#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৫)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
“আমি এই বিয়ে মানি না।”
আবরারের কথাতে সবাই চমকে উঠল, কমবেশি সকলেই জেনে গেছে আবরার নাজিয়াকে ভালোবাসে তাই চমকানোর মাত্রাটা একটু বেশিই ছিল।
আবির আবরারকে ধমক দিয়ে বলল,
– “এখন ঝামেলা না করে সাইনটা করে দে।পরে বসে সবকিছু ঠিকঠাক করা হবে।”
– “কখনোই না”
আবির বিরক্ত হয়ে বলল,
– “বাচ্চাদের মতো কি শুরু করেছিস বল তো! বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে, ইসলাম মতে নাজু আর তুই স্বামী-স্ত্রী তাহলে সামাজিক বৈধতা দিতে এতটা নাটক করছিস কেন?”
– “এই বিয়েতে আমার অনুমতি নিয়েছ?”
সকলের মুখটা থমথমে হয়ে যায়। আবরার সকলের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “তোমরা অই কেউ একটাবার আমার দিকটা ভেবে দেখছ! অন্য কারোর সাথে বিয়ে হবে ভেবে আমার কি অনুভূতি হয়েছে, সেটা কি কেউ একটাবার ভেবেছ? এতটা নাটক আমার সাথে না করলেও পারতে।”
আবরার রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করে দিয়ে চলে গেল, বসার ঘরের সকলের মুখ থমথমে হয়ে আছে। আবির মনে মনে অনুশোচনা করল, ছেলেটাকে এতটা ট্রেস না দিলেও হতো। আবির নাজিয়ার কাছে গিয়ে চাপা স্বরে বলল,
– “যা রগচটা বর’টার রাগ ভাঙা।”
নাজিয়া উশখুশ করতে লাগল, এত মানুষের সামনে দিয়ে কিভাবে যাবে! আবির বিষয়টা বুঝতে পেরে শ্রেয়াকে ইশারা করল নাজিয়াকে নিয়ে যাবার জন্য, শ্রেয়া ওকে নিয়ে সকলের আড়ালে এসে বলল,
– “আবরার প্রচন্ড রেগে গেছে সামলাও ওকে গিয়ে।”
নাজিয়া মৃদু হেসে বলল,
– “ওহ রাগ করেনি, অভিমান করেছে সবার উপরে। ওর মনে হয়েছে, সবাই ওর সাথে মজা করেছে, ওকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেয়েছে তাই রিয়াক্ট করে ফেলেছ।”
শ্রেয়া নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে শয়তানি হেসে বলল,
– “বাবা বিয়ে না হতে হতেই কত দিকে খেয়াল। যাও বরের কাছে যাও।”
নাজিয়া মৃদু হেসে ছাদের দিকে পা বাড়াল, ওহ জানে এই মূহুর্তে আবরার ছাদে ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে পারে না। আর ওর সন্দেহটাই ঠিক হলো, আবরার ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। নাজিয়া আবরারের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
– “ভাগ্য কতই অদ্ভুত তাই না!”
আবরার উত্তর দিল না, এমনকি পাশ ফিরে দেখলেও না। নাজিয়া আবরারের দিকে আর একটু সরে এসে বলল,
– “আমিই মনে হয় প্রথম বউ, যে বাসর রাতে না গিয়ে নিজের পায়ে হেঁটে বরের রাগ ভাঙাতে ছাদে এসেছে।”
– “তোমাকে কে আসতে বলেছে? চলে যাও।”
– “কেউ বলেনি নিজেই এসেছি, একটা গুড নিউজ দেবার ছিল।”
আবরার গম্ভীর গলায় বলল,
– “কি?”
– “আমি তোমার বউ হয়ে গেছি।”
কথাটা বলার সময়ে নাজিয়ার কন্ঠে অন্যকিছুর আভাস পাওয়া গেল। কিছুটা লজ্জা, কিছুটা আনন্দের মিশ্রনে এই অনুভূতি। এতগুলো দিন, বছর একপ্রকার একতরফা ভালোবাসার পর অবশেষে তাকে পেল এর থেকে আনন্দের অনুভূতি আর কি হতে পারে?
আবরার নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, হুট করে নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।
– “আরে আসতে লাগছে তো।”
আবরার আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “আমারও লাগত এতদিন।”
– “আর এখন?”
– “অনেক…. শান্তি লাগছে।”
নাজিয়া ফিক করে হেসে দিল। আবরার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাজিয়ার মাথায় ভালোবাসার পরশ দিল। এতদিনের অপেক্ষার পর ভালোবাসার মানুষটি আজ ওর একান্ত নিজের ব্যক্তিগত।উফ্ অনুভূতিটাই একদম আলাদা।
—
বর্তমানে শ্রেয়া আর আবরারের ঝগড়া চলছে, শ্রেয়া বলছে নাজিয়া ওর সাথে থাকবে আর আবরারের দাবি সে কিছুতেই তার বউকে অন্য কারোর কাছে দেবে না। আর এইদিকে ওদের ঝগড়া শুনে নাজিয়া লজ্জায় শেষ। আবির এতক্ষন এইখানে থাকলেও এদের ঝগড়া শুনে পালিয়ে গেছে, যতই হোক বড়ো দাদা তো। এরা যা ঠোঁট কাটা কখন কি বলে ফেলে কে জানে, তাই আগে- ভাগেই চলে গেছে। প্রান আজ ওর দাদু- দিদুনের কাছে থাকবে যদিও নাজিয়া বলেছিল ওর কাছে রাখার জন্য কিন্তু বড়োরা রাখতে দেয়নি অত্যন্ত আজকের দিনটা ওরা নিজেদের মতো করে কাটাক।
– “দ্যাখ শ্রেয়া এইটা কিন্তু ঠিক না, আমার বিয়ে করা বউ আর আমার কাছেই থাকবে না!”
– “আজকের দিনটা আমার কাছে থাকুক না।”
– “সারাদিন তোর কাছেই ছিল, এখন আমার কাছে থাকবে পালা এইখান থেকে।”
– “ঠিকাছে যেতে পারি কিন্তু…
– “আবার কিন্তু কি?”
– “পাঁচ হাজার টাকা দাও।”
– “এ্যাঁ!!”
– “এ্যাঁ নয় হ্যাঁ। তোমার বউকে এত সুন্দর করে সাজিয়ে দিলাম ফ্রিতে, আবার এখন তোমাদের প্লেস করে দিচ্ছি তো পাওনা একটা তো থাকেই তাই না!”
আবরার বুঝল এই মেয়ে কিছু না ধিয়ে কিছুতেই যাবে না, তাই বলল,
– “দুই দিই?”
– “দুই তে কি হবে? আমার পাঁচ লাগবে আর না যদি দাও তাহলে আজকে সারারাত আমি এইখানেই থাকব।”
আবরার নড়েচড়ে দাঁড়াল, এই মেয়ে এইখানে থাকবে মানে কি!
– “কি হলো? কি করবে বলবে তো!”
আবরার করুন চোখে নাজিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে, শ্রেয়ার হাতে তিনহাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বলল,
– “বইন প্লিজ মাফ কর। আমি আর পারব না।”
শ্রেয়া টাকাটা গুনে নিয়ে বলল,
– “এইবারের মতো ছাড় দিলাম, পরের বার..
আবরার পুরোটা বলতে না দিয়ে বলল,
– “আবার পরের বার কি! আমি কি বছর বছর বিয়ে করব নাকি?”
– “সে সময় হলে দেখা যাবে। এখন বাই, বেস্ট অফ লাক।”
শ্রেয়া একছুটে রুমের বাইরে চলে যায়। আবরার যেন দম ফেলে বাঁচে, ওই মেয়ে যদি সত্যি সত্যি এই ঘরে থাকত তো!
আবরার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এসে বলল,
– “এই ওযু করে আসো তো, একসাথে নামাজ পড়ব।”
দুজন নামাজ আদায় করে, নিজেদের নতুন জীবনের জন্য দোয়া করল।
—
আবরার নাজিয়ার হাতটাকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
– “আমাদের জীবনে কতকিছুই হয় তাই না!”
– “হুম। জীবন খরস্রোতা নদীর মতো, কখনো জোয়ার আবার কখনো ভাটা।কখনো ওঠা আবার কখনো পরা দুইয়ের মিশ্রনেই জীবন।”
– “আজ থেকে আমি তোমাকে নাজি বলে ডাকব।”
– “নাজি!”
– “হুমম। আমার নাজি।”
নাজিয়া মৃদু হাসল। আবরার নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
– “তোমার পরিবর্তন আমাকে ভাবিয়েছিল, আমি অনেক ভেবেও তোমার বদলে যাবার কারন খুঁজে পাইনি। অবশেষে আমাদের মধ্যেকার “এক_আকাশ_দূরত্ব’টা” মিটল।
নাজিয়া মনে মনে বলল,
– “আর সেটা কখনো তুমি জানতেও পারবে না। আমি চাই না, আমার কারনে তোমাদের মা- ছেলের সম্পর্কে কোনো আঁচ আসুক। মা ছেলের সম্পর্ক সুন্দর সম্পর্ক, সেটা আজীবন সুন্দর থাকুক এইটুকুই চাই।”
আবরার নাজিয়াকে ডেকে বলল,
– “কি ভাবছ?”
– “কিছু না। বলছি ঘুমাবে না?”
আবরার শয়তানি হেসে বলল,
– “বাসর রাতে কে ঘুমায়? সবাই তো বলে বাসর রাতেই বিড়াল মারতে হয়।”
নাজিয়া লজ্জা পেয়ে আবরারের বুকে মুখ লোকায়। আবরার হেসে উঠে প্রিয়তমার কান্ডে। দুটি মন,প্রান ভালোবাসার সাগরে একে অপরের সাথে মিশে গেল। ভালো থাকুক ভালোবাসারা।
—
সময় বহমান। দেখতে দেখতে কেটে গেছে একটা মাস। নাজিয়া নিজের নতুন সংসারে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। আবিরের মা নিজের কথা রেখেছেন, নাজিয়ার বন্ধু হয়ে উঠেছেন। সংসারের কাজ সেরে একসাথে আড্ডা দেওয়া, গল্প করা সবকিছুই চলে বউ-শাশুড়ির মধ্যে। প্রান ছোটমা আর দিদুনের আদর-যত্নে বেড়ে উঠছে। আবরার নিজের অফিস পরির্বতন করে নিয়েছে, সকালে বের হয় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায় আবিরেরও সেম অবস্থা। বাড়ি ফিরে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে পরিবারের সকলে মিলে একটা আড্ডায় মেতে উঠে, হইহই করে সময় কেটে যায়। সবকিছুর মধ্যে আবিরের বারবার নিসার কথা মনে পড়ে, সে থাকলে সবকিছু পূর্ন হতো।
দিনশেষে সবাই নিজেদের মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লে আবির বড্ড একা হয়ে পড়ে। প্রানটাও খুব ছোট, ওকে একা সামলে রাখতে পারবে না বলে নিজের কাছে রাখা হয়না। আবির জানে নাজিয়া কোনো অযত্ন করবে না তার ছেলের তবুও..
আবির নিসার ছবির উপর হাত বুলিয়ে বলল,
– “জানো নিসা আমাদের পরিবারটা আগের মতো পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে কিন্তু আমি অসম্পূর্ণ। তোমাকে ছাড়া আমি বড্ড নিঃস্ব, একা। দিনশেষে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার জন্য তুমি নেই, ক্লান্ত মনটাকে স্থির করার জন্য তোমার কাঁধটা নেই, মনখারাপের সময়ে আগলে রাখার জন্য তোমার বুক নেই, হাত নেই। আমি বড্ড একা হয়ে গেছি, তোমার আর আমার মাঝের দূরত্বটা এক আকাশ সমান হয়ে গেছে। আচ্ছা তুমি খুব ভালো আছো তাই না! আমি কষ্ট পাচ্ছি, সেইগুলো দেখতে তোমার খুব আনন্দ লাগছে তাই না!”
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল, দিনকে দিন একাকিত্ব আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। সারাদিনের ব্যস্ততা, দিনশেষে বাড়ি ফিরে সকলের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত থাকাতে কিছুই মনে হয় না কিন্তু রাত বাড়লেই স্মৃতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। এই রুম, রুমের প্রত্যেকটা জিনিসে নিসার স্মৃতি জড়িয়ে আছে, সেইগুলো কিভাবে ভুলবে!
নিসার ছবি নিজের বুকে জড়িয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে, সেইদিকে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙে ফোনের রিংটোনের আওয়াজে। আবির ঘুমঘুম চোখে ফোনটা কানে ধরতেই চমকে উঠল,
– “আবির বাবা সর্বনাশ হয়ে গেছে। শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছ, অবস্থা খুব খারাপ হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে।”
আবিরের ঘুম উড়ে যায়। শ্রেয়া সুই-সাইড করার চেষ্টা করেছে? কিন্তু কেন!!!
#চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।