#এক_আকাশ_দূরত্ব (৪)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
নাজিয়া কিছুতেই নৌকায় উঠতে চাইছে না, কিন্তু শ্রেয়ার জোরাজুরির কবলে পড়ে নাও করতে পারছে না। আবরার নাজিয়ার ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘ভীতু মানুষরা এইসব থেকে দূরে থাকাই ভালো।’
কথাটা নাজিয়ার গায়ে লাগল। আবরার’কে কিছূ না বলেই নৌকায় চড়ে বসলো। শ্রেয়া সেটা দেখে মুখটা ফ্যাকাশে করে বলল,
– ‘ওহ তো আমাদের নৌকা’টাই বসে পড়ল। এখন আমরা কোথায় বসবো?’
– ‘তুমি আর নাজিয়া একটাতে বসো আর আমি অন্যটাতে বসছি।’
– ‘কেন?’
– ‘নাজিয়া পানিতে ভয় পাই, তাই তোমাকে যেতে বলছি।’
– ‘থাক বাবা তুমিই যাও। আমি সামলাতে পারব না।’
– ‘আচ্ছা।’
আবরার নাজিয়ার নৌকায় উঠে বসতেই নাজিয়া ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘আপনি এইখানে কেন?’
– ‘তুমি যেখানে আমিও সেইখানে।’
– ‘ধ্যাত যান তো।’
– ‘যা বাবা, যার জন্য আসলাম সেই বলে চলে যেতে।’
– ‘আমি কি আসতে বলেছি নাকি?’
– ‘কিন্তু পানিতে ভয়টা তো পাও।’
নাজিয়া আবরারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
– ‘এখনো আমার সম্পর্কে প্রতিটা ছোট বড়ো বিষয় তুমি মনে রেখেছ। কেন এতটা ভালোবাসলে আমাকে, আমি যে তোমাকে কিছুতেই গ্রহন করতে পারব না।’
মনের কথাগুলো হয়তো নাজিয়া আবরার’কে কখনোই বলতে পারবে না।
নৌকা চলতে শুরু করল। শ্রেয়া আনন্দ করছে, ছবি তুলছে আর নাজিয়া? ভয়েতে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। আবরার মৃদু হেসে আশেপাশের ছবি ক্যামেরা বন্ধী করার মাঝে নাজিয়ার কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।
– ‘এতই যখন ভয় তাহলে তেজ দেখিয়ে নৌকায় ওঠার কি দরকার বুঝি না বাবা।’
আবরারের ঠেস মারা কথা শুনে নাজিয়া চোখ খুলে তাকাল। আবরার ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে, ফলে ওর রাগটা আরো বেড়ে গেল। রাগ নিয়ে উঠতে যাবে তখনি নৌকাটা ঠলে যায়, আবরার দুহাতে আগলে ধরে। দুজন দুজনের চোখাচোখি হয়ে যায়, দুজন দুজনের চোখেই নিজেদের জন্য ভালোবাসা অনুভব করতে পারছে। নাজিয়ার ধ্যান ভাঙতেই সরে এসে বসে পড়ল।
আবরার নাজিয়ার কাছে বসে বলল,
– ‘তোমার চোখের ভাষা বলে দেই তুমি কি চাও তবুও মুখ ফুটে বলতে এতটা বাঁধা কেন?’
– ‘চোখের ভাষা আবার হয় নাকি?’
– ‘হুমম হয় তো। যারা যাদেরকে ভালোবাসে তাদের চোখের ভাষা পড়তে পারে, কেন তুমি পড়তে পারোনি?’
– ‘আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না, তাহলে কিভাবে আপনার চোখের ভাষা বুঝবো!’
আবরার মৃদু হাসল। নাজিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
– ‘হাসছেন কেন?’
– ‘ না আমি কি একবারও বলেছি তুমি আমাকে ভালোবাসো! তাহলে তুমি কেন কথাটা বললে? ওই যে বলে না চোরের মন তল্পির দিকে।’
– ‘কাকু নৌকাটা পাড়ে নিয়ে চলুন আমরা নামবো।’ (নাজিয়া বিরক্ত হয়ে বলল)
– ‘না খবরদার নয়, আমরা এখন এইখানে থাকব। আপনি নৌকা চালিয়ে যান।’
নৌকা চলতে লাগল। আবরার নাজিয়ার কাছাকাছি বসে পড়ল। নাজিয়া’ও চুপ করে নৌকা চড়া-টাকে উপভোগ করে চলেছে, এইটা নিয়ে দ্বিতীয় বার নৌকা চড়া। প্রথম বার নৌকাতে উঠে কেঁদে ফেলেছিল। সে কি যাচ্ছে চাই অবস্থা আর সেটা নিয়ে আবরার কম ক্ষেপায় নি ওকে। আজকে দ্বিতীয়বার নৌকাতে উঠল কিন্তু অতটাও ভয় লাগছে না, কিন্তু কেন? অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে বলে, নাকি আবরার আছে বলে?
– ‘কেমন লাগছে?’ (আবরার ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল)
– ‘ভালো।’
বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ওরা বাড়ির পথে রওনা দেয়। নাজিয়ার মনটা ভালো হয়ে উঠেছে। দিন আগিয়ে যেতে লাগল। নিসার শরীরের অবস্থার অবনতি ঘটাতে লাগল, নাজিয়া ওই বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে আর আবরার’ও বাড়িতেই আছে। শ্রেয়া ২দিন পর ফিরে যাবে এই নিয়ে আবরারের মায়ের কত অভিযোগ, উনি কিছুতেই ওনার আদরের ভাতিজাকে ছাড়তে রাজি নন। কিন্তু শ্রেয়ার পড়াশোনা আছে, এইভাবে বসে থাকলে চলবে না তাই বাধ্য হয়েই ফিরতে হচ্ছে। নাজিয়ার সাথে আবরারের সম্পর্কের কোনরকম উন্নতি ঘটেনি, নৌকায় চড়ার পর থেকে নাজিয়া যেন আরো এড়িয়ে চলছে ওকে। আবরারের মাথা খারাপ হয়ে যাবার জোগাড় কিছুতেই নাজিয়াকে বোঝাতে পারছে না নিজের মনের কথা। ঠিক করলো, সরাসরি নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করবে নাজিয়ার সামনে। কি হবে এর পরিনাম?
নাজিয়া ঘর গোছা-ছিল তখনি আবরারের কন্ঠস্বর শুনে পেছন ফিরে তাকাল, আবরার দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
– ‘আপনি?’
– ‘হুমম তোমার সাথে কথা আছে, ছাদে আসো।’
– ‘কেন এইখানেই বলুন।’
– ‘প্লিজ ছাদে আসুন।’
– ‘যা বলার এইখানেই বলুন আমার অনেক কাজ আছে।’ (নাজিয়া বিরক্ত হয়ে বলল)
আবরারের রাগ মাথা চাড়া দিয়ে উঠে, এমনিতেই কয়েকদিন ধরে নাজিয়ার ইগনোর ওর মাথা খারাপ করে ছেড়ে দিচ্ছে তার উপরে এইরকম কথা শুনে রাগটা কন্ট্রোল করতে না পেরে এগিয়ে এসে হাতটা ধরে নিজের দিকে টেনে নিলো। রাগী গলায় বলল,
– ‘এত তেজ কেন তোমার?’
– ‘এইসব আপনি কি বলছেন?’
– ‘কেন বুঝতে পারছো না? না বুঝেও না বোঝার চেষ্টা করছ?’
– ‘হাতটা ছাড়ুন, কেউ চলে আসবে।’
– ‘আমি কাউকে ভয় পাইনা।’
নাজিয়া আবরারের হাতটা ঝাড়া দিয়ে বলল,
– ‘আপনি ভয় না পেলেও আমি ভয় পাই। আপনারা ছেলেরা সবকিছু করে পার পেয়ে গেলেও আমরা মেয়েরা কিন্তু সেইটা পাবো না, তাই সাবধান থাকা উচিত। আর একটা কথা, আমার সাথে কথা বলতে আসবেন না ফলাফল কিন্তু খুব একটা ভালো হবে না তাতে।’
আবরার তেঁতে উঠল, নাজিয়ার হাতটাকে পুনরায় ধরে ক্ষিপ্ত গলায় বলল,
– ‘কি করবে তুমি!’
নাজিয়া আবরারের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
– ‘এই বাড়ি সারাজীবনের জন্য ত্যাগ করব।’
আবরারের হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেল, পুরানো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটুক সে চাই না। আবরার অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,
– ‘এইসব তুমি কি বলছো?’
– ‘ঠিক বলছি। আপনি এমন কিছু করবেন না যাতে এই বাড়িতে আসা বন্ধ করতে হয় আমাকে।’
আবরার ব্যথিত কন্ঠে বলল,
– ‘ঠিকাছে আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না তবুও তুমি এই বাড়িতে আসা বন্ধ করো না।’
নাজিয়া কোনো উত্তর দিলো না, আবরার নাজিয়াকে ছেড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।
গভীররাত সবাই ঘুমে মগ্ন কিন্তু দুটো মানুষের চোখে ঘুম নেই। একজন প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে প্রত্যাখান পেয়ে ব্যথিত আর অন্যজন আঘাত দিয়ে সেই আঘাতে ব্যথিত। কি আছে দু-প্রান্তের মানুষ দুটোর কপালে। দূরত্ব যে বেড়েই চলেছে, এর পরিনাম কি হবে!
—
আজ শ্রেয়া বাড়ি ফিরে যাবে, স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসার দায়িত্বটা আবরারের ঘাড়েই পড়েছে। এই দুইদিনে আবরার নাজিয়ার সাথে কোনোরকমের কথা বলার চেষ্টা করেনি, সামনে পড়লেও এড়িয়ে গেছে বিষয়টি নাজিয়ার কাছে কষ্টদায়ক হলেও হাসিমুখে মেনে নিতে হচ্ছে।
নাজিয়া রান্নাঘরে সকলের জন্য ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছে, আবরার আর শ্রেয়া একটু পরেই বের হবে ওদের জন্য একটু তাড়াতাড়িই তৈরি করছে। শ্রেয়া রেডি হয়ে নীচে আসতেই আবরারের মা খাবারের জন্য তাড়া দিতে লাগলেন, নাজিয়া তাড়াহুড়ো করে করতে লাগল।
হাঁক-ডাক করতে দেখে শ্রেয়া বলল,
– ‘মামনি এত তাড়াহুড়া করতে হবে না, একটু ওয়েট করো নাজিয়া নিয়ে আসছে তো।’
– ‘ওর জন্য কি ছেলে-মেয়ে দুটো না খেয়ে বের হবে! জানত তো আজ সকাল সকাল তোরা বের হবি একটু আগে উঠলে কি ক্ষতি হতো?’
আবরারের মায়ের কথা শুনে নাজিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়। রান্নাঘর থেকে বসার ঘরের কিছুটা অংশ এবং সমস্ত কথা শুনতে পাওয়া যায়, তাই ওহ পাচ্ছে।সে তো আর ইচ্ছা করে দেরিতে উঠেনি, তাড়াতাড়ি উঠেই রান্নাঘরে এসেছে যাতে ওরা না খেয়ে না যায়। তারপরেও এইসব কথা শুনতে কার ভালো লাগে!
মায়ের কথা শুনে আবিরের ভ্রু কুঁচকে গেল, রাগী গলায় বলল,
– ‘মা কাকে কি বলছো তুমি!’
– ‘দ্যাখ না বাবা শ্রেয়া-রা এখুনি বের হবে এখনো রান্না হয়নি তাই…
– ‘মা আমি সবটা শুনেছি তাই আলাদা করে কিছু বলতে হবে না। মা কাল তোমার বৌমার পেইন উঠেছিল, নাজু সারারাত ওর কাছে ছিল ভোরের দিকে এসে ঘুমিয়েছে তাই উঠতে দেরি হয়ে গেছে। আর মা নাজু নিসার ছোটবোন আমাদের বাড়ির আত্মীয় কাজের মেয়ে নয় যে তুমি ওকে এইভাবে কথা বলবে। নিসা অসুস্থ তাই আমি ওকে এখানে এনেছি নিসার দেখাশোনা করার জন্য তবুও তো ওহ আমাদের গোটা সংসার সামলাচ্ছে।’
– ‘তুই মেয়েটার জন্য আমাকে এতগুলো কথা শোনা-লি?’ (অবাক চোখে)
– ‘মা নাজিয়া আমার কাছে ছোটবোনের মতো। নিসা এবং আমাদের সন্তানের জন্য আমি নাজু’কে ওর হোস্টেল থেকে এখানে নিয়ে এসেছি, আসার সময়ে ওর বাবাকে বলেছিলাম ওর পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না কিন্তু দেখো মেয়েটা সারাদিন সংসারের কাজ করতে করতে পড়ার সময় পাচ্ছে না। এখানে আমার মুখটা কোথায় থাকবে তুমিই বলো!’
আবরারের মা ক্ষেপে উঠলেন,
– ‘তাহলে তুই কি বলতে চাইছিস আমি সংসারের সব কাজ করব!’
– ‘না মা আমি সেটা কখনোই বলিনি। আমি তো চেয়েছিলাম একটা কাজের মেয়ে রাখতে কিন্তু তুমি রাজি হওনি। একটিবার ভেবে দেখছে, নাজু না থাকলে তুমি একা হাতে কিভাবে সবটা সামলাতে!!’
– ‘আমি ঠিক পারতাম, আমি আমার সংসারের জন্য একাই যথেষ্ট। ওই মেয়েকে আর কিছু করতে হবে না, আমি আজ থেকে সবকিছু একা করব। ওকে যে কাজে এনেছিস সেটা ভালো করে করতে বল।’
– ‘মা তুমি ভুল বুঝছ..
– ‘থাক আমার আর কিছু বোঝার নেই, সব বুঝে গেছি। তোর কাছে তোর মায়ের থেকে তোর শালি বেশি আপন হয়ে গেছে, সব বুঝেছি আমি।’
আবরারের মা কাঁদতে কাঁদতে উঠে চলে গেলেন, আবার মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে ওর মা এতটা অবুঝ কেন? শ্রেয়া বিরক্ত হলো ওনার কাজকর্মে, এই কয়েকদিনে দেখেছে নাজিয়া এই পরিবারের জন্য কতটা করছে ওর জায়গায় অন্য কেউ কি ওহ নিজে হলেও এতটা করত না। শ্রেয়ার মনে প্রশ্ন জাগল, মামনি নাজিয়ার প্রতি এতটা ক্ষিপ্ত কেন!
চলবে…