#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৪
কুমিল্লা শহরে থাকবার জন্য ভালো মানের হোটেল পাওয়া খুবই দুষ্কর। যেগুলো আছে তাদের মাঝে হোটেল কিউ প্যালেসটাকেই মিশেল মোটামুটি পছন্দ করল। মঈন সেখানেই মিশেলের থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়ে বলল, “কিছু খেয়ে নিও। প্লিজ। আমাকে বাসায় যেতে হবে।”
এই বলে বেরিয়ে এল সে। তারপর থেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। রাত থেকে শুরু করে সকাল, সকাল থেকে দুপুর অবধি সিগারেটের প্যাকেট কটা শেষ করেছে এখন আর মনে করতে পারছে না। কিছু একটা খেতে হবে। কাল সন্ধ্যার পর থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। পেট এর ভেতর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মঈন একটা রিকশা ডেকে কান্দিরপাড় চলে এল। সিটি মার্কেট এর ২য় তলায় ক্যাফে এভেনজার্স এর বাইরে চেয়ার টেনে বসল সে। ভেতর থেকে ওয়েটার এসে বলল, “স্যার, ভেতরে টেবিল খালি আছে।”
মঈন বলল, “লাগবে না। মেন্যুটা দিয়ে যান।”
মঈন মেন্যু দেখে খাবার অর্ডার দিলো। ওয়েটার বলল, “স্যার বিশ, ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।”
মঈন পায়ের উপর কনুইয়ের ভর রেখে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে রইল। ক্লান্তি ওর শরীর বেয়ে উপচে পড়ছল। শিল্পীকে চূড়ান্ত কষ্ট দিতেই তো সে চেয়েছিল। এখন তা দেওয়া হয়ে গেল, কিন্তু বিপরীতে সে নিজে কি পাচ্ছে? উত্তর হলো যন্ত্রণা। তবুও শিল্পীর এ কষ্ট প্রাপ্য ছিল। বন্ধু ভেবেছিল শিল্পীকে। শিল্পী তার এই বন্ধুত্বের, ভরসার সুযোগ নিয়েছে। জোহরাকে এক পলক দেখবার জন্য সে যখন হলের সামনে চড়কির মত ঘুরঘুর করত তখন শিল্পী একদিন ওকে দেখে ভরসার হাসি হেসেছিল। মঈন ধরে নিয়েছিল শিল্পী মঈনের বিষয়টা ধরতে পেরেছে। যে ওকে বুঝে তার সাথে বন্ধু্ত্ব করতেই হয়। এজন্যেই মঈন এগিয়ে গিয়েছিল। তারপর কখন যে দুজন এত বেশি ভালো বন্ধু হয়ে গেল, টেরই পেল না সে। প্রয়োজনে তো লোকে বন্ধুর কাছেই যায়। সেও গিয়েছিল, আর অবশেষে বন্ধু কি করল? প্রতারণা!
খাবার এসে পড়েছে। ওয়েটার আবার জিজ্ঞাসা করল, “স্যার আপনি চাইলে কিন্তু ভেতরে আসতেই পারতেন।”
“চাইছি না।”
ওয়েটার খাবার পরিবেশন করে চলে গেল। মঈন চামচ তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে রেলিং এর নীচে তাকাল। নীচে তাকিয়ে রিকশার সুন্দর জ্যাম, আর ব্যস্ত মানুষ দেখতে দেখতে সে খাবার মুখে তুলল। অনেকের কাছে মনে হতে পারে জ্যাম আবার সুন্দর কি করে হয়? ঢাকা ছাড়া পৃথিবীর সব জ্যামই মার্জিত এবং সুন্দর জ্যাম। মঈন অবজ্ঞার হাসি হাসল! এখন আবার তাকে বলে সে নাকি ওকে ব্যবহার করেছিল! কক্ষণো না। শুধু ভরসা করেছিল! ভরসা করতে করতে নিজেকে পর্যন্ত তুলে দিলো। ভুল করেছিল। ভাগ্যিস জোহরার সাথে দেখা’টা হলো! আবার কখনো কখনো মনে হয় দেখা না হলেই ভালো হতো। শিল্পীকে এই কষ্টগুলো পেতে হতো না। ওদের সংসারটা এভাবে শেষ হয়ে যেত না। বাচ্চাগুলোরও এই দুর্দশা হতো না। সত্যি বলতে শিল্পীকে কষ্ট দিতে গিয়ে সে আনন্দের চাইতে বেশি বেদনা’ই কুড়ায়। কিন্তু এখানে মূখ্য বিষয়টি হলো শিল্পীকে কত বেশি কষ্ট ফিরিয়ে দেয়া যায়, এটি করতে গিয়ে ওকে কতটা যন্ত্রণা পেতে হয়, কি কি খোয়াতে হয় তা ধর্তব্য নয়। মঈন হাতের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে না রাখতেই মিলার কলটা এলো। মঈনের লজ্জায় কলটা ধরতে ইচ্ছে করছে না। বাচ্চাদের সামনে কি করে মুখ দেখাবে সে এখন? ওদের বাবার এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার চলছে। এতদিন আকারে ইঙ্গিতে ওদের মা ওদের যা বলছিল, ওরা যা বিশ্বাস করতে চাইছিল না তাই ওদের সামনে খোলাশা হয়ে গেল। প্রমাণ হয়ে গেল। মিলা কেন কল করছে? কলটা ধরলেই হয়তো বলে বসবে, “বাবা আমরা তোমাকে অনেক ঘৃণা করি।” এরকম কিছু বলতেই কি কল করছে? কলটা বেজে নিজে নিজেই কেটে গেল। সবকিছুর’ই একটা সময় থাকে। সময় ফুরালে সবকিছু এমন করেই ফুরিয়ে হয়ে যায়। এই যে সে এখন যা ভাবছে তা ভাবা পুরোপুরি অনর্থক। বাচ্চাদের কথা তো ওর আরো আগে ভাবা উচিত ছিল। মঈন মোবাইলটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগল। মিলা আবারো কল করল। এইবার মঈনের মনে হলো মিলা খুবই লক্ষী মেয়ে। ও কখনো এমন কিছু বলবে না। বললে মুবিন বলতে পারে। মুবিনের খুব রাগ, জেদও বেশি। একদম ওরই মতন। মিলা যেহেতু কল করছে অবশ্যই জরুরি কিছু। শিল্পী? শিল্পী ঠিক আছে তো? কিছু করেটরে বসেনি তো? কথাটা মনে হতেই দ্রুত টেবিল ছেড়ে ক্যাফের ভেতর গিয়ে বিল মেটাল। তারপর ব্যস্ত হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মিলাকে কলব্যাক করল, “বলো, মিলা।”
মিলা কিছু বলছিল না। মোবাইলের ওপাশে শুধু কান্নার শব্দ। মঈন একটা রিকশায়য় উঠে রিকশাওয়ালাকে আঙুল দিয়ে পথ দেখাল। এখন কথা বলার মত সময় তার নেই। রিকশাওয়ালা বলল, “আমি ঐদিকে যামু না।”
মঈন ক্ষেপে গিয়ে বলল, “আরে মিয়া যাও তো।”
রিকশা ওয়ালা বিড়বিড় করতে করতে রিকশা টান দিয়ে বলল, “এই দুনিয়াত গজব পড়ত না তো কোন দুনিয়াত পড়ব? বড়লোকের বাহাদুরি আল্লাহ ছুটাইব।”
মঈন এসবে কান না দিয়ে মোবাইলে আবারো বলল, “কি হয়েছে, মা? এভাবে কাঁদছ কেন?”
“আমার জন্য সব হয়েছে।”
“কি হয়েছে? তোমার মা ঠিক আছে?”
“হু।”
মঈন একটু ইতঃস্তত করে বলল, “কি করছে ও? তোমাদের কি খুব মেরেছে?”
“না, মা ঘুমাচ্ছেন।”
“তাহলে?”
মিলা এক মুহূর্ত একটু থামল। থেমে বলল, “বাবা, মুবিন চলে গেছে।”
“চলে গেছে মানে?”
“ওকে রাগ করে উল্টাপাল্টা কথা বলেছিলাম। তাই ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে জানি না। চিঠি দিয়ে গেছে।”
“কখন গিয়েছে?” মঈন মুহূর্তেই ঘেমে গেল।
“জানি না। তবে সকালে টের পেয়েছি।”
“সকালে টের পেয়েছ আর তুমি এখন বলছ আমাকে? এতক্ষণে?” মঈন ধমকে উঠল।
মিলা চোখ মুছে কিছু বলতে চাইছিল। তার আগেই মঈন বলে উঠল, “তোমার মাকে কেন বলোনি?”
“বলেছি, সকালেই বলেছি।”
“মুবিনের খোঁজে এখনও বের হয়নি?”
“না।”
“কি বলল?”
মা বলেছিলেন, “শুনেছি তোমাদের বাবাও নাকি এই বয়সে একবার বাড়ি ছেড়ে সুনামগঞ্জ পালিয়ে গিয়েছিল। সময়মতো আবার ফিরেও এসেছে। তোমার ভাই তো আর ভালো হয়নি। হয়েছে বাপটার মতই বদমাইশ। সেও আমাকে জ্বালিয়ে অঙ্গার করার কোনো পথ’ই আর বাকি রাখবে না। এখন যাও সামনে থেকে যাও। সারারাত ঘুমাইনি, ঘুমাতে দাও।”
মিলা বুঝে মার মাথা এখন ঠিক নেই। আর সে খুব ভালো করেই জানে কতটুকু বলতে হতো, তাই বলল, “শুনে মায়ের শরীর খারাপ হয়ে গেছে। তাই জোর করে ঘুম পারিয়েছি।”
মঈনের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। সে কঠিন গলায় বলল,
“আমার ছেলে সকাল থেকে বাসায় নেই, আর সে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে? পৃথিবীতে অনেক জঘন্য মহিলা দেখেছি, কিন্তু তোমার মায়ের মতন আর একটি জঘন্য মহিলা কখনো আমার চোখে পড়েনি।”
.
অপেক্ষা করা হচ্ছে ইমাদের জন্য। অপেক্ষা’টা করছে কড়ি। অপেক্ষা করবার স্থান ধর্মসাগর পাড়। সে বসে আছে ধর্মসাগর পাড় জুড়ে থাকা কৃত্রিম দীর্ঘ আসনে। যে আসন পুরো দীঘিটাকে আগলে রেখেছে নিজের গহীনে, বুকের ঠিক ভেতরে।
চলবে…
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী।
পর্বঃ ৩৫
ইমাদ বাদুরতলার কুমিল্লা মহিলা মহাবিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে কড়িকে কল করল, “কোনদিকে?”
কড়ি ঘাড় উঁচু করে ইমাদকে দেখতে পেল। বলল, “দেখেছি আপনাকে। আরেকটু এগিয়ে আসুন। সবুজ জামা।”
ইমাদ কল কেটে সামনের দিকে এগুলো। কড়ি তীক্ষ্ণ চোখে ইমাদকেই লক্ষ্য করছে। ইমাদ ইটের রাস্তা দিয়ে নির্বিকারভাবে হেঁটে আসছে। দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো রাস্তায় ছায়ার যোগানদাতা। বাহারি পাতাগুলো নরম রোদ আর নির্মল হাওয়ার সাথে নাচতে নাচতে রাস্তায় নানান ধরের নকশা আঁকছে। এই রাস্তাটা ডানে মোড় নেয়ার জায়গাটায় গোল করে চারিদিক মুক্ত এক ঘরের আদল তৈরী করা। নাম তার অবকাশ। কয়েকটা ছেলেমেয়ে সেখানে চেয়ার পেতে বসে পিকনিক টেবিলে হাতের তালে শব্দ করতে করতে সমস্বরে গান গাইছে,
“বন্দে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে,
বন্দে মায়া লাগাইছে পিরিতি শিখাইছে
দেওয়ানা বানাইছে,
কী যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে…”
তার ঠিক সামনেই এক কোণায় এক বৃদ্ধ বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তার সামনে একটা বোর্ড। বোর্ডে নানান রঙের বেলুন সাঁটা। নানান বয়সী মানুষজন এসে এসে বন্দুক দিয়ে বেলুন ফুঁটাচ্ছে। এই বৃদ্ধে রোজগার জমজমাট।
ইমাদের মাঝে কোনো উৎকণ্ঠা নেই। চাহনিতে নেই কোনো আগ্রহ। অনেকেই এভাবে হেঁটে আসছে। কেউ চলে যাচ্ছে সোজা রাস্তায় আর কেউ’বা অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের দেখে ঝাপিয়ে পড়ছে, বসে থাকা প্রেমিকাকে দেখে মিষ্টি করে হাসছে, দুষ্টু চোখে তাকাচ্ছে। কিন্তু ইমাদ! সে এক বিস্ময়! অন্য পথচারী যাঁদের মঞ্জিল এখানে নয়, শুধু রাস্তাটা শর্টকাট বলেই এখান দিয়ে চলা, তাঁদের মতই তার মুখের অভিব্যক্তি। এটা যেন ওর পথ, সামনেই যে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করছে, তাকে যে এখন ঐ মানুষটিকে খুঁজে বের করতে হবে, তাকে দেখে তার কোনো আঁচ’ই পাওয়া যায়না। সে তার মতই হেঁটে এসেছে। এদিকওদিক তাকিয়ে কড়িকে খুঁজেনি, দেখার পর হাসেওনি, না ছুঁড়ে দিয়েছে অন্যরকম কোনো চাহনি। শুধু এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। কড়ি নিজের বিস্ময় লুকাতে লুকাতে বলল, “বসুন।”
ইমাদ বসল তবে কড়ির মত পথের দিকে মুখ করে নয়। সে দীঘির দিকে পা ঝুলিয়ে বসল। কড়ি বলল, “আপনি আমাকে এত পছন্দ কেন করেন?”
“আপনি অনেক আন্ডারস্ট্যান্ডিং।”
“তার মানে আমি আপনাকে ভালো বুঝি।”
“জি।”
“আমি যদি আপনার জায়গায় থাকতাম তবে কখনো প্রপোজ’টা করতাম না।”
“আচ্ছা।”
কড়ি বলল, “প্রশ্ন করুন, কেন?”
ইমাদ বলল, “কেন?”
“সম্পূর্ণ পড়া হয়ে যাওয়া, পুরোপুরি বুঝা হয়ে যাওয়া বই যতই সুন্দর হোক সেটি বুকশেলফেই পড়ে থাকে। ধুলাবালি জমে। দাগ পড়ে! মানুষও এমন। মানুষকে হতে হয় আধা পড়া উপন্যাসের মত। আজীবন ধরে একটু একটু করে যে আমায় পড়তে পারবে, প্রতিদিন যে নতুন করে আগ্রহী হবে তাকে বিয়ে করার কথা ভাবা উচিত।”
“তার মানে আপনি এখনও সেরকম কোনো প্রিয় বই খুঁজে’ই পাননি।”
“হতে পারে। আবার অনেক প্রিয় বই আছে, যেটা কালেকশনে নেই ওটার জন্য ঠিকই মন আনচান করে। কিন্তু নিজের কাছে থাকলে সেটার দিকে ফিরে তাকানোর সময়ও হয় না। কিছু কিছু মানুষ শুধু দূর থেকেই আরাধ্য।”
“বুঝলাম!”
কড়ি আগ্রহভরে বলল, “কি বুঝলেন?”
ইমাদের ঠোঁটে মুচকি হাসি, “আপনি বুঝাতে চাইছেন আমাদের রিলেশন বা বিয়ে কোনোটাই ওয়ার্ক আউট করবে না।”
কড়ি ইমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ! ইমাদ তাকাচ্ছে না। সে হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপা দীঘির জলে চেয়ে আছে। দীঘির চারিদিকে কত কত গাছ। ঐ পাড়ে একটা লাল বোট ভাসছে। পাশে কি একটা ফুল গাছ। কিছু ফুল জলে স্নান করছে। বাতাসের শীতল ঝাপ্টায় বুক ভরে প্রশান্তি নিতে নিতে একসময় ইমাদ বলল, “আপনার একটা ভুল ভাঙার দরকার আছে।”
কড়ি একটু অবাক হলো, “কি ভুল?”
“আপনি আমাকে অন্যদের তুলনায় ভালো বুঝেন, কিন্তু পুরোপুরি বুঝেন না।”
কড়ি ইমাদকে ব্যঙ্গ করে মজার ছলে বলল, “আচ্ছা।”
ইমাদ এইবার কড়ির দিকে তাকাল। খুব স্বাভাবিক, শীতল চাহনি, “যদি সৎ উত্তর দিবেন বলে আশ্বাস দিন তাহলে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।”
কড়ি ঠাট্টার গলায় বলল, “কি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করব?”
ইমাদ বলল, “আমায় ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করলেই হবে।”
কড়ি চোখ ছোট ছোট করে ইমাদের দিকে তাকাল। ইমাদ বলল, “আমিও ঠাট্টা করলাম।”
“এমন ঠাট্টা করবেন না।”
“আচ্ছা।”
“বলুন কি বলছিলেন।”
“আমি আপনাকে ভালোবাসি তা আমি বলার আগে বুঝেছিলেন?”
“ভালোবাসি না বলে পছন্দ করেন বললে আমার ভালো লাগবে।”
“আচ্ছা।”
“উহুঁ খেয়াল করিনি।”
“আপনি যেদিন শাড়ি পরলেন সেদিন আমি যে দূরে দূরে থেকেছি খেয়াল করেছেন?”
কড়ির ভ্রু কুঁচকাল, চোখে কৌতূহল জমল। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “উমম, হ্যাঁ করেছিলাম।”
“নিশ্চয়ই কিছু ভেবেছেন?”
“হ্যাঁ কিছু একটা ভেবেছিলাম।”
“কি ভেবেছিলেন?”
“বলতেই হবে?”
“জি বলতে হবে।” ইমাদ কড়ির চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
কড়ি মনে করতে করতে বলল, “ভেবেছিলাম আমার বিয়ের কথা শুনে আপনি পিছু হটে গেছেন।”
ইমাদ মুখ ঘুরিয়ে দীঘির ওপাশের গাছ আর গাছগুলোর পেছনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা কুমিল্লার বড় বড় অট্টালিকাগুলো দেখতে দেখতে বলল, “আমি সেদিন দূরে দূরে থাকছিলাম অন্য কারণে।”
“কি কারণ?”
“বলব না।” ইমাদ হাসল। ওর হাসির কোনো শব্দ নেই।
কড়ি শুনতে মরিয়া হয়ে গেল, “এখন বলব না বললে তো হবে না। বলতেই হবে।”
ইমাদ কড়ির কথায় কান না দিয়ে তার পরবর্তী প্রশ্নে চলে গেল, “আমি যখন এদিকটায় হেঁটে আসছিলাম, আমাকে দেখে আপনার মাথায় ঠিক কি চলছিল?”
কড়ি থমথমে গলায় বলল, “আমিও বলব না।”
ইমাদ শান্ত গলায় বলল, “প্লিজ।”
কড়ি কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল, “ভাবছিলাম আপনি একবারো আমি কোথায় আছি খুঁজে দেখছেন না কেন?”
ইমাদ বলল, “কিছু খাবেন?”
কড়ি বলল, “না, থেঙ্ক ইউ।”
“আপনার ঝাল পছন্দ নাকি মিষ্টি?”
“বললাম তো কিছু খাব না।”
“প্লিজ।”
“আপনি একটু পর পর এরকম প্লিজ প্লিজ করবেন না তো।”
ইমাদ বলল, “ঝাল নাকি মিষ্টি?”
কড়ি বিরক্ত হয়ে বলল, “টক পছন্দ। যান টক কিছু কিনে নিয়ে এসে আমায় উদ্ধার করুন। আর দয়া করে বাকি কথাটুকুও শেষ করুন।”
ইমাদ চট করে ঘুরে বসে বসার জায়গাটা ছেড়ে উঠল। উঠে গিয়ে কড়ির জন্য আমড়া কিনে ফিরে এল। কড়ির হাতে কাগজটা দিয়ে আবার আগের মত করে বসল, “আমি আগে আপনাকে সেখানে দাঁড়িয়ে খুঁজে বের করেছি। তারপর কল করেছি।”
কড়ি প্রচন্ড অবাক হয়ে বলল, “আসলেই?”
ইমাদ চুপ করে রইল। কড়ি আমড়া খেতে খেতে বলল, “আচ্ছা কেন এটা অন্তত বলুন।”
ইমাদ নির্লিপ্ত গলায় বলল, “চট করে আপনার সামনে এসে দাঁড়ালে অপ্রস্তুত হতে পারেন। আগেভাগে জানিয়ে দিলাম যে আমি এসে গেছি। একটু পরেই আপনার সামনে আসব।”
কড়ি ভ্রু কুঁচকাল। তারপর আমড়া খেতে খেতে চোখ উল্টে ইমাদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। কড়ির এই দৃষ্টি, এই হাসি দেখে ইমাদ মনে মনে নিজেকে শুনাল, “অতি সুন্দর! অতি সুন্দর!”
কিন্তু সামনাসামনি ওকে দেখলে যে কেউ বলবে কই? ও তো তাকাল না পর্যন্ত! কড়ি বলল, “ভালো লাগল। ধন্যবাদ।”
ইমাদ বলল, “আপনি আমাকে মোটামুটি বুঝেন। সবটুকু বুঝেন না।”
রসায়নের অনেক দুর্বোধ্য কোনো বিক্রিয়া বুঝবার পর ক্লাসের ছাত্রীরা যেমন করে মাথায় দোলাায়, কড়ি সেভাবে মাথা দোলাতে দোলাতে বলল, “হ্যাঁ, এখন বুঝলাম।”
ইমাদ আবারো বলল, “আসলে আপনি আমাকে বুঝবার চেষ্টা করেন। এইটুকুই যথেষ্ট। আমার আশেপাশের কেউ সাধারণত আমাকে বুঝবার চেষ্টা করে না। ধরুন এই যে আমি আপনাকে খুঁজিনি আপনার জায়গায় অন্য কেউ হলে মনে মনে ভাবত আমার ভাব বেশি, বা আমার ওর প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু আপনি আর যাই ভেবে থাকেন না কেন অন্তত এটা ভাবেননি।”
“এর মানে আপনি বলতে চাইছেন…”
কড়ি পুরো বাক্যটা শেষ করবার আগেই কায়েস এসে সামনে দাঁড়াল, “কিরে, কড়ি? তুই এখানে?”
এই হলো কুমিল্লা শহরের সমস্যা। আপনি বাসা থেকে বের হবেন, এক জায়গায় যাবেন আর আপনার পরিচিত কেউ আপনাকে দেখে ফেলবে না বা, আপনি কাউকে দেখবেন না আর যাই হোক তা হয়না। কুমিল্লায় সূর্য রাতে উঠতে পারে, কিন্তু আপনি বেরুবেন আর এইধরনের সাক্ষাতের মুখোমুখি হবেন না, তা হয় না। আসলেই তা হয় না। অনেকে আবার একে কুমিল্লা শহরের জাদুও বলে।
চলবে…