একা_তারা_গুনতে_নেই পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0
450

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৫
ইমাদ কড়ি কলে কথা বলছিল। একটা সময় কড়ি মনে করে বলল, “আমি ছেলেটাকে চিনেছি। আপনি যেন ট্রেনে উঠতে না পারেন রেলস্টেশনে আপনার ব্যাগ টেনে ধরে রেখেছিল। বিচ্ছু ছেলে।”
ইমাদ চুপ করে রইল। কড়ি বলল, “আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই।”
“না।”
“কেন না?” কড়ি একটু অবাক’ই হলো।
ইমাদ বলল, “মুবিন খুব বাজে ব্যবহার করে। আপনার কথা বলার প্রয়োজন নেই।”
কড়ি হেসে বলল, “উফ এখানেও আপনার ফ্লার্ট করতে হবে।”
ইমাদ বলল, “এটাকে ফ্লার্ট করা বলে?”
“তাহলে কি বলে?”
“কি বলে সেটা আপনিও জানেন।”
কড়ি বুঝল ইমাদ এটাকে নিজের ভালোবাসা মানে। কিন্তু বলল, “জানি না।”
“তাহলে বাদ দিন। আসল কথায় আসি। আপনার অনেক সময় নষ্ট করছি আমি।”
“আমি তেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই যে আমার সাথে দু মিনিটের জায়গায় চার মিনিট কথা বললে পৃথিবী উচ্ছন্নে যাবে।”
“পৃথিবী উচ্ছন্নে যাওয়া না যাওয়া দিয়ে আমার কি? বেশি কথা বললে আমিই এলোমেলো হই।”
কড়ি বলল, “এইবার বেশি বেশি হচ্ছে।”
“স্যরি।”
“যদি মুবিনের সঙ্গে আমাকে কথা বলতেই না দিন তবে আমার কাছে কেন?”
“মুবিনকে নিয়ে চিন্তিত।”
“দীপা ভাবিকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে আমার প্রেমে পড়ে গেলেন। এখন মুবিনকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে আবার কোন মুশকিলে পড়েন! সাবধানে।”
“এখন কি আপনি ফ্লার্ট করছেন? সাবধানে।”
“অবাককান্ড! আপনাকে দেখলে ভালো মানুষ মনে হয়।”
ইমাদ আশেপাশে তাকিয়ে পরখ করে নিলো কেউ তাকে হেসে ফেলতে দেখে ফেলল না তো!
কড়ি বলল, “যাই হোক কি করতে চান?”
“মুবিনকে সাহায্য করতে চাই।”
“মুবিনকে সাহায্য করতে যাবেন? উল্টো মুবিনের কাছে সাহায্য চাইতে হবে আপনার।”
“আচ্ছা।”
মুবিন রগচটা, জেদী ছেলে। কাউকে পরোয়া করে না। ইমাদকে তো পছন্দই করে না। তাই ইমাদই ওর কাছে ধরনা দিবে। সে নিজেকে বড় আর শক্তিশালী ভাবতে ভালোবাসে। তার কাছাকাছি যাওয়ার এই একটাই পথ৷
.

মুবিন সিঁড়িতে অন্ধকারে টর্চ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটা পা সামনের দিকে দেয়ালে ঠেশে ধরা। গেইটের শব্দ হলেই সে সিঁড়িতে টর্চ মেরে দেখছে কে এসেছে। একটু পর পর মেসে অনেকজনই ঢুকল। ইমাদ এলো অনেক পর৷ অনেকগুলো টিউশন ছিল তার৷ এসে গেইটে ঢুকতেই মুবিন টর্চ জ্বালল। ইমাদকে দেখে টর্চ আর নিভাল না। মুবিন গটগট করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ইমাদ নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে গলা হাঁকিয়ে বলল, “মুবিন একটা বিপদ হয়েছে।”
মুবিনের টান টান হয়ে থাকা ঘাড় কিছুটা শীতল হলো। সে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “মরে গেছে নাকি আপদটা? নাকি কেঁদেকেটে পুলিশে নালিশ করেছে?”
ইমাদ খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করল। এগিয়ে এসে সিঁড়িতে উঠে চট করে মুবিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ঐ মেয়ের কিছু হয়নি। আমার একটু ঝামেলা হয়ে গেছে। হেল্প করো, প্লিজ।”
মুবিন বিরক্ত হয়ে ইমাদের হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি এখানে আপনাকে ওয়ার্নিং দিতে দাঁড়িয়ে আছি, হেল্প করতে না৷ আপনি আমার বিষয়ে নাক গলাতে আসবেন না৷ সকালে যা করেছেন তা যেন আর না হয়। দূরে থাকুন৷ আপনি আপনার রাস্তায়, আমি আমার রাস্তায়৷”
মুবিন সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে চলে গেল। ইমাদ সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই কড়িকে মেসেজ করল, “ও তো শুনলই না। বলল আমি আমার রাস্তায়, সে তার রাস্তায়।”
কড়ি সাথে সাথে উত্তর পাঠাল, “আবার যান। একেবারেই কি কিছু হয় নাকি?”
“আচ্ছা।”
কড়ি আবার লিখল, “ও যে ছোট বলে সমস্যাটা বুঝতে পারছে না এমন কিছু একটা বলতে পারেন। মনে হয় কাজে আসবে।”
“আচ্ছা।”
ইমাদ মুবিনের ঘরে গেল। মুবিন হাউকাউ করে উঠল, “কি সমস্যা আপনার? এখানে কি?”
ইমাদ মুবিনের বিছানায় বসে পড়ল। বলল, “ছোট মানুষ বলে তুমি বুঝতে পারছ না৷ তুমি যদি বড় ছেলে হতে তাহলে বুঝতে। এ ধরনের সমস্যাগুলোয় আসলে সব ছেলেরাই একে অপরকে সাহায্য করে।”
কথাটা বোধহয় কাজে লাগল। মুবিন বলল, “কি এমন হয়েছে আপনার?” মুবিনের চোখে একটা কৌতূহল।
ইমাদ বলল, “থাক বাদ দাও। গার্লফ্রেন্ডের প্যারা। তুমি এসব বুঝবে না।”
মুবিন বলল, “না বুঝলে আমাকে বলতে এলেন কেন? নিজের ঘরে যান।”
“রাগ করছ কেন? তুমিও ওর মতই। কথায় কথায় রাগ করে ফেলো। আমি কি বলছি শুনতেই চাও না।” ইমাদের কণ্ঠ শীতল তবে শব্দগুলো দ্রুত।
“ওর মত মানে আপনার গার্লফ্রেন্ডের মত?”
ইমাদ চুপ করে রইল। মুবিন মজা করে বলল, “কি দোষ করলেন, স্যার?”
ইমাদ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “বলব?”
“বলতে না চাইলে চলে যান। আমার সময় নষ্ট করছেন কেন?”
“আমি খেয়ে আসি। অনেক ক্ষুধা লেগেছে। সারাদিন খাওয়া হয়নি।”
ইমাদ হেঁটে চলে যাচ্ছিল। মুবিন ডাকল, “দাঁড়ান।”
সে নিজের জন্য কেনা কাচ্চির প্যাকেট থেকে একটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “খেতে পারেন। আমি অনেক বেশি খাই তাই দুটো এনেছিলাম।”
ইমাদ এর আগেও খেয়াল করেছে মুবিন আসলে অনেক বেশি খায় এবং অনেক বেশি ঘুমায়৷ সাধারণত ডিপ্রেশনে থাকা মানুষরা এমন হয়৷ সে বলল, “না আমার জন্যে মেসে রান্না করা হয়৷ আমি সময়ের জন্য খেতে পারিনি।”
“আপনার ইচ্ছা।”
ইমাদ কি একটা ভেবে বলল, “আচ্ছা।”
মুবিন বলল, “আচ্ছা মানে হ্যাঁ, নাকি না?”
“হ্যাঁ।”
মুবিন কাচ্চির প্যাকেটটা ইমাদকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আপনার গার্লফ্রেন্ড আপনার আচ্ছা, আচ্ছা সহ্য করে কীভাবে কে জানে! আমার সাথে আচ্ছা আচ্ছা করবেন না। আমার এসব সহ্য হয় না, স্যার। আমার আপনার প্রতি প্রেম নেই যে এসব সহ্য করব। আপনাকে বিদেয় করার অন্যতম একটা কারণ ছিল আপনার এই আচ্ছা, আচ্ছা।”
ইমাদ আবার বলল, “আচ্ছা।”
মুবিনের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। সে তার চৌকিতে একটা জোরে লাথি মেরে বলল, “যন্ত্রণা।”
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৬
ইমাদ খেতে খেতে মুবিনকে কি কি বলা যেতে পারে গুছিয়ে নিলো। খাবার শেষ করে বলল, “থ্যাংক্স।”
মুবিন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ মুবিনকে ইশারায় এ ঘরের অন্য বাসিন্দা আলিকে দেখাল। ফিসফিস করে বলল, “আলি ভাই। বাইরে যাবে? তোমার যদি সমস্যা না থাকে।”
মুবিন হামি তুলে এবারেও বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ উঠেও মুবিনের জন্য দাঁড়িয়ে রইল। মুবিন বসে পা নাচাতে নাচাতে আরো একটু ভাবল। এরপর ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়াল। ইমাদ নিজে আগে না গিয়ে মুবিনকে সামনে হাঁটতে দিলো। কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলবে কিছুই বলল না। সবটা মুবিন আর তার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিলো। মুবিন সিঁড়িতে বসে বলল, “কথা প্যাঁচাবেন না।”
ইমাদও মুবিনের পাশে সিঁড়িতে বসল। মুবিন ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমাদ তাকাল না। সে অন্ধকার গেইটের দিকে চেয়ে বলল, আমাকে বেশ কমাস ধরে একটা মেয়ে অনবরত মেসেজ করে। কলও করে। মেয়েটা কে আমি এখনও জানি না। এটা নিয়েই আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমার ঝামেলা।”
বিরতি নিয়ে ইমাদ মুবিনের দিকে তাকাল। মুবিন ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ বলল, “আমার গার্লফ্রেন্ড এখন আমাকে সন্দেহ করে।”
“মিচকা শয়তান বলে?” মুবিন ঠ্যাশ দিয়ে বলল।
ইমাদ আহত হলো। তবুও জোর করে ঠোঁটে হাসি টেনে এনে বলল, “আজকে আবার তোমার সাথের মেয়েটাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আরো বিপদে পড়েছি।”
“বাসায় পৌঁছে দিয়েছেন?”
“হাত দিয়ে রক্ত ঝরছিল।”
আচ্ছা।” মুবিন লম্বা করে মাথা নাড়াল।
ইমাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “এখন আমাকে উদ্ধার করো।”
মুবিন বিরক্ত মুখে চেয়ে রইল। ইমাদ না চাইতেও বলল, “আমি ওকে বলেছি আমি মেয়েটাকে চিনি না। তোমার সাথে ঝগড়া বাঁধায় এগিয়ে গিয়েছি। বিশ্বাস করছে না। তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
মুবিন আবার হামি তুলল। ইমাদ বলল, “তোমার ঘুম নষ্ট করলাম।”
“জি।” উঠে দাঁড়াল সে। দুমদাম করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল। ইমাদও উঠে দাঁড়াল। আবার বলল, “ও তোমার সাথে কথা বলতে চায়।”
মুবিন না থেমে বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আচ্ছা মানে কি হ্যাঁ নাকি না?”
“ভাবুন, ভাবুন। আচ্ছা মানে কি ভাবতে থাকুন।” মুবিন টগবগ করে চলে গেল।
ইমাদ পড়ে গেল মুশকিলে। নীচে গিয়ে কড়ির সাথে কথা বলল। কড়ি শুনে শব্দ করে হেসে ফেলল। পরে বলল, “ছেলেটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।”
“আমাকে ভুগাল বলে?”
কড়ি রহস্য করে বলল, “কি মনে হয়?”
ইমাদ কথা ঘুরিয়ে বলল, “ও কথা বলবে বলে মনে হয়?”
“এখনও বলা যাচ্ছে না।”
ইমাদ চিন্তায় পড়ে গেল। এই আচ্ছা মানে কি কথা বলবে নাকি বলবে না? তখনও দুজনের কানে ফোন ধরা। কড়ি হঠাৎ বলল, “কথা বলবে।”
“কেন মনে হলো?”
“খুব সোজা৷ বলব?”
“জি।”
“গোলাপের পাঁপড়ি গুণে বের করেছি।” বলে সে আবার হেসে ফেলল।
ইমাদ বলল, “পাঁপড়িগুলো ছিঁড়ে ফেলেছেন?”
“কষ্ট হলো?”
ইমাদ বলল, “গোলাপ তো আমার দেওয়া নয়। কষ্ট কেন পাব?”
“গোলাপ আপনার দেওয়া নয় এটাই তো কষ্ট।”
“আচ্ছা।”

পরদিন ভোরে ইমাদ গেল ফুলের দোকানে। শুধু শুধু টাকা জলে ফেলে এক মুঠো গোলাপ কিনল। কড়িকে দেওয়ার জন্য নয়। পাঁপড়ি ছিঁড়ে গুণে দেখবে সে। কড়ির গয়না দিতে পারবে নাকি পারবে না পরখ করার জন্য। সেই ভোরেই কড়ি বেরুলো বইয়ের দোকানে। ঢাকা শহরের বইয়ের দোকানগুলোর আনাচকানাচে সে কিশোরকিশোরীদের উপর লেখা বিভিন্ন সাইক্যোলজির বই, ম্যাগাজিন, খুঁজতে লাগল।
.
রিমা দরজা খুলে একগাল হাসল, “এতদিন কোথায় ছিলে? ভুলেই গেলে মনে হলো।”
তাহমিদ বলল, “এখন কি তাই শাস্তি দিবে? ভেতরে আসতে দিবে না?”
রিমা সরে বলল, “এসো ভাই এসো।”
দীপা শ্বশুরকে সকালের নাশতা দিচ্ছিল। ওড়নায় হাত মুছে আসতে আসতে বলল, “কে এসেছে, রিমা আপু?”
রিমা যতক্ষণে বলল কাদিনের প্রিয় বন্ধু তাহমিদ এসেছে ততক্ষণে দীপা ড্রয়িংরুমের দরজায়। তাহমিদকে দেখে সে সরে পড়ছিল। তার আগেই রিমা বলল, “এসো পরিচয় করিয়ে দিই।”
তাহমিদ দীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা পরিচিত।”
“পরিচিত?”
দীপা বিস্ময়, ক্রোধ আর ভয় মিশ্রিত চোখে চেয়ে রইল। তাহমিদ দীপার চোখে চোখ রেখে হেসে বলল, “বিয়েতে পরিচয় হয়েছে।”
দীপা মুহূর্তটা থেকে মুক্তি পেল কাদের সাহেবের বদৌলতে। কাদের সাহেব দীপাকে ডাকছেন। দীপা বলল, আসছি, বাবা।”
কাদের সাহেবের কাছে গেল সে। রিমা গেল তাহমিদের জন্য চা নাশতার ব্যবস্থা করতে। সব ট্রেতে সাজিয়ে সে ট্রে নিয়ে এল দীপার কাছে। বলল, “নিয়ে যাও৷ আমি সব গুছিয়ে আসছি।”
দীপা ঢোক গিলল একটা। ট্রে হাতে নিয়ে বলল, “আমি গুছাই।তুমি যাও গল্প করো।”
রিমা বলল, “তুমি ছোট মানুষ। এত কাজ করতে হবে না তো।”
দীপা এই ঘাবড়ে যাওয়া অবস্থাতেও হেসে ফেলল। আদুরে গলায় বলল, “তুমি কি আমার শাশুড়ি নাকি?”
“ওরকমই ভেবে নাও। তটস্থ থাকবে ভয়ে।”
দীপা হাসতে হাসতে ট্রে নিয়ে ড্রয়িংরুমে গেল। তাহমিদ বলল, “কি অবস্থা, দীপা? মনে হচ্ছে ভালোই আছো।”
দীপা বলল, “অনেক ভালো আছি।”
তাহমিদ চায়ে চুমুক দিলো। দীপা চলে আসছিল। তাহমিদ নীচু গলায় বলল, “ভাবি ডাকব নাকি তোমাকে?”
দীপার এত রাগ হলো যে ও বলল, “আপু ডাকলে বেশি খুশি হব।”
তাহমিদ হেসে বলল, “তুমি বদলাওনি।”
“আমি তো খারাপ না যে বদলে যাব? পারলে তুমি নিজেকে শুধরে নিও।”
“কাদিন অফিসে?”
“এ সময়ে আর কোথায় থাকবে?”
“হ্যাঁ, ও আবার খুব জ্যান্টেলম্যান। পড়াশুনা, কাজ এসব ছাড়া অন্যকিছুতে নেই। আসলে সবকিছুরই অভিজ্ঞতা থাকা ভালো। নাহয় শেষে এমনটাই হয়।”
“এমনটা হয় মানে?”
“সব বলব। একদিন দেখা করি চলো।”
“তোমার মাথা ঠিক আছে?” দীপা চটে গেল।
তাহমিদ বলল, “রেগে যাচ্ছ কেন? তোমাকে নিয়ে ভেগে যাচ্ছি না। তোমাকে আমিই ছেড়েছিলাম।”
“খুব ভালো করেই সব মনে আছে। কতটা কষ্ট দিয়েছিলে তুমি।”
“এখানে আর কথা না। ঐযে রিমা আপু আসছে৷ আমরা বরং একদিন দেখা করি। তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা আছে আমার।”
“আমার তোমার সাথে কথা বলার রুচি নেই। ভ্যারি স্যরি।”
দীপা উঠে চলে গেল। তাহমিদ দাঁতে দাঁত পিষল।
চলবে…

#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৭
অফিসে সাইন দিয়ে ফাইল বন্ধ করতে গিয়ে কাদিন থমকাল, তার মুখ কুঁচকে গেল। পিয়ন কাম দারোয়ানকে ডেকে বলল, “একটা ফ্লুইড কিনে নিয়ে আসুন৷”
পিয়ন ফ্লুইড কিনে আনতে গেলে কাদিন টেবিলের উপর থাকা ফাইলগুলোর দিকে তাকাল। কি করেছে সে! হাত দুটো একত্র করে টেবিলের উপর রেখে সেখানে মাথা ঠেকাল। প্রতিটা ফাইলে নিজের নাম স্বাক্ষরের বদলে দীপা! দীপা! দীপা! শিট! এখানে দীপার কি আছে? সকালে আসার সময়ও তো দীপা তার সাথে কথা বলেনি। মুখ ঘুরিয়ে শুয়েছিল।

ফ্লুইড পেয়ে ব্লান্ডার করে দেয়া কাজ আবার ঠিক করতে বসল কাদিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দীপার সহ্য ক্ষমতা ভালোই। গত রাতে এবং আজ সকালে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তার মানে কাদিন সত্যিই বাড়াবাড়ি করে ফেলছে। কিন্তু সে ঠিক ইচ্ছে করে এমনটা করে তাও নয়। সে সহজে কিছু ভুলতে পারে না। একবার তাকে কেউ অনুচিত কথা বললে সে রেশ তার মাঝে আজীবন থেকে যায়। সে অনুচিত কিছু করে না। তাই কেউ তার সাথে করলেন সেও মেনে নিতে পারে না। তার সঙ্গে দীপার সম্পর্ক আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মতই। মাঝে মাঝে তারচেয়েও বেশি মধুর। কিন্তু যেই মুহূর্তে দীপা আবেগে টইটম্বুর, খুব রোমান্টিক মুডে থাকে তখন তার মনে একটা ঝামেলা বাঁধে। দীপার মুড নষ্ট করার ঝামেলা। দীপা কেন তাকে লুচ্চা বলবে? কেউ তাকে লুচ্চা বলবে এই দিনও তাকে দেখতে হলো! সেই কেউটা আবার অন্য কেউ নয়। বরং তার স্ত্রী! এমনও নয় যে সোহাগ করে বলেছে। এখন তাকে হাজারবার লুচ্চা বললেও সে ক্ষ্যাপত না। যখন ঝামেলা চলছিল তখন কেন বলল? সম্পর্কের গোড়ার দিকে এসব বলা! অবিশ্বাস্য!
.
মুবিন স্কুলে যাবার জন্য রিকশা ডাকতে গেটের সামনে দাঁড়াতেই ইমাদ বারান্দা থেকে তাকে ডাকল। উপর থেকে বলল, “কথা আছে। দুমিনিট।”
মুবিন ঘাড় উঁচিয়ে তাকাল৷ বলল, “আচ্ছা।” ইমাদ হুড়মুড়িয়ে নীচে নামল, কিন্তু নীচে এসে দেখল মুবিন চলে গেছে। সে আবার মেসে ফিরে যেতেই মুবিন অন্য বিল্ডিংয়ের আড়াল থেকে দাঁত ক্যালিয়ে হাসতে হাসতে বেরুল। কিন্তু ইমাদও কম কিসে? সেও আবার মেস থেকে বের হয়ে মুবিনকে খপ করে ধরে ফেলল। সেও গেটের ভেতর দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় ছিল। মুবিনকে সে খুব ভালো করে চেনে। মুবিন থতমত খেয়ে বলল, “কি?”
ইমাদ বলল, “আরে ভাই আসলেই বিপদে আছি আমি। আর তুমি মশকরা করো? কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ।”
মুবিন বলল, “কোথায় মশকরা করলাম? আপনার জন্য কি আমি খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্যান্টের চেইন ঠিক করব? আপনি করেন নাকি?”
ইমাদ সেসবে কান না দিয়ে বলল, “কথা বলবে?”
মুবিন বলল, “আচ্ছা।”
“এটা কোন আচ্ছা? হ্যাঁ, আচ্ছা নাকি না আচ্ছা।”
“কি মনে হয়?”
ইমাদ খানিক ভেবে ইচ্ছে করে বলল, “নাসূচক আচ্ছা।”
এবং মুবিন প্রায় সাথে সাথেই শুধু ইমাদকে ভুল প্রমাণ করতে বলল, “কী অদ্ভুত! এটা হ্যাঁসূচক আচ্ছা।”
.
কাদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে শার্ট খুলতে খুলতে বলল, রাতে একটা দাওয়াত আছে।”
কাদিনের জন্য তিনদিন পর পর বালিশের কভার বদলাতে হয়। এমন না করলে নাকি চুলের ক্ষতি হয়। দীপা বালিশের কভার খুলে নতুন কভার লাগাচ্ছিল। সে চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকল। কাদিন তাকিয়ে দেখল এখনও দীপা গাল ফুলিয়ে রেখেছে। সে ফ্রেশ হতে চলে গেল। অনেকক্ষণ পর বাথরুম থেকে গলা উঁচিয়ে বলল, “টাওয়াল আনতে ভুলে গেছি।”
দীপা টাওয়াল নিয়ে বাথরুমের দরজায় নক করলে কাদিন দরজা খুলে টাওয়াল সহ দীপার হাত ধরে টেনে বলল, “এসো।”
দীপা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “না যাব না। সেদিন কেন ওমন করেছিলে তুমি? তোমার ইচ্ছাই শেষ কথা না।”
কাদিনও হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে।” সে টাওয়াল নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ফ্রেশ হয়ে এসে আলমারি খুলে দীপা কোন শাড়িটা পরবে, শাড়ির সাথে কি কি ম্যাচিং করে পরবে সব সময় নিয়ে স্যাট করে গেল দীপাকে ডাকতে। দীপা রিমার সাথে রিমার ঘরে বসে গল্প করছিল। কাদিন রিমার দরজায় নক করে বলল, “আপু আসব?”
রিমা ঠাট্টা করে বলল, “বউকে নিতে এলি? যা ভাই নিয়ে যা তোর বউ।”
কাদিন বলল, “একটা ডিল সাকসেসফুল হওয়ায় বস সব এমপ্লয়িদের ট্রিট দিচ্ছেন। বউসহ দাওয়াত।”
“অবিবাহিতদের কি হবে?”
“প্রেমিকাসহ যেতে চাইলে যাবে।”
“আর প্রেমিকা না থাকলে একা যাবে?”
“সেরকমই। দীপা, তৈরী হও। দেরি হচ্ছে আমাদের।”
দীপা বলল, “আমার তৈরী হতে দশ মিনিট। আমি তৈরী হয়ে বসে থাকত পারব না।”
কাদিন মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। এই মেয়ে কি একবার তার দিকে তাকাবেও না? কত সুন্দর কেতাদুরস্ত হয়ে সে তৈরী হয়ে এসেছে! বউই যদি না তাকায় কি লাভ এই টিপটপ থাকার? রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে একশোটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মত গুছানো ছেলে পুরো কুমিল্লা শহরে আর একটা থাকলে সে তার নাম বদলে ফেলবে। আর এই অন্ধ মেয়ে তাকে বলে তৈরী হতে! আর কি তৈরী হবে সে? এতক্ষণ কি তাহলে সে নেচেছে? কাদিন বিরক্তিতে কাঁদা হয়ে বলল, “আমি রেডি।”
দীপা উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খুব দ্রুত শাড়ি পরে সেজেগুজে সে বের হয়ে এল। অন্যদিন এসে কাদিনকে জিজ্ঞেস করে, “সব ঠিকঠাক? তুমি তো এসব ভালো বুঝো। দেখো তো ভালো করে।”
কাদিনও নিখুঁতভাবে তার ফিডব্যাক জানায়। আজ এসবের কিছুই বলল না দীপা। তাই কাদিনই বলল, “এত বড় হ্যান্ডব্যাগ! তুমি ছোটখাটো, পাতলা মানুষ৷ ছোট কোনো হ্যান্ডবাগ নিলে ভালো হয়।”
দীপা ঘরে ফিরে গেল। কাদিনও পিছু পিছু গিয়ে দেখলো দীপা হ্যান্ডব্যাগ উল্টে ব্যাগের সব জিনিসপত্র ড্রেসিংটেবিলে ফেলল। তারপর জরুরি যা কিছু তা ছোট হ্যান্ডব্যাগে নিয়ে নিলো। ঠোঁটে হাসির ছিঁটা পর্যন্ত নেই। গাল দুটো থমথম করছে। দাওয়াতে গিয়েও এই অবস্থা বহাল রইল। অন্যদিন কাদিন দীপার অনর্থক বেশি কথা বলা, এবং হাসাহাসি করা নিয়ে আতঙ্কিত থাকে। বারবার ইশারায় এটাওটা বুঝিয়ে বলে। আজ যে কথাটুকু না বললেই নয় দীপা ওটুকুও বলতে চাইল না। এমন দীপাকে কাদিন চেনেই না!
.
কড়ি কাপে চা ঢালতে ঢালতে গুনগুন করল, “এখন তো সময় চা খাওয়ার,
চা আর কড়ির কাছে আসার।
চা যে একা, আমিও যে একা
লাগে যে ভালো,
ও চা… ও চা….
মহানন্দে সে কাপ নিয়ে আয়েশ করে বসল। জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে। সবটা মন দিয়ে সে চায়ে চুমুক দিলো। এই সময়ের নাম চায়ের সময়। চা পান করার সময়টা সে যতটা পারে দীর্ঘ করে। তবে আজ খুব দ্রুত ইতি টানতে হলো। কারণ ইমাদের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে, “মুবিন কথা বলবে। ওর নাম্বার ০১*********। কাইন্ডলি কল হিম।”
কড়ি দেরি করল না। চা বাদ রেখে সে সাথে সাথে মুবিনকে কল করল। দেরি করা ঠিক হবে না। ছেলেটা মত পাল্টে ফেলার আগেই তার সাথে খাতির জমাতে হবে।
মুবিন আইপ্যাডটা স্তূপীকৃত তার নামকাওয়াস্তে টেবিলে সাজিয়ে রাখা গাইড বইগুলোর উপর হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে হাতে বার্গার নিয়ে বসল। বার্গারে মস্ত বড় বড় কামড় বসিয়ে সে অ্যানিমেটেড ইংরেজী সিনেমা দেখছে। এরমাঝে মোবাইল বেজে উঠায় সে মোবাইল বন্ধ করে ছুড়ে ফেলে আইপ্যাডে ফিরে এল। পুরো সিনেমা দেখা শেষ করে সে আবার পেস্ট্রি খেল। তারপর যখন তার মন চাইল তখন মোবাইল খুলে সেই নাম্বারটায় কল করে বড়দের মত বলল, “কাকে চান?”
কড়িও বলল, “আমি মুবিন সাহেবকে চাইছি।”
মুবিনের বড় হতে ইচ্ছে করে। অনেক বড়। কড়ি তাকে ত্রিশ সেকেন্ডে ছোট্ট মুবিন থেকে মুবিন সাহেব করে দিলো। মুবিনের মনে হলো ইমাদ স্যারের গার্লফ্রেন্ডকে কিছু সময় দেয়াই যায়।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে