটো হট কফি আর একটা কোল্ড কফি অর্ডার দিল। নাজিয়া শান্তকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল কিন্তু আবরার ইশারায় থামিয়ে দিল।
আবরার শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করল,
– “তুই এখানে কি করছিস?”
– “আসলে বিষয়টা একটুখানি গন্ডগোলের।”
– “কেন?”
– “কালকে একজন হুট করে ফোন করে দেখা করতে চাইল, প্রথম আমি না করে দিয়েছিলাম পরে অনেক ভেবে রাজি হয়েছি।”
– “তা দেখা করবি না?”
– “পরে করব, তোর সাথে কতদিন পর দেখা হয়েছে আমার। এখন আড্ডা দেব শুধু।”
আবরার মৃদু হাসল, ছেলেটা এখনো বদলানো না।আবির আবরারকে ফোন করছে, শান্ত যে দেখা করাটা ক্যানসিল করে দিয়েছে এটাতে বেজায় ক্ষেপে গেছে আবির।
আবরার ফোনটা রিসিভ করে শুধুমাত্র একটা কথাই বলল,
– “কফিশপে চলে আসো, ফাস্ট।”
বিষয়টা আবির বুঝল না, কিন্তু যখন ডাকছে তখন তো যেতে হবে। আবির কফিশপের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
আবরার শান্তকে ইচ্ছাকৃত খোঁচা দিয়ে বলল,
– “তাহলে তুই বিয়ে করবি কবে?”
– “আর বিয়ে!”
শান্তর কন্ঠে স্পষ্ট তাচ্ছিল্য। আবরার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– “কেন? কি হযেছে?”
– “একজনকে ভালোবাসলাম কিন্তু সে হঠাৎ করেই কিছু না বলে সবজায়গা থেকে আমাকে ব্লক করে দিয়েছে।”
– “মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিসনি? জানতে চাসনি মেয়েটা কেন এইরকম করল?”
– “অনেকবার ফোনে ট্রাই করেছি, অন্য নম্বর দিয়েও কর করেছি। দেখা করার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু দেখা পায়নি। এই কয়েকটা দিন আমার যে কিভাবে কাটছে আমিই জানি।”
– “যদি শুনিস মেয়েটা আর এই পৃথিবীতে নেয় বা মৃ-ত্যুর পাথে লড়াই করছে তখন কি করবি?”
শান্ত আঁতকে উঠল, করুন কন্ঠে বলল,
– “ভাই প্লিজ এইসব বলিস না।ওর কোনো ক্ষতি আমি সহ্য করতে পারব না, সে আমার না হলেও ভালো থাকুক। প্রয়োজনে আমার আয়ু ওর হোক।”
আবরার মৃদু হেসে নাজিয়ার দিকে তাকাল, নাজিয়াও আবরারের দিকে তাকাল। দুজনে স্পষ্ট শান্তর চোখে খাঁটি ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু সবটা জানার পর ভালোবাসা’টা থাকবে তো?
#চলবে….
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।