#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৮
নিলয় আর ইমাদ রাস্তার পাশের টঙ দোকানে মুখোমুখি দুটো বেঞ্চে বসে আছে। ইমাদের হাতে চায়ের গ্লাস, নিলয়ের ঠোঁটে সিগারেট। সে সিগারেটে টান দিয়ে বলল, “এই মেয়েকে ভুলে যা, ইমাদ।”
ইমাদ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “আচ্ছা।”
নিলয় হাতের সিগারেট ছুঁড়ে ফেলল। উঠে এসে ইমাদের বেঞ্চিতে বসে ইমাদের কাঁধ জড়িয়ে ধরল, “সত্যি সত্যি আচ্ছা বল।”
ইমাদ নিশ্চুপ। নিলয় হতাশামিশ্রিত গলায় বলল, “তুইও দীপুর মতই করছিস। আমরা দুজনে মিলে তখন দীপুটাকে না করেছিলাম। ও তো অবুঝ, বুঝেনি। কিন্তু তুই তো এমন না।”
ইমাদ এবারেও চুপ। মুখে কোনো রা নেই। সে তাকিয়ে আছে টঙ দোকানের লাইটের দিকে। যেখানে কয়েকটা পোকা দল বেঁধে আছে। নিলয় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, “বুঝলাম প্রেমে পড়লে সবাই এমন। একই!”
ইমাদ তখনও কথা না বলায় নিলয় বলল, “তোর পেট ফেটে যায় না কেন? আর কিছু লুকাচ্ছিস না তো? এমন চুপ করে কেন?”
“না লোকাচ্ছি না।”
“বিশ্বাস নেই তোর। কতকিছু যে লুকাস তুই! আমি যদি সেদিন তোকে কড়ির জানালার সামনে না দেখতাম আর আজ ডিএসপিতে একসাথে তাহলে তো কিছুই জানা হতো না আমার! সেদিন অবশ্য জানালার সামনে দেখেও ঠাহর করতে পারিনি।”
“আচ্ছা।”
নিলয় ইমাদের দিকে তাকিয়ে ওর হাবভাব বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুই বুঝল না। তবুও আন্দাজে বলল, “তুই বুঝতে পারছিস না মেয়েটা খুবই অদ্ভুত? লোভীও।”
ইমাদ এবার মুখ খুলল, “লোভী না।”
নিলয় বলল, “গেছে তোর মাথাটাও গেছে।”
ইমাদ বলল, “আমাকে বাজাতে চাইছে। পরীক্ষা।”
নিলয় কিছু একটা বলতে নিচ্ছিল তার আগেই ইমাদ উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করতে করতে বলল, “তোর কথাটা শুনে আরেকটা জিনিস মনে হলো।”
নিলয় বলল, “কী?”
ইমাদ দোকানদারকে টাকা মিটিয়ে বলল, “তুই যা ভাবছিস বা সবাই শুনে যা ভাববে তা সে আমাকেও ভাবাতে চাইছে। দূর করবার ফন্দিও হতে পারে।”
নিলয় বলল, “তা এখন কী করবি? যদি মেনেও নিই সে লোভী না তবুও তোর কী করার আছে?”
“যা চায় তাই দিব।”
“এত টাকা কোথায় পাবি? কেমনে সম্ভব?”
“জানি না।”
নিলয় খুবই হতাশ। দীপুর সুখ আসতে না আসতেই ইমির ঝামেলা শুরু। ওর মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
.
কড়ি লাগেজ টেনে ঘর থেকে বেরুলো। কাইয়ূম লাগেজটা ধরে বলল, “রিকশা বাইরে দাঁড়ানো। তুই আয়, আমি যাচ্ছি।”
কড়ি বলল, “তোমার যেতে হবে না।”
“আমার যেতে হবে নাকি হবে না সেটা আমি জানি।”
“একা ঢাকা যেতে পারব আর বাস স্টপ পর্যন্ত যেতে পারব না? তুমি অফিসে যাও, অফিসের দেরি হবে।”
রিমা বলল, “তোর বড় ভাইয়া শুধু বাসে উঠাতে যাচ্ছে না, ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছে।”
কড়ি হেসে বলল, “হে পারলে কোলে করে নিয়ে যেতে বলো এত বড় মেয়েকে।”
কাদের সাহেব বললেন, “ব্রেক নিয়েছ আশা করি এই সেমিস্টারে মন দিয়ে পড়াশুনা করবে।”
“ইনশাআল্লাহ, বাবা।”
দীপার মুখটা খুবই মলিন। ও পারলে কেঁদে দিতো। কাদিনের জন্য কাঁদতে পারছে না। কাঁদলে আবার কী না কী বলে! কড়িকে বলল, “তোমাকে অনেক মিস করব।”
কড়ি হেসে দীপাকে জড়িয়ে ধরতে গেল। দীপা বলল, ” না, না ধরো না। ধরলেই কেঁদে দিব।”
সবাই হাসল একমাত্র কাদিন ছাড়া। কায়েস বলল, “কেঁদো না মেজভাবি, আমি আছি না তোমার জন্য? শুধু তোমার জন্য…..” শেষের দিকে সুর করে বলল।
দীপা এবার নিজেও হেসে ফেলল। কাদিন বলল, “দেরি হয়ে যাচ্ছে, কড়ি।”
কড়ি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এল। বাসে বসতেই কড়ির মোবাইল টুং করে উঠল। কড়ি পার্স থেকে মোবাইল খুলল। রিমার মেসেজ। মেসেজে লিখা, “তোর বড় ভাইয়া কাল রাতে আমাকে বলছিল হয়তো এটাই বোনের সাথে আমার শেষ এমন যাত্রা। পরে তো ও সবসময় ওর বরের সাথেই আসা যাওয়া করবে। বা আমার সাথে কোথাও গেলেও কতকিছুই বদলে যাবে। পাশের সিটটা তখন ওর বরের হয়ে যাবে। ওর কিছু খেতে ইচ্ছে করলে আমাকে কখনই বলবে না। বরকে বলবে কিনে দাও। ওর ব্যাগ টানবে সেই লাকিম্যান। তাই আমি কাল ওর সাথে ঢাকা যাব। কবে বোনটার বিয়ে হয়ে যায় ঠিক নেই।”
মেসেজটা পড়ে কড়ি হাসবে না কাঁদবে তা নিয়ে দোটানায় পড়ে গেল। রিমাকে রিপ্লাই লিখল, “তুমি আমার কাছে একটা ট্রিট পাওনা রইলে, আপু। থেঙ্ক ইউ।”
তারপর সাথে সাথে পাশের সিটে বসা কাইয়ূমের হাত ধরে বলল, “বড় ভাইয়া, আমার না আচার খেতে ইচ্ছে করছে। এনে দাও।”
কাইয়ূম বলল, “কিসের?”
“প্রাণের আমের আচারটা আনবে। অনেকগুলো।”
কাইয়ূম বলল, “উফ আগে বলবি না? এখন বাস ছাড়বার সময় হয়েছে। এখন এলি বিরক্ত করতে।”
বলতে বলতে কাইয়ূম বাস থেকে নামল। কড়ি হাসল। তার একেক ভাই তাকে একেকরকম আদর করে। কাইয়ূমের আদর মা মা আদর। মায়ের মত সবসময় মায়া আর মায়া। যেন মা যে নেই সেটা সে কোনোভাবেই কড়িকে বুঝতে দিতে নারাজ।আর কাদিন ঠিক বাবার মতন। আসার সময় হাতে কতগুলো টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, “সাবধানে।”
কিন্তু কখনোই জড়িয়ে ধরবে না, আবার কখনো ধমকও দিবে না। কিন্তু কড়িকে সবকিছুই অঢেল দিতে পারলেই সে শান্তি পায়। আর কায়েসের আদর পৃথিবীর সেরা ভাইদের আদরের মতন। জড়াজড়ি, ধমকাধমকি, শাসন, মজা, আদর, স্নেহর ফুলপ্যাকেজ। কড়ি মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ্ বলল। এবং সে যা করেছে তা যে ঠিকই করেছে তা নিশ্চিত হলো। এই বাবা – ভাইদের ইচ্ছা আর সাধের চাইতে অধিক মূল্যবান কিছু নেই। ইমাদের কাছে গয়নার চ্যালেঞ্জ ছু্ঁড়ে দেয়া দারুণ একটি কাজ হয়েছে। ইমাদ এখন নিশ্চয়ই তাকে লোভী ভাববে এবং তার প্রতি থাকা অনুভূতিগুলোও মলিন হয়ে যাবে। এইরকম লেইম কথাবার্তা বলা মেয়েদের প্রতি ভালোবাসা ধরে রাখা অসম্ভব। আর যদি কোনোভাবে ইমাদ বিষয়টা ধরতে পারে তাতেও সমস্যা নেই। ইমাদের পক্ষে কতটুকু কী করা সম্ভব, ওর পরিবারের আর্থিক অবস্থা কেমন সব সম্পর্কেই কড়ি দীপার কাছ থেকে ইনিবিনিয়ে সব জেনে নিয়েছে। দীপা ত সহজসরল টেরও পায়নি। সব শুনে কড়ির মনে হয়েছে ইমাদ কখনই এত গয়না যোগাড় করতে পারবে না। আর ইমাদ যেধরনের মানুষ গয়না দিতে না পারলে জীবনে কড়িকে আর মুখও দেখাবে না। সহজ সমাধান। কড়ি নিজের আঙুলে থাকা রামিমের মায়ের দেয়া আঙটি ঘুরাতে ঘুরাতে হাসল। বিড়বিড় করল, “থেঙ্কস আন্টি। আপনার দোয়া আর দাওয়া দুটোই কাজে লাগল! মায়েদের দোয়ার অনেক ক্ষমতা!”
.
দীপার সারাদিন অসম্ভব মলিন হয়ে রইল। একে তো কাদিন ওর সাথে এমন করে, তারপর আবার কড়িও চলে গেল। মায়ের জন্যও মন পুড়ছে। কিন্তু জিদ দেখিয়ে কাদিনকে বলেছে সে না গেলে ও যাবে না। সবদিক মিলিয়ে মন খুবই থমথমে। দুপুরে ভালো মত খেলোও না। কিছু ভালো লাগে না তার। তাই ছাদে এসে বিকেলের নরম রোদে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। এরপর হঠাৎ মনে হলো কেউ বোধহয় তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দীপা মনে মনে বলল, “হুম জীবনে এখন ভূতপেত্নী আসাটাই বাকি আছে।”
ভাবতে ভাবতে ফিরে তাকিয়েই দেখল ভূত নয়, কাদিন। সে বলল, “ওহ আপনি। আজ এত তাড়াতাড়ি?”
দীপা আবার সামনে তাকাল। কাদিন পেছনে দাঁড়িয়েই বলল, “যাওনি কেন?”
“এমনভাবে বলছেন যেন মনে হচ্ছে আপনি জানেন না!” দীপা ঠেশ দিয়ে বলল।
কাদিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “যাও ঘুরে এসো।”
“আমি জাহান্নামে যেতে রাজি কিন্তু বাপের বাড়ি আর কোনোদিন যাব না। কেউ মরলেও যাব না।” অভিমানে দীপার কণ্ঠ ভেজা ভেজা।
খানিক পরে নিজেই আরো যোগ করল, “হাসপাতালে দেখে নিব।”
কাদিন কথা না বাড়িয়ে নীচে নেমে গেল। দীপা ছাদে বসতে গিয়েও বসল না। ছাদে এভাবে বসলে কাদিন ওকে আবার গোসল করাবে নিশ্চিত। দরকার নেই। পাগলের সাথে বিয়ে হয়েছে তার। আর দাঁড়িয়েও থাকা যাচ্ছে না। পা ব্যাথা করছে তাই সেও নীচে নেমে গেল। ড্রয়িংরুম পাড় করে তারপর ভেতরে ঢুকতে হয়। দীপা সেদিক দিয়েই আসছিল, কাদিন ওর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “কালকে নিয়ে যাব।”
দীপা আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল। অতিআনন্দে কাদিনের শার্ট খামচে ধরে আচমকা তার গালে চুমু খেয়ে ফেলল। কাদিন বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে এদিকওদিক তাকিয়ে বলল, “দীপা! এসব কী?”
চুমুটা সে ইচ্ছে করেই খেয়েছে। সুযোগ খুঁজছিল এমন কিছু একটার। নিজের ভুল শুধরাতে আর কাদিনের রাগটা যেন কেটে যায়, তাই আরকি। কিন্তু, কাদিন খুশি হওয়ার বদলে ক্ষেপে যাবে সেটা দীপা ভাবেনি। রাগে, লজ্জায় মেঝের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বলল, “স্যরি, ভুলে দিয়ে ফেলেছি।”
কাদিন দীপাকে ধাক্কা দিয়ে সরে গেল। দীপা ধাক্কা খেয়ে পাশে থাকা সোফায় বসে পড়ল। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল কাদিনের চলে যাওয়ার দিকে। কাদিনও হতভম্ব! কী বলে এই মেয়ে? সে ভুলে চুমু খেয়েছে? কাদিন প্রথমে বিরক্ত হয়েছিল এই ভেবে যে, যে কেউ দেখে ফেলতে পারতো! এটা ড্রয়িংরুম। কিন্তু ভুলে কথাটা শুনে কাদিনের মেজাজটা চড়ে গেল।
চলবে…
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৯
গাড়িটা ছুটে যাচ্ছে চিটাগাং রোডে। বাইরে ভোর হচ্ছে। মঈন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। চট্টগ্রাম ওর আসতে ইচ্ছে করে না। গাড়িটা রাস্তা দিয়ে নয় ওর বুকের উপর চলছে। কী অসহ্য যন্ত্রণা। শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে না। পাশে তাকাল সে। শিল্পী শক্ত হয়ে বসে আছে। কোনো নড়াচড়া নেই। ঘাড়টা অস্বাভাবিক রকমের নুয়ে আছে। মঈন ভ্রু কুঁচকে ফেলল। শিল্পীর কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকুনী দিয়ে বলল, “অ্যাই?”
শিল্পী বিদ্যুতের মত ঘাড় তুলে ওর হাত সরিয়ে দিলো। বলল, “দূরে থাকো।”
মঈন একটু সময় তাকিয়ে রইল। এরপর আবার জানালা দিয়ে বাইরের তাকাল। গাড়ির কাঁচ নামাল। বাতাস হেলেদুলে ওর চোখে মুখে পড়ছে। পুলিশ ধারণা করছে ওরা মুবিনকে পেয়েছে। ছেলেটা মুবিন কিনা নিশ্চিত করতেই ওরা দুজন ছুটেছে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। ছেলেটা কী তার উপর রাগ করে চলে গেল? নাকি চলে গেছে লজ্জায়? জন্মদিনে নতুন মা পেয়ে ওর বোধহয় আর বাড়িতে মন টেকেনি। কী লজ্জা! কী লজ্জা! নিজের মায়ের কীর্তি শুনলে এই ছেলে কী করে বসবে আল্লাহই ভালো জানে। ও বোধহয় বিশ্বাসই করতে পারবে না যে ওর মা এমন জঘন্য কাজ করতে পারে। সে নিজে কী বিশ্বাস করতে পেরেছিল? আহ শিল্পী কেন এমন করলে তুমি? তুমি ত এমন হওয়ার কথা ছিলে না। মঈন সিটে হেলান দিলো। চোখ বন্ধ করল। চোখ জ্বলছে। তারচেয়ে চোখ খোলাই থাকুক। আবার চোখ মেলল সে। ছুটে যাওয়া রাস্তার মত করে স্মৃতিগুলোও এদিকওদিক চোখের সামনে ছুটছে। সময়টা বেশ কয়েক বছর আগের। রাঙামাটির পেদা টিং টিং রেস্টুরেন্টে হঠাৎ জোহরার সাথে ওদের দেখা। পেদা টিং টিং যে একটা রেস্টুরেন্টের নাম এটা প্রথমে মঈনরা জানতো না। ভেবেছিল এমনি শুধু ঘুরবার জায়গা। পরে শুধু ঘুরবার জন্য গিয়েই দেখতে পেল একি এখানে ত ভোজনরসিকদের আড্ডা। ব্যস ওরা বসে গেল ব্যাম্বো চিকেন নামক অমৃত খেতে। খাওয়া দাওয়া শেষে ওরা পেছন দিকের সবুজের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল। বাচ্চারা খেলছিল। শিল্পী আর মঈন বসেছিল তৈরী করা বসার জায়গায়। ক্লান্ত শিল্পী মঈনের বুকে মাথা এলিয়ে আঁচলে বাতাস করছিল। এটা সেটা নিয়ে কথা বলছিল, গল্প করছিল দুজন। ঠিক তখন ছায়াটা ওদের সামনে পড়ল। কার ছায়া ঘুরে দেখতেই অবাক হয়েছিল তিনজোড়া চোখ। মুখোমুখি জোহরা, মঈন আর শিল্পী। কয়েকটা মুহূর্ত গেল তারপর জোহরা বলল, “আপু না?”
শিল্পী উঠে দাঁড়াল। দুজন ঝাঁপিয়ে পড়ল দুজনের উপর। মঈন স্মিত হাসল। তারপর জোহরা আর শিল্পীর কত কথা। কেমন যাচ্ছে দিনকাল, কার কয় বাচ্চা, কে কোথায় আছে এসব। মুবিনরা কী একটা দেখে অবাক হয়ে মাকে ডাকছিল। মাকে দেখিয়ে জানতে চাইবে এটা কি? শিল্পী ভাবল কী না কী তাড়াতাড়ি করে ছুটে গেল। মঈন বসে রইল চুপচাপ। জোহরাও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। এক সময় জোহরা বলল, “মঈন ভাই, আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখে অনেক ভালো লাগছে আমার। কেমন একটা প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে।”
মঈন বলল, “শিল্পী খুব ভালো মেয়ে। আমি সুখী।”
জোহরা বলল, “হ্যাঁ, আপু খুব ভালো। ভালো বলেই তো বুকে পাথর চেপে চিঠিটা আমার কাছে নিয়ে ছুটে এসেছিল।”
মঈন তাকাল জোহরার দিকে, “বুকে পাথর চেপে মানে?”
জোহরা অবাক হলো, “আপনি কী কিছুই জানেন না, মঈন ভাই?”
মঈন উঠে দাঁড়াল, “কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না।”
“আপু আপনাকে ভালোবাসত, প্রথম থেকেই। এখনও জানেন না?”
“মানে?”
জোহরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “মানে আপু আপনাকে এখনও কিছুই বলেনি। প্রথম থেকেই আপনাকে ভালোবাসত আমি জানতাম। আর আমি ভাবতাম আপনিও তাই। এজন্য কখনো নিজের ভালো লাগার কথা বলে আপনাদের মাঝে আসবার কথা চিন্তা করিনি। বাবা বিয়ে ঠিক করায় নাও করিনি। পরে আপনি যখন আমাকে চিঠি দিলেন আপু খুব কষ্ট পেল। তবুও আমার কাছে চিঠি নিয়ে এসেছিল। হেরে যাওয়া মানুষের মত বলেছিল, “জোহরা, একটা ভুল হয়ে গেছে। মঈন আমাকে নয় তোকে ভালোবাসে। বিয়েটা ভেঙে দে। ও তোর জন্য পাগল।”
জোহরা হাসবার চেষ্টা করে আরো বলল, “কিন্তু আমার আকদ হয়ে গিয়েছিল। তাই আপুকে বলেছিলাম, তোমার ভালোবাসার শক্তি আমাদের ভালোবাসার শক্তির চাইতে অনেক বেশি। আমরা এক হতে পারব না, কিন্তু তোমরা হলে আমি খুব খুশি হবো।”
মঈন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছিল। জোহরার ডাক পড়ায় ও চলে গেল। শিল্পী এসে জোহরাকে না পেয়ে বলল, “কী ব্যাপার ও চলে গেল নাকি?”
মঈন কোনো কথা না বলে আচমকা শিল্পীকে জড়িয়ে ধরল।
নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছিল তার। একটা মানুষ তাকে এতটা ভালোবাসে তবুও বছরের পর বছর পাশে থেকেও প্রকাশটুকু পর্যন্ত করেনি। সন্ধ্যা নেমে আসছিল। জোহরা একটু পরেই আবার ফিরে এল। ওদের ডেকে বলল, “আজ আমার আর আমার হাজবেন্ডের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। এখানে কাটবে বলে ও কেক নিয়ে এসেছে। তোমরাও এসো না?”
কেক নিয়ে জোহরার স্বামী অপেক্ষা করছিল। হাতে হাত রেখে দুজন কেক কাটার সাথে সাথে করতালিমুখর হয়ে উঠে আশপাশ। জোহরা সবাইকে কেক দিচ্ছিল। মঈন কেক খাচ্ছিল। আচমকা পাশ থেকে কে একজন তার পাশের মানুষটাকে ভারি গলায় জিজ্ঞেস করল, “আজ কত তারিখ?”
পাশেরজন বলল, “৯ জুলাই।”
মঈন চমকে উঠলে, “৯জুলাই?”
জোহরার বিয়ে ৯ জুলাইয়ে হয়েছে? আর ও চিঠি দিয়েছিল ৬ জুলাই। মঈন জোহরাকে ডেকে বলল, “একটু কথা ছিল।”
“জি।”
“তোমার বিয়ে ৯ জুলাই হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“শিল্পী কত তারিখ তোমার ওখানে যায়?”
“আমার বিয়ের পরদিন। ১০ জুলাই।”
মঈন দীর্ঘশ্বাসে হাসল, “আমি ৬ জুলাই চিঠি দিয়েছিলাম। ভাগ্য আসলেই আমাদের চায়নি।”
জোহরা এবার অবাক হলো, “৬ তারিখ দিয়েছিলেন, চিঠি? আপনার ঠিক ঠিক মনে আছে?”
“হ্যাঁ অবশ্যই মনে আছে। কিছু কিছু দিন মানুষ আজীবন চেষ্টা করেও ভুলতে পারে না। ভুল করেও না।”
জোহরা মৃদু হাসল, “অথচ, ৭ তারিখ তো আমি আবার ক্যাম্পাসে আসি। আমার কী একটা কাজ ছিল ভার্সিটিতে খুব জরুরি। বাধ্য হয়ে যেতে হয়েছিল। তখন আমি আমার বিয়ের কার্ডও আপুকে দিয়ে এসেছিলাম। সেদিনও যদি আমাদের দেখা হতো কিংবা আমি আপনাকেও আমার বিয়ের কার্ড দিতাম! যাইহোক সৃষ্টিকর্তার এটাই ইচ্ছা ছিল।”
মঈন খানিক চমকে বলল, “কি বললে?”
জোহরা তাকাল, কিছু বুঝল না। মঈন প্রশ্ন করল, “তুমি ৭ তারিখ এসেছিলে?”
“হ্যাঁ।”
মঈন স্তব্ধ হয়ে গেল। জোহরা বলল, “কি হলো?”
মঈন অনেকক্ষণ কথা বলতে পারল না। অনেকক্ষণ বাদে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, “শিল্পী তাহলে তোমাকে সেদিন কেন বলেনি? তখনি তো বলতে পারত, চিঠিটাও দিতে পারত!”
জোহরাও থমকে গেল। যা বুঝার বুঝল। হঠাৎ তার মনে হলো দেখাটা না হলেই ভালো হতো। তারপর অনেকটা তড়িঘড়ি করেই চলে গেল। কিন্তু মঈন যেতে পারল না। দাঁড়িয়ে রইল বজ্রাহতের মত। কোথায় যাবে সে? প্রতারক বড় বোনসম রুমমেটকে রেখে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু প্রতারক স্ত্রীকে রেখে কী করে চলে যাবে, মঈন? যে শিল্পীর জন্য কয়েক মুহূর্ত আগে সম্মানে, ভালোবাসায় বুক ভরে উঠেছিল, সে শিল্পীর জন্যই মুহূর্তের ব্যবধানে দু নয়নে হেমলক জমছিল।
.
দীপা আর কাদিন দীপার বাবার বাড়িতে এসেছে। খেতে বসে কাদিন খানিক উশখুশ করছিল। দীপা সেটা লক্ষ্য করে বলল, “আমি রেঁধেছি সব।”
কাদিন নিশ্চিন্ত হলো। খেতে খেতে ওর মনে হলো দীপা বোধহয় ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। আজকাল ওকে একটুআধটু বুঝে। খাওয়া শেষে কাদিন ড্রয়িংরুমে বসেছিল। দীপা এসে বলল, “আপনি কি একটু ঘুমাবেন?”
কাদিন বলল, “না।”
দীপা বলল, “আমি চাদর পাল্টে দিয়েছি। নতুন চাদর বিছিয়েছি।”
কাদিন অ্যাকুরিয়াম থেকে চোখ সরাল। দীপার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি গিয়ে রেস্ট নাও।”
কাদিনের খারাপ লাগছিল। বিয়ের পর বাপের বাড়িতে বেড়াতে এসেও যদি রান্নাঘরে ঢুকতে হয় তবে এ আর কেমন বেড়ানো? ওর জন্য দীপাকে এসেই রান্না করতে হলো।
দীপা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমার ঘরে কেউ থাকে না। আমি চলে গেলেও ফাঁকাই ছিল। মেহেদী আর মা নিজেদের ঘরে থাকে।”
কাদিন দীপার দিকে তাকিয়ে রইল। দীপা বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাই। আপনাকে বোধহয় বিরক্ত করছি।”
দীপা চলে যাচ্ছিল। কাদিন বলল, “তোমার ঘর কোনটা?”
দীপা বলল, “এদিকে। আসুন।”
কাদিন উঠে দীপাকে অনুসরণ করল। দীপা কাদিনের সামনে বিছানা আবার ঝাড়ু দিয়ে দিলো। বলল, “বালিশের কভারও পাল্টে দিয়েছি।”
কাদিন আস্তিনের কাফলিঙ্ক খুলতে খুলতে বলল, “হুম থেঙ্কস।”
দীপা বেরিয়ে গেল। কাদিন শুয়েছিল। মেহেদী পাশের ঘরে জোরে জোরে পড়া মুখস্ত করছিল। খানিক পর মেহেদীর পড়ার শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। কাদিন বুঝল ওর ঘুমাতে সমস্যা হবে বলে দীপা মেহেদীকে শব্দ করে পড়তে নিষেধ করেছে। কাদিনের ঘুমটা এত আরামের হলো! ঘুমিয়ে উঠে খুব ফুরফুরে লাগছিল তার। মুখে পানি ছিটিয়ে সে ঘর থেকে বেরুলো। দীপাকে এদিকওদিক তাকিয়ে খুঁজে পেল না। মেহেদীকেও দেখল না। দীপার মা নিজ থেকে বললেন, “ভাই-বোনেতে মিলে ছাদে গেছে। আমি ডেকে দিচ্ছি, বাবা।”
কাদিন বলল, “না আমি যাচ্ছি।”
কাদিন চেয়েও মা বলতে পারল না। মা থাকলে মা বলা সহজ। কিন্তু মা না থাকলে কাউকে মা ডাকা অনেক বেশি কঠিন। সিঁড়ি বেয়ে কাদিন যখন উঠছিল ওর হঠাৎ মনে হলো, ওর যেমন মা নেই, দীপারও তেমন বাবা নেই। কিন্তু দীপা তো দিব্যি ওর বাবাকে বাবা ডেকে ডেকে জান দিয়ে দিচ্ছে। কড়ির পর বাবাকেই দীপা এত বেশি পছন্দ করে। দীপার মনটা স্বচ্ছ। ওর মতো অত জটিল নয়। দীপার বাবা নেই তাই ও আরেকটা বাবা খুঁজে নিয়েছে। অপরদিকে, ওর মা নেই তাই উল্টো শাশুড়িকে মা বলে ডাকতে পারে না। কেমন যেন লাগে! মানুষে মানুষে বহুত তফাৎ। ভাবনা-চিন্তা, জীবনযাপন, অনুভূতি, প্রতিক্রিয়া, প্রকাশ সবকিছুতেই একেকজন একেকরকম। কারো সাথে কারো মিল নেই। এই মিল আশা করাও বোকামো।
ছাদে উঠেই কাদিন দেখতে পেল দীপা মেহেদীর পিঠে চাপড় দিতে দিতে হোহো শব্দ করে হাসছে। লুটোপুটি খাচ্ছে কিছু একটা বলতে বলতে। মেহেদীর মুখখানা বিরক্তিমাখা। ও বারবার বোনের হাত সরাতে সরাতে বলছে, “উফ আমায় মারছিস কেন? এজন্য তোকে আমি সুখে দেখতে পারিনা। তুই সুখে থাকলেই আমার পিঠের ছাল উঠে যায়।”
আমোদ পেয়ে দীপার হাত আর হাহাহিহি দ্বিগুণ বেড়ে গেল। কাদিন এগিয়ে যেতেই কাদিনকে দেখে দীপা মুহূর্তেই হাসি থামিয়ে দিলো। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ঝারতে শুরু করল। মেহেদী বলল, “ঘুম হলো ভাইয়া?”
কাদিন বলল, “হ্যাঁ।”
“আমি যাই। মা আমাকে খুঁজবে।”
মেহেদী চলে যেতেই কাদিন বলল, “তোমার ভাইয়ের বুদ্ধি ভালো। খুব বোঝদার।”
দীপা বলল, “হ্যাঁ, আমার মত বেকুব না।”
কাদিন নিঃশব্দে হাসল। দীপা প্রশ্ন করল, “আমাকে কী এখন আবার গোসল করতে হবে? কাপড় পাল্টে ফেললে হবে?”
“হবে না। আর কখনো যেখানে সেখানে বসো না।”
দীপা মুখ কালো করে বলল, “ঠিক আছে।”
কাদিন বলল, “এরপর থেকে মোড়া নিয়ে এসো।”
“ঠিক আছে।”
কাদিন কপাল কুঁচকাল, “তুমি দেখি তোমার ঐ বন্ধুটার মত হয়ে যাচ্ছ।”
“কোন বন্ধুটা?” বন্ধুদের কথা শুনতেই দীপার চোখ মুখ আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠল।
কাদিন বলল, “ঐ যে কথায় কথায় আচ্ছা আচ্ছা বলে ওর মত।”
“ওওওওও আমাদের ইমি!” দীপার ঠোঁট হাসছিল।
কাদিন বলল, “সব কথায় ঠিক আছে বলছ।”
দীপা হাসি বন্ধ করে চুপ হয়ে গেল। কাদিন বলল, “শুনো তোমাকে আমি হাসতে নিষেধ করিনি। শুধু অন্যদের তোমার উপর হাসিয়ো না। আমার বউকে নিয়ে কেউ হাসাহাসি করুক তা আমার ভালো লাগে না। তুমি তোমার ভাইয়ের সাথে একা একা যত ইচ্ছা হাসো। আমাকে দেখে চুপসে যেয়ো না।”
কাদিন এইটুকু বলে চলে গেল।
এই ভর সন্ধ্যায় ছাদ থেকে নেমে দীপাকে গোসল করতে হলো। নিজেকে নিজে বলল, “দীপা খুব শীঘ্রই তোর নিউমোনিয়া হতে চলল। তোর স্বোয়ামি আসলে এটাই চায়। ব্যাটা মন মত বউ পায়নি তো, তাই বারবার তোকে গোসল করিয়ে তোর নিউমোনিয়া করিয়ে ছাড়বে। এরপর তুই নিউমোনিয়ায় মরে যাবি। আর ও ওর মন মত কোনো মেয়েকে আবার বিয়ে করবে। অযথা বেদনায় দীপা বেশি সময় ধরে গোসল করল। ঝরনার নীচে দাঁড়িয়ে কেঁদে কেঁদে চোখও লাল করল। তারপর যখন বাথরুম থেকে বেরুলো ওর লাল টকটকা চোখ দেখে কাদিন বলল, “তোমার কী জ্বর এসেছে?”
দীপা মনে মনে বলল, “আমার কপাল জ্বরের না, সতীনের কপাল। নিউমোনিয়ায় মেরে ফেলার ফন্দি করিস ব্যাটা আবার জানতে চাস জ্বর কীনা!”
কিন্তু মুখে বলল, “না।”
রাতে ঘুমানোর সময় কাদিন দীপার কপালে হাত দিলো, “না, জ্বর নেই।”
দীপা কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল। একসময় ঘুমিয়েও পড়ল। কাদিন দীপার কাঁধে ঝাঁকুনী দিয়ে বলল, “উঠো তো উঠো।”
দীপা ঘুমের মাঝেই কিসব বলে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। কাদিন এবার দীপাকে কাঁচা ঘুম থেকে টেনে তুলল। দীপা ঘুমঘুম চোখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কাদিন প্রশ্ন করল, “তুমি কি সত্যিই স্যরি?”
দীপা হা করে তাকিয়েই রইল। কাদিন আবার বলল, “কি হলো বলো। তুমি কি সত্যিই স্যরি?”
দীপা কোনোমতে বলল, “হু।” তারপর আবার শুয়ে পড়ল।
“আবার স্যরি বলো।”
দীপা ঘুমে বিরক্ত হয়ে বলল, “স্যরি।”
কাদিন বলল, “যাও মুখ ধুয়ে এসো।”
দীপা বোধহয় ঘুমে শুনলোও না। কাদিন ঝুঁকে আবার ডাকল, “অ্যাই, অ্যাই?”
দীপা চোখ বন্ধ রেখেই বলল, “কি?”
“এসো, এসো মুখ ধুবে।”
কাদিন উঠে বাতি জ্বালাল। দীপাকে আবারো টেনে তুলল, “যাও মুখ ধুয়ে এসো।”
দীপা আড়মোড়া ভেঙে অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
“গ’না কিস।”
দীপা চোখ বড় বড় করে একদম শক্ত কাঠ হয়ে গেল। কাদিন হাত ধরে ওকে টেনে নিয়ে গেল বাথরুমে। টুথব্রাশ হোল্ডার থেকে টুথব্রাশ নিয়ে ব্রাশে টুথপেস্ট নিলো। দীপার হাতে ব্রাশ ধরিয়ে দিয়ে বলল, “দাঁত মাজো।”
দীপা বিহ্বল, হতভম্ব। কাদিন তাড়া দিয়ে, ঠেলে, ধাক্কে জোর করে ব্রাশ করাল দীপাকে। দীপা কুলকুচা করে, মুখে মাথায় পানি দিতে দিতে বলল, “আমার মাথা ঘুরাচ্ছে, আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।”
কাদিন পানির কল বন্ধ করে দীপাকে হ্যাচকা টানে ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “ঘুরাক।”
দীপার সারা শরীর ঝিমঝিম করে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এল।
চলবে…