#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫২
স্কুলের মাঠে সুহা একদল মেয়ে নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। মিলাও সঙ্গে ছিল। মুবিন সুহাকে ইশারায় কিছু বলল। সুহা চেঁচিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বলল, “ইশারা করো কেন? যা বলার সামনে এসে বলো।”
গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদর দলটা মুবিনের দিকে ঘুরে তাকাল। মুবিন মাথা উঁচু করে গম্ভীর ভঙ্গিতে হেঁটে এগিয়ে এল। মিলা অবাক হয়ে বলল, “কিছু বলবি?”
মুবিন সুহার দিকে আঙুল তাক করে বলল, “ওর সাথে কথা।”
সুহা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “বলুন, জনাব।”
মেয়েরা হাসতে গিয়েও মুবিনের ভয়ে কেউ হাসল না। মুবিন বলল, “আমার সুহার সাথে কথা আছে।”
মিলা বাদে সবাই সরে গেল। মুবিন মিলার দিকে তাকাল। মিলা বলল, “আমি যাব না।”
মুবিন চোখ উল্টে বিরক্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা সুহা শুনো। দোষ তোমারও৷ বলো সন্দেহ করোনি আমাকে?”
“ভালো করেছি সন্দেহ করেছি। তুমি সন্দেহ করার মত পাবলিক।”
মিলার কোটর থেকে চোখজোড়া বের হওয়ার উপক্রম হলো। সে ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে বলল, “মানে কি? কিসের সন্দেহ? তোরা একজন আরেকজনকে ডেইট করছিস?”
মুবিন সুহা দুজনই একসাথে মিলার দিকে তাকিয়ে ঝারি মেরে বলল, “তুই চুপ থাক।”
মিলা মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মুবিন বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করে তোমার সবগুলো প্র্যাক্টিকেল খাতা একেবারে দাওনি বলে ক্ষেপেছিলাম। মাথা ঠান্ডা হওয়ার পর ধন্যবাদ দিতেই কেকটা পাঠিয়েছি। টাকার গরম মনে করার কিছু নেই।”
সুহা আবার মুখ বাঁকাল। মিলা বলল, “কিসের কেক? কিসের প্র্যাক্টিকেল খাতা? তোরা কি নিয়ে কথা বলছিস?”
মুবিন বলল, “এক থাপ্পরে দাঁত ফেলব মিলা।’
সুহা বলল, “অ্যাই, আমার বান্ধবীকে ধমকাবে না তুমি। খবরদার।”
মুবিন বলল, “যাকগে থ্যাংকস।”
সুহা বলল, “আচ্ছা আমিও স্যরি।”
“এই তো লাইনে এসেছ।”
সুহা খুব ভাব নিয়ে বলল, “এখন ফুটো।”
মুবিন বলল, “আমি তারিখ লিখতে ভুলে গেছি।”
সুহা বলল, “আজ তো আনিনি কাল নিয়ে আসব।”
“আজই লাগবে। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
সুহা একটু ভেবে বলল, “তুমি ছুটির সময় আমার সাথে এসো। এখন খাতা বাসায়।”
“তোমার বাসায় সমস্যা হবে না?”
“তা একটু হবে। আম্মু ঝামেলাবাজ। সমস্যা নেই আমি সামলে নিব।”
মিলা এতক্ষণে বুঝল। মুবিনের প্র্যাক্টিকেল খাতা দরকার৷ সে বলল, “তুই আমারগুলো নিয়ে নে। উফ আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“তোর খাতা তোর কাছেই রাখ। আমাকে কখনো দিতে আসবি না।” মুবিন ঘাড় শক্ত করে বলল।
স্কুল ছুটি হলে মুবিন সাইকেলে বসে একটা পা রাস্তায়, অন্য পা প্যাডেলে রেখে অপেক্ষা করছিল। ভিড়ের মাঝে মুবিনকে খুঁজে বের করতে সুহার কষ্ট হলো। পেয়ে বলল, “ধুর মিঞা তুমি গেইটের বাইরে এসে পড়েছ। আর আমি ভিতরে খুঁজতে খুঁজতে শেষ।”
মুবিন কথা বলার প্রয়োজনবোধ করল না। মেয়েরা ফাউ কথা বেশি বলে। সুহা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রিকশা নেওয়ার চেষ্টা করল। দামাদামিতে বনছে না তার। মুবিন অন্যদিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে করতে বলল, “ভাড়া তো ত্রিশ টাকাই।”
সুহা বলল, “বলেছে তোমাকে! আমি প্রতিদিন পঁচিশ টাকা দিয়েই যাই।”
মুবিন বিরক্ত হলেও কিছু বলল না। কিছু বললে বলবে টাকার গরম।
অনেকটা সময় পর যখন বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রীরাই চলে গেল। রাস্তা ফাঁকা হলো তখন সুহা পঁচিশ টাকা দিয়ে রিকশা ঠিক করল। মুবিন রিকশা অনুসরণ করে সুহার পেছন পেছন গেল। বাসায় পৌঁছে সুহা রিকশা থেকে নেমে মুবিনকে বলল, “বাসায় এসো।”
“না।”
“আচ্ছা দাঁড়াও তুমি।”
সুহা এক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে তার প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো খুঁজে নিয়ে এল। মুবিনকে খাতাগুলো দেওয়ার সময় বারান্দা থেকে সুহার মা ওদের দুজনকে দেখল। সুহাও খেয়াল করল মা তাকিয়ে আছে। মুবিন চলে গেলে সে বাসায় গেল। মা কিছু একটা বলতে চাইছিলেন তার আগেই সুহা হাত দেখিয়ে মাকে থামাল, “শুনো শুনো ঐ পুঁচকে পোলাপানের সঙ্গে আমি আর যাই করি প্রেম করব না। যাও নাকে তেল দিয়ে ঘুমাও।”
.
ইমাদ রাতে মুবিনের রুমমেটের সাথে দেখা করবার ছুঁতোয় মুবিনের ঘরে ঢুকল, “আলি ভাই আপনার কাছে স্ক্রু ড্রাইভার আছে?”
মুবিন উগ্র চোখে তাকাল একবার। পরে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ইমাদ কথা বলতে বলতে মুবিন কি করছে লক্ষ্য করে চিন্তিত হয়ে পড়ল। সে টেবিলে একটার পর একটা প্র্যাক্টিক্যাল খাতা তুলছে আর শরীরে সর্ব শক্তি দিয়ে পাতাগুলো মাঝখান থেকে ছিঁড়ে ফেলছে। প্রতিটা পাতা ছিঁড়বার সময় তার ঠোঁটে ক্রুর হাসি।
.
সুহা অনেক রাতে ইমাদকে কল করল। ইমাদ কল ধরল না। সুহা মেসেজে লিখল, “আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়? কয় ভাই বোন আপনারা? আপনি কি আমার সাথেই এত চুপচাপ? নাকি সবার সাথে এমন? আমার কণ্ঠটা সুন্দর না? কল ধরুন।”
ইমাদ রিপ্লাইয়ে লিখল, “আপনি কে?”
সুহা লিখল, “আমি খুবই মিষ্টি দেখতে দুষ্টু একটা মেয়ে। সবাই বলে আমার চোখজোড়া কথা বলে। আমার চুল কালো, লম্বায় কাঁধ পর্যন্ত। আর আমি লম্বায় একদম আপনার বুকের কাছে পড়ব। পড়াশুনায় মোটামুটি। নাচতে জানি। মাঝে মাঝে মেঘলা দিনে ছাদে উঠে নাচি। তবে লুকিয়ে লুকিয়ে। মা দেখলে পিঠের ছাল তুলবেন৷ ভালো লাগে আপনাকে। অন্যায় এবং টাকার গরম অপছন্দ করি। ঠাশ ঠাশ কথা বলা বদভ্যাস (মায়ের দৃষ্টিতে)। বন্ধু হিসেবে আমি সেরা। এই ছিল আমার জীবনবৃত্তান্ত।”
ইমাদ লিখল, “আপনার নাম কি?”
সুহা লিখল, “আমার নাম নেই। আমি অনামিকা। কল ধরুন৷ আপনার সঙ্গে কথা আছে।”
ইমাদ লিখল, “আগে নাম বলুন।”
“বলব না।”
“আচ্ছা।”
সুহা কল দিলো। ইমাদ মোবাইল বন্ধ করে ফেলল।
চলবে ইনশাআল্লাহ….
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৩
শিল্পী মিলার সাথে দেখা করতে এসেছে। প্রায়দিনই আসে৷ আজ মিলার বিছানায় শুয়ে নেতিয়ে রইল। বলল, “আর কদিন একা থাকলে আমি মরে যাব৷ একা বাসায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”
মিলা বলল, “তুমিও কোনো কর্মজীবী হোস্টেলে উঠে যাও।”
শিল্পী বালিশ থেকে মাথাটা তুলে মিলার দিকে তাকাল। মিলা পড়ার টেবিলে। কিছু একটা লিখছে। শিল্পী নরম গলায় বলল, “তবুও বললি না যে মা আমি তোমার সঙ্গে থাকব।”
মিলা লিখতে লিখতেই বলল, “আমার পরীক্ষা যে… বারবার এদিকওদিক হলে পড়ায় মন বসে না।”
“তাহলে এ কদিন নাহয় কষ্ট করি৷ এরপর তুই আমার কাছে চলে আসবি।”
“সম্ভব হবে না, মা। আমি ঢাকা গিয়ে হলিক্রসে ভর্তি হব। কুমিল্লা আর থাকব না।”
শিল্পী উঠে বসল, “আমি বদলি হয়ে তোর সাথে ঢাকা যাব।”
“মুবিনের কি হবে?”
“ওকেও ঢাকার কোনো কলেজে ভর্তি করাব।”
মিলা খাতা বন্ধ করে বলল, “ও রাজি হবে না।”
“নাহলে এখানেই থাকুক। ইমাদ যতদিন আছে সমস্যা হবে না।”
“তুমিও এখানে থাকো।”
শিল্পী বিছানা থেকে উঠে এসে মিলার পাশে দাঁড়াল। মিলার মুখটা দুহাতে তুলে ধরে বলল, “আমার উপর তোর অনেক রাগ, মিলা।”
মিলা মায়ের হাত ধরে হেসে বলল, “কই না তো!”
“তোকে জোর করব না। সবসময় তোকেই জোর করি। কাজটা ঠিক না। আজীবন তোর বাবা, আর মুবিনের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে পেয়ে সেই রাগ আমি তোর উপর ঝেরেছি। লক্ষী ছিলি যাই করতাম, বলতাম বিনা তর্কে মেনে নিতিস।” শিল্পীর গলা ধরে এল।
মিলা বলল, “শুয়ে থাকো, মা। তোমার শরীরটা ভালো না।”
শিল্পী গিয়ে শুয়ে রইল। মিলার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বইয়ের পাতায় পড়ল। সে অযথাই বই খুলে রেখেছে।
জানালা দিয়ে দল বেঁধে বিকেলের মশাগুলো ঢুকছে। মিলা উঠে গিয়ে জানালাটা বন্ধ করল। কয়েলের প্যাকেট থেকে কয়েল বের করে ধরিয়ে শিল্পীর পায়ের কাছে রাখল। শিল্পী হঠাৎ বলল, “মুবিন কিছু বলেছে তোকে?”
“কি বলবে?”
“ওর সাথে কথা হয়না?”
“ওকে তো চিনো, মা।”
শিল্পী দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে বলল, “মুবিন আমাকে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখেছে।”
মিলা দাঁড়িয়ে থেকেই জানতে চাইল, “পরে?”
শিল্পী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ও আমাকেও ওর বাবার মত ভেবেছে।”
“তুমি কখনোই বাবার মত না। তুমি একজন অনেক ভালো মা।” মিলার প্রতিক্রিয়া।
শিল্পী অন্যদিকে মুখ করেই ফুঁপিয়ে উঠল।
.
যে ছেলেটা সুহার চিঠি মুবিনকে দিয়ে ঘুষি খেয়েছিল সে ছেলেটিকে দিয়েই মুবিন মিলার ছেঁড়া প্র্যাক্টিকেল খাতাগুলো পাঠিয়েছে। সাথে খাতা থেকে হুট করে ছিঁড়ে নেয়া ছোট একটা এবড়োথেবড়ো সাদা কাগজে বাজে হাতের লেখায় লিখা, “স্টুপিড।”
খাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখে সুহার চোখে পানি চলে এল। এখন এই শেষ মুহূর্তে এসে সে পড়বে নাকি এসব করবে? আর সাইন! দোকান থেকে করিয়ে আনলেও স্যার, ম্যাডামরা কেউ সাইন করবেন না নতুন করে। হাতে পায়ে ধরে করালেও অনেক অনেক বকুনিঝকুনি। মিলা সুহার কাঁধে হাত রাখল। খুবই লজ্জিত হয়ে বলল, “স্যরি, সুহা। আমার খুবই খারাপ লাগছে। আমি তোকে সব লিখে দিব।”
সুহা ধরে আসা গলায় বলল, “আমি মুবিনকে মেরে ফেলব।”
মিলা একইসাথে বিস্মিত ও হতাশ হয়ে বলল, “ও কেন এমন করল?”
সুহা সে উত্তর দিলো না৷ ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও কোথায়?”
ছেলেটা বলল, “মুবিন খাতাগুলো আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেছে। স্কুল ড্রেস পরে আসেনি৷ বাইরের পোশাক ছিল। গেইট থেকেই চলে গেছে।”
স্কুলের অ্যাসেম্বলি এখনও শুরু হয়নি। সুহা চট করে সিঁড়ি বেয়ে ক্লাসে গেল। ডেস্ক থেকে স্কুল ব্যাগটা টেনে নিয়ে কাঁধে তুলে দৌড়ে নীচে নেমে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল। মিলা পেছন থেকে অনেক ডাকল। সে শুনলই না। বের হয়ে খানিক সামনে হেঁটে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করল। স্কুলে সে লুকিয়ে মোবাইল নিয়ে আসে। কেউ জামে না। মুবিনের নাম্বারে কল করল সে। মুবিন কল হতে না হতেই ধরে ফেলল। বিশ্রী আনন্দে বলল, “অপেক্ষা করছিলাম। এত দেরি কেন?”
সুহা সোজা তুইতোকারি শুরু করল, “তুই কোথায় গিয়ে লুকিয়ে আছিস? সাহস থাকলে আমার সামনে আয়।”
মুবিন মোবাইলটা কাঁধ দিয়ে কানে চেপে ধরে বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “আমি তোর মত মেয়ের পিছনে ঘুর ঘুর করব কোন দুঃখে? তোর দরকার হলে তুই আমার পেছনে আয়।”
সুহা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, “আমি তোর নামে মামলা করব।”
মুবিন কায়দা করে বাদাম শূণ্যে উড়িয়ে মুখে নিয়ে বলল, “প্র্যাক্টিকেল খাতা নষ্ট করবার মামলা? ভেরি গুড।”
“নাহ ইভিটিজিং এর মামলা।”
“তোর কোনো চেহারা আছে? তোকে কে করবে ইভটিজিং?”
সুহা হিসহিসিয়ে উঠল, “মোবাইলে বাহাদুরি করা বন্ধ করে সামনে আয়। তোকে আমি নিজ হাতে শায়েস্তা করব।”
মুবিন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া বাদামের খোসাগুলো ঝেরে বলল, “মেসের ঠিকানা দিচ্ছি। মরতে মন চাইলে চলে আয়।”
সুহা ঠিক ঠিক মেসে গেল। মেসের সামনে দাঁড়িয়ে মুবিনকে আবার কল করে বলল, “আমি তোর মেসের সামনে। তুই আয়।”
মুবিন কল কেটে দিয়ে হেলেদুলে মেসের গেইট থেকে বেরুলো। মুবিনকে দেখার সাথে সাথে সুহা মুবিনকে মারতে গেল। মুবিন সুহার হাত ধরে মুচড়ে দিলো। ব্যথায় ককিয়ে উঠল সুহা। ইমাদ তখন মেসে ছিল না। সে গিয়েছিল পাউরুটি আর কলা কিনতে পাশের গলির দোকানে। সে পাউরুটি কলা নিয়ে হেঁটে এসে হতভম্ভ হয়ে গেল। হ্যাংলা পাতলা মেয়েটি মুবিনকে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করতেই মুবিন মেয়েটিকে এক ধাক্কায় নীচে ফেলে দিলো। মেয়েটি রাস্তায় পড়ে কনুই ছিলে ফেলল। মানুষজন হেঁটে যেতে যেতে বারবার তাকাচ্ছে, হাসছে। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে মোবাইলে দৃশ্য ধারণ করছে কিন্তু কেউ এগিয়ে এসে দুজনকে ফেরানোর প্রয়োজন মনে করল না। ইমাদ হাতের পাউরুটি কলা ফেলে দ্রুত গিয়ে মুবিনকে সামনে থেকে জাপটে ধরল, “মুবিন শান্ত হও৷ ভেতরে চলো।”
মুবিন শরীর বাঁকিয়ে ইমাদের হাত থেকে বেরিয়ে যেতে চাইল। বলল, “আপনি সরুন। ছাড়ুন আমাকে।”
সুহা রক্তঝরা কনুই চেপে ধরে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করতে করতে দেখল তাকে খলনায়ক মুবিন থেকে উদ্ধার করতে স্বয়ং নায়ক ইমাদ স্যার চলে এসেছেন৷ ইমাদ মুবিনকে ঠেলে ভেতরে নিয়ে বাইরে থেকে গেইট আটকে দিলো। সুহার দিকে তাকিয়ে সুহার হাত ধরল। বলল, “রক্ত পড়ছে। চলো আমার সাথে।”
সুহার মনে হলো সে এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। হাত থেকে রক্ত ঝরছে এজন্য নয়, ইমাদ তার হাত ধরেছে তাই। মুবিন ভেতর থেকে ষাঁড়ের মতন গেইটে এলোপাথাড়ি লাথি বসাচ্ছে। সুহা সে শব্দে বিরক্ত হলেও মুবিনকে ইমাদের ওয়াস্তে মাফ করে দিলো। ইমাদ তার হাত ধরেছে! এর জন্য আরো হাজারটা প্র্যাক্টিকেল খাতা লিখা যায়, নষ্ট করা যায়, জলে ফেলা যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫৪
সুহাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে ইমাদ সাইকেলটা একটা সাইড করে রাখল। কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে রইল। কত বয়স হবে মুবিনের? এক ক্লাসে দুইবার পড়লেও ষোলো সতেরোর বেশি বয়স হবে না। মিলা অবহেলিত-উপেক্ষিত ছিল বলে তার দুঃখ হতো। অথচ, মুবিনকে ঘুণপোকারা খেয়ে ফেলছে। মিলাকে নিয়ে চিন্তা নেই। মিলা খুব ভালো করবে, একদিন ভালো থাকবেই। কিন্তু তছনছ হয়েছে মুবিন। মুবিনকে সে বুঝেনি, কেউ বুঝেও না। ইমাদ অনেক চিন্তা করল। যদি কিছু একটা করতে পারত ওর জন্য! সেখানে দাঁড়িয়েই সে একটা মেসেজ লিখল। মেসেজে লেখা “এইবার সত্যিই খুব জরুরি কথা।” প্রাপক কড়ি।
সুহা জানালা দিয়ে দেখল ইমাদ স্যার এখনও তার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে। এখনও যাননি৷ বাসায় এনে এক কাপ চা খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। কতবার বলল সে, ইমাদ স্যার এলেন না। সুহাও কম না। চট করে চা বানাতে চলে গেল সে। রান্নাঘরে গিয়ে চা করল। চায়ের কাপ হাতে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল ইমাদ স্যার নেই। বিড়বিড় করল, “হুম অদৃশ্যমানব!”
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বাসায় ফিরে গেল। ধরে নিলো, সে চা পান করা যে কথা, ইমাদ স্যার পান করাও একই কথা। সে কি আলাদা নাকি! মন থেকে সে এখন ইমাদ স্যারের সাথে মিলেমিশে একাকার। নিজের ভাবনায় নিজেই হাসতে হাসতে বাসার সিঁড়িতে গরম চা ফেলল। তারপর সে চায়ে পিছলে পড়ে আবার ব্যথা পেল। কাপ ভাঙল, মা উপর থেকে চেঁচিয়ে উঠল। তবুও সে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল। আজ খুশি খুশি দিন। ইমাদ স্যার তাকে নিয়ে ফার্স্ট এইড ব্যান্ডেজ কিনেছে। তারপর নিজ হাতে সেঁটে দিতে দিতে তার দিকে তাকিয়েছে। সেও ইমাদ স্যারের দিকেই তাকিয়েছিল। তিনি তাকাতেই অন্যদিকে চোখ সরিয়ে ফেলেছিল। তিনি শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, “বাসা কোথায়?”
উত্তর দেবার বাহানায় সে সুযোগ পেয়ে গেল। সুযোগ হাতছাড়া না করে কিশোরীর চঞ্চল চাহনি ছুঁড়ে দিয়ে ঠিকানা বলল। তিনি হঠাৎ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা একটি পাউরুটির প্যাকেট আর কলা তুলে সুহার হাতে দিলো। সুহা বলল, “না, না লাগবে না।”
তিনি শুধু তাকালেন, কিছু বললেন না। সেও বুঝল তিনি তাহলে সত্যি সত্যি কথা কম বলেন৷ আরো জানতে চায় সে। আরো, আরো এবং আরো৷
পরে তিনি আরো বললেন, “তোমার সাথে আসছি।” তিনি রিকশাও ডাকলেন। সুহা আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে ছিল। কী হচ্ছিল তার সাথে? ইমাদ স্যার পথ চলতে সঙ্গী হবেন? একটা ঘোরের মাঝে সে রিকশায় উঠল, কিন্তু হায় ইমাদ স্যার ভেতর থেকে সাইকেল নিয়ে এলেন! সে ফুঁস হয়ে গেল। এক রিকশায় এলে কি এমন হতো? সে নাহয় একটু শান্তি পেত, আরেকটু অস্থির হতো।
.
অফিসের কাজ করতে করতে কাদিনের মাথাটা ধরে গিয়েছিল। তাই ডেস্কের চেয়ারটা টেনে বারান্দায় নিয়ে গেল। দীপা ঘরে বসে তার নিজের পড়া পড়ছিল। সে বই বন্ধ করে এসে বারান্দায় উঁকি দিয়ে বলল, “কি হয়েছে?”
কাদিন কপালে হাত রেখে বলল, “মাথা ব্যথা।”
দীপা ঘাড় দুলিয়ে বলল, “ম্যাসাজ করে দিব?”
কাদিন বলল, “না।”
“চলে যাবে।”
“এসব অভ্যাস হয়ে যায়।”
“তাহলে একটা আদা দিই। চিবিয়ো। সাথে সাথে মাথা ব্যথা চলে যাবে।”
কাদিন নাকে হাত চেপে ধরে বলল, “অসম্ভব, আমি এখনি গন্ধ পাচ্ছি।”
দীপা শশব্যস্ত হয়ে বলল, “তাহলে লবঙ্গ একটা তাওয়ায় গরম করে এনে দিই। রুমালে রেখে ঘ্রাণ নিবে।”
“লাগবে না। তুমি বসো।”
দীপা ঠাট্টা করে বলল, “ভয় পেও না আমার রুমাল দিব না, বাবু।”
কাদিন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “আগে কায়েস বিরক্ত করত এখন তুমিও।”
দীপা কাদিনের মুখটা ধরে বলল, “তোমাকে নিয়ে কোথায় যাই বলো। চা- কফিও তো খাও না। সবকিছুতে তোমার অভ্যাস হয়ে যাবে এই এক ভয়।”
কাদিন দীপার হাত সরিয়ে বলল, “গুনী স্বামী পেয়েছ। কদর করো। গিয়ে নিজের বান্ধবীদের জিজ্ঞেস করো। বরের জন্য চা- নাশতা বানাতে বানাতে দিন ফুরোয় ওদের।”
দীপাও ক্যাটক্যাট করে বলল, “আর আমার দিন ফুরোয় তোমার ঘর পরিষ্কার করতে করতে।”
কাদিন চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বলল, “কথা বলে বলে আরো মাথা ব্যথা করে ফেলছ।”
দীপা কোমরে হাত রেখে বলল, “যত দোষ দীপা ঘোষ।”
কাদিন চুপ হয়ে গেল। দীপা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে অন্তত পানি খাও। পানি খেলেও মাথা ব্যথা কমে।”
কাদিন বলল, “তুমি চুপ করে বসলেই আমার মাথা ব্যথা কমবে৷ চুপ করো।”
দীপা থমথম করে উঠল। বারান্দায় নীরবতার হৈ হৈ। আর একটাও কথা না বলে সে ঘরে চলে যাচ্ছিল। কাদিন চোখ বন্ধ করে আছে। তার চোখে পড়বে না বলে দীপা কিছুটা গিয়ে থেমে দাঁড়াল। ফ্লোরের সাথে পা ঘঁষে ঘঁষে শব্দ তুলে যেতে যেতে কাদিনকে চোখ খুলবার কারণ তৈরী করে দিলো। পায়ের শব্দে কাদিন বুঝল দীপা চলে যাচ্ছে। চোখ খুলে বলল, “চলে যাচ্ছ যে?”
দীপা খুবই বিরক্ত হয়েছে ভান করে বলল, “আহা তোমার জন্য আমি একটু পড়াশুনাও করতে পারব না নাকি?”
“চুপ করতে বললাম সেটা শুনলে, রাগ করলে। অথচ, চুপ করে যে আমার পাশে একটু বসতে বললাম সেটা কানে গেল না, ভালো লাগল না।” কাদিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিল।
দীপা হেসে ফেলল। বলল, “তাহলে ঠিক আছে।”
“চেয়ার নিয়ে এসো যাও।”
“চেয়ার লাগবে কেন?” বলতে বলতে দীপা কাদিনের গলা জড়িয়ে ধরে তার কোলে বসে পড়ল৷ কাদিন দীপাকে ধরতে গিয়েও ধরল না। হাত গুটিয়ে নিয়ে আচমকা রেগে গেল, “বললাম মাথা ব্যথা।” দীপাকে ঠেলে উঠিয়ে দিলো। দীপার খুব গায়ে লাগল, “কাদিন, তোমার সমস্যা কি?”
“কয়বার বলব মাথা ব্যথা?”
শক্ত গলায় কথা বলা দীপার দ্বারা হয় না। তার কণ্ঠ ভিজে এল। কষ্ট পেয়ে বলল, “আমাকে নিয়ে তোমার সমস্যা কি সেটা বলো।”
“তোমাকে বললাম চুপ করো।”
“তুমি খুবই ডমিনেটিং কাদিন৷ সবসময় তোমার কথামত কেন চলতে হবে?” দীপার কণ্ঠ নড়বড়ে।
“ঠিক আছে। কিছু বলব না।”
“তোমার যখন ইচ্ছে কাছে আসবে। অথচ, আমি এলে তুমি আমাকে এভাবে অপমানিত করো। সবসময়।”
কাদিন কিছু বলবার প্রয়োজন মনে করল না। তাই দীপাও বলল, “আমি আর থাকব না।”
চলবে…