একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৬৪+৬৫+৬৬

0
496

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী
পর্ব: ৬৪
ইমাদ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল কিছু না বলে। মুবিন উঠে চলে যাচ্ছিল। ইমাদ ডেকে বলল, “থ্যাঙ্কস, মুবিন।”
মুবিন কপাল কুঁচকে বলল, “কিসের?”
ইমাদ আর উত্তর দিলো না। মুবিন যেখানে বসেছিল ও গিয়ে সেখানে বসল। অন্যদিকে মুখ করে তাকিয়ে রইল চুপচাপ, নির্লিপ্তভাবে। একটা দুইটা কাক কা কা করছে। দুপুরের রোদ প্রকট। মুবিন শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল নিজের কাজে। এরপর খাওয়া দাওয়া করে ইচ্ছামত টৈ টৈ করল। বিকেলে মেসের গেটে ঢুকতে গিয়ে চোখ পড়ল ছাদে। তার ভ্রু উঁচু হয়ে গেল। স্যার এখনও ছাদে! নামেননি! কাঁধ ঝাঁকাল মনের অজান্তেই। তাতে তার কি? সন্ধ্যার দিকে বেশ শোরগোল শোনা গেল। বের হয়ে দেখল স্যারের বন্ধু নিলয় স্যারকে ছাদে দাঁড়িয়ে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করছেন। মুবিনের কেন যেন মনে হলো কিছু একটা হয়েছে। আর সেটা তার বলা তখনকার কথাগুলোর জন্য কিনা তা শোনার প্রয়োজনবোধ করল। আড়ি পেতে কথা সে কোনোকালেই শুনে না। এবারেও শুনবে না। সে ছাদে উঠে ছাদের পিলারে হেলান দিয়ে ওদের সামনেই দাঁড়িয়েই শুনতে লাগল, “যা হয়েছে হয়েছে। কতক্ষণ বসে থাকবি এখানে?”
ইমাদ বলল, “এখানে আমার ভালো লাগছে।”
“না তোর লাগছে না।”
এর মাঝে ইমাদ মুবিনকে দেখে নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে ধমকে উঠল, “তুমি এখানে কি করছ?”
মুবিন বলল, “মেসে তো আপনাদের চিৎকার চেঁচামেচির জন্য থাকাই যাচ্ছে না।”
ইমাদ বলল, “তাহলে বাড়ি যাও।”
“সেটা আপনাকে বলে দিতে হবে?” মুবিন ক্ষেপে গেল।
নিলয় বলল, “প্লিজ থামো। ওকে এখন বিরক্ত করো না, মুবিন। আজকে ওর ব্রেকআপ হয়েছে।”
ইমাদ বলল, “ব্রেকআপ হয়নি, আমি করেছি।”
মুবিন বলল, “আমি বিরক্ত করছি না, আপনারা মেসের সবাইকে বিরক্ত করছেন।”
মুবিন চলে গেল গটগট করে, ইমাদও নামল বিরক্তির একটা ভাব নিয়ে। কেবল নিলয় ভাবতে লাগল, “ইমাদ এসব কি করছে? কেন করছে? আর তাকেই’বা এসব বলতে শেখাচ্ছে কেন? আর এসবে কড়ি কেমন করে চলে এল? ও না এত বড় শর্ত দিয়ে রাখল ইমাদকে। ঐ মেয়েই তো বলল, প্রেম করতে গয়না লাগবে, গয়না। এখন গয়না ছাড়া ওদের ব্রেকআপ কীভাবে হলো? প্রেম এল কোথা থেকে? নিলয় মাথা চুলকাতে লাগল।
.
দীপা ঘুমাচ্ছিল। কাদিন দীপার পায়ের কাছে বিছানায় বসে দীপাকে দেখছিল। হঠাৎ দীপার পা জোড়া নিজের কোলে টেনে নিলো। দীপা পায়ে একটা আংটি পরে। আংটিটা সুন্দর। কাদিন আংটিটা একবার খুলল তারপর আবার পরিয়ে দিলো। আবাট খুলল, আবসর পরালো। এমন করতেই থাকল। দীপার ঘুমটা ছুটে গেল। সে চোখ কচলে তাকিয়ে দেখল কাদিন এখনও যায়নি। ওকে না বিদায় হতে বলল এখান থেকে? দীপা বলল, “আমার কথার কি কোনে মূল্য নেই, কাদিন? তুমি কি কখনই আমার কথাকে গুরুত্ব দেবে না?”
“দিব তো।”
“তাহলে যাও এখান থেকে।”
“চলে যাব।” বলেও কাদিন আরো বসে রইল। দীপা বলল, “আমার তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না।”
“বাতি নিভিয়ে দিব?”
দীপা বলল, “আমাকে রাগাবে না, কাদিন।”
কাদিন বলল, “তোমার পায়ে এত ময়লা কেন?”
দীপা অনেকক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল কাদিনের দিকে। তারপর দুঃখে কষ্টে, রাগে পা সরিয়ে নিয়ে বলল, “যে মেয়েদের পা সুন্দর তাদের পায়ে গিয়ে চুমু খাও।”
কাদিন নাকি সুর করে বলল, “ছিইইই।”
দীপা বলল, “নাটক করবে না। যাও তুমি।”
কাদিন উঠল। বাতি নিভিয়ে, দরজা টেনে দিয়ে বলল, “যাই।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৫
দিন ধূসর। চারিদিকে মেঘজমা বৃষ্টি উপচে পড়ছে। একটু পর পর মেঘের গুড়গুড় শব্দ। মাত্র বাজ পরল কোথাও। বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে মসজিদ অন্ধকার হয়ে গেল নিমিষেই। কুরআন শিখতে আসা শিশুদের কিচিরমিচির শুরু হয়ে গেল। বাইরের আলো বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে গেছে যেন। অন্ধকারে ইমাম সাহেব সবাইকে চুপচাপ বসিয়ে রেখেছিলেন। ঠিক তখনই সুযোগ বুঝে মুবিন তার প্রধান শত্রুকে ঘায়েল করল। আজকাল ইমাদ স্যার’ই সব নয়। ইমাদ স্যারকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে মুবিনের প্রধান শত্রু হিসেবে জয়ী মেসের উল্টাপাশে থাকা বেটে ভুড়িওয়াল ভদ্রলোক। তিনি এলাকায় নতুন। মুখোমুখি দালানে পরিবার সমেত থাকেন। ভুড়ি আর মাথার টাক ছাড়া দুটো মেয়ে এবং একটি স্ত্রীও আছে। মুবিনের সাথে এই লোকের যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ঠিক তখন যখন মুবিনের বল ঐ মেয়ে দুটোর ঘরের জানালা দিয়ে গিয়ে ওদের বিছানায় পড়েছিল। কেন মুবিনের বল ওদের ঘরেই যাবে? ভুঁড়িওয়ালা রেগেমেগে বলল, “মেয়ে মানুষের জানালা দেখলেই আর হুঁশ থাকেনা এইসব ছেলেদের।”
মুবিনেরও তো ধৈর্য্য নেই। উত্তরে বলেছিল, “বড়লোকের ছেলে দেখলে এইসব মেয়েদের বাপেদেরও আর হুঁশ থাকে না।” ব্যাস! তারপর তো ধুন্ধুমার। ভদ্রলোক চড় মেরে বসেছিল মুবিনকে। মুবিন কোনোদিক দিয়েই ভদ্র ছেলে নয়৷ সেও কলার চেপে ধরে লোকটাকে শাসিয়েছিল, “এখানে আর আপনার থাকা হচ্ছে না। শান্তিতে বাঁচতে চাইলে মেয়েদের নিয়ে এলাকা ছাড়ুন।”
ভদ্রলোক স্তম্ভিত হয়ে চেয়েছিল শুধু৷ এইটুকু একটা ছেলে কি তার ব্যবহার, কি তার দৌরাত্ম্য। ভদ্রলোকের বড় মেয়েটি মুবিনদের বয়সী হলেও ছোট মেয়েটি বেশ ছোট। টু, থ্রীতে পড়ে হয়তো। প্রতিদিন ভোরে কাছের মসজিদে আমপারা নিয়ে পড়তে যায়। মুবিন ওঁত পেতে থাকে। অনেক অনেক ভোরের ঘুম বলি দিয়ে প্রতিদিন মসজিদে ঘাপটি মেরে থাকার পর অবশেষে আজ সুযোগ এসেছে। মেয়েটা কিছু বুঝার আগেই মেয়েটার বাবা যেভাবে তাকে চড় মেরেছিল ঠিক সেভাবেই মেয়েটাকে আচমকা আধো আলো, আধো অন্ধকারে সে চড় মারল। মেয়েটা ভয়ে চিৎকার করে উঠল। ইমাম সাহেব কোনোভাবেই খুঁজে বের করতে পারলেন না চড়টা কে দিয়েছে। প্রচন্ড ভয়ে অন্য ছেলেমেয়েগুলো পুরো এলাকায় গল্প ফাঁদল। ওরা বলে বেড়ালো কোনো মানুষ না, এর পেছনে নিশ্চয়ই অন্য কিছু। সে রাতে মেয়েটার প্রচন্ড জ্বর উঠেছিল৷ খুব অসুস্থ হয়ে পড়ল। মেয়েটা স্বাভাবিক হতে পারবে এই আশায় ভুড়িওয়ালা এবং তার পরিবার শেষ পর্যন্ত এলাকা ছাড়ল। ওদের আর এই এলাকায় দেখা যায়নি। তারপরও প্রতি ভোরে মুবিন নিয়ম করে মসজিদে গিয়ে এক কোণায় ঘাপটি মেরে বসে থাকতো। ভুড়িওয়ালার মেয়ে আসবে, তাকে আবার মারবে এ কারণে নয়। সে বসে থাকতো অযথা, অকারণে কিংবা, অভ্যাসে। প্রথমদিকে যারা আরবি পড়ে তাদের ছুটি পর্যন্ত এবং পরবর্তীতে যতক্ষণ বসে থাকা যায় ঠিক ততক্ষণ। তবুও আসেই। এসে আর কিচ্ছু নয়, বসে থাকে। আসার সময় কিছু না কিছু কিনে নিয়ে আসে। খায় আর তামাশা দেখে। একটা সময় এমন হলো মুবিন এই মসজিদে আসা নিয়মিত, অনিয়মিত সবাইকে চিনে। এখানে সবাই অসহায়। সবাই কাঁদে। ওর ভালো লাগে। ও একলা কেবল অসহায় না। পৃথিবীর সবাই অসহায়। ও অসুস্থ নয়, হিংসুটেও নয়, ও আসলে দুঃখী। একটা লোক আসত। প্রতিদিন। লোকটা হাউমাউ করে কাঁদত না। লোকটার কেবল চোখ ভিজে থাকতো। মুবিনের দেখতে ভালো লাগতো। কেন কাঁদত কে জানে? তারপর একদিন লোকটার কান্না বদলে গেল। সে এসে দু’হাত তুলে হাউমাউ করে কাঁদল। সেই প্রথম মুবিনের মনে হলো লোকটা কষ্টে কিংবা আল্লাহর কাছে কোনো কিছু চেয়ে কাঁদছে না। লোকটা কাঁদছে অতি আনন্দে। সে জানে না, লোকটার কি চাওয়া ছিল, লোকটা কি পেয়ে গেল। শুধু জানল, এইখানে কষ্টকান্নার সাথে সাথে আনন্দাশ্রুরও স্বাক্ষী হতে হয়। আরেকজন বৃদ্ধ এসে সরবে তার কোনো এক সময়ে করা বিরাট কোনো পাপের জন্য ক্ষমা চাইতে থাকত। লোকটা মারা গেল মসজিদেই। সেই প্রথম মুবিন কাউকে চোখের সামনে মরতে দেখল। নামাজে দাঁড়িয়ে হঠাৎ ঢলে পড়ল লোকটা। তারপর আর নেই। মুবিন ভয় পেল না। সে কোনোকিছুতে ভয় পায় না। সে কেবল মজা পায়। তারপর একদিন মসজিদ থেকে বেরুবার সময় দেখল ইমাদ স্যার মসজিদে ঢুকল। মুবিন যেন সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে গেল। আবার ফিরে গেল ভেতরে। ইমাদ স্যার কি করে সে দেখবে। না স্যার কাঁদেননি, কেবল মনটা খুব খারাপ হয়ে ছিল তার। যাঁর চেহারায় কখনো কোনো রকম অনুভূতির প্রকাশ নেই তার চেহারায় এত কিসের মনখারাপি? কি সমস্যা স্যারের? স্যারের সমস্যা কড়ি নন তো?
.
জড়োসড়ো বিকেলে কড়ি বাবার ডাকে একদিনের জন্য কুমিল্লা এল। কড়ির সাথে কথা বলতে চান তিনি। কড়ি জানে কাদের সাহেব কি বলবেন। তবু কিছু বুঝিনা, জানি না ধরনের একটা মুখ বানিয়ে কড়ি ঢাকা থেকে বাসায় চলে এল। দুপুরের রাজভোজ, সন্ধ্যার টক, ঝাল, মিষ্টি নাশতা এবং রাতের শাহী খানাপিনা শেষে কড়ি অপেক্ষা করছিল বাবার জন্য। বাবা কখন ডাকবেন, কখন কথা বলবেন আর কখন সে তার সিদ্ধান্ত জানাবে। ডাক এল না। কাদের সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। কড়ি রিমার ঘরে গিয়ে বসল আলাপ চালাতে,
“রিমা আপু, মেজ ভাইয়া আর ভাবির মাঝে কি কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“হয়েছে বোধহয়।”
“কিছু জানো?”
“কাদিন কিছু বুঝতে দেয়ার মানুষ?”
“তাহলে বুঝলে কীভাবে?”
“বুঝা যায়। তুই যেভাবে বুঝেছিস।”
“কথা বলেছ এ নিয়ে?”
“হ্যাঁ।”
“কি বলল?”
“থ্রি ম্যা কিপ আ সিক্রেট, ইফ টু অফ দ্যাম আর ড্যাড।”
কড়ি হেসে উঠে পড়ল। এজন্যই বোধহয় মেজ ভাইয়া রিমা আপুর ভক্ত। তবে তার এখানে ছোট একটা প্রশ্ন আছে। প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া যাবে মেজো ভাইয়ার কাছ থেকেই।
কাদিন শুয়ে পড়েছিল। এত রাতের কলিংবেল এর তিক্ত শব্দ হঠাৎ বড় মধুর হয়ে উঠল। কাদিন ফট করে এক লাফে উঠে পড়ল। দীপা এসেছে। গেল পরে ফিরিয়ে দিলো আর এখন নিজেই না থাকতে পেরে চলে এল।
ও মানুষটা আসলে খুব ভালো। চলে এলো তো। আর থাকতে পারল না। কিন্তু এই অসুস্থ শরীর নিয়ে একা না এলেও হতো। তাকে একটা কল করলেই সে গিয়ে নিয়ে আসত। দরজা খোলার আগে সে নিজের গায়ের টি-শার্টটা খুলল। তারপর খুলল আলমারি। আলমারি থেকে খুঁজে টুঁজে নতুন কেনা সাদা রঙের টি-শার্টটা পরে, পারফিউম স্প্রে করতে করতে দীপা তার দরজায় চলে এল। এইবার দরজায় কড়া নাড়ছে। কাদিন আরেকবার হাসল নিজে নিজেই। তারপর দরজা খুলে কাদিনের মুখ রক্তশূণ্য। কড়ি! তাহলে কলিংবেলটা কিসের?
কড়ি বলল, “আসব?”
কাদিন বলল, “এত রাতে কলিংবেল?”
“ভাড়াটিয়াদের মেহমান এসেছে। মেহমানদের সাথে আসা বাচ্চারা দুষ্টামি করছে।”
“ওহ।”
“ভেতরে আসি?”
কাদিন কড়ির গালে হাত রেখে হাসল, “ওয়েলকাম।”
কড়ি কাদিনের হাতটা ধরল। ভেতরে এসে বলল, “বসব না। মেজ ভাবি কোনদিন আসবে?”
“কিছু বলেনি।”
“কি হয়েছে?”
কাদিন মুহূর্তেই অন্য ভাষায় কথা বলে উঠল। যে ভাষায় আমি তাকে ভালোবাসিকে রূপান্তর করলে হয়,
“ও কিছু করেনি।”
কাদিন ঠিক এ কথাটাই বলল। কড়ি কয়েক সেকেন্ড এর জন্য স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কথাটা মেজ ভাইয়া বলল? কড়ি জানে না কি হয়েছে। তবে এটুকু বুঝে, যা কিছু হয়েছে তাতে ভুলটা দীপার, দোষটা কাদিনের। মাথা পেতে সকল দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নেয়ার মত মানুষ কাদিন না৷ তবু নিলো। তার মানে বউকে ভালোবাসে। প্রেমটা কেবল নেই। কড়ি মুখ টিপে টিপে হাসল। কাদিন বলল, “বাবার সাথে কথা হয়েছে?”
“কোন বিষয়ে?”
“তারমানে হয়নি। বাবাই বলুক।”
“অফ টপিক। আমার একটা প্রশ্ন আছে।”
“কর।”
“রিমা আপুকে তুমি নিজের অনেক কিছুই বলো যা আর কাউকেই বলো না। কেন?”
“আপুর কাছে সব রহস্য রহস্যই।
“আপু ছাড়াও এ বাড়ির আরো অনেকেই রহস্যকে রহস্য রাখতে জানে।”
কাদিন স্মিত হাসল, “যেমন তুই।”
“তাহলে এবার আমকে বলো তোমাদের মাঝে কি হয়েছে।”
কাদিন বলল, “রহস্যকে রহস্য বলা যায় না।”
আচমকা কড়ির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল, “মানে?”
“রহস্যের বই পড়ে রহস্য জানতে হয়। আর রহস্য লিখতে হয় গোপন ডায়েরীতে। রিমা আপু গোপন ডায়েরী। আর তুই রহস্যের বই।”
কড়ি কাদিনের দিকে তাকিয়ে রইল, “আর মেজ ভাবি?”
কাদিন গিয়ে বিছানায় বসল, “দীপা? দীপা সাদা কাগজ।”
কড়ি প্রশ্ন করল, “কেন?”
কাদিন গাঢ় গলায় বলল, “ভালোবেসে যা ইচ্ছে তাই লেখা যায়।”
“তুমি কি লিখেছ?”
“কবিতার মত কিছু একটা লিখেছিলাম। কিন্তু কাটাকুটি ছিল বলে মুচড়ে ফেলেছি।”
“এখন কি করবে?”
“হারিয়ে ফেলা সেই কাগজ খুঁজে বের করব। তারপর যত্ন করে রাখব।”
“বেস্ট অব লাক।”
.
এক উষ্ণ বিকেলে টেবিল চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে মিলার ঝিমুনি এসে যাচ্ছিল। হঠাৎ হোস্টেলের খালা এসে ডাকলেন। তার সঙ্গে নাকি কেউ দেখা করতে এসেছেন। মা কিংবা সুহা ছাড়া আর কেউ ত কখনো আসেনা? কে এল? ওরা এত আসে যে চেনা জানা হয়ে গেছে। অনুমতির অপেক্ষা করতে হয় না। সোজা ভেতরেই চলে আসে। মিলা নিচে নেমে দেখল তার বাবার প্রেমিকা তার জন্য ফুল হাতে দাঁড়িয়ে। মিলা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বাংলায় বিড়বিড় করে যা বলল সেসবের কিছুই মিশেল বুঝল না। সে ইংরেজিতে হেসে বলল, “কেমন আছো? তুমি কি আমার সাথে ইংরেজীতে কথা বলবে?”
মিলা ইংরেজীতে কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
“তোমার সাথে দেখা করতে।”
“কেন?”
“কারণ তুমি মঈনের মেয়ে। ফুলগুলো তোমার জন্য। প্লিজ নাও।” মিশেল ফুলগুলো বাড়িয়ে ধরল।
মিলা বলল, “স্যরি। আমার ফুল পছন্দ না।”
“ঠিক আছে। তাহলে নিতে হবে না। তোমার জন্য আমি একটা বিশেষ উপহার এনেছিলাম। কিন্তু দেওয়ার সুযোগ হয়নি।”
“কি এনেছেন?”
“মিস ডায়র পারফিউম।”
“আমার পারফিউম পছন্দ না।”
“তুমি কি আমার উপর রাগ করে আছো?”
“না।”
“তাহলে?”
“আমি আমার বাবার উপর রাগ করে আছি।”
“সে গাড়িতেই আছে। ডাকব?”
“প্লিজ না।”
মিলা ফুল, উপহার না নিয়েই চলে গেল উপরে। পড়ার বইটা খুলে বসে গেল পড়তে। মিলা চলে যাবার পরেও অনেকক্ষণ মিশেল দাঁড়িয়ে ছিল গেটের ভেতর। অনেক পরে সে গাড়িতে ফিরে এসে মঈনকে বলল, “আমি মুবিনের সাথেও দেখা করতে চাই।”
.
মুবিনকে মেসে নিজের ঘরে খুব কমই পাওয়া যায়। সারাদিন সে যে কোথায় থাকে কেউ জানে না। শুধু ভোরের দিকে কয়েক ঘন্টা মসজিদটায় তাকে বসে থাকতে দেখা যায়। মিশেল আর মঈন এসেছে বিকেলে। তাই মুবিনকে ওরা পায় নি। মুবিনের রুমমেট রানাকে মুবিনের বাবার পরিচয় দিতেই রানা মঈন আর মিশেলকে ঘরে এনে বসিয়েছে। মিশেল এত সুন্দর যে রানা মিশেলের দিকে হা করে তাকিয়েছিল। মুবিনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রাত হলো। এর মাঝে মঈন বেশ কবার মুবিনকে কলও করেছিল। মুবিন প্রতিবারই কল কেটে দিয়েছে৷ সে যখন মেসে ফিরল তখন রাত আটটা নটা। সে বোঝেনি তার বাবা এখানে এসে তাকে কল দিয়েছে। ওঁদের দেখে দরজায় একটা লাথি মারল। তারপর উল্টা ঘুরে সোজা ইমাদের ঘরে চলে গেল। ইমাদ তার এক ছাত্রের পরীক্ষা নিবে বলে বিছানায় হেলান দিয়ে শোয়ে প্রশ্নপত্র তৈরি করছিল। মুবিনের দিকে একবার ঘাড় তুলে তাকাল। তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মুবিন ঘাড় শক্ত করে ঝাড়ি দিয়ে বলল, “ওদের বিদায় করেন।”
ইমাদ শীতল কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা।”
“এখনও বসে রইলেন কেন?”
“আমি তোমাদের ব্যক্তিগত বিষয়ে কি করতে পারি?”
“কি করবেন সেটা আপনি জানেন।”
“আচ্ছা।”
তারপর উঠে গায়ে শার্ট চড়িয়ে ও ঘরে যাবে ঠিক তখনি মঈন আর মিশেল মুবিনকে খুঁজতে খুঁজতে এখানেই চলে এল। মঈন বলল, “এ কেমন ব্যবহার মুবিন? আন্টিকে স্যরি বলো।”
মুবিন কিছু বলবে তার আগেই ইমাদ বলল, “স্যরি মঈন সাহেব, মুবিন স্যরি বলবে না।”
“এক্সকিউজ মি! আপনি আমাদের মাঝে কথা বলছেন কেন?”
“মুবিনের এই পরিস্থিতির জন্য আপনারাই দায়ী। আপনার ওকে স্যরি বলা উচিত।”
মঈনের রক্ত চাউর হয়ে গেল। সে ইমাদকে ঘুষি মারল, “দুই টাকার মাস্টার তুই বলে দিবি আমি কি করব?”
ইমাদ বাঁকা হয়ে নাক চেপে ধরল। শান্ত ইমাদ সময় নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনার এখন আমাকেও স্যরি বলা উচিত।”
মঈন এক সেকেন্ডও দেরি না করে দ্বিগুণ শক্তিতে, ইমাদকে দ্বিতীয় ঘুষিটা মারল এবং বলল, “এই নে তোর স্যরি।”
মুবিন এবং মিশেল কিছু বুঝে উঠার আগেই ইমাদ তীব্র ব্যথায় টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল৷ মুবিন দৌড়ে গিয়ে ইমাদকে মেঝে থেকে টেনে তুলল। তারপর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বাবা, স্যারকে স্যরি বলো।”
“বাপকে শেখাস? বেয়াদব ছেলে। তোর মা তোকে পুরা নষ্ট করে ফেলেছে।”
মুবিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “হয় তুমি এখনি স্যারকে স্যরি বলবে নতুবা..”
“নতুবা কি?”
মুবিন সাপের মত ঠান্ডা চোখে চেয়ে বলল, “নতুবা, আমি এই মহিলাকে মারব। আজ হোক, কাল হোক, এখানে হোক, বাইরে হোক, দেশে হোক, বিদেশে হোক, দশ বছর পর হলেও আমি মারব।”
মঈন ছেলের বেয়াদবি আর স্পর্ধা দেখে নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল। পরে বলল, “তোমার মা তোমাকে এগুলোই শিখিয়েছে না?”
“তুমি শিখিয়েছ।”
“তুমি কি জানো না ও তোমার আরেকটা মা? তুমি এ ধরনের কথা আর কখনো বলবে না।”
“আসল বাপ মাকেই গুনিনা আর তুমি বলো নকলটার কথা।”
মঈন ছেলেকে চেনে। তার ছেলে কিচ্ছু মানে না, কাউকে মানে না। কথার আগে হাত উঠে। আস্ত বেয়াদব এই ছেলে দ্বারা সবই সম্ভব। তাই এক কথায় ইমাদকে স্যরি বলে মিশেলকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ওরা চলে যেতেই ইমাদ বলল, “তুমি যে কথাটা বলেছ সেটা বলা মোটেও ঠিক হয়নি।”
মুবিন ইমাদকেও ঝাড়ি মারল, “আপনি বলে দিবেন আমি কি বলব?”
তারপর বেরিয়ে চলে গেল। ইমাদ নাকের ব্যথায় অস্থির হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। হাত দিয়ে বারবার দেখছে রক্ত পড়ছে কিনা। না পড়ছে না৷ একটা সময় ব্যথা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল সে। ঘুম ভাঙল মুবিনের ডাকে, “উঠুন, উঠুন। আমি কি আপনাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার চাকুরী নিয়েছি?”
“বলো।”
“আমি কিছু বলব না। আপনি উঠুন৷ এখানে দুই প্যাকেট কাচ্চি আর এক বোতল বোরহানি রাখা আছে। উঠে খেয়ে নিন।”
“আচ্ছা।”
“আর মলম টলম লাগবে?”
“একটা কলম লাগবে।”
“কলম কোথায়?”
“আমার টেবিলের উপর রাখা কলমদানিতেই আছে।”
“পারব না।”
“আচ্ছা।”
মুবিন চলে গেল। ঘণ্টা খানেক পর আবার এল। ইমাদ তখন আবারো সেই অর্ধেক করা প্রশ্নপত্র নিয়ে বসেছিল। মুবিন আসতেই বলল, “বলো।”
মুবিন সহজ গলায় বলল, “কড়ি আমাকে ওসব বলেনি।”
ইমাদ উপর মীচ মাথা নাড়ল, “আচ্ছা।”
মুবিন বলল, “আপনি আমার দেয়া মোবাইলের বদলে টাকা দিয়েছিলেন বলে আমি রেগে গিয়েছিলাম।”
“আচ্ছা।”
“স্যরি।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
মুবিনের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। সে ইমাদের চৌকিতে একটা লাথি মেরে চৌকি নাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার স্যরি আমি ফেরত নিলাম।”
ইমাদ আবারো বলল, “আচ্ছা।”
.
ক্যালেন্ডারের পাতা বদলেছে। আজ নতুন মাসের এক তারিখ। কাদিন গত পনেরো দিন ধরে দীপাদের বাসায় প্রতিদিন নিয়ম করে ঔষুধ খাওয়ার মত দু’বেলা আসে। অফিস যাওয়ার পথে একবার, অফিস থেকে ফিরে আরেকবার। সকালে বলে যায়, “ব্যাগ গুছিয়ে রেখো।”
রাতে এসে বলে, “চলো না।”
দীপা দু’বারই ক্ষেপে, “তুমি আর এখানে আসবে না।”
কাদিন চেষ্টা চালিয়ে যায়। কোনো কিনারা পায় না।
কাদিনের শাশুড়ি কাদিনকে একটা কিনারায় তুলে দিতে চেষ্টা করে। দীপা সোজাসাপটা বলে, “তুমি ওকে জোর করে নিয়ে যাও।”
“জোর করে কীভাবে নিয়ে যাব?”
“আমরা ওকে দিয়ে দিব।”
“আপনারা কীভাবে দিয়ে দিবেন।”
“যখন দিব তখন দেখো।”
কাদিন অস্বস্তি বোধ করে, “দীপাকে এখানে থাকতে দিবেন না?”
“ওকে সেটাই বুঝাব।”
কাদিন রাজি হয় না, “দীপার নরম মন৷ ও কষ্ট পাবে।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্ব: ৬৬
হাওয়ায় হাওয়ায় চন্দ্রমল্লিকা দুলে ছাদ-বাগানে। গোলাপ হেসে উঠে হঠাৎ। নীলকণ্ঠ কাঁধ এলিয়ে দেয়। পাতাদের নাচন তালে লয়ে। সন্ধ্যার পর দীপার ছাদে বসে থাকতেই ভালো লাগে। এক কোণে একটা দোলনা আছে৷ সে দোলনায় পা তুলে বসল। পালা করে ফুল আর আকাশ দেখে উদাস হলো। তারপর উঠে এসে চন্দ্রমল্লিকার টবের কাছে দাঁড়াল। উবু হয়ে চন্দ্রমল্লিকাটা ধরে মুগ্ধ হয়ে দেখল। মুখটা আরো কাছে নিয়ে চন্দ্রমল্লিকায় নাক ঘঁষল। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ভরে ঘ্রাণ নিলো। চন্দ্রমল্লিকাও তাকে আদর করে দিলো। সোহাগ করল তার গালে, চোখে, ঠোঁটে। দীপা চোখ মেলে দেখল চন্দ্রমল্লিকা কাদিনের হাতের মুঠোয়। কাদিনই এতক্ষণ দীপার গালে চন্দ্রমল্লিকা বুলাচ্ছিল৷ দীপা ঝা করে কাদিনের হাতটা সরিয়ে দিলো। চন্দ্রমল্লিকা ছিটকে পড়ল আশেপাশেই। দীপা রুঢ়ভাবে বলল, “সরো। এইসব নাটক আমার ভালো লাগেনা।”
কাদিনের চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করল,”এত কঠিন ত তুমি নও দীপা।”
“তোমারো তো এত প্রেম নেই।”
কাদিন ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে, “ব্যাগ গুছাও তো দীপা। আমার আর এসব ভালো লাগছে না৷”
“কখনো শুনেছ যমের বাড়ি যেতে কেউ ব্যাগ গুছোয়!”
“এভাবে বললে!”
“যা সত্য তাই বললাম।”
“এখন তুমি আমায় মানসিকভাবে অত্যাচার করছো, দীপা।”
“বাহ্! কখনো বিরক্ত, কখনো মানসিকভাবে অত্যাচারিত। আমাকে নিয়ে এতই যখন অভিযোগ কি দরকার আমাকে? বাদ দিয়ে দাও।”
কাদিন আহত হলো, “আমি এভাবে বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি তোমার জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে।”
“আমার জন্য কারো কখনো কষ্ট হয়না। আমার এই কপাল নেই।” আর দাঁড়াল না। নেমে গেল ছাদ থেকে। কাদিনও নামল পিছু পিছু। ড্রয়িংরুমে রাখা অফিসের ব্যাগটা নিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল। দীপা অনেকক্ষণ পরে ছাদে গিয়ে ফুলটা তুলে এনে ধুলো ঝেড়ে যত্ন করে রেখে দিলো।
“থাকোগো ফুল, থাকো কাছে।
মোর সখা হৃদয়ে যেথায় আছে।
প্রিয়তমেষুর পুষ্প সোহাগে
ছুঁলো বলে কিযে দমবন্ধ লাগে!”
কাদিন দীপাদের বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল উদ্দেশ্যহীনভাবে। যেন তাড়া নেই বাড়ি ফেরার। যেন অসহ্য বাসা। যেন থাকা যায় না ও ঘরে৷ যেন অফিস ছুটিই মিছিমিছি। কতক্ষণ থম মেরে বসে থেকে এখানে ওখানে ঘুরে কাদিন রিকশাওয়ালাকে বলল, রিকশা ঘুরাতে। সে বাসায় যাবে। যে বাসায় তার বউ আছে। সে যেখান থেকে এসেছে সেখানেই ফিরে যাবে। দীপার কাছে।
“মন যে ভাঙতে জানে।
মানও তো সেই ভাঙাবে।
বিদায় দিলেও, ফিরে ফিরে যাবে।
ফুলের বেদনায়, ফের ভালোবাসা হবে।”
.
মুবিন একা একা বসে কেরাম খেলছিল। রানা হুড়োহুড়ি করে ঘরে ঢুকতে গিয়ে কেরাম এর সাথে সংঘর্ষে মুবিনের সব গুটি নাড়িয়ে ফেলল। মুবিন চটে গেল, “কি সমস্যা আপনার? চোখ পকেটে নিয়ে ঘুরেন?”
রানা বলল, “তুমি এখানে ঘরের মাঝখানে কেরাম নিয়ে বসলে কেন?”
“আমার ইচ্ছা।”
রানা মুবিনের দিকে চোখ গরম করে তাকাল। মুবিন রানার দিকে তাকাল চোখ বড় বড় করে। রানার এত রাগ হলো, তবু সে এই মুহূর্তে কোনো তর্কে না গিয়ে চট জলদি নিজের ব্যাগ গোছালো। তারপর মুখ কালো করে পিঠে ব্যাগ ঝুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। প্রায় সাথেই সাথেই আবার চার্জার, চার্জার করতে করতে ফিরে এল। রানা যখন চার্জারটা খুঁজছিল মুবিন দেখল সেটা কোথায় আছে। চার্জার রানার টেবিলের পাশে এক কোণায় পড়েছিল। রানা যখন হন্য হয়ে চার্জারটা খুঁজছিল, মুবিন এক ফাঁকে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে টেবিলের নীচে ঠেলে দিলো। রানা আর পায় না চার্জার। ওদিকে ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে। মুবিন বসে বসে আরামসে কেরাম খেলছে। পাশের ঘরের অনেকেই এসে একটু পর জড়ো হয়ে গেল, “রানা ভাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“আরে মিঞা চার্জার পাই না।”
একজন বলল, “লাগবে না। পাওয়ারব্যাঙ্ক আছে। চলেন, চলেন।”
রানা বলল, “দাঁড়াও আরেকটু খুঁজি।”
এইবার ইমাদ আর নিলয়ও এসে দাঁড়াল, “হলো?”
রানা বলল, “থাক পাই না। চলো।”
মুবিন জটলার দিকে তাকিয়ে দেখল, মেসের সবাই এখানে। সবার কাঁধে, পিঠে ব্যাগ। ওর ভ্রু কুঁচকে গেল, “আপনারা সবাই কোথায় যাচ্ছেন?”
ভিড়ের মাঝে কেউ একজন ব্যস্ত হয়ে উত্তর দিলো, “ট্যুরে যাচ্ছি।”
“কিসের ট্যুর?”
“এমনি ট্যুর।”
“কোথায় যাচ্ছেন?”
“সুন্দরবন।”
মুবিন উঠে দাঁড়াল, “আমিও যাব।”
“তুমি কীভাবে যাবে?”
মুবিন দৃঢ়তার সাথে বলল, “যেভাবে আপনারা যাচ্ছেন। আমিও তো এই মেসে থাকি। আমাকে ফেলে যাওয়া যাবে না।”
“তুমি ছোট মানুষ। তুমি যেতে পারবে না।”
যে কথাটা বলল তার নাম রওনক। মুবিন তার দিকে এগিয়ে গেল। হাত দিয়ে হাইট মেপে দেখাল, “আপনার চেয়ে বড়।”
আরেকজন বলল, “দেখো, বাবু তোমাকে নেয়া যাবে না।”
“কেন?”
“আমরা যে যার মত ঘুরব। তোমাকে দেখবে কে? তুমি হারিয়ে গেলে?”
মুবিনের মাথা গরম হয়ে গেল। তাকে আবার দেখবে কে? সে কেন হারাবে? মনে মনে বলল, “একবার ট্যুরে যেতে দে, তোকেই ফেলে আসব।” কিন্তু, রাগটা সে পরে উসুল করবে বলে রেখে দিলো। আঙুল তুলে ইমাদকে দেখিয়ে বলল, “ঐযে, ইমাদ স্যার আমার গার্জিয়ান। স্যার দেখবেন আমাকে।”
সবাই একসাথে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ ভাবলেশহীন। কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া নেই। নিলয়ের চারিদিক অন্ধকার হয়ে এল, “এই মুসিবত সঙ্গে যাবে নাকি! তসর উপর আবার তার আর ইমাদের সাথে থাকবে! অসম্ভব।”
কেউ রাজি নয়। পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্ক। মুবিন একটা বললে, ওরা আরেকটা বলে। ওরা দুইটা বললে, মুবিন পাঁচটা বলে। জান দিয়ে মুবিনের যাওয়া ঠেকাতে চেষ্টা করল যে দুজন তারা হলো রানা, আর নিলয়। অন্যরাও চেষ্টা করল। তবে রানা, আর নিলয়ের যেন জীবন-মরণের এটা প্রশ্ন। তবে শেষ পর্যন্ত মুবিনকে না নিয়ে ওরা এক পাও নড়তে পারল না। মুখ কালো করে সবার মুবিনকে সঙ্গে নিয়েই বেরোতে হলো। বাসে উঠে মুবিন কার পাশে বসবে তা নিয়ে আরেক গ্যাঞ্জাম। রানার রুমমেট বলে রানার পাশে মুবিনের সিট বরাদ্দ করতেই রানা দু’হাত তুলে সাফ সাফ জানিয়ে দিলো, “না, না। রুমমেট টুমমেট বুঝিনা। যার খোকা তাকে সঙ্গে নিতে বলো। যাও যাও মুবিন, তুমি তোমার গার্জিয়ান ইমাদ স্যারের পাশে বসো।”
নিলয় প্রতিবাদ করল, “আরে আমি কেন উঠব? আমি আর ইমাদ একসাথে যাচ্ছি।”
রানা নিলয়কে সাইডে ডেকে এনে বুঝাল, “ঝামেলা করিস না। এই বাচ্চা খতরনাক। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরে বলবে তোর সাথে বসবে। তারপর হোটেলেও তোর তার সাথে রুম ভাগ করতে হবে। আমার রুমমেট। আমি জানি এই বেদনা।” রানা নিজের বুকে হাত দিয়ে বড় কাতর হয়ে আরো বলল, “আমার কলিজাটা প্রতিদিন নুনমরিচ লাগিয়ে খায়।”
নিলয় আর একটা কথাও বলল না। চুপচাপ অন্য সিটে গিয়ে বসল। পেছন থেকে কেউ একজন সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে টিটকারি দিয়ে বলল, “ধরে নিন আপনার বন্ধুর পাশে তার গার্লফ্রেন্ডকে বসতে দিচ্ছেন।”
বাসের সবাই হো হো করে বাস কাঁপিয়ে হেসে উঠল। সেই থেকে মুবিনের নাম পড়ল, “ইমাদের খোকা।”
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে