এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১১

0
533

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১১)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

দিন কাটতে লাগল, শ্রেয়াকে নিয়ে আবিরের মা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। শ্রেয়া ঠিকমতো করে কিছুই সামলাতে পারছে না, সংসারের কথা না হয় বাদই দিলাম কিন্তু প্রানকে! তাকে তো সামলানোর জন্য একটা লোকের দরকার আর সেটা শ্রেয়া সামলে উঠতে পারছে না। প্রানের ঠান্ডা লেগে গেছে গুরতর ভাবে, ছোট শিশুটা সারাদিন কেঁদে কেঁদেই দিন‌কাটাচ্ছে। সবকিছু নিয়ে আবিরের মায়ের চিন্তা আকাশ ছোঁয়া।

আনমনে, চিন্তায় মগ্ন থাকা অবস্থাতে সিঁড়ি থেকে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়েন আবিরের মা।

শ্রেয়া রান্নাঘরে প্রানের জন্য খাবার করছিল, এর মধ্যে মামনির চিৎকার শুনতে পেয়ে তড়িঘড়ি এসে দেখল সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। আবিরের মা সেন্সলেস হয়ে গেছেন, কপালের কিছুটা অংশ কেটে গেছে। শ্রেয়া কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না, একদিকে প্রান খিদেতে কেঁদে চলেছে, আর অন্যদিকে মামনির এই অবস্থা। শ্রেয়া কোনদিকে যাবে! বুঝতে পারছে না। কিছু না বুঝতে পেরে আবরারকে কল লাগায়..

– ‘হ্যালো আবরার
– ‘কি হয়েছে তোমার গলা এইরকম লাগছে কেন?’
– ‘মামনি, মামনি সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি এখন কি করবো?’
– ‘আমি রাস্তায় আছি দশমিনিটের মধ্যে যাচ্ছি। তুমি মায়ের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করো ফাস্ট…

আবরার বাড়ির পথেই ছিল, শ্রেয়ার কথা শুনে বাইকের গতি বাড়িয়ে দিল।

আবরারের মাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে। অতিরিক্ত চিন্তায় ওনার প্রেশার একদম তলানীতে চলে গিয়েছিল সেই কারনেই মাথা ঘুরিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছেন। ভালোমতোই জখম হয়েছেন, ডাক্তার জানিয়েছে আপাতত এখন সম্পূর্ণ বেড রেস্টে থাকতে হবে।

নাজিয়ার বাবাই -মা আবিরের মায়ের এইরকম রকম খবর শোনামাত্রই দেখতে এসেছেন। পরিস্থিতি খারাপ দেখে নাজিয়ার মা আবিরের মায়ের কাছে থাকতে চেয়েছিলেন কিন্তু স্বামী সংসার ফেলে অন্য জায়গায় থাকাটা ওনার মতো গৃহিনীর পক্ষে সম্ভব নয় তাই নাজিয়াকে রেখে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা নিয়ে অবশ্য নাজিয়ার ঘোর আপত্তি, এতকিছুর পর আবার ওই বাড়িতে থাকতে মন করছে না কিন্তু বাবা মায়ের মুখের উপর কিছুই বলতে পারছে না।

৩দিন‌ পর…

আজকে আবিরের মায়ের বাড়ি ফেরার দিন। এই তিনদিন নাজিয়ার মা ওনার সাথে থেকেছিলেন, হসপিটালে একটা যুবতী মেয়েকে রাখার সাহস ওনার হয়নি তাই কষ্ট করে নিজেই থেকেছিলেন। আবিরের মায়ের যখন জ্ঞান ফেরে তখন নাজিয়ার মাকে সবক্ষন নিজের পাশে পেয়ে অবাক হন। তার সেবা, যত্ন সবকিছু দেখে মুগ্ধ হন। আজকে তো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন, সেখানে তো ওনার আপন মানুষগুলো একবারের জন্যও আসেননি। কথাতে বলে না, বিপদে পড়লেই মানুষ চেনা যায়, আবিরের মাও চিনেছে।

নিজেল সাথে নাজিয়াকে আহমেদ ভিলাতে ফিরতে দেখে আবিরের মা একটু অবাক হন। স্বামীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
– ‘নাজিয়া কোথায় যাবে?’
– ‘আমাদের বাড়ি।’
– ‘কেন?’
– ‘তোমার ভাই মেয়ে তো সবকিছু একা হাতে সামলাতে পারছে না, তাই নাজিয়াকে কাজের মেয়ে করে নিয়ে যাচ্ছি।’

খোঁচা মেরে কথাটা বললেন আবিরের বাবা। বিষয়টা আবিরের মায়ের কাছে কিরকম একটা শুনতে লাগল, চুপচাপ সবকিছু গিলে নিয়ে ঠাঁই বসে থাকল।

নাজিয়াকে উনি প্রথম থেকে অপছন্দ করেন বিষয়টা এইরকম না। আসলে কিছু কারনের জন্য নাজিয়া ওনার চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে।

তখন আবির সবেমাত্র কলেজ শেষ করে চাকরিতে জয়েন করেছে, আবিরের মা বেজায় খুশি ওনার এতদিনের ইচ্ছা ভাইয়ের মেয়ে শ্রেয়াকে আবিরের বউ করে আনবে। আসলে ইচ্ছাটা ছিল ওনার মায়ের, আবিরের মা নিজের মাকে বড্ড ভালোবাসতেন। মা শখ করেছিলেন আবিরের সাথে শ্রেয়ার বিয়েটা দেখে যাবেন কিন্তু তার আগেই উনি মারা যান, মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরন করতে পারবে এর থেকে আনন্দের কি হতে পারে!

আবিরের মা বিয়ের কথা তুলবেন তার আগেই আবির জানায় একটা মেয়েকে ভালোবাসে। বিষয়টা উনি মানতে নারাজ, স্বামীকেও বলেছিলেন, এই সম্পর্ক মানলে উনি এই সংসার ছাড়বেন। ফ্যাসাদে পড়ে স্বামীও কোনো সিদ্ধান্ত জানান দেননি। তখনি নাজিয়া কিভাবে যেন আবিরের বাবাকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে ফেলে, আবিরের মায়ের সব রাগ গিয়ে পড়ে নাজিয়া ও নিসার উপর। যদিও সবটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যায়, আবিরের মা নিজের সিদ্ধান্ত বদল করে শ্রেয়ার সাথে আবরারের বিয়ের কথা ভাবেন। মানে উনি শ্রেয়াকে এই বাড়ির বউ করবেনই এইরকম একটা ব্যাপার।

নিসার ব্যবহার যত্ন সবকিছু আবিরের মায়ের মন জয় করে নেয়। নিসাকে আবিরের বউ হিসাবে মেনে নেয়, সবকিছু ভালোই চলছিল হঠাৎ করেই আবরারের কিছু ব্যবহার ওনার নজর কাড়ে। উনি বুঝতে পারেন ছেলে প্রেমে পড়েছে, ওনার প্রচন্ড রকমের রাগ হয় এইবারেও কি উনি কথা রাখতে পারবেন না!

ছেলের আচার-আচরন দেখে উনি খুব সহজেই ধরে ফেলেন আবরার কার প্রেমে পড়েছে। তখন সমস্ত রাগটা ওনার নাজিয়ার উপর গিয়ে পড়ে, ওর কারনেই সবকিছু হয়েছে। তীব্র রাগ-ক্ষোভ নিয়ে উনি নাজিয়ার মুখোমুখি হন।

– ‘নাজিয়া।’
– ‘জ্বি আন্টি বলুন..
– ‘আবরারকে পছন্দ করো?

নাজিয়ার মুখটা হাঁ হয়ে যায়। একজন মা তার ছেলের ব্যাপারে কাউকে এইরকম প্রশ্ন করতে পারে বলে নাজিয়ার ধারনা ছিল না।

– ‘মুখের দিকে না তাকিয়ে উত্তর দাও।’
নাজিয়া ছোট থেকেই মুখচোরা স্বভাবের, যা বলার সোজাসুজি বলে দিতে ভালোবাসে। তাই কথাটা গোপন না করে বলল,
-জ্বি।

নাজিয়ার সোজাসুজি উত্তর শুনে আবিরের মায়ের রাগটা আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল,
– ‘বেয়াদব মেয়ে। নিজের মুখে আবার বলছো!’
– ‘আন্টি আপনিই কিন্তু জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আমি তো শুধু উত্তর দিয়েছি।’
– ‘শোনো মেয়ে আমার সাথে বেশি পাকামো করতে এসো না। আর আবরারের থেকে দূরে থাকো, ওর বিয়ে আমার ভাতিজির সাথে ঠিক করা আছে।’

নাজিয়া চমকালো, বিষয়টা সম্পর্কে ওহ অবগত ছিল না। নাজিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেইই আবিরের মা আবারো বললেন,

– ‘আমার বারন করার পরেও যদি আবরারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা যোগাযোগ করার চেষ্টা করো তাহলে কিন্তু বড্ড ভুল করবে। ভুলে যেও না এইটা তোমার দিদির সংসার তোমার করা ছোট ভুল তোমার দিদির সংসারটাকে শেষ করে দিতে পারে। তাই সাবধান।’

দিদির সংসারের প্রসঙ্গ আসতেই নাজিয়া দমে গেল। ওহ ভালো করেই জানে নিসা আর আবির দুজন দুজনকে ঠিক কতটা ভালোবাসে, ওহ কখনোই নিজের জন্য ওদের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারবে না।

আবিরের মায়ের কথা শুনে, দিদির সংসারককে শান্তিপূর্ণ রাখতে নাজিয়া আবরারের জীবন থেকে সরে আসে। আবরারের সাথে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বন্ধ করে পড়াশোনার জন্য হোস্টেলে চলে যায় তারপর আবারো নিসার প্রেগন্যান্সির সূত্রে দুজন মুখোমুখি হয় তারপরেরটা সবারই জানা।

ওনার ভাবনার মাঝে গাড়ি বাড়ির সামনে চলে আসে। আবরার ওর মাকে ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। নাজিয়া সবকিছু গুছিয়ে ওনার ঘরে রেখে আসেন।

যত্ন-আত্তিতে ওনার দিন ভালোই কাটতে লাগল। আবিরের মা নিজের করা ভুলগুলোকে বুঝতে পেরেছেন, হয়তো এই এক্সিডেন্টটা না হলে উনি ওনার ভুল বুঝতে পারতেন না। কিন্তু বড্ড সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। একদিকে ছেলে একজনকে ভালোবাসে আর অন্যদিকে একটা মেয়েকে কথা দিয়েছেন বাড়ির বউ করবেন এই পরিস্থিতিতে ওনার কি করা উচিত সেটাই ভেবে উঠতে পারছেন না।

আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আছে, যাদের কাছে নিজের ওয়াদার দাম অনেক। যদি কোন একটা কথা কাউকে দিয়ে থাকেন তো, সেটা যেকোন মূল্যে যেকোন ভাবে পূরণ করার চেষ্টা করেন। ঠিক তেমনি আবিরের মা, নিজের মায়ের শেষ ইচ্ছা রাখতে গিয়ে অনেক অন্যায় করেছেন। দুটো ভালোবাসার মানুষকে আলাদা করার চেষ্টা করেছেন তার জন্য কম শাস্তি তো পাননি। আদরের ছোট ছেলে কর্মসূত্রে বাইরে চলে গেল, তারপর মেয়েতূল্য বউমাকে হারালেন, সংসার নামক বোঝাটা আবারো ঘাবড়ে এসে বসল, স্বামী- সন্তানদের সাথে সম্পর্কে তিক্ততা আসলো। ভাইয়ের মেয়েকে বাড়িতে এনে পরীক্ষা করতে গিয়ে বুঝলেন, মেয়েটা তার সংসারের দায়িত্ব নিতে পারলেও প্রান’এর দায়িত্ব নিতে পারবে না। আর সবশেষে নিজে আঘাত পেয়ে হসপিটালে ভর্তি হলেন। তার পরিবার, প্রিয়জন তাকে ছাড় দিলেও উপরওয়ালা ওনাকে ছাড় দেননি শাস্তি ঠিকই দিয়েছেন।

আবিরের মা নিজের ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আনমনে নিজের করা কাজগুলোর কথা ভেবে চলেছেন। কতই না খারাপ ব্যবহার করেছে নাজিয়ার সাথে অথচ মেয়েটা এখন ওনারই সেবা করে চলেছেন। মনে মনে বড্ড অনুতপ্ত উনি, নাজিয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে চান কিন্তু কিভাবে চাইবেন সেটাই বুঝতে পারছেন না।

– ‘মা আসবো?’

ছেলের কন্ঠস্বর শুনে আবিরের মা ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলেন। দরজায় আবির দাঁড়িয়ে আছে,

– ‘আয় বাবা ভেতরে আয়।’

আবির মায়ের পাশে বসে মায়ের শরীরের খোঁজ খবর নিয়ে বলল,
– ‘মা তোমার সাথে আমার একটা কথা বিষয়ে কথা ছিল। ‘
– ‘বল।’
– ‘আমি আবরার আর নাজিয়ার বিয়ে দিতে চাই।’

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে