#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৬
নাঈম রিকশা ঠিক করে উঠে পড়েছিল। ইমাদকে হেঁটে আসতে দেখে রিকশাচালকের কাঁধে হাত রেখে হেসে বলল, “একটু দাঁড়ান।”
নাঈম রিকশা থেকে নেমে মেসের গেটে দাঁড়াল। ইমাদ আরো কাছাকাছি এলে নাঈম চোখ উজ্জ্বল করে হাসল, হাত নাড়ল। ইমাদও তাকে দেখল। তবে হাসির বিনিময়ে হাসল না, নাঈমকে দেখে হাঁটার গতিও বাড়াল না। সে যেভাবে হেঁটে আসছিল ওভাবেই এল। একদম কাছাকাছি যখন চলে এল নাঈম এগিয়ে গিয়ে ইমাদের কাঁধ চাপড়ে বলল, “কি ভাই! কেমন আছো তুমি? আমি যখন মেসে থাকি, তুমি থাকো না। আর রাতে তোমায় বিরক্ত করতে চাই না। তুমি ব্যস্ত থাকো।”
“আচ্ছা।” ইমাদের চাহনিতে প্রাণ নেই।
“আমি চলে যাচ্ছিলাম। তোমাকে আসতে দেখে দাঁড়ালাম। এই দেখো রিকশা ঠিক করা।”
ইমাদ আগেই দেখেছে। তবুও রিকশার দিকে তাকাল। বলল, “আচ্ছা। কিছু বলবে?”
নাঈম মুখ অন্ধকার করে ফেলল, “তোমার কি মনে হয়? আমি কি কোনো দরকার আছে বলে দাঁড়িয়েছিলাম? কারণ ছাড়া দেখাসাক্ষাৎ হয় না মানুষে মানুষে?”
নাঈম প্রশ্ন করে আবার সে নিজেই মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে উত্তর দিলো, “হয়, হয়। মানবসমাজে কারণ ছাড়াও দেখাসাক্ষাৎ হয়। কেউ কেউ আমার মত কারণ ছাড়াই হাসে। আবার কেউ কেউ তোমার মত হাসেই না।”
“আচ্ছা।” নাঈমের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ ইমাদের চোখ চলে গেল মেসের বারান্দায়। সেখানে মুবিন ওর শার্ট রসিতে মেলে দিচ্ছে। সাদা শার্ট নীল হয়ে গেছে। মুবিন শার্ট রেখে আবার ঘরের ভেতর গেল। চোখের পলকে ফিরেও এলো। ওর বোধহয় মনের বাসনা এখনও মেটেনি। হাতে লাল প্লাস্টিকের সসের বোতল। সে শার্টের বুকে ইচ্ছে মতো সস ঢালছে। নাঈম এইদিক দিয়ে বলছে, “কোনো সমস্যা নেই। তোমাকে হাসতে হবে না। যে মানুষের মন হাসে তাকে না হাসলেও চলে। তোমাকে দেখে অহঙ্কারী মনে হয়। আর তুমি’ই আমাকে আমার বিপদে সাহায্য করেছ। নিজের টিউশনী আমায় দিয়ে দিয়েছ। তুমি ভেবেছ আমি কখনো জানব না? টের পেয়ে গেছি আমি। খুব রাগ করেছি। এখন তোমাকে আমার রাগ ভাঙাতে হবে। অন্তত, এক মগ কফি খাও আমার সাথে। রিকশায় উঠো।”
বারান্দা থেকে চোখ নামিয়ে ইমাদ নাঈমের দিকে তাকাল, “আরেকদিন।”
ইমাদকে জোর করা অরণ্যে রোদন। নাঈম মলিন মুখেই রিকশায় উঠে চলে গেল। ইমাদকে একদিন সে বস্তায় ভরে নিয়ে গিয়ে হলেও ট্রিট দিবে।
নাঈম চলে যাওয়ার পরও ইমাদ অনেকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল। মুবিনকে যতক্ষণ না সন্তুষ্ট মনে হলো ততক্ষণ সে অপেক্ষা করল। মুবিনের ক্রোধ মেটানো সম্পূর্ণ হবার পর সে মেসে প্রবেশ করল। সাথে সাথেই বারান্দায় গেল না। নিজের অন্যান্য কাজ সাড়ল, খাওয়া দাওয়া করল। পরে গেল বারান্দায়। দড়ি থেকে শার্টটা নামিয়ে, হাতে নিয়ে নিঃশব্দে এসে নিজের ঘরে চৌকিতে বসল। খুব মন খারাপ হয়েছে তার। শার্টটার সাথে তার জীবনের বিশেষ মানুষটি জড়িত। কড়িকে প্রথম দেখেছিল পূর্ণিমা রাতে। ইমাদ গিয়েছিল তার গ্রামে। ভেবেছিল সপ্তাহব্যাপী থাকবে। থাকা হলো না। দীপুর আত্মহত্যার চেষ্টার খবর পেয়ে অবিলম্বে কুমিল্লা আসতে রওনা দিলো। বাস কুমিল্লা বিশ্বরোডে এসে ফিলিং স্টেশনে ঢুকল। দীপুর জন্য দুশ্চিন্তিত, বিধ্বস্ত ইমাদ ক্লান্ত হয়ে জানালা দিয়ে আলো, অন্ধকারের মিলমিশ দেখতে দেখতে আহত হচ্ছিল। আলোদের কাছে অন্ধকার কেন এত আকর্ষণীয়? আলোরা কেন ছুটে যায় অন্ধকারে? দীপু কেন ছুটল তাহমিদের কাছে? ইমাদের মাথা ব্যথায় ফেটে যাচ্ছিল। ও বাসের জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিলো। এদিকওদিক তাকিয়ে ঔষুধের দোকান আছে কিনা দেখতে লাগল। দেখল না। বাসের পাশ দিয়ে কে একজন যাচ্ছিল। ইমাদ ডাকল ফ্যাকাশে গলায়, “ভাই, এখানে কোনো ঔষুধের দোকান দেখেছেন?”
লোকটা ঘাড় উঁচু করে বাসের জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে রাখা ইমাদকে বলল, “জি ঐপাশে দেখেছি।”
“ধন্যবাদ।”
ইমাদ মাথা ব্যাথার ঔষুধ কিনতে বাস থেকে নামল। এক কাপ চাও খেল। চা খাওয়া শেষ করে উঠে বাসের দিকেই যাচ্ছিল। চায়ের দোকানের বেঞ্চি থেকে উঠার সময় হোঁচট খেল। পাশে বসা মেয়েটি ছেলেটিকে বলল, “ব্যাগটা ওভাবে কেন রেখেছ? চলতে ফেরতে মানুষের পায়ে ঠেকবে তো।”
ছেলেটি ব্যাগটা সাইড করে রাখতে রাখতে ইমাদকে স্যরি বলল। মেয়েটি বলল, “ওখানে রেখো না।”
ছেলেটি হেসে বলল, “কেন? গুপ্তধন নাকি?”
মেয়েটি বলল, “বেশি কথা বলো।”
“তোমার সাথে কথা বলতে আনচান করি।”
ইমাদ দূরে চলে আসায় বাকি কথা আর কানে আসেনি। বাসে উঠে বাস ছাড়ার অপেক্ষা করছিল। ফিলিং স্টেশনে গাড়ির ইয়া বড় লাইন লেগে আছে। আরো দেরি হবে। আচমকা সে দেখল সেই ছেলেটি ব্যাগ হাতে একটা সিনএনজিতে উঠল। সঙ্গে মেয়েটি নেই। ইমাদের নজর তীক্ষ্ণ হলো। ছেলেটি একাই চলে গেল। খানিক বাদে মেয়েটাকে দেখা গেল। সে প্রথমে শান্তভাবে, পরে দিশেহারা হয়ে ছেলেটাকে খুঁজল। মানুষজনকে জিজ্ঞাসাও করল। তারপর কতক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল। একটুও কাঁদল না এবং কতক্ষণের মাঝে বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক হয়ে গেল। সিএনজি ডাকল। ইমাদও সাথে সাথে বাস থেকে নেমে গেল। দীপুর মেয়েটাকে একবার হলেও দেখা দরকার। সে সিনএনজি ডেকে কড়ির সিএনজির পিছু নিলো। তারপর’ই দীপুর কাছে কড়িকে নিয়ে আসা। সেদিন ইমাদ এই শার্টটিই পরেছিল।কাকতালীয়ভাবে, যেদিন সে কড়িকে ট্রেনে প্রপোজ করল সেদিনও তার গায়ে ছিল এই শার্ট। ইমাদ চোখ বন্ধ করল। সুখকর সেই মুহূর্তর্টি সে আবার দেখছে। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। ট্রেন ধরতে দৌড়োচ্ছে। কড়ি তার দিকে হাত বাড়াল, কিন্তু সে ধরল না। শেষে, কড়ি’ই তার শার্টের হাতা খামচে ধরে তাকে ট্রেনে তুলল। এই শার্টটার হাতা’ই খামচে ধরেছিল!
চলবে ইনশাআল্লাহ্….
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৭
দীপা গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আয়নার সামনে কাদিন। দীপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “কিগো, তোমার হলো?” ওর কণ্ঠে ক্লান্তি। আর কতক্ষণ?
কাদিন বলল, “দু’মিনিট।”
“আর কতক্ষণ ধরে দু’মিনিট দু’মিনিট করবে তুমি?”
কাদিন কিছু বলল না। সে নিজেকে তৈরী করতে ব্যস্ত। রিমা বাইরে থেকে দরজায় কড়া নেড়ে ঠাট্টায় মাতল, “দীপা, দ্রুত তৈরী হও। কাদিন বেচারাকে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করাবে? বেশিরভাগ দাম্পত্যকলহ স্ত্রীর সাজগোছ নিয়েই কিন্তু হয়। এত সময় নিয়ে সাজা স্বামীরা পছন্দ করে না, বোন।”
দীপা ঘন ঘন চোখ পিটপিট করে আয়নার ভেতর দিয়ে কাদিনকে দেখতে দেখতে বলল, “স্যরি, কাদিন। রাগ করো না। এই তো আমার হয়ে যাবে। আর দু’মিনিট।”
রিমা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়াল, “জানো, দীপা কড়ি বলছিল বাবাকে বলে কান্দিরপাড় একটা দোকান নিতে। দোকানের নাম কাদিন কসমেটিক্স। দোকান নাকি সেই চলবে?”
দীপা বলল, “কড়ি যেহেতু বলেছে নিশ্চয়ই চলবে। আমরা অবশ্যই নিব।”
রিমা বলল, “আচ্ছা আমি গিয়ে বাবার সঙ্গে আলাপটা পাড়ি।”
হাসতে হাসতে চলে গেল রিমা। দীপার মোবাইলটাও বেজে উঠল। ইমাদের কল। দীপা হাসিমুখে লাফিয়ে উঠে ফোন ধরল, “হে ইমাদ বল।”
ইমাদ জানতে চাইল, “সাদা শার্ট থেকে সসের দাগ কীভাবে তুলতে হয় জানিস?”
দীপা বলল, “ডিটার্জেন্ট দিয়ে ধুয়ে ফেল, উঠে যাবে।”
“হচ্ছে না।”
” হচ্ছে না? তাহলে আর কীভাবে? ব্লিচিং পাউডার? ব্লিচিং পাউডার দিয়ে দেখ।”
কাদিন প্রশ্ন করল, “কি পরিষ্কার করতে চাচ্ছে ও?”
দীপা ফোন কানে চেপেই বলল, “সসের দাগ।”
কাদিন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “ডিটারজেন্ট, ঠাণ্ডা পানি, স্পঞ্জ আর সাদা ভিনেগার নিতে বলো। প্রথমে সসের দাগ লাগা জায়গাটায় ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ভিজিয়ে ডিটারজেন্ট দিবে। তারপর দশ/পনেরো মিনিট রেখে দিতে হবে। এরপর সাদা ভিনেগারে স্পঞ্জ ভিজিয়ে সেই স্পঞ্জটা দিয়ে দাগটা আবার ঘষবে। ঘষবার পর সাধারণ নিয়মে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে নিবে। দ্যাটস এনাফ।”
দীপা কাদিনের বলা প্রক্রিয়াটা ইমাদকে বুঝিয়ে বলল। ইমাদ বলল, “আচ্ছা।”
ফোন রেখে দিলো সে। দীপা কাছে এসে পেছন থেকে কাদিনকে জড়িয়ে ধরল। কাদিনের পিঠে মাথা রেখে বলল,
“রূপ লাগি আঁখি ঝুরে, গুণে মন ভোর,
প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে, প্রতি অঙ্গ মোর।
হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে,
পরাণ পিরিতি মোর থির নাহি বান্ধে।।”
কাদিন স্মিত হাসল, “কোথায় শুনেছ?”
দীপা বলল, “শুনিনি, পড়েছি।”
কাদিন অবাক, “তুমি বৈষ্ণব পদাবলী পড়েছ?”
দীপা বলল, “বৈষ্ণব পদাবলী পড়তে যাব কেন? ইমাদের ডায়েরীতে পড়েছি।”
কাদিন হাতের আঙুলে আংটি পরতে পরতে বলল, “অনুমতি ছাড়া পড়োনিতো?”
দীপা মনে মনে জিহ্ব কাটল। সে অনুমতি ছাড়া পড়েছে। কিন্তু কাদিনকে তা বলা যায় না। মুখে বলল, “না, না। অনুমতি ছাড়া পড়তে যাব কেন? তাছাড়া, ওর ডায়েরীতে তেমন কিছু নেইও। ইমির ডায়েরী ইমির মত’ই রোবট রোবট।”
প্রথমটুকু মিথ্যে হলেও শেষ কথাটা সত্য। ইমাদের ডায়েরীতে এরকম ছড়ানো ছিটানো কিছু সংগৃহীত লাইন ছাড়া কিছুই নেই। কাদিন হাতঘড়ি পরে বলল, “রোবট রোবট না। অনুভূতি আছে বলেই লাইনগুলো টুকে রেখেছে। প্রেমিকার জন্য টুকেছে।”
দীপা শব্দ করে হেসে ফেলল, “কি বললে তুমি? কি বললে? ধুর ইমির আবার প্রেম, প্রেমিকা!!! আমি হাসি থামাতেই পারছি না।”
“এটা পড়ার পরও এ কথা বলছ?”
“এমন লাইন টুকে রাখলেই নাকি মানুষ প্রেমিক হয়ে যায়। ইমি হবে প্রেমিক?” দীপা বিরতিহীন হাসছে। হাসতে হাসতে কাদিনের পিঠে ঢলে পড়ছে। কাদিন ধীরে সুস্থে গায়ে পারফিউম মেখে ঘুরে দাঁড়াল। দীপার কপাল থেকে চুল সরিয়ে গালে আঙুল বুলাল। চোখে চোখ ডুবিয়ে বলল, “মাই ইনোসেন্ট লাভ।”
দীপা তখনও হাসছে। হাসি নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন।
চলবে ইনশাআল্লাহ….
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৪৮
নরম হাওয়ার রোদেলা সকাল। শিল্পী দ্রুত রিকশা খুঁজছে। সে ঘড়ি দেখল। মিলার স্কুলের এবং তার ব্যাংকের সময় হয়ে যাবার আগেই তাকে মিলার হোস্টেলে গিয়ে পৌঁছুতে হবে। শিল্পী হাঁটা ধরল। রিকশা পাওয়া মুশকিল।
মিলা ভোরে উঠেই পড়তে বসে। রসায়নের বিক্রিয়া লিখে লিখে পড়ছিল সে। শিল্পীকে দেখে বই রেখে উঠল। লেবুর শরবত বানাল। শিল্পী বলল, “কিছু করতে হবে না। পড়ছিলি পড়।”
মিলা শিল্পীর হাতে গ্লাস দিয়ে বলল, “ঠাণ্ডা পানি নেই।”
শিল্পী গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “এখানে থাকতে হবে না তোকে। আমার সাথে থাকবি।”
মিলা বলল, “আমি এখানেই ভালো আছি।”
শিল্পী বলল, “আমি একা ভালো নেই। তুই আমার সাথে থাকলে আমি হয়তো ভালো থাকব।”
মিলা বলল, “স্যরি, মা। বারবার জায়গাবদল করলে আমার পড়ার ক্ষতি হয়। আমি যাব না।”
“তুই যাবি। তুই আমার উপর রাগ করে আছিস। তাই এমন করছিস।”
মিলা একবার ভাবল বলবে, “রাগ করাটাই কি স্বাভাবিক না?”
কিন্তু বলল না। মাকে কষ্ট দিতে ওর কষ্ট হয়। বলল, “রাগ করে নেই, মা। পড়াশুনার কথা ভেবেই বলছি। আমার এসএসসির পর আমি তোমার কাছে চলে আসব।”
শিল্পী হাতের গ্লাসটা রেখে চড় মারবার ভঙ্গি করে বলল, “একটা চড় মারব। বাপের মত ধুরন্ধর হয়েছিস সবকটা। এসএসসির পর যে তুই ঢাকায় যাবি বলে ঠিক করে রেখেছিস, সেটা কি আমি জানি না? কলা দিয়ে ছেলে ভোলানো হচ্ছে? সবগুলা স্বার্থপর।”
মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মুবিনকে নিয়ে যাও, মা।”
শিল্পী বলল, “কথা যে শোনে তাকেই বলেই কাজ হলো না। অবুঝটা কি বুঝবে?”
“আমাকে জোর করো না, মা। আমি একা’ই থাকব। পারলে তোমার ছেলেকে জোর করো।”
শিল্পী ওড়নায় চোখ মুছে বলল, “মায়ের কষ্ট বুঝলি না।”
মিলা ঘাড় কাত করে বলল, “আরেক গ্লাস শরবত করে দিই?”
শিল্পী বলল, “কর, করে তোর বাপ আর তোর বাপের প্রেমিকাকে দিস। মা ভালো না। মা খারাপ। সৎ মা অনেক আদর দিবে।”
“বসো, মা। যেও না।”
“তাহলে আমার সঙ্গে চল।”
“স্যরি মা।”
শিল্পী কষ্ট নিয়েই ফিরে গেল। মিলা হোস্টেলের জানালা ধরে দাঁড়াল। মাকে যতক্ষণ দেখা যাবে ততক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকবে।
শিল্পীর আশেপাশে অনেক খালি রিকশা টুংটাং শব্দ করে যাচ্ছে। কোনো কোনো রিকশাচালক নিজ থেকেই বলছেন, “আফা, কই যাইবেন?”
শিল্পী কোনো উত্তর দিচ্ছে না।
.
কড়ির সঙ্গে যে ছেলেটি দেখা করতে এসেছে তার নাম মৃন্ময়। মৃন্ময় ধানমন্ডি লেকের কাছে কড়ির অপেক্ষা করছিল। কড়িকে দেখে বলল, “তুমি বড় হয়ে গেছ।”
উত্তরে কড়ি বলল, “আসসালামু আলাইকুম।”
মৃন্ময় বলল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। চলো কোথাও বসা যাক।”
কড়ি বলল, “না বসব না। আমার একটু তাড়া আছে। আসলে ক্লাস আছে। ক্লাসটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি মিস করতে চাই না।”
“ওহো, স্যরি। আচ্ছা, তোমার নাম্বারটা দাও। তোমার নাম্বার না থাকায় কাদিনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসতে হয়েছে।”
কড়ি নাম্বার বলল। মৃন্ময় নাম্বার সেভ করে বলল, “ঠিক আছে ভালো থেকো। তুমি যখন ফ্রি থাকবে দেখা করব।”
কড়ি তড়িঘড়ি করে চলে এল। তার কপালে চিন্তার রেখা। মেজো ভাইয়ার পছন্দের পাত্র হলে তো গজব। ইমাদকে দেয়া সময় পর্যন্ত বিয়ে আটকাবার জন্য কোনো ছুঁতো খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।
.
ক্লান্ত, অবসন্ন শিল্পী নিজের চেয়ারে বসল। হেঁটে আসায় ব্যাংকে আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে। পাশ থেকে জুয়েল সাহেব বললেন, “আজ এত দেরি কেন, শিল্পী?”
শিল্পী যন্ত্রের মত বলল, “কাজ ছিল।”
“কি কাজ?”
শিল্পী বিরক্ত হয়ে বলল, “অফিসিয়াল কোনো কাজ না।”
“আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”
শিল্পী চুপ করে রইল। এই লোকটাকে আজকাল অসহ্য লাগে তার। জুয়েল সাহেব নিজেই আবার বললেন, “কি হয়েছে, বলুন তো? আপনি সাধারণত দেরি করে আসেন না।”
শিল্পী কম্পিউটার চালু করতে করতে বলল, “জুয়েল সাহেব, আমি ব্রাঞ্চটা চেঞ্জ করতে চাচ্ছি না। আমার অসুবিধা হয়ে যাবে। আপনি এরকম করতে থাকলে আমি বদলি হয়ে যেতে বাধ্য হব।”
জুয়েল সাহেব আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। শিল্পী সে সুযোগ দিলো না।
.
মুবিন সুহার শেষ প্র্যাক্টিকেল খাতাটা ফেরত দিয়ে চলে যাচ্ছিল। সুহা ডেকে বলল, “অ্যাই মুবিন শুনো।”
মুবিন চলে যেতে যেতে ঘুরে তাকাল। সুহা ভ্রুকুটি করে বলল, “ধন্যবাদ দিলে না যে?”
মুবিন স্থির গলায় বলল, “অনেক সময় নষ্ট করেছ আমার। আমাকে সবগুলো খাতা একেবারে দিলে সুবিধা হতো। একটা একটা করে দেয়ায় খাতা নিতে প্রতিদিন স্কুলে আসতে হয়েছে। নাহয় ঐ সময়টায় বাসায় বসে প্র্যাক্টিকেলগুলো করলে আরো তাড়াতাড়ি শেষ হতো।”
“কি বলছ তুমি?”
মুবিন প্রশ্ন করল, “বয়রা নাকি?”
সুহার মুখ শক্ত হয়ে গেল, “তুমি আমাকে এখনি ধন্যবাদ বলবে। এখনি।”
মুবিন বলল, “বলব না।”
সুহার মুখ লাল হয়ে গেল, “বলবে না?”
মুবিন ঘাড় শক্ত করে বলল, “বলব না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করোনি।”
মুবিন অবশ্য ঠিকই বলেছে। সুহা তাকে বিশ্বাস করেনি। সন্দেহ ছিল খাতা নিয়ে ফেরত দিবে কিনা। তাই সব খাতা বোকার মত একেবারে দিয়ে দেয়নি। একটা একটা করে দিয়েছে। গেলেও একটা যাবে। অথচ, মুবিন সুহার প্রতিটা খাতাই খুব যত্ন সহকারে ফেরত দিয়েছে। সুহা খাতা খুলে দেখেছেও। একটুও নষ্ট হয়নি।
ঘণ্টা বেজে উঠল। ঢং ঢং ঢং। অ্যাসেম্বলির সময় হয়ে গেছে। মুবিনকে কড়া কথা বলবার অবকাশ না পেয়ে সুহার সারা অঙ্গ জ্বলে গেল।
চলবে ইনশাআল্লাহ….