#এক_আকাশ_দূরত্ব (৭)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
‘আপনারা নিজেদের সামলান, আমরা অনেক চেষ্টা করেও প্রেসেন্ট’কে বাঁচাতে পারিনি। সি ইজ নো মোর ভেরি সরি…
একটা দমকা হাওয়া সবটা এলোমেলো করে দিলো। কাউকে সন্তান হারা, কাউকে বোন হারা, আবার কাউকে মা হারা করে দিলো। আবির কথাটা শোনার পর থেকে পাথর হয়ে গেছে, আবরার নাজিয়া আর আবিরকে একসাথে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে চলেছে। বাধ্য হয়েই ওর বাবাকে এবং নিসার বাবাকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে আস্তে বলল।
আবরার আবিরের কাঁধে হাত রাখতেই ওহ পাগলের মতো প্রলাপ বকতে লাগল।
– ‘এই আবরার ডাক্তারটা কি পাগল নাকি! দ্যাখ কিসব উল্টো পাল্টা কথা বলে গেল তোর ভাবি নাকি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। দূর এইটা হতে পারে নাকি! তোর ভাবি আমাকে কথা দিয়েছে আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না, একসাথে আমরা সংসার করব। বাবুকে মানুষের মতো মানুষ করব আর ডাক্তার’টা কিসব বলে গেল বল তো!’
দাদার কথাগুলো শুনে আবরারের নিজেরই দমবন্ধ করা অনুভূতি হচ্ছে। নিসাকে ওহ বড়ো বোনের মতো ভালোবাসত, ওর মৃত্যুটা সবার জন্যই একটা বড়ো যন্ত্রনার। নাজিয়া বাচ্চাটাকে আঁকড়ে ধরে কেঁদেই চলেছে, বাচ্চাটাকে একটুও আলাদা করছে না এইটা যে ওর দিদির শেষ চিহ্ন তাকে কিভাবে নিজের থেকে আলাদা করবে!
দুইদিকে দুইটা মানুষ পাগলের মতো আচরন করে চলেছে, আবরারের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। কাকে ছেড়ে কাকে সামলাবে বুঝতে পারছে না। হসপিটালের ফর্ম পূরণ করতে হবে তবে নিসার লাশকে নিয়ে ফিরতে পারবে অনেক কাজ করতে হবে কিন্তু একা হাতে আর কতদিক সামলাবে!
আবরারের বাবা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। বাবাকে দেখা মাত্রই আবরার উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরল, চোখ নিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, এতক্ষন নিজেকে সামলে রাখতে পারলেও আর পারল না। ছেলেকে বিধ্বংস্ত দেখে উনি বললেন,
– ‘কি হয়েছে! সবকিছু ঠিক আছে তো?’
– ‘না বাবা কিছু ঠিক নেই। ভাবি আর আমাদের মাঝে নেই, দাদার অবস্থা পাগল প্রায়, একা একা থাকা বলে চলেছে আর নাজিয়া তো কেঁদেই চলেছে আমি কি করব বাবা।’
আবিরের বাবা বড়ো একটা ধাক্কা খেলেন। নিসা ওনার বাড়িতে পুত্রবধূ হয়ে আসার পর থেকে নিসাকে মেয়ের নজরেই দেখে এসেছেন। মেয়ে না থাকার আক্ষেপটা নিসার দ্বারাই পূর্ন করতে চেয়েছিলেন আর নিসাও নিজের সবটা দিয়ে মেয়ে হয়ে উঠেছিল। বিয়ের এত বছরেও বেবি না হওয়া নিয়ে ওনার কোনও আক্ষেপ ছিল না আর যখন নিসা প্রেগনেন্ট শুনলেন তখন খুব খুশি হয়েছিলেন প্রানভরে দোয়া করেছিলেন। মেয়ে তূল্য বউমা আর পৃথিবীতে নেই এইটা তিনি মানতে পারছেন না। আর এইদিকে আবরারের কথা শুনে আরো ভেঙে পড়েছেন। কে কাকে সামলাবে সেটাই কেউ বুঝতে পারছেন না। সবার মনটাই চূর্ন- বিচূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নিসাকে ওর শশুর বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে ।নাজিয়ার মা মেয়ে হারানোর শোকে কাঁদতে কাঁদতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। আবিরের মা অনুভূতিহীন হয়ে নিসার লাশের দিকে তাকিয়ে আছেন, নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে সেইদিন উনি ঝামেলা না করলে হয়তো নিসা এই বাড়িতেই থাকত আর জীবিত থাকত।
নিসার বাবা এককোনে বসে চোখের পানি ফেলে চলেছে , একজন বাবার কাছে তার সন্তানের লাশ কতটা ভারী সেটা একমাত্র তিনিই জানেন । আবিরের বাবা ওনার কাছে বসে আছে ওনার চোখেও পানি।
আবরার আবিরের কাছে আছে, আবির কিরকম একটা গুম মেরে গেছে। আর নাজিয়া! সে তো নিজের মধ্যেই নেই এত কান্নাকাটি, লোকজনের ভীড় অথচ নাজিয়া এইখানে উপস্থিত নেই ওহ নিজের ঘরে বাবুকে নিয়ে খেলতে, গল্প করতে ব্যস্ত। নাজিয়া যেন অন এক জগতে বসবাস করছে, যেখানে কোনো দুঃখ নেই কোনো অনুভূতি নেই।
নিসার দাফন কার্যের সময় চলে আসে। সবাইকে শেষ বারের মতো নিসাকে দেখানো হয়, নিসার বাবা মা, আবিরের বাবা মা আবির সবশেষে নাজিয়াকে নিয়ে আসা হয়। নাজিয়ার কোলে ছোট বাবুটা যে মায়ের আদর পাবার আগেই মাকে হারিয়ে ফেলেছে। নাজিয়া নিসার দিকে তাকিয়ে আছে, সাদা দুধের মতো ফর্সা মুখটাই গোলাপী ঠোট চোখগুলো বন্ধ করা যেন মনে হচ্ছে নিসা মুখ চেপে নিজের হাসি আটকে রাখছে। নাজিয়া মুগ্ধ নয়নে নিসার দিকে তাকিয়ে রইল। কম্পিত হাতটা নিসার মুখমন্ডল স্পর্শ করার জন্য বাড়াতেই কয়েকজন স্পর্শ করতে বারন করল। নাজিয়া হাতটা গুড়িয়ে দিয়ে বাবুর দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘দেখছছিস সোনা ওরা তোর মাকে আমাকে ছুঁতে দিলো না। কিন্তু দ্যাখ না আমার না বড্ড লোভ হচ্ছে তোর মায়ের সুন্দর মুখশ্রীটা স্পর্শ করার। দ্যাখ সোনা তোর মা তোর দিকে তাকিয়ে হাসছে তুইও একটু হেসে দে।’
বাবুটা কি বুঝল কে জানে হাত পা ছড়িয়ে হাসতে লাগল। নাজিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল,
– ‘দেখেছিস দিদি তোর ছেলে কিন্তু আমার কথা সব শোনে, আজ থেকে ওহ তোর ছেলে নয় ওহ আমার ছেলে আমার প্রান।’
নাজিয়া বাবুর কপালে চুমু এঁকে দিলো। সবাই অবাক চোখে নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আবরার সহ আরো কিছুজন নিসার লাশটাকে জানাযার জন্য নিয়ে চলে গেল। নিসার লাশটা নিতে চলে যাবার পরপরেই নাজিয়া ঢুকরে কেঁদে উঠল, পাগলের মতো আচরন করতে লাগল। নাজিয়ার এক কাজিন ওর কোল থেকে বাবুকে নিয়ে চলে গেল। নাজিয়ার কান্না গোটা বাড়িকে কাঁপিয়ে তুলেছে, একটু আগেই যে মেয়েটা উল্টো পাল্টা কথা বলছিল, হাসছিল এখন সেই মেয়েটাই পাগলের মতো কেঁদে চলেছে। এতক্ষন ঠিক কতটা কষ্ট বুকে চেপে ছিল সেটা সকলের ধারনার বাইরে।
নাজিয়া ওর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বল- –
-‘ওহ মা ওরা আমার দিদিকে কোথায় নিয়ে গেল! ওই অন্ধকার কবরে দিদি থাকবে কি করে মা! মা আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, দিদিকে একবার ফিরে আসতে বলো না আমি আর কখনো ওকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। মা গো আমি যে দিদির জীবিত মুখটা শেষবারের জন্য দেখতে পারলাম না, আমি দিদিকে ছাড়া কিভাবে থাকব! দিদির সাথে কথা বলে আমি যে থাকতে পারি না মা। ওহ মা দিদিকে একবার ফিরতে বলো না..
নাজিয়াকে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যায়। নাজিয়ার কান্না, আজাহারি সবার কষ্টকে আরো দ্বিগুন করে তুলেছে। নিসা বিহীন জীবন সবার কেমন হতে চলেছে!
আজ নিসার মৃত্যুর দুইদিন। বাড়িটা সেই আগের মতোই নীরব হয়ে আছে, আবির নাজিয়া নিজেদের মতো জীবনযাপন করছে, যেন ওরা এই পৃথিবীতে নেই। আবিরের মা ছেলের অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যাচ্ছেন । নাজিয়া এই বাড়িতেই আছে, বাবুর দেখাশোনা করছে কারোর সাথে কোনোরকমের কথা বলছে না।
নাজিয়া নিজের ঘরে বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল তখনি আবরার দরজায় টোকা মারল।
– ‘আসবো?’
– ‘হ্যাঁ।’
আবরার নাজিয়ার রুমে এসে কিছু একটা বলার জন্য উশখুশ করতে লাগল কিন্তু কিছু বলতে পারল না। সেটা বুঝতে পেরে নাজিয়া বলল,
– ‘কিছু বলতে চাও?’
– ‘বলছি বাবুর নাম কিছু ঠিক করলে! বার্থ সার্টিফিকেট তৈরি করতে হবে তো।’
– ‘ওর নাম আনাস আহমেদ প্রান।’
– ‘শেষে প্রানটা দিতে হবে? অনেকটা বড়ো হয়ে গেল না।’
– ‘না প্রানটা দেবে, ওহ আমার প্রান,আমাদের প্রান।
– ‘আচ্ছা দেব। আর একটা কথা।’
– ‘কি?’
– ‘দাদাকে সামলাতে পারছি না আমরা কেউ। তুমি কি একটু চেষ্টা করে দেখবে!’
– ‘আচ্ছা দেখছি।’
নাজিয়া প্রানকে ঘুম পাড়িয়ে আবিরের ঘরের দিকে পা বাড়াল। কিছুদিন আগেই এই ঘরটা ওর দিদির ছিল আজ সবকিছুই অতীত। নাজিয়া শুধুমাত্র প্রানকে আগলে রাখার জন্য এই বাড়িতে পড়ে আছে, নাহলে এইখানে ওর দমবন্ধ লাগছে নিসার স্মৃতিগুলো বড্ড তাড়া করে বেড়াচ্ছে। আবির প্রানকে একবারের জন্যও কোলে তুলে নেয়নি, ছেলেটার মুখটাও ভালো করে দেখেনি।
নাজিয়া আবিরের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, আবির নিসার ছবি বুকে জড়িয়ে নিজের মনে মনে কথা বলে চলেছে, নাজিয়ার দমবন্ধ’কর অনুভূতি হলো। আবির তো নিসাকে কম ভালোবাসত না, তাহলে তাদের ভালোবাসার এই করুন পরিনতি কেন হলো!
– ‘আবির’দা।’
আবির নাজিয়ার দিকে মুখ তুলে তাকাল, পরিপাটি ছেলেটা সেইদিনের পর থেকে কিরকম একটা এলোমেলো হয়ে আছে। ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে আর না অফিস যায়না আড্ডা দেয়না। যেন জীবনের আসল মানেটাই ভুলে গেছে।
– ‘নাজূ তুই আয় ভেতরে আয়।’
নাজিয়া ভেতরে যেতে যেতে আবিরকে প্রশ্ন করল,
– ‘কি করছো?’
– ‘তোর দিদির সাথে কথা বলছি কিন্তু দ্যাখ না তোর দিদি আমার উপর রাগ করে আছে কিছুতেই কথা বলছে না। তুই একটা বুদ্ধি দে না।’
নাজিয়ার কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে যেতে লাগল, নিজেকে সামলে নিয়ে এসেছিল কিন্তু আবিরের কথাতে সামলাতে পারল না। আগে যখনি নিসার রাগ হতো তখনি আবির নাজিয়াকে ফোন করে বুদ্ধি চাইত কিভাবে বউয়ের রাগ ভাঙাবে। এখন সত্যি সত্যি নিসা রাগ করে চলে গেছে, নাজিয়া যে আর কোনও বুদ্ধিতেই নিসাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।
– ‘কিরে নাজু বল না।’
নাজিয়া নিজেকে সামলে নিল, না ভেঙে পড়লে চলবে না। আবিরকে আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে নাহলে ছেলেটা যে পাগল হয়ে যাবে।
– ‘আচ্ছা বলব তার আগে তুমি গোসল করে খেয়ে নাও তো, আমি হবার জন্য খাবার বানাচ্ছি তাড়াতাড়ি নীচে আসো।’
– ‘আগে বল আমার বউয়ের রাগ ভাঙাব কিভাবে?’
-‘না আমার কথা আগে শুনতে হবে তবেই বলব।’
আবির বাচ্চাদের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল,
– ‘আমি তোর সব কথা শুনব।’
নাজিয়া আর সহ্য করতে পারল না। আবিরকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল কাঁদতে কাঁদতে, মানুষটা কিভাবে বাঁচবে নিসাকে ছাড়া!
#চলবে…