একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৫৮+৫৯+৬০

0
471

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৮
দীপা- কাদিন ডিনার থেকে ফিরল একটু রাত করে। কাদের সাহেব তাদের জন্য ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করছিলেন। তাদের দেখেই তিনি বললেন, “তোমার জিনিস এনেছি বাবা।”
দীপা আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়াল, “কই দেখি?”
কাদের সাহেব পাঞ্জাবীর পকেট থেকে দুটো চকোলেট কোকোলা ওয়েফার রোল বের করে দিয়ে বলল, “বলেছিলাম না এগুলো এখনও আছে৷”
কাদিন না থাকলে দীপা এখন আনন্দে দুটো লাফ দিতো। কাদিন পাশে থাকায় দীপার আনন্দ শুধু চেহারাতেই ঝলমল করতে পারল। দীপা খপ করে দুটো চকোলেট ওয়েফার রোল নিয়ে বলল, “এগুলো খুব ছোটবেলায় স্কুলের পাশের এক দোকানে পেতাম। আমি ভাবতাম আর নেই, হারিয়ে গেছে।”
কাদের সাহেব বললেন, “খুঁজে বের করেছি।”
দীপা বলল, “আচ্ছা এগুলোর নাম কি? আমি নাম জানি না। ছোটবেলায় শুধু খেয়েছিই।” বলে কাদের সাহেবের পাশে বসে ওয়েফার মুখে দিলো। তারপর চোখ বন্ধ করে খেতে খেতে বলল, “আগেরটা আরো বেশি মজা ছিল।”
কাদের সাহেব বললেন, “এটার নাম চকোলেট ওয়েফার রোল।”
দীপা চোখ খুলে হাতে থাকা অবশিষ্ট আরেকটা ওয়েফার রোল কাদের সাহেবকে হাসতে হাসতে খাইয়ে দিলো। কাদের সাহেব হাসতে হাসতে কাদিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই মেয়ে আমায় মেরে ফেলবে৷ এমনি মিষ্টি খেতে দেয় না আর এখন ওয়েফার রোল ঠুশে ঠুশে খাওয়াচ্ছে।”
দীপা হাত ঝেরে বলল, “ইশ শেষ। আরো থাকলে আরো খাওয়াতাম।”
কাদের সাহেব হাসতে হাসতে উঠে গিয়ে আস্ত দুটো বয়াম নিয়ে এসে বললেন, “অনেক আছে।”
দীপা বয়াম দুটো নিয়ে মনের আনন্দে ঘরে ফিরে এলো। জামা কাপড় না বদলে বয়াম খুলে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসল। কাদিন গেল ফ্রেশ হতে। পা দোলাচ্ছিল, আর খাচ্ছিল দীপা। বাথরুমের দরজার খোলার শব্দ হতেই সে পা দোলানো বন্ধ করে দিলো। কাদিন সেটা দেখল। বলল, “আমাকে বলোনি কেন?”
দীপা উত্তর দিলো না। কাদিন পাশে বসে একটা ওয়েফার নিলো। দীপার মুখ কুঁচকে গেল। মনে মনে বলল, “এই জিনিসটায় ভাগ বসাতে হলো তার! এখন তার শরীরে ক্ষতি হয় না?”
কাদিন ওয়েফারে ছোট কামড় দিয়ে খেল। বলল, “আহামরি কিছু না।”
দীপা বলল, “আহামরি না হলে খাচ্ছ কেন? বাকিটা ফেরত দাও।”
কাদিন দীপার হাতে অবশিষ্ট অংশ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “নাও, নাও। অবস্থা দেখো! তুমি এই কোকোলা ওয়েফারের বদলে স্বামীও বিক্রি করে দিবে।”
দীপা বলল, “ফালতু কথা।”
কাদিন শুয়ে পড়ে বলল, “সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”
দীপা উত্তর কি দিবে ভেবে পেল না৷ ও কথা জানে না কেন? অসহ্য!
কাদিন আবার বলল, “আর খেও না।”
“হে তখন তো মোটা হয়ে যাব৷ তোমার জন্য সমস্যা।”
কাদিন ওপাশ ফিরে চোখ বন্ধ করল। দীপা উঠে শাড়ির পিন খুলে শাড়ি খুলল। কাদিন হঠাৎ ঘুরে অবাক হয়ে গেল। লাফ দিয়ে উঠে চাপা চিৎকার দিলো, “দীপ!”
দীপা ভড়কে গিয়ে বলল, “কি?”
কাদিন অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বলল, “দরজা, জানালা সব খোলা।”
দীপা হকচকিয়ে উঠল, “আমি খেয়াল করিনি।”
তারপর দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল। কাদিন উঠে বারান্দার দরজা বন্ধ করল। জানালা বন্ধ করে, পর্দা টানল। এ কেমন মেয়ে? এ কেমন ছন্নছাড়া আচরণ?

অনেকক্ষণ পর দীপা ভয়ে ভয়ে বেরুলো। কাদিন রুষে গিয়ে বলল, “তুমি দরজা, জানালা সব খুলে শাড়ি খুলে ফেলেছ।
তোমার কি মাথা কাজ করেনা? তুমি কি পাগল?”
দীপা মিনমিন করে বলল, “আমার খেয়াল ছিল না।”
“এখন আমি না থাকলে কি হতো?”
দীপা আবারো বলল, “আমার খেয়াল ছিল না।”
কাদিন শক্ত গলায় বলল, “সারাক্ষণ কথা বলতে থাকলে খেয়ালটা হবে কখন? মানে কি করে না করে কিচ্ছু ঠিক নেই।”
দীপা বলল, “সারাক্ষণ কোথায় কথা বলি? হিসাব করে করে চলতে চলতে তোমার বাসায় আমার দমবন্ধ হয়ে আসে।”
কাদিন বলল, “কি বললে?”
দীপা বলল, “বলেছি তোমার সাথে সংসার করা অসম্ভব। তোমার সাথে আর একদিনও না।”
“তুমি ভুল করলে আবার তুমিই মেজাজ দেখাচ্ছো?”
“শক্ত শক্ত কথা খালি তুমিই বলতে পারো? আর কেউ আমরা পারি না?”
“এখন কি আমার রাগারাগি করার কথা না?”
“না তুমি কেন রাগবে? নিঃশ্বাস ফেলার আগেও আমাকে ভাবতে হয় নিঃশ্বাস নিলে তুমি আবার কি মনে করো।”
কাদিন বলল, “আরে এই মেয়ে তো বদ্ধপাগল।”
দীপা বলল, “আমি পাগল তাই আমি চলে যাচ্ছি। অনেক সহ্য করেছি। তুমি ম্যাচিওর বুড়া দাদী বিয়ে করে নিয়ে থাকো। আমি তো ছোটোখাটো পাতলা মানুষ, ইরান থেকে ইরানী সুন্দরী নিয়ে এসো। যার হাতে বড় হ্যান্ড ব্যাগ মানাবে। পারলে বোবা, কথা বলতে জানে না এমন একটা বউ খুঁজো।”
কাদিন বলল, “তুমি বোবাদের ছোট করে কথা বলছ। তোমার বুঝা উচিত আল্লাহ তাদের বাকশক্তি দেননি। সোউ মিন।”
“আমার কপাল এত খারাপ?” দীপা আলমারির উপর থেকে লাগেজ নামাল৷ লাগেজ আছড়ে ফেলে আলমারি থেকে জামা কাপড় বের করে লাগেজ গুছাতে শুরু করল৷ কাদিন বলল, “এরকম ধুমধাম শব্দ করবে না। রাত হয়েছে মানুষ ঘুমাচ্ছে।”
দীপা বলল, “এজন্যই আমি আর তোমার সাথে থাকব না। এখানেই সব শেষ।”
কাদিন বলল, “কালকে যাবে না এখনি?”
দীপা চিৎকার করে বলল, “এখনি, এখনি, এখনি, একশোবার এখনি।”
কাদিন উঠে হাত দিয়ে দীপার মুখ চেপে ধরে বলল, “চুপ। চিৎকার করে সিনক্রিয়েট করবে না। লাগেজ গোছাও। আমি নিজেই তোমায় দিয়ে আসব।”
দীপা কান্নাচোখে তাকিয়ে বলল, “আমি একা যেতে পারব।”
“একা কেন যাবে? একা এসেছ এ বাসায়? আমি যখন নিয়ে এসেছি, আমি আবার ফেরত দিয়ে আসব।”
দীপা বলল, “যথা আজ্ঞা।”
দীপা লাগেজ গুছাতে লাগল। কাদিন চুপচাপ বসে রইল। সে একসাথে কয়েকটা বড় ধরনের ভুল করে ফেলেছে। প্রথমত, সে দীপাকে বিয়ে করেছে। দ্বিতীয়ত, নারীসঙ্গহীন সে প্রথম কোনো নারীর সান্নিধ্য পেয়ে অল্পতেই এই আবোলতাবোল মেয়েকে ভালোবেসে ফেলেছে। এখন তাকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে। যাইহোক, অশান্তির চেয়ে আলাদা থাকা ভালো।
.
মুবিনের সাথে কথা বলে কড়ি অনেকক্ষণ মোবাইল হাতে বসে রইল। তার ভ্রু ধনুকের মত বেঁকে আছে। সেই বেঁকে যাওয়া ভ্রু নিয়েই সে ইমাদকে কল করল। ইমাদও যেন অপেক্ষায় বসে ছিল। খপ করে মোবাইল কানে ধরল। কণ্ঠ তবু স্পৃহাহীন, “কি হলো?”
“কথা হলো।”
“পরে?”
কড়ির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল, “আনপ্রেডিক্টেবল।”
“কি মনে হয়?”
“মুশকিল।”
“আচ্ছা।”
কড়ি বলল, “শাট আপ।”
ইমাদের হাসি পেয়ে গেল। সে মাথা চুলকে বলল, “মুবিনের সাথে কথা বললে প্রথম প্রথম এমনই হয়।”
কড়ি বলল, “স্যরি।”
“ইটস টোটালি ওকে। ছাত্রের মেজাজ গরম হলেও স্যার খারাপ না।”
“উফরে আবার ফ্লার্টিং।” কড়ি পুরা বিরক্ত হয়ে গেল।
ইমাদ নিঃশব্দে হাসছিল। ঘরে বাইরে কেউ নেই, কড়িও সামনে কই? এখন হাসলে কি ক্ষতি? কড়ি’ই আবার বলল, “একসাথে একজন বিরক্ত করলে সহ্য করা যায়। পালা করে পেছনে পড়লে খারাপ হবে। একজনকেও ছাড়ব না। স্যারকেও না, ছাত্রকেও না।”
ইমাদ দুঃখিত হয়ে বলল, “খুব জ্বালাল?”
কড়ি বলল, “এই পিচ্চি খুবই ডেঞ্জারাস।”
“এজন্যই চাইছিলাম ওর সাথে কথা না বলুন।”
কড়ি শান্ত হয়ে বলল, “সমস্যা নেই। ওর সাথে ঠাণ্ডা মাথায়ই কথা বলেছি।”
“আচ্ছা।”
কড়ি হতাশ কণ্ঠে বলল, “সে আপনার পক্ষ নিয়ে একটা কথাও বলেনি। আমাদের পুরো পরিকল্পনাকে এক মিনিটে নাস্তানাবুদ করে দিয়ে বলেছে আপনি নাকি সারারাতই ঐ মেয়ের সঙ্গে কথা বলেন। এর মানে আপনার জন্য ওর মনে কোনো সফট কর্ণারই তৈরী হয়নি। সে আপনার সাহায্য করতে কল করেনি। কত বড় বিচ্ছু!”
“সফটকর্ণার আপনারও হয়নি। তবু লেগে আছি। ওর বেলায়ও থাকব।”
“আমি ভেবেছিলাম আমরা সিরিয়াস কথা বলছি।”
“আপনার কথা বলছি মানে আমি সিরিয়াস।”
কড়ি বলল, “যাইহোক, অপরপক্ষকে দূর্বল ভাবা অনেক বড় ভুল। আমি তাকে আবার কল করব। ওর মস্তিষ্ক অনেক দ্রুত চলে। আরো সাবধানী হব।”
“আমি কি একটি পরামর্শ দিতে পারি?”
“জি অবশ্যই।”
“মুবিনকে বলতে পারেন আপনি আমাকে হাতেনাতে ধরে শায়েস্তা করতে চান। সে আপনাকে প্রমাণ বের করে দিতে পারবে কিনা।”
কড়ির বিড়ালাক্ষী চোখে একটা ঝিলিক বয়ে গেল, “দারুণ বলেছেন৷ কি বুঝাতে চাইছেন বুঝেছি।”
ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৯
মিলার পরপর দুটো প্রাইভেটের মধ্যে এক ঘণ্টার গ্যাপ ছিল। আবার বাসায় না গিয়ে এক ঘণ্টা আগেই সে পরবর্তী প্রাইভেটে এসে পড়ল৷ অন্য একটা ব্যাচের পড়া চলছিল বলে সে উপর তলায় ছাদে উঠার সিঁড়িতে উঠে বসে রইল। কয়েকটা সিঁড়ি উপরে অভ্র বসেছিল একদম ছাদ বন্ধ করা গেইটটার কাছে। দুপুরের রোদ আর অভ্র মুখোমুখি। ওর নিশ্চয়ই এমন কিছুই হবে। মিলা ব্যাগ থেকে বই খুলে কোলের উপর রেখে গুনগুন করে পড়তে লাগল। পড়ার তালে তালে দুলছে ও। অভ্র ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি কি সারাক্ষণ’ই পড়ো?”
মিলা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, “থ্যাঙ্কস।” তারপর আবার বইয়ে ঝুঁকে পড়তে শুরু করল। অভ্র বিস্মিত হয়ে বলল, “কিসের থ্যাংঙ্কস?”
মিলা আবার ফিরে তাকিয়ে ধীর গলায় বলল, “সবসময় পড়ি বলায় থ্যাঙ্কস বললাম।”
অভ্র ভাবুক হয়ে চেয়ে বলল, “এটা তো কমপ্লিমেন্ট না। প্রশ্ন?”
“ও। মনে হয় পড়ি।”
অভ্র মাথা ঝাঁকাল৷ আগের ব্যাচের ছুটি হয়ে গেলে মিলা উঠে দাঁড়াল। কাঁধে ব্যাগ, হাতে বই নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে নেমে গেল। অভ্র উঠল না। মেয়েরা সামনে বসার পর তারপর ছেলেদের বার জায়গা। এখন গেলে বারবার উঠে মেয়েদের সামনে বসবার জায়গা দিতে হবে। তারচেয়ে শেষে যাওয়া ভালো। সে রোদ আর ছায়া দেখছিল। হঠাৎ মিলা আবার উঠে এল। অভ্র জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল, “কি হয়েছে নীচে?”
মিলা খানিক আমতা আমতা করে বলল, “আমার ছোট্ট একটা হেল্প লাগবে।”
বিস্ময়ে অভ্রর চোখ বড় বড় হয়ে গেল, “পড়াশুনার বিষয়ে?”
“না।”
অভ্র মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “আমিও তো বলি পড়াশুনার হেল্প কেন লাগবে তোমার!”
মিলা একটু কেশে বলল, “ছুটির সময় তুমি সবার জুতায় পাড়া দিয়ে ময়লা করে দৌড়ে নামো। প্রায়দিন আমাদের জুতার উপর জুতা পায়ে দাঁড়িয়েও থাকো। জুতা ময়লা হয়ে গেলে বাজে দেখায়৷ একটু খেয়াল করে নেমো।”
অভ্র বলল, “তোমার জুতা কোনগুলো দেখি।”
মিলা তার সাদা লংস্কার্ট খানিক উঁচিয়ে ধরল। অভ্র জুতার চেয়ে বেশি দেখল মিলার পায়ের পাতা। পায়ের পাতায় ছোট্ট তিল।
.
ব্যাংকে শিল্পীর কাছে একজন গ্রাহক ঋণ নেবার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে উঠে গেলেন। আরেকজন চলে আসবার আগেই শিল্পী কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখেই ডাকল, “জুয়েল সাহেব।”
জুয়েল সাহেব পাশের ডেস্ক থেকে ভয়ে ভয়ে তাকালেন, “জি বলুন।”
শিল্পী বলল, “আপনার বন্ধু যাকারিয়া সাহেবের নাম্বারটা আছে?”
জুয়েলের আতঙ্কিত চেহারা মুহূর্তেই আলোকিত হলো। তিনি আগ্রহ নিয়ে বললেন, “জি, জি আছে তো। লাগবে নাকি?”
শিল্পী ক্লান্ত ভঙ্গিতে কিছু কাগজে সিল মারতে মারতে বলল, “লাগবে বলেই তো বললাম।”
জুয়েল সাহেব আন্তরিক ভঙ্গিতে নিজের সবকাজ ফেলে রেখে রঙিন কাগজ নিলো। কমলা একটা ছোট কাগজে নীল কলমের কালিতে যাকারিয়া সাহেবের নাম্বার লিখে শিল্পীর দিকে বাড়িয়ে ধরল। শিল্পী কাগজটা হাতে নিয়ে হাসল। পরিস্কার গলায় সাবলীলভাবে বলল, “জুয়েল সাহেব, আপনি ভালো মানুষ।”
জুয়েল সাহেব দু’হাত গুটিয়ে একদম লজ্জিত হয়ে গেলেন। জিহ্বে কামড় বসিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “কি যে বলেন!”
.
কড়ি খাতা কলম নিয়ে বসল। মুবিনকে সে যতটা সহজ ভেবেছিল ততটা সে নয়। ছেলেটা প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন। অপরিপক্ব তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন মুবিনের সাথে কথা বলার আগে কড়ি খাতার মাঝখানে একটা লাইন টানল। একপাশে সে কি কি বলবে সেগুলোর বুলেট পয়েন্টগুলো লিখল। অন্যপাশে লিখল মুবিনের কথা বলার ধরন এবং তার সাথে কথা বলার সময় যে যে বিষয়ে দৃষ্টি রাখতে হবে সে বিষয়গুলো। তারপর সময় নিয়ে এক কাপ চা খেয়ে মুবিনকে কল করল।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৬০
মুবিন কল ধরে চোখ উল্টে বলল, “আবার কি?”
কড়ি বলল, “আপনার সাথে একটা পরামর্শ করতে চাই।”
“আমি কোনো অ্যাজেন্সি না।” মুবিন মুখের উপর বলল।
কড়ি বলল, “আমি ইমাদকে হাতেনাতে ধরব। ওকে আমি ছাড়ব না।”
মুবিন বলল, “হোয়াটএভার।”
কড়ি একটু কঠিন হয়ে বলল, “মুবিন সাহেব, আপনি প্রমাণ দিতে পারবেন কিনা সেটা বলুন।”
মুবিন আরো কঠিন হয়ে বলল, “কেন আমি প্রমাণ দিব?”
কড়ি এবার মোলায়েম হয়ে গেল। বলল, “ইটস ওকে মুবিন সাহেব। আই টোট্যালি আন্ডারস্ট্যান্ড। আপনি আসলে ইমাদের সাথে পেরে উঠবেন না। সে ধুরন্ধর। সারাক্ষণ এত চুপচাপ থেকে সে কি করে জানেন? বসে বসে বুদ্ধি বের করে। মাথার ভেতর শুধু শয়তানী বুদ্ধি।”
মুবিন কর্কশ কণ্ঠে বলল, “আপনি কি সোজা কথা বুঝেন না?”
কড়ি মিষ্টি করে বলল, “স্যরি। আমি বুঝিনি।”
মুবিন রেগে গিয়ে বলল, “কেন আমি আপনাকে প্রমাণ বের করে দিব? প্রয়োজনটা কি আমার? আমার এত সময় নেই।”
কড়ি বলল, “রেগে যাচ্ছেন কেন? রাগ করবেন না।”
মুবিন বলল, “ন্যাকামো বন্ধ করুন। মেয়েরা এত ন্যাকা হয় কি করে?”
কড়ি সুযোগ পেয়ে বলে বসল, “আপনার গার্লফ্রেন্ডও ন্যাকা?”
মুবিন শক্ত গলায় বলল, “আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই।”
“উমা! কি বলেন! কেন নেই?” কড়ি যেন ভীষণ অবাক।
মুবিন বলল, “আমার আপনাদের ভালো লাগে না। তাই নেই।”
“কেন? আমরা মেয়েরা কি করি? স্বাধীনতায় বাধা দিই? বন্ধুদের সাথে ফূর্তি করতে সময় দিই না?”
মুবিন বলল, “আমি একাই এনাফ। আমার কোনো বন্ধুর প্রয়োজন নেই ”
কড়ির মুবিনের জন্য হঠাৎ এত মায়া হলো! আহারে ওর কোনো বন্ধুও নেই। এই বয়সেই তার বন্ধু নেই! অথচ, খাঁটি বন্ধু পাওয়ার বয়স চলে যাচ্ছে। যত বড় হতে থাকবে, তারপর যাদের সাথে দেখা হবে সবাই হবে স্বার্থপর। বন্ধু আর ভরসার জায়গা বড় হয়ে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। বড় হলে মানুষ দুনিয়াদারি শিখে যায়। তখন আর কাউকে বিশ্বাস করা মুশকিল। হয় আশেপাশের মানুষকে ব্যবহার করতে হয় নতুবা, তাদের দ্বারা ব্যবহৃত হতে হয়। কমবয়সের লেনদেন ভালো। সে আফসোস ঢেকে রেখে বলল, “পারবেন না বললেই হয়। আমার ব্যবস্থা আমিই করব। আমার কাছে সাহসী ছেলেপেলের অভাব নেই।”
মুবিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “করুন ব্যবস্থা।”
তারপর কল কেটে দিলো। কড়িও মুবিনকে সময় দিলো। টিনএজারদের উপর কিছু চাপিয়ে দিতে নেই। তাদের ভাবতে সময় দিতে হয়। মুবিনকে সময় দেয়া হলো।
.
শিল্পী অফিস থেকে ফেরার সময় খাবার কিনে নিয়ে এল। আজকাল রান্না করতে ইচ্ছে করে না আর। প্যাকেট খুলে যে খাবে সেটা করতেও রাজ্যের অলসতা। নিঃশব্দে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। খেতে হবে না। এক রাত না খেলে মরবে না সে। চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকল মুবিন মিলা সাথে থাকলে নিশ্চয়ই সে আজ রাঁধত। কি রাঁধত? কি কি খাবার রাতের জন্য রান্না করার সম্ভাবনা ছিল সেগুলো ভাবতে ভাবতেই তন্দ্রা লেগে গিয়েছিল। গালে মশা নামের যন্ত্রণাটা এসে বসতেই ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলে এলোমেলো চুলগুলোতে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে উঠল সে। অন্ধকার হাতড়ে বাতি জ্বালল। খাবারের প্যাকেট ফ্রিজে রেখে কয়েল ধরাল। কয়েল খাটের পাশে রেখে বসবার কয়েক মুহূর্ত কাটতেই সে ঝুঁকে কয়েলটা ফের হাতে নিলো৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কয়েলটা মেঝেতে চেপে ধরে নিভিয়ে দিলো। মশা না যাক। একা ঘরগুলোতে পর্দা নেচে উঠতেই সে নিঃসঙ্গতায় ডুবে মরে। অন্তত মশারা থাকুক। দমবন্ধ না লাগুক। বুজের ভেতর শূণ্যগা নিয়ে ব্যাগ থেকে জুয়েল সাহেবের দেয়া নাম্বারটা বের করল। দ্বিধাহীনভাবে কত রাত হয়েছে সে পরোয়া না করে কল করল। যাকারিয়া কল ধরলেন। শিল্পী বলল, “আসসালামু আলাইকুম। যাকারিয়া সাহেবকে চাইছিলাম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। যাকারিয়া বলছি।”
“শিল্পী বলছিলাম। জুয়েল সাহেবের কাছ থেকে নাম্বার সংগ্রহ করেছি।”
“জি জুয়েল আমাকে বলেছে।”
“এত রাতে কল করবার জন্যে দুঃখিত।”
“সমস্যা নেই। সারাদিন হয়তো ব্যস্ত থাকেন।”
“ধন্যবাদ৷ আমি আপনার কাছে আমার ছেলের ব্যবহারের জন্য খুবই স্যরি। আচমকা এসে আমাদের একসাথে দেখে রিঅ্যাক্ট করে ফেলেছে।”
“ছোট মানুষ। আমি কিছু মনে করিনি।”
“ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।” শিল্পী মোবাইল রেখে দিচ্ছিল। যাকারিয়া বললেন, “আমাদের বিষয়টা ভেবে দেখবেন।”
শিল্পী হেসে বলল, “আমার কাছে আমাদের বলতে এখন শুধু আমি আর আমার ছেলেমেয়ে। আমরা তিনজন’ই আমাদের।”
“পরে খুব একা লাগবে। আমি আগে ভাবতাম বিয়ে না করলে কি হবে? এখন বুঝি, একা লাগে।”
“আপনার ছেলেমেয়ে নেই তাই একা লাগে। আমি মা। আমি একা না।”
“তবু একবার ভেবে দেখবেন। ছেলেমেয়ে বড় হলে ঠিকই বুঝবে। এখন হয়তো সাময়িকভাবে অভিমান করতে পারে।”
“ওদের চাওয়া তো পরের কথা। আমি’ই চাই না। আমি কল করেছি আমার ছেলের হয়ে ক্ষমা চাইতে৷ আর কিছু না। ভালো থাকবেন।”
“জি আপনিও।”
শিল্পী মোবাইল রেখে বাতি নেভাল। এই একাকিত্বের কিছু একটা করতে হবে৷ এভাবে আর হবে না।
.
কাদের সাহেব টিভিতে সংবাদ শুনছিলেন। কায়েস পাশে বসে বলল, “বাবা খেলা চলে।”
কাদের সাহেব কায়েসের হাতে রিমোট দিয়ে উঠে যেতে যেতে বললেন, “দেখ।”
কায়েস বলল, “যাচ্ছ কোথায়? বাংলাদেশের খেলা চলে। দেখবে না?”
কাদের সাহেব বললেন, “না তুই দেখ।”
“শরীর খারাপ নাকি?”
“না বাসাটা খালি খালি। রিমা সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকে। তোরা তো বাসায়ই থাকিস না।”
কায়েস বলল, “মেজো ভাবিকে কল করে বলি চলে আসতে?”
“না, না। কতদিন পর মায়ের কাছে গেল। কাদিন বলল রাতে মাকে মনে পড়ায় রাতেই চলে গেছে। ইচ্ছেমতো মায়ের কাছে থেকে আসুক।”
“ওকে।” কায়েস হাত দিয়ে থামস আপ দেখাল। কাদের সাহেব নিজের ঘরের দিকে গিয়েও আবার ফিরে এসে কাদিনের ঘরে গেলেন। কাদিন কিছু ফাইলপত্র নিয়ে বসেছিল। কাদের সাহেব দরজায় নক করতেই সে বিছানা থেকে বিনয়ী হয়ে উঠে দাঁড়াল। ফাইলপত্র বিছানা থেকে সরিয়ে বাবার জন্য বসবার জায়গা করে দিতে দিতে হেসে বলল, “বসো বাবা।”
কাদের সাহেব বললেন, “না বসব না। দীপার সাথে ভিডিয়ো কলে কথা বলবার ব্যবস্থা করে দে তো। কথা বলি।”
“এখনি দিচ্ছি।”
কাদের সাহেব এসে বসলেন। কাদিন ল্যাপটপ অন করল। কাদের সাহেব হেসে বললেন, “মেয়েটা একটা বাবু। ও থাকলে মনে হয় বাসায় একটা না, কয়েকটা বাচ্চা আছে।”
কাদিনও হাসল। দীপার সাথে বাবাকে ভিডিয়ো কলে বসিয়ে দিয়ে সে ফাইলপত্র নিয়ে অন্য ঘরে চলে এল। সেখানে বসে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে লাগল। দীর্ঘদিন দীপার সঙ্গে থেকে সেও দীপার মত শিশুসুলভ আচরণ শুরু করেছিল। কথায় কথায় ঝগড়া করা থেকে শুরু করে অনেক কিছুই ছিল তার বোকামো৷ দীর্ঘদিন একসঙ্গে থেকে সেও দীপার মত হয়ে যাচ্ছিল৷ সে ভেবেছিল দীপাকে রেখে এসে তার একা থাকতে কষ্ট হবে। কোনো কষ্টই হচ্ছে না। সবসময় সে যেমন থাকে তেমনি আছে। কোনো ফারাক নেই। মুদ্রার উল্টোপিঠে দীপা কেঁদেকেটে ইতোমধ্যে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শোকাহত, মর্মাহত৷ সারাদিন কাঁদে, সারাদিন। কাদিনের কি ওকে একটু মনেও পড়ে না?
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে