#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৯
সুহা বটি নিয়ে বসেছে। পেয়ারা কাটছে। প্রায় বিকেলেই তার পেয়ারার নেশা উঠে। পেয়ারা কাটা শেষ। লবণ মরিচ দিয়ে পেয়ারা খেতে যাবে তখনি ঠিক কলিংবেলটা বাজল। সে মহাবিরক্ত! শান্তি বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই।
সুহার মা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখলেন সুহার হাতে কেক। কেকের উপর বড় করে লেখা, “থ্যাংক ইউ।”
তিনি চোখ সরু করে তাকালেন, “কি এটা?”
সুহা বলল, “কেক এটা। চকোলেট কেক।”
“কেক যে আমিও তা দেখতে পাচ্ছি। টাকা কি গাছে ধরে? কোনো জন্মদিন না, উপলক্ষ না কিসের কেক?” তিনি প্রায় হুঙ্কার দিলেন।
সুহা বিরক্ত হয়ে বলল, “আহা, মা। গিফ্ট এসেছে। তোমার টাকা যায়নি।”
“গিফ্ট! কিসের গিফ্ট?”
“একজনকে আমার প্র্যাক্টিকেল খাতা দিয়েছিলাম তাই…” “একজনটা ছেলে না মেয়ে?”
“ছেলে হলে কি হবে আর মেয়ে হলে কি হবে?”
“ছেলে হলে তোর পা ভেঙে দেয়া হবে আর মেয়ে হলে মেয়েটাকে একদিন নিয়ে আসবি বাসায়। এত ভালো মেয়ে! কৃতজ্ঞতার মত সহজ গুণ সবার থাকে না।”
সুহা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে নিয়ে আসব ওকে।”
“কি নাম ওর?”
সুহা একটু ভেবে মুবিনের বদলে মিলার নাম বলে দিলো। সুহার মায়ের ভ্রু কুঁচকে গেল। এত ভালো ছাত্রী সুহার কাছ থেকে দেখে লিখে? অসম্ভব। মেয়ে কিছু একটা লুকাচ্ছে। কিন্তু এখন তিনি আর কিছু বলবেন না। মেয়ে ডালে ডালে চললে, মাকে চলতে হয় পাতায় পাতায়।
.
সুহা নিজের ঘরে এসে পায়চারি করতে করতে মুবিনকে কল করল। মুবিন কল ধরল না। সুহা বারবার করতে থাকল। সে বিফল নয়। মুবিন বলল, “হ্যালো।”
সুহা তার রিনরিনে গলায় ঝগড়া করে উঠল, “কেক ফেরত পাঠাচ্ছি তোমার ঠিকানা বলো।”
“কেক চাই না? ঝাল কিছু খাবে? আমার আগেই বুঝা উচিত ছিল ঝগড়াটে মেয়েরা মিষ্টি খেতে পারে না। তাদের ডায়রিয়া হয়।”
“কি বললে তুমি? কি বললে?” সুহা রেগে বোম্ব।
মুবিন বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ বলেছি।”
“তুমি থ্যাঙ্ক ইউ বলোনি। তুমি শো-অফ করেছ। টাকার গরম দেখিয়েছ।”
“সবকিছুতেই তুমি টাকার গরম পাও। তোমার মাথায় সমস্যা আছে।”
“আমার ইচ্ছা আমি তোমাকে খুন করব।”
“আমারো একই ইচ্ছা। ভাবছি লোক দিয়ে খুন করাব। টাকার গরম দেখাব।”
মুবিন লাইনটা কেটে দিলো। মেয়েটা বেশি বেশি। ফোন কেটে দেয়ার পরও সুহা আরো কল দিতে থাকল। কাজ হলো না। মুবিন ধরল না। সুহা তাই মেসেজ লিখতে মেসেজবক্সে গেল। মেসেজেই ধুয়ে দিবে মুবিনকে আজ। কিন্তু মেসেজ বক্সের দখিন হাওয়া সুহাকে মুহূর্তেই শান্ত করে দিলো। দখিন হাওয়ার নাম ইমাদ। সুহা গতরাতে ইমাদকে বলেছিল, “কে আপনি বলা ছাড়া আপনার কি কোনো কথা নেই? আমি কে এত জানতে হবে না আপনার। শুধু জেনে রাখুন, আমি ভাত খেতে বসলে আপনি খেয়েছেন কিনা সে চিন্তায় গলা দিয়ে আমার ভাত নামে না। বৃষ্টি নামলে আপনি ঘরে না বাইরে সেটাই ভাবি। ভ্যাপসা গরমে হাত পাখা নিয়ে আপনার কাছে দৌড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে। আপনি ঘুমোবেন আমি বাতাস করব।”
জবাবে ইমাদ লিখেছে, “আচ্ছা।”
সুহা বুকে কোল বালিশ জড়িয়ে আনন্দে কতক্ষণ গড়াগড়ি খেল। বুকের ভেতরের ধুকপুক।
.
অফিস শেষে শিল্পী প্রায়ই বাসা খুঁজতে বের হয়। এখন যে বাসাটা নিয়েছে সেটি অফিস থেকে দূর হয়ে যায়। অফিসের কাছাকাছি একটা বাসা নেওয়ার ইচ্ছা তার। তাই প্রতিদিনই বাসা খুঁজে বেড়ায়। আজ বাসা খুঁজতে বেরিয়ে একটা ঘটনা ঘটল। শিল্পী যে বিল্ডিং এ ফ্ল্যাট দেখছিল সে বিল্ডিংয়েই জুয়েল সাহেব থাকেন। শিল্পী জানতো না। বাড়ি ওয়ালার পাশের ফ্ল্যাটে জুয়েল সাহেব সপরিবারে বাস করেন। শিল্পী বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা শেষ করে বেরিয়েছে। জুয়েল সাহেবের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গেল। শিল্পী অবাক। এ বাসায় জুয়েল সাহেব থাকেন! জুয়েল সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে বেরুচ্ছিলেন। শিল্পীকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, “আরে আপনি এখানে?”
শিল্পী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “জি এখানে। ভাবির সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।”
জুয়েল সাহেব চমকালেন, “কি কথা?”
“কথা তো আপনার সাথে না। ভাবির সাথে।”
“ও বাসায় নেই।” বলেই জুয়েল সাহেব তড়িঘড়ি করে বাসায় ঢুকে গেলেন। ভেতর থেকে দরজা আটকে ফেললেন। শিল্পী হেসে ফেলল। জুয়েল সাহেব আজ আর বাজারে যাবেন না। বউকে শিল্পীর কাছ থেকে আগলে রাখবেন। বউয়ের কাছে তার কীর্তিকলাপ ফাঁস করে দেবার ভয় দেখাতে চেয়েছিল শিল্পী। তিনি পুরোদস্তুর আতঙ্কিত। হায়রে নষ্টা পুরুষদের দল!
চলবে ইনশাআল্লাহ….
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫০
ব্যাংকের সামনে রিকশা’টা এসে অলসভাবে থামল। শিল্পী ভ্যানিটি ব্যাগে খুচরা টাকা খুঁজছিল। রিকশাচালকের কাছে ভাংতি নেই। শিল্পী রিকশা থেকে নেমে কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে বলল, “আপনার কাছে ভাংতি হবে?”
লোকটা বলল, “জি হবে। কত টাকা লাগবে?”
“একশো টাকার ভাংতি হলেই হবে।”
লোকটা মানি ব্যাগ বের করে টাকা দিলো। শিল্পী বলল, “ধন্যবাদ।”
লোকটা বলল, “আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।”
“জি বলুন।”
“আমি জুয়েলের পুরোনো বন্ধু।”
শিল্পীর চোখ মুখ শক্ত হয়ে এল। রুক্ষ গলায় বলল, “আপনি জুয়েল সাহেবের বন্ধু। আপনার আমার সাথে কি?”
লোকটা একটু ঘাবড়ে গেল। সকাল সকাল শিল্পীর দিনটাই খারাপ হয়ে গেল। জুয়েল সাহেব তাঁর বন্ধুদের সাথেও তাকে নিয়ে আলোচনা করছেন। কতটা নির্লজ্জ, বেহায়া এই লোক! শিল্পী ঠিক করল সত্যি সত্যি জুয়েল সাহেবের স্ত্রীকে বিষয়টা জানাবেন। মহিলার জানার দরকার আছে! বিশ্বাস করবেন কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু কষ্ট পাবেন নিশ্চিত। রাতের ঘুম উড়ে যাবে। আর তাদের সন্তানগুলো…। আর ভাবতে চায় না সে। সে এইসব অনুভূতির সাথে পরিচিত। আজকাল তো এই অনুভূতিগুলোই তার রাতের সঙ্গী। ছেলে তার সাথে দেখা না করলেও অনুভূতিগুলো ঠিকই রোজ তাকে একবার এসে দেখে যায়। মেয়ে তার সঙ্গে অভিমান করলেও এই অসহায় উপলব্ধিগুলোর কোনো আত্মসম্মান নেই। যতই দূর দূর করে তত জাপটে ধরে। ঘায়েল, নিঃসঙ্গ শিল্পী এলোমেলো পায়ে দরজা ঠেলে ব্যাংকে ঢুকল। গার্ড সালাম দিলো। শিল্পী শুনলও না। লোকটা যে তাকে অনুসরণ করে ভেতরে আসছে তারও খেয়াল নেই। কানে বাজল, “আপনার সাথে কথা বলতে চাই। বেশিক্ষণ সময় নিব না। আমার আবার আরেক জায়গায় যেতে হবে।”
শিল্পী থমকে দাঁড়াল। ভ্রু কুঁচকে ফিরল। অনেকটা ধমকে বলল, “আমার সাথে কি কথা আপনার?”
লোকটা আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “কথাটায় জুয়েল ইনভলবড তো। এখানে বলা ঠিক হবে না।”
শিল্পীর এখন একটাই ইচ্ছা। উপরতলায় গিয়ে জুয়েল সাহেবকে কষিয়ে একটা চড় দেওয়া। শিল্পী বলল, “তাহলে জুয়েল সাহেবের বাসায় চলুন। কাছেই তো। উনার বাসায় বসে কথা বলাটাই সবচেয়ে ভালো। ভাবি আমাদের চা নাস্তাও খাওয়াবেন নিশ্চয়ই।”
লোকটার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। শিল্পী দরজা ঠেলে বাইরে বের হয়ে এল। কর্মস্থলে ঝামেলা করা ঠিক হবে না। এমনিতেই ডিভোর্সী বলে সবাই আমোদ পেয়ে আছে।
শিল্পী কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। লোকটা কেশে কথা শুরু করল, “আমি যাকারিয়া করিম। জুয়েল আমার কলেজ জীবনের বন্ধু। খুবই অমায়িক মানুষ। কারো সঙ্গে তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আপনিও তো এত বছর ধরে একসাথে কাজ করছেন। আপনারো জানার কথা সে কতটা ভালো মানুষ।”
“জি আমি জানি তিনি কতটা ভালো মানুষ।” শিল্পীর চোখের দৃষ্টি শীতল, গলার স্বর তীক্ষ্ণ।
যাকারিয়া নড়েচড়ে বসে বললেন, “আসলে আপনি যা ভাবছেন ব্যাপারটা তা না।”
“ব্যাপারটা কি বলার জন্য আপনার কাছে বেশি সময় নেই। পাঁচ মিনিট আছে।”
“আপনি জুয়েলের বাসায় গিয়েছিলেন?”
“আপনার বন্ধুকে বলে দিবেন আমাকে বিরক্ত করার ফল খুবই খারাপ হবে।”
“আ… আসলে কয়েকদিন আগে জুয়েলের সঙ্গে দেখা করতে আমি ব্যাংকে গিয়েছিলাম। তখন আপনাকে দেখেছি। আপনার সম্পর্কে সব শুনেছিও। ভাবলাম জুয়েলের কলিগ আপনি। সে যদি আমাদের পরিচয়টা করিয়ে দেয় খুবই ভালো হয়। এখানে জুয়েলের কোনো দোষ নেই। আপনি ভাবির কাছে যাওয়ায় বেচারা খুবই ঘাবড়ে গেছে। আমি চাইনা তাদের মাঝে কোনো ঝামেলা হোক।”
“তাহলে আপনার বাসার ঠিকানাটা দিয়ে যান। এখন তো আমার আপনার স্ত্রীর কাছে যেতে হয়।”
“আমার স্ত্রী নেই।”
“ছাত্র জীবনে পরীক্ষার সময় বহুবার স্যার ম্যাডামদের কাছে দাদী নানীকে এভাবেই মেরেছি।”
“জি না আপনি ভুল বুঝছেন। আমি অবিবাহিত।”
শিল্পী বিরক্ত আর অধৈর্য্য হয়ে চোখ ফেরাল। তখন’ই চমকে গেল। আতঙ্কে জমে উঠল সে।
.
ঝুম ঝুম শব্দ। পানিগুলো কাদিনকে ছুঁয়ে নীচের দিকে ছুটে চলেছে। কাদিনের চোখে মুখে সাবানের তুলতুলে সাদা ফেনা। বাইরে থেকে দীপা দরজায় ধাক্কা দিলো। কাদিন হাতের সাবানটা খুব যত্ন সহকারে কেইসে রাখল। যেন সাবান ব্যথা পাবে। সে না খেয়ে থাকতে পারবে, কিন্তু সাবান ছাড়া একদিনও না। তারপর ঝরনা বন্ধ করে বলল, “বলো, দীপা।”
দীপা বলল, “আমিও আসি?”
কাদিন শক্তভাবে বলল, “না।”
দীপা দুষ্টু গলায় বলল, “এত লজ্জা কিসের তোমার? তোমাকে তো আগেই শেষ করে দিয়েছি ছেলে।”
কাদিন কোনো উত্তর না দিয়ে আবার ঝরনা ছেড়ে দিলো। দীপা বলল, “পরে তোমার আফসোস হবে, মিস্টার স্বামী।”
কাদিন কঠিনস্বরে ডাকল, “বলেছি না।”
দীপার মুখটা ছোট হয়ে গেল। কাদিন প্রায়’ই এমন করে। কেন করে দীপা বুঝতে পারে না।
চলবে ইনশাআল্লাহ…
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৫১
শিল্পীর দৃষ্টি অনুসরণ করে যাকারিয়া উচ্চতায় লম্বা, নাদুসনুদুস একদম কম বয়সী একটা ছেলেকে পাশের টেবিলে বসে থাকতে দেখল। ছেলেটা অনবরত পা নাচাচ্ছে। যাকারিয়া শিল্পীকে বলল, “কি হয়েছে? কোনো সমস্যা? আপনাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন?”
শিল্পী কিছু বলার আগেই মুবিন চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে শিল্পীদের টেবিলের সামনে দাঁড়াল। যাকারিয়াকে বলল, “আমি দুটো বারবিকিউ স্যান্ডউইচ খেয়েছি। সাথে একটা মিল্ক শ্যাক। বিল পে করে দিন।”
যাকারিয়া হা হয়ে তাকিয়ে রইল, “আমি কেন তোমার বিল পে করব?”
মুবিন একগাল হেসে বলল, “মাগনা কেউ বাপ ডাকে না।”
শিল্পী ধমকে উঠে বলল, “বিহেভ ইউরসেল্ফ, মুবিন।”
মুবিন শিল্পীর দিকে তাকালোও না। সে যাকারিয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে শীতল হাসি বজায় রাখল। বলল, “কনগ্রাচুলেশন্স টু বোউথ অফ ইউ।”
মুবিন গটগট করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল। ডানে বায়ে তাকিয়ে কোন পথে যাবে ভাবল। একবার কি মিলার কাছে যাবে? মিলাকে বলবে মাও বাবার মতন? দুজনের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। মাও তাদের কথা ভাবেননি? না, না মিলার কাছে যাওয়া যাবে না। মিলা তাকে বুঝে? মিলার কাছে সে মিলার সুখশান্তিতে ভাগ বসানো দৈত্য ছাড়া বেশি কিছু তো না। রাস্তায় মানুষের মাথা গুনতে বসলে তারা গুনবার দশা হয়। অথচ, দুটো কথা রাখা যায় এমন একটা মানুষের আকাল পড়েছে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা সুপারশপ চোখে পড়ল মুবিনের। কয়েক বছর আগেও কুমিল্লায় সুপারশপ ছিল বিরল। এখন অভাব নেই। সুপার শপটিতে প্রবেশ করবার আগে মানুষজন টোকেন নিয়ে শপিংব্যাগ গার্ডের কাছে রেখে যাচ্ছে। গার্ডটি নির্দিষ্ট টোকেনের মালামাল নির্দিষ্ট লকারেই রাখছেন৷ ক্রেতারা ফিরে এলে টোকেন দেখিয়ে নিজের জিনিসপাতি বুঝে ফেরত নিচ্ছেন। বিশ্বস্ত জায়গা। মুবিনের খুব ইচ্ছা গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি কথা রাখেন? তাহলে একটা টোকেন দিন৷ আমার কিছু কথা আছে। আপনাকে বলি।”
.
ভোরে কাদিন কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে৷ ভোরের বাতাস স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী৷ দীপা উঠে দেরি করে। সকালের ঘুম তার খুব প্রিয়৷ শীতল বাতাস গায়ে মেখে কাদিন দালান ও বাড়ির গেইটের মাঝে থাকা ছোট পথটায় পকেটে হাত রেখে হাঁটছিল। কয়েকটা রঙ্গন গাছ পাশে দাঁড়িয়ে। নাম জানা কোনো পাখি চেনা ডাকে ডাকছে। পাশের বাড়িতে কোনো এক সুরেলা কণ্ঠী গানের রেওয়াজ ধরেছে। হারমোনিয়ামের সুরের সাথে কণ্ঠ দুলছে। গাইছে,
“আমার গানের মালা
আমি করবো কারে দান
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে
করুণ অভিমান ।”
কাদিনের ঠোঁটে ম্লান হাসি, মনে সূক্ষ অভিমান। তবুও গান শুনে নিজেকে ধরে রাখত পারল না সে। বাসায় গিয়ে দীপাকে ডেকে তুলল। দীপা ঘুমে ঢুলে ঢুলে বলল, “আমি ঘুমাব, আমি ঘুমাব।”
কাদিন বলল, “না, চলো বাইরে হাঁটি।”
“না।” দীপা আবার শুয়ে পড়ল। কাদিন আদুরে গলায় ডেকে বলল, “আরে চলো না৷ পাশের বাসার মেয়েটা গান গাইছে। দুজনে গান শুনব।”
পাশের বাসার মেয়ের কথা শুনে দীপা চোখ খুলল। উঠে বসে বলল, “চলো।”
ব্রাশ করে, চোখে মুখে পানি দিয়ে কাদিনের সাথে চলল সে। মেয়েটা অন্য আরেকটা গান ধরেছে,
“ছিল মন তোমারই প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে,
জন্ম জনম গেল বিরহ শোকে
বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে”
কাদিন হাঁটতে হাঁটতে দীপার হাতটা ধরল, “কী সুন্দর গায় শুনলে?”
দীপা কাদিনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “প্রতিদিন গায়?”
“হ্যাঁ, প্রতিদিন।” কাদিন তাকিয়ে আছে ডালে ঝুলে থাকা একটা রূপসী লালচে পাতার দিকে। দীপা হঠাৎ কাদিনের হাত টেনে ধরল, “ঘরে চলুন।”
“মাত্রই তো এলাম।”
“চলুন।”
“আরে কি হলো?”
“আপনি আর এখানে হাঁটবেন না। হাঁটতে হলে বাইরে যাবেন।”
কাদিন তাকিয়ে দেখল দীপার ভ্রু কুঁচকে আছে। প্রশ্ন করল, “কি হয়েছে তোমার?”
দীপা ঝাড়ি মেরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “কি হবে আমার?”
কাদিন বলল, “আমি মেয়েটাকে চিনিও না।”
দীপা বলল, “চেনার বোধহয় শখ আছে! প্রতিদিন গান শুনতে চলে আসে! রুনা লায়লার প্রতিবেশী উনি।”
কাদিন দীপার নাক টেনে বলল, “কি কিউট তুমি!”
দীপা রেগেমেগে চলে এল। কাদিন পেছনে পেছনে এসে বলল, “আচ্ছা যাও আর এখানে হাঁটব না। পার্ক থেকে ঘুরে আসব।”
দীপা সিঁড়িতেই ঘুরে কাদিনের গলা জড়িয়ে ধরল, “আর এই মেয়ের গান শুনবেন না।”
কাদিন বলল, “শুনব না।”
দীপা গলা ছেড়ে কাদিনের বাহু ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল, “আপনি অনেক ভালো।”
কাদিন হাসল, কিছু বলল না। দীপা বলল, “কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন যেন হয়ে যান।”
কাদিন এখনও চুপ।
.
শার্ট থেকে সসের দাগ ইমাদ তুলতে পেরেছে। আধভেজা ইমাদ সাদা ফকফকা ভেজা শার্টটা বারান্দায় ঝুলিয়ে এসে ঘরে বসল। তারপর প্রায় সাথে সাথে আবার উঠে বারান্দায় গেল। বারান্দায় শুকোতে দেরি হবে এবং মুবিন সুযোগে কিছু করবে ভয়ে দড়ি থেকে শার্টটা নামিয়ে রান্নাঘরে নিয়ে গেল সে। চুলার উপর ঝুলে থাকা রসিতে কাপড় শুকাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যতক্ষণ না শার্টটা শুকাল সে এক পাও নড়ল না৷ বাড়িয়ে দেয়া আগুনের আঁচে শার্ট শুকাতে বেশিক্ষণ লাগল না। শার্ট শুকিয়ে যেতেই ঘরে এনে ইস্ত্রি করল। তারপর ভাঁজ করে তুলে রাখল। এই শার্ট আর কোনোদিন পরবে না সে। যদি নষ্ট হয়ে যায়! মনে মনে সে মরেই যাবে!
শার্ট ভাঁজ করে রেখে কড়িকে একটা কল করল। ধরলে বোনাস না ধরলেও ক্ষতি নেই। কড়ির ঠান্ডা লেগেছে। গলা বসে গেছে। ধরা গলায় সে মোবাইল কানে চেপে ধরে বলল, “জরুরি কিছু হলে বলুন।”
“আচ্ছা।” ইমাদ কল কেটে দিলো। জরুরি কিছু তো নয়। কি কথা বলবে সে?
তবে কড়ি কলব্যাক করল, “ঠিক আছে। প্রথম ও শেষবারের মতন অজরুরী কথা বলে ফেলুন।”
ইমাদ নিস্তরঙ্গ গলায় বলল, “আপনার কণ্ঠ শোনার তেষ্টা পেয়েছিল।”
কড়ি কলের ওপাশে নখ খুটতে খুটতে বলল, “আপনি এর আগে কখনো প্রেম করেছেন?”
ইমাদ বলল, “জেনে কি করবেন?”
“ঠিক আছে বলতে হবে না। আপনার কি মন খারাপ?”
ইমাদ বলল, “আপনার মন খারাপ।”
কড়ি হেসে বলল, “আমি যদি আপনাকে এখন আমার মন খারাপের কারণটা বলি আপনি কি ভেবে নিবেন আমি আপনার প্রেমে পড়েছি?”
“জি ভাবব।”
কড়ি নিঃশব্দে হাসল, “মন খারাপে কারণ শুনবেন না?”
“শুনব।”
“কিন্তু আমি তো এখন আর বলব না।”
“আচ্ছা।”
“আপনি খুবই সৎ।”
“আচ্ছা।”
“আমার মন খারাপের কারণ শুনতে আপনি মিথ্যের আশ্রয় নেননি। আপনি একজন সৎ মানুষ৷ আপনার সঙ্গে আমার আগে দেখা হলে আমি সম্ভবত আপনার প্রেমেই পড়তাম।”
“আচ্ছা।”
কড়ি বলল, “রাখি?”
“আচ্ছা।”
“এই আচ্ছার অর্থ কি রাখুন নাকি ইচ্ছে হয় না?”
ইমাদ উত্তর দিলো, “রাখতে ইচ্ছে হয় না।”
“আমার ইচ্ছে আমায় ঠকিয়েছে। তাই ইচ্ছেরা এখন মূল্যহীন।” কড়ি কল কেটে দিলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ…