#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী
শেষ পর্ব : প্রথম অংশ।
সময় কি? সময় কোথায়? সময় কার? সময় প্রেমিকের হাত ধরে প্রেমে পলায়নকারী ঘরের মেয়ে। রাতের অন্ধকারে যে চৌকাঠ পেরিয়ে যায়, কাউকে না জানিয়ে। সময়ের পদবী বদলায়। আজ থেকে গতকাল হয়ে যায়। সময় অবুঝ কনের বেখেয়ালি ভুলচুকে লেগে থাকা মেহেদীর ঘ্রাণে। সময় বিশ্বস্ত বন্ধুর শক্ত করে ধরে রাখা হাতের মাঝে। সময় বেপরোয়া পুত্রের অবাধ্যতায়।
সময় প্রাক্তনের। সময় নিঃসঙ্গতায়, সময় সফলতায়। সময়ের খুব তাড়া। আকাশের তারা গুনা শেষ হবার আগেই সময়ের সময় শেষ হয়ে যায়। এক লহমায়, ঠিক যেন চোখের পলকে। যেভাবে শেষ হয়েছে সবার উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া মুবিনের সুন্দরবন ট্যুর। ঠিক সেভাবেই ফুরিয়ে এসেছে কড়ির বেঁধে দেয়া ইমাদের গয়না কেনার সময়। শেষ হয়েছে মিলার পরীক্ষা। হয়েছে শ্বশুরালয় হতে কাদিনের বিদায়। ফুরিয়েছে মিশেলের মুগ্ধ চোখে পুরো বাংলাদেশ ভ্রমণ। মিশেল যেদিন ব্যাগ গোছাচ্ছে, ফিরে যাবে বলে, সেদিন মিলার সাথে একবার দেখা করার খুব চেষ্টা করল। মিলার হোস্টেলে গেল। কিন্তু মিশেল এসেছে শুনে মিলা কিছুতেই নামল না। মিশেল অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিল। মিলার নাম্বার যোগাড় করে কল করল। মিলা কল রিসিভ করে কণ্ঠস্বর শুনেই কল কেটে দিচ্ছিলো, তখনই মিশেল বলল, “ফ্রান্সে চলে যাচ্ছি। আমার দেশে।”
মিলা কয়েক মিনিট চুপ থেকে কলটা কেটে দিলো। নীচে নামল তারপরই। কেন নামল? বাবার জন্য? বাবা চলে যাবেন বলে? এতক্ষণ কেন নামেনি? মায়ের জন্যে? মা দুঃখ পাবে বলে? মিলা ঠিক জানে না। বাবার জন্য, না মায়ের জন্য ও সত্যিই জানে না। প্লাজো আর টি-শার্ট পরা, মাথায় উঁচু করে পনিটেল বেঁধে রাখা ভীষন পড়ুয়া মিলাকে দেখে মিশেল মিষ্টি করে হাসল, “কেমন আছো, মিলা?”
মিলা হাসল না। শুধু তাকিয়ে রইল। মিশেল বলল, “ভেবেছিলাম তোমার সাথে কোথাও বসে কফি খাব। কিন্তু আমার হাতে একদমই সময় নেই।”
মিলা বলল, “আমার হাতেও সময় নেই। আপনি কি কিছু বলবেন?”
“হ্যাঁ, আমি আমার দেশে ফিরে যাচ্ছি। একেবারের জন্য। তোমার বাবার অবশ্য ফ্রান্সে সেটেল হতে সমস্যা নেই কোনো।”
মিলার কলিজাটা অযথাই মোচড় দিয়ে উঠল৷ অযথাই তো। ওর বাবা বিদেশে চলে গেলেই বা কি? এখানে থেকেও বা আছে কই? আর এখানে থাকলেই মিলার কি? ওর বাবার কাছে ওর খুব একটা মূল্য নেই। মিশেল’ই আবার বলল, “আমিও চাইলে এ দেশে থাকতে পারি। একটা থ্রিল কাজ করে। কিন্তু আমি এ দেশে থাকব না। তোমার বাবাকেও আমার দেশে আসতে বলব না। আমরা আলাদা হয়ে যাচ্ছি।”
মিলা ছোট করে বলল, “ওহ্।”
“কদিন বাদেই তোমার এসএসসির রেজাল্ট দিবে। এখানে আর থেকো না। রেজাল্ট পেয়েই তুমি আমার কাছে ফ্রান্সে চলে এসো। বাকি পড়াশুনা ওখানে করবে। তোমার সবকিছু আমি দেখব। যা প্রয়োজন, যেভাবে চাও, সব পাবে। পূর্ণ স্বাধীনতা, মানসম্মত পড়াশুনা, সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, আর তোমার পরিবার থেকে মুক্তি।”
“মুক্তি!”
“হ্যাঁ, মুক্তি। তোমার মত প্রতিভাবান একটা মেয়ের কদর ওরা করতে পারেনি। ওরা মানবিকভাবেও তোমার প্রতি অন্যায় করেছে।”
“আমি আপনার কাছে কেন যাব?” মিলা ভ্রু কুঞ্চিত কপাল নিয়ে তাকিয়ে রইল।
“তুমি আমার কাছে কেন আসবে সে কারণ আমি তোমায় দিতে পারব না। তুমি যদি আমার কাছে আসার কোনো কারণ খুঁজে পাও তবেই এসো। তাছাড়া, ঠিক আমার কাছেও নয়। তুমি যাবে তোমার আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নের কাছে। আমি তোমার মঞ্জিল নই, মা নই, পরিবার নই। আমি তোমার বন্ধু। তোমাকে পথ দেখাব। তুমি ওখানে ভালো থাকবে।” মিশেল ঘড়ি দেখতে দেখতে বলল।
মিলা বলল, “আমাদের দেশে বাবার প্রেমিকা কখনো বন্ধু হয় না।”
“আমি এখন আর তোমার বাবার প্রেমিকা নই।”
“কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করব?”
“অবশ্যই মিষ্টি মেয়ে।”
“কেন চলে যাচ্ছেন আপনি?”
“কার জন্য থাকব?”
“কার জন্য এসেছিলেন? কেন এসেছিলেন এখানে?” মিলার চোখ জ্বলে উঠল।
মিশেল একটুও রাগল না। ওর মুখ থেকে মিষ্টি হাসিটাও গেল না। বলল, “এসেছিলাম মঈনের জন্য৷ কিন্তু ওকে এখন আর আমি নিতে পারছি না।”
“কেন?”
“কদিন আগে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম৷ তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে।”
“হ্যাঁ, আছে।”
“আমি মুবিনের সাথেও দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওর জন্যেও কিছু গিফ্ট এনেছিলাম। তোমার এখানে এসে তোমার বাবা গাড়ি থেকেই নামেননি। তোমার সাথে একটাবার দেখাও করতে চায়নি। ওদিকে ছেলের মেসে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা উৎসাহ নিয়ে অপেক্ষা করেছে। ফলাফল যে খুব সুখকর ছিল তা নয়। এরকম ছোটোখাটো অনেক অন্যায় আমি দেখেছি। তোমার মা এবং বাবার মুবিনকে নিয়ে লড়াই এবং তোমার প্রতি অবহেলা। মঈনের চিন্তা-ভাবনা আমার বিরক্তির কারণ। ওর সঙ্গে আমার ঠিক যায় না৷ চিন্তা চেতনায় মিল না থাকলে, সম্মান করতে না জানলে আমরা একসঙ্গে এক মুহূর্তও থাকতে পারি না। এটা আমাদের সংস্কৃতি।”
মিলা তাজ্জব বনে গেল। কি বলবে বুঝে উঠল না। মিশেল একটা কার্ড এগিয়ে দিলো, “এটা রাখো। আমার ঠিকানা, পরিচয় এবং কনাক্ট নম্বর। তোমার ভালো লাগলে যোগাযোগ রেখো। আসতে ইচ্ছে হলে চলে এসো।”
মিশেল রোদচশমা মাথা থেকে নামিয়ে চোখে দিলো৷ তারপর মিলার গালে গাল স্পর্শ করে চুমু খেয়ে বলল, “বিদায়।”
মঈন অত সহজে এ বিদায় মানতে পারছিল না। ও শেষ পর্যন্ত মিশেলকে আটকে রাখার চেষ্টা করল৷ ভালোবাসায় আদরে, প্রলোভনে, অনুতাপে, মিনতিতে এবং করুণায়। মিশেল আটকাল না কোনো হুকেই। সে পাখির মত ছটফট করে বলল, “তোমার সাথে আমার যায় না, মঈন৷ তোমাকে আমার আর ভালো লাগছে না।”
“কি চাও তুমি? বলো কি চাও? কোথায় স্যাটেল হতে চাও?”
“স্যরি, মঈন তোমার সাথে আমি কোথাও থাকছি না।”
“কেন? কি হয়েছে তোমার হঠাৎ?”
“সংকীর্ণতা আমাকে ভোগায়।”
“আমি তো তোমাকে বদলাতে চাইনি। কিসের সংকীর্ণতার কথা বলছ তুমি?”
“না তুমি আমাকে বদলাতে চাওনি। কিন্তু তুমি খুবই সংকীর্ণমনা। আর আমিও তোমাকে বদলাতে চাই না।”
“তাই পথ বদলে নিচ্ছো?”
মিশেল মঈনকে কাছে টেনে নিলো। একটা গাঢ় আলিঙ্গন, প্রগাঢ় চুম্বন। তারপর, “ভালো থেকো।”
রুক্ষ মঈন মিশেলকে দূরে ঠেলে দিলো। আক্রোশে বলল, “ভালো থেকো বললেই কি ভালো থাকা যায়? তোমার জন্য আমি আমার ঘর -সংসার, ছেলে -মেয়ে স্ত্রী, সব ছেড়েছি।”
“মিথ্যে বলো না, মঈন। তুমি আমার জন্য কিছুই ছাড়োনি। তুমি ওদের কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েই আমার কাছাকাছি এসেছিলে। তুমি তোমার অতীতের জন্য ওদের ছেড়েছ। আমি তোমার অতীত নই। ভবিষৎ হলেও হতে পারতাম। আমি হবো না।”
মঈন রাগে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। ওর চোয়াল শক্ত, হাত মুঠো করা। মিশেল চলে গেল। সে কিছুই করতে পারল না।
.
হাজারটা পাত্রকে, তুচ্ছ, তুচ্ছ কারণে বাদ দিয়ে, পুরো রাষ্ট্র খোঁজে, সবদিক দিয়ে অসাধারণ একজনকে নিজের বোনের জন্য পাত্র হিসেবে নিয়ে এসেছে কাদিন। ছেলেটার নাম মৃন্ময়। কাদিনের পূর্ব পরিচিত। মৃন্ময় চাকুরী করছে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে। মোটা অঙ্কের বেতন। পাত্রের ফ্যাশন সেন্স ভালো। কাদিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। বেল্টের রঙের সাথে মিলিয়েই শু পরে। কালার কম্বিনেশন বুঝে। সেন্স অব হিউমার ভালো। ইজি গোয়িং, আর মিশুক। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন, শান্ত স্বভাবের পরিশ্রমী ছেলে মৃন্ময়। মুখে সারাক্ষণ হাসি লেগেই থাকে। বাড়ির সবারও একই মত। কড়ির সাথে খুব মানাবে। না, কাদিন নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি কড়ির উপর। কেবল বলেছে, “আমার খুব পছন্দ মৃন্ময়কে৷ তোর কেমন লাগে? ঢাকায় তোর সাথে দেখা করার জন্যে একবার ওকে পাঠিয়েছিলাম।”
কড়ি বলেছে, “দেখা হয়েছে। কয়েকবার কথা বার্তাও হয়েছে।”
“তোরা আরো কথা বল। ভাব, ভেবে উত্তর দিস।”
“ঠিক আছে। তোমার আর মেজো ভাবির কি হলো?”
কাদিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চলে যায়। কিছু বলে না। কড়ি কিছুক্ষণ বাদে ডাইনিংয়ে পানি খেতে গিয়ে দেখল কাদিন সামনের বারান্দায় গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। কড়ি পাশে দাঁড়াল, “চলে এলে ভাবিদের বাসা থেকে?”
“রাখলো না আমায়।”
“আবার যাবে?”
“বাহানা খুঁজছি।”
“আমার বিয়ের বাহানায় ভাবিকেই নিয়ে আসো না।”
“উঁহু হবে না। ও এত কঠিন বুঝতেই পারিনি।”
“হিসাবটা ঠিক মিলছে না।”
“কিসের হিসাব?”
“তোমাদের হিসাব। আমি তোমাকে চিনি ভাইয়া।
জঘন্য কোনোরকম অপরাধ তুমি কখনই করবে না। ভুল করতে পারো। তার বেশি নয়। আমি মেজো ভাবিকেও চিনি। ভাবির, অত রাগ নেই। খুব ইমোশনাল একটা মানুষ। আর যাইহোক, আপনজনদের উপর সে দীর্ঘমেয়াদে রাগ ধরে রাখতে পারে না। চট করে সব ভুলে যায়। এমনকি যাই ঘটতে থাকুক সবকিছুতে শুধু নিজের দোষ খোঁজে। সবসময় ভাবে সব ওর ভুল। সব ওর জন্য হয়েছে।”
কথাটা কাদিনের মাথায় গেঁথে গেল। সে খুব ভাবলো এবং সেই ভাবনা ধীরে ধীরে ডাল-পালা গজাতে লাগল।
.
নিলয়ের আজ জীবনানন্দ দাশের মত বলতে ইচ্ছে হলো, “ওইখানে যেওনাকো তুমি, বোলোনাকো কথা ওই যুবতীর সাথে; ফিরে এসো ইমাদ …”
নিলয় কয়েকবার দীপাকেও মনে মনে বলল,
“সখী, ভাবনা কাহারে বলে। সখী, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস- রজনী
‘ভালোবাসা’ ‘ভালোবাসা’
সখী, ভালোবাসা কারে কয়! সে কি কেবলই যাতনাময়।’
আহা প্রেম! দানব প্রেম নিলয়ের দুই বন্ধুর জীবন তছনছ করে দিলো। চোখ মেলে যেদিকেই তাকাচ্ছে কেবল ধ্বংসযজ্ঞ। কোথাও দীপার ধ্বসে যাওয়া ঘর, কোথাও ইমাদের নির্বাক আর্তনাদ।
নিলয় নিশ্চিত একদিন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে তার দুই বন্ধুর প্রেমের জন্যই। একদিকে বোকা দীপা আর বেচারা ইমাদ। অন্যদিকে, হিটলার কাদিন এবং নাৎসি কড়ি। প্রেম ও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, নিলয় বাকরুদ্ধ। দীপার হৃদয়ঘটিত গ্যাঞ্জাম একটা সাইকোলজিক্যাল ডিফ্রেন্স। হিটলার কাদিন দীপাকে বুঝে না। বেচারি দীপা হিটলার কাদিনকে মানে না। আর ইমাদের হৃদয়ঘটিত গ্যাঞ্জামটুকু অর্থমন্ত্রণালয়ের আওতাধীন। নাৎসি কড়ি ইমাদের কাছ থেকে প্রেমের ট্যাক্স চায়। ইমাদের ট্যাক্স জমা দেয়ার সময় শেষ। কড়ির দেয়া ছয় মাস ছুঁ মন্তর। তন্ময় নামে এক পাত্রকে নিজের জন্য বাছাই করে ফেলেছে সে। তাদের শেষ টেলিফোনকথন নিলয় জানে। ইমাদ কলটা করেছিল রুমের ভেতরেই। সে সুবাদে নিলয় কিছুটা শুনেছে৷ ইমাদের কল পেয়ে কড়িকে মোটেও উত্তেজিত শোনায়নি। সে ঢাল তলোয়ার নিয়ে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল, “হঠাৎ কল দিলেন। কিছু বলবেন?”
ইমাদ নিরবতা ভেঙে বলল, “দীপা বলল।”
“কি বলল?” কড়ির গা-ছাড়া জবাব।
ইমাদ হঠাৎ চুপ হয়ে গেল। কড়ি বারবার হ্যালো, হ্যালো করছিল, “হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো লাইনে আছেন? হ্যালো আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না।”
ইমাদ কথা বলল, “আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে যাচ্ছে?”
কড়ি বলল, “আগেই শুনে ফেললেন? আমি আপনাকে কার্ড পাঠাতাম।”
ইমাদ শান্তভাবে বলল, “আমাদের মাঝে একটা চুক্তি হয়েছিল।”
“মনে আছে।”
“আমি এখনও চুক্তিতে হেরে যাইনি।”
“এখনও জিতে যাননি। আর সময় নেই। শেষ।”
“আচ্ছা।”
“আর কিছু বলবেন?”
ইমাদ সময় নিয়ে বলল, “কোনো চুক্তিনামা নেই বলে আফসোস হচ্ছে।”
কড়ির সোজাসাপ্টা জবাব, “আমাদের মাঝে কোনো চুক্তি হয়েছিল বলে আপনার এই ধারণটাই ভুল।”
“তাহলে কি হয়েছিল?”
“আমার জন্য আপনি আপনার জীবনে আসা ভালোবাসা পাননি এই দায়ভার নিতে চাই না। পাবেন কি পাবেন না সেটা আপনার সক্ষমতা কিংবা, ব্যর্থতা।”
“ভালো যে বাসি বুঝেছেন। এখন একটু ভালো লাগছে।”
“আমি ভালোবাসা চেনায় পারদর্শী না।”
“কিন্তু আমি ভালোবাসায় পারদর্শী। পরশু একবার দেখা করুন।”
“না।”
“খাজনা নিবেন না, রাণীসাহেবা?”
কড়ি মোবাইল কানে ধরে স্তব্ধ হয়ে গেল। ইমাদের ঠোঁটের কোণে মিটিমিটি হাসি।
সেরাতে এবং পরের রাতে কড়ি ঘুমাতে পারেনি। ইমাদ তার করা অপরাধের চাক্ষুশ স্বাক্ষী৷ ধরা পড়ার ভয়ে, নিশ্চিত শাস্তি থেকে বাঁচতে প্রত্যক্ষ স্বাক্ষীর সাথে কোনোরকম ঝামেলায় সে যেতে চায়নি। সেইফ খেলতে চেয়েছে। কড়ি ইমাদকে ইমাদের জন্য সময় দেয়নি। সময় দিয়েছিল নিজের জন্য। ইমাদ তার গোপন কথা জানে। সে পালিয়েছিল, গয়না সমেত। প্রেমিকের সাথে। তার প্রেমিক ভেগেছিল গয়না সমেত তাকে ফেলে। তারপর ফিরে আসে কড়ি। ঘটনা ধামাচাপা দেয়। কোনোরকম বিপদে সে পড়তে চায় না। ইমাদ প্রত্যাখিত হয়ে তার সকল ঘটনা ফাঁস করে দিবে বলে একটা আশঙ্কা ছিল! কড়ি কাউকেই এখন আর বিশ্বাস করতে পারে না৷ বাসায় জানিয়ে দিলে সব শেষ হবে। তাই সরাসরি প্রত্যাখান না করে, ইমাদকে দিতে চেয়েছিল শুভঙ্করের ফাঁকি। কিন্তু ইমাদ তার দাবার চাল পাল্টে দিয়েছে। চারদিক থেকে রাণী ঘেরাও৷ এখন কেবল চেকম্যাট! কড়ি দি কুইন অব চেজ।
দেখা করার দিন রাণীরদীঘির দক্ষিণ পাড় কড়ি দাঁড়িয়েছিল। পরনে কালো সেলোয়ার-কামিজ। একটু পর পর কেমন ঠান্ডা একটা হাওয়া আসছিল বলে ওড়না দিয়ে কান পেঁচিয়ে রেখেছে। ইমাদ এলো হঠাৎ করে। রিকশা থেকে নামল না। রিকশায় বসেই বলল, “গয়না আনতে পারি নি। আপনার নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা।”
কড়ি তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলল, “সেদিন তো অন্যরকম কথা বলছিলেন।”
ইমাদ বলল, “কথায় চিড়া ভিজে না। ভালো থাকবেন।”
ইমাদের রিকশাটা হাওয়ার গতিতে এসে, ঝড়ের গতিতে চলে গেল। ইমাদ চলে যাবার পরেও কড়ি কতক্ষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেটা আবার কিছু করে ফেলবে না তো? না হাতের রগ কাটবে, গলায় দড়ি দিবে, ডিপ্রেশনে দরজা বন্ধ করবে এসব কিছুর কথা সে বলছে না৷ সে যে কিছু করার কথা ভাবছে সে কিছু হলো বাসায় কোনো খবর লিক করে দেয়া, তন্ময়কে কানপড়া দেয়া অথবা, অন্যভাবে কোনো সিনক্রিয়েট করা। এটা কি কোনো রকমের ব্যাকআপ প্ল্যান? কড়ি রাণীর দীঘির পাড় একটা জায়গা খুঁজে বসে ঠান্ডা মাথায় ভাবল কিছুক্ষণ। তারপর ইমাদকে কল করল। ইমাদ কল ধরছে না। নাহ এভাবে সে নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। সেদিন এক কথা বলল, আজ আরেক কথা! সেদিনের কথা শুনে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল ইমাদ গয়নার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। আজ এ কথা কেন? ঘটনা যাইহোক কড়ির সবটা জেনে রাখা ভালো। যেহেতু, ঘটনাটা তাকে নিয়েই। সে চট করে একটা রিকশা ঠিক করে ইমাদের মেসের দিকে রওনা হয়ে গেল। ইমাদ এখন মেসে আছে কিনা তা বলা যাচ্ছে না। তবে এখন না এলেও একটু পরে ত আসবে। তাকে পেতে হলে যেতে হবে ওখানেই।
মেসের গেটের মুখে মুবিনের সাথে কড়ির দেখা হয়ে গেল। কড়ি হেসে বলল, “হাই মুবিন। আমি কড়ি। চিনতে পেরেছ?”
মুবিন মহাবিরক্ত। কলে তাকে কড়ি মুবিন সাহেব বলছিলেন। আপনি করে বলছিলেন। এখন তুমি করে বলছে! সে কি অনুমতি দিয়েছে? না উনি অনুমতি নিয়েছেন? মুবিন কর্কশ গলায় জবাব দিলো, “না, চিনিনি।”
কড়ি বুঝল। তাই আর ঘাঁটাল না৷ বলল, “তোমার স্যার কোথায়? জরুরি বিষয়ে এসেছি।”
“আছে ঘরেই।” মুবিন চোখ উল্টে জবাব দিলো।
কড়ি ভেতরে চলে গেল। ইমাদের ঘরের দরজা খোলা। বাইরে থেকে ইমাদকে দেখা যাচ্ছে। একটা চেয়ার বসে আছে। হা়ঁটুর উপর কনুই রেখে দু’হাতে মুখ ঢাকা। কড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করল, “আসতে পারি?”
ইমাদ চমকে মুখ তুলল, “আপনি!”
ইমাদের চেয়েও বেশি চমকাল কড়ি, “আপনার কি হয়েছে? চেহারার অবস্থা এমন কেন? কোনো সমস্যা?”
ইমাদ রক্তবর্ণ চোখ দুটো সরিয়ে নিলো, “শরীর খারাপ।”
“নাকি মন খারাপ?”
“না।”
“আমার মনে হয় কিছু একটা হয়েছে৷ সেটা কি আমি কি জানতে পারি?”
ইমাদ চুপ করে রইল। কড়ি জেরা করল, “কি হলো কথা বলছেন না কেন?”
“কি বলব?”
“কি হয়েছে বলুন।”
“কিছু হয়নি।”
“আমি কি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব?”
ইমাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, “স্যরি। আসুন।”
কড়ি এসে চেয়ারটায় বসল। ইমাদ বসল খাটের এক কোনায়। ওর এলোমেলো চুল, একপাশে ইন খুলে যাওয়া শার্ট, রক্তবর্ণ চোখ সবকিছুই কোনোকিছুকে ইঙ্গিত করছে। সেটা কি? কড়ি ধরার চেষ্টা করছে। পারছে না। কড়ি প্রশ্ন করল, “এটা স্পষ্ট যে আপনি গয়না যোগাড় করতে পারেননি বলার জন্য নিশ্চয়ই আমার সাথে দেখা করতে চাননি। বরং যোগাড় করেছিলেন বা করতে পারবেন ভেবেই সেদিন ঐ কথা বলেছিলেন। আমাকে সত্যিটা বলুন।”
“হাতের মোয়া?”
“আমাকে সত্যিটা বলুন আমি চলে যাব।”
ইমাদ এক মিনিট চুপ থেকে বলল, “আমি একটা জিনিস বিক্রি করেছিলাম৷ ভেবেছিলাম ওটার দামে হয়ে যাবে।”
“তারপর?”
“হলো না।”
“কি বিক্রি করেছিলেন?”
“পাথরে খোদাই করা মূর্তি।”
কড়ি বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলল, “পাথরে খোদাই করা মূর্তি আপনি কোথায় পেলেন?”
“আমি বানিয়েছিলাম।”
“আপনি!”
ইমাদ চুপ করে রইল। কড়ি বলল, “দেখতে কেমন?”
ইমাদ ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল, “ছবি ডিলিট করে দিয়েছি।”
“কেন?”
“আমি দুঃখ পুষি না।”
“দুঃখ কি করেন?”
“ভুলে যাই।”
“যদি বিক্রি করে আপনার উদ্দেশ্য হাসিল না করতে পারেন তবে বিক্রি করলেন কেন?”
ইমাদ ঘরের একটা কোণে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। জায়গাটা ফাঁকা৷ কড়ি আরো কিছুক্ষণ বসে ছিল। তারপর একটা সময় উঠল। বলল, “যাচ্ছি। আমি বোধহয় আপনার সর্বনাশ করে ফেললাম।”
ইমাদ হাসার চেষ্টা করল। পারল না৷ কেবল বলল, “আপনি কিছু করেননি।”
“আই হোউপ সো।”
কড়ি চলে যাচ্ছিল। ইমাদ ভদ্রলোকের মত উঠে বলল চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। কড়ি বলল, “লাগবে না৷”
“রিকশা ঠিক করে দিচ্ছি৷ এ সময়ে রিকশা পাওয়া মুশকিল।”
ইমাদ দরজাটা ভেজিয়ে কড়ির সাথে বেরুচ্ছিল মুবিন হাজির হয়ে বলল, “ভেতরে যান কথা আছে।”
ইমাদ বলল, “ব্যস্ত আছি। পরে।”
মুবিন বলল, “আমাকে ব্যস্ততা দেখাবেন না। আপনার ভালোর জন্যে আপনাকে একটা গুরুতৃবপূর্ণ ইনফরমেশন দিতে এসেছি।”
ইমাদ বলল, “শুনতে চাচ্ছি না।”
“আপনার ঐ মূর্তিটার বিষয়ে।”
“কারো ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আঁড়ি পেতে কথা শুনতে নেই মুবিন।”
কড়ি থামাল, “কি বলতে চাইছে শুনুন না।’
ইমাদ বলল, “বললাম তো আমি ব্যস্ত।”
মুবিন কাঁধ ঝাঁকাল, “ঠিক আছে।”
ইমাদ কড়িকে একটা রিকশায় তুলে দিয়ে নিজেও বের হলো। মেসে ফিরল রাতে। এসে প্রচন্ড অবাক হলো। কারণ কড়ি এখনও এখানে। সে যায়নি৷ কড়ি বসেছিল মুবিনের সাথে, মুবিনের ঘরে৷ ইমাদকে দেখে বেরিয়ে এল। মনে মনে প্রচন্ড বিরক্ত হলো ইমাদ, “আপনি এখনও যাননি!”
“যাই নি। আপনার বন্ধু নিলয় কোথায়?”
“ও বাড়ি গেছে।”
“বাড়ি যায়নি। পালিয়েছে। রাসকেল।” মুবিন গাল বকল।
ইমাদ কড়া চোখে চেয়ে বলল, “মুবিন!”
কড়ি বলল, “মূর্তিটা নিলয় বিক্রি করে দিয়েছে।”
ইমাদ ছোট করে বলল, ‘আচ্ছা।”
“মুবিনের বাবার গার্লফ্রেন্ডের কাছে।”
“আচ্ছা।”
“মুবিন নিজ চোখে দেখেছে।”
“আচ্ছা।”
“মহিলার নাম মিশেল উড৷ উনি মূর্তিটা নিয়ে ফ্রাঞ্চে চলে গেছেন।”
“আচ্ছা।”
“নিলয়কে পঞ্চাশ লাখ টাকার চেক দিয়েছে।”
“আচ্ছা।”
“উনি ভেবেছেন মূর্তিটা নিলয়ের।”
“আচ্ছা।”
“মুবিন নিজ চোখে দেখেছে।”
“আচ্ছা।”
“মুবিনও ভেবেছে ঐ মূর্তি নিলয়ের।”
“আচ্ছা।”
এবার মুবিন বলল, “স্যারের বোধহয় বিশ্বাস হয়নি। আপনি স্যারের গার্লফ্রেন্ড হলে কি হয়েছে, ঐ নিলয় উনার বউ।”
কড়ি বলল, “হাসিও না মুবিন। বিষয়টা সিরিয়াস।”
“আমি কোনো জোকস বলিনি। ফ্যাক্ট বলেছি। আপনার আমার কথা বিশ্বাস করছে ভেবেছেন?”
ইমাদ বলল, “আর কিছু বলবেন?”
“হ্যাঁ, ওকে খুঁজে বের করার ব্যবস্থা করুন।”
“প্রয়োজন নেই।”
মুবিন চেঁচাল, “দেখলেন? উনি বিশ্বাস করেন নি।”
“মুবিন তুমি সত্যি বলছো তো?” কড়ির একটু সন্দেহ হলো।
মুবিন এইবার ক্ষেপল, “মিথ্যে বলে আমার লাভ?”
“কোনো প্রমাণ দিতে পারবে তোমার স্যারকে?”
“পারব। একশবার পারব৷ ঐ মহিলার সাথে যোগাযোগ করব। উনার মুখ থেকেই সব শুনে নিয়েন। উনি মিলাকে ঠিকানা দিয়ে গেছেন। আমি এখনই মিলার কাছ থেকে ঠিকানা নিচ্ছি।” মুবিন পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করছিল।
ইমাদ বলল, “লাগবে না।”
মুবিন গোঁ ধরল, “লাগবে।”
ইমাদ বলল, “আমি জানি তুমি সত্যি কথা বলছো।”
“আপনি জানেন না। আপনার কলিজার বন্ধু কত সাধু সেটা আমি আপনাকে দেখাব। ওয়াচ টাউয়ারে শয়তানটাকে ল্যাং মারায় তো খুব রাগ করেছিলেন।”
ইমাদ বলল, “দেখাতে হবে না। আমি আগেই দেখেছি।”
কড়ি অবাক, “দেখেছেন? কীভাবে?”
ইমাদ বলল, “মূর্তির দু চোখে দুটো ছোট্ট ক্যামেরা ফিট করা আছে। নিলয় সেটা জানতো না।”
মুবিন বিস্ফারিত চোখে চেয়ে বলল, “আপনি জানতেন?”
ইমাদ চুপ করে রইল। মুবিন চেঁচাল, “আপনি শয়তানটাকে হাতেনাতে ধরেননি কেন? শয়তানটা পালিয়েছে।”
কড়ি বলল, কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না মিশেল উডের কাছে নিলয় ওটা বিক্রি করল কি করে?
ইমাদ বলল, “মিশেল উড মুবিনের সাথে একদিন দেখা করতে এসেছিলেন। তখন আমাদের ঘরে মূর্তিটা দেখেছেন৷ মুবিনের সাথে সেদিন তাঁদের ঝামেলা হয়েছিল৷ পরে আরেকদিন উনি এসেছেন মূর্তিটার জন্য। আমি সেদিন ছিলাম না। নিলয় ছিল ঘরে। মূর্তি বিক্রি হবে কিনা জিজ্ঞেস করেছেন। ও বলেছে, পরে জানাবে। আমি আসার পর আমাকে জানায়। টাকার অ্যামাউন্টটা বলে৷ আমি রাজি হয়নি।”
“কেন?”
“বিক্রি করতে চাইনি।”
“পরে কখন ঠিক করলেন বিক্রি করবেন?”
“সেদিন রাতে।”
“যখন আমাকে বললেন গয়নার টাকা যোগাড় করতে পারবেন তখন?”
“হ্যাঁ।”
“আপনার কাছ থেকে না কিনে নিলয়ের কাছ থেকে কিনল কেন?”
“কারণ উনি জানতেন না মূর্তিটা কার।”
“আপনি কেন সরাসরি উনার সাথে যোগাযোগ করেননি?”
“কারণ আমি উনার কাছে বিক্রি করতে চাইনি।”
“আপনি কোথায় বিক্রি করছিলেন?”
“অন্য কোথাও। এটা কেনার আরো কয়েকটা অফার ছিল।”
“সেখানে আরো বেশি পেতেন?”
“না, কম আরো।”
“তাহলে?”
“ওতে আপনায় গয়না কেনার টাকা হয়ে যেত।”
“উনার কাছে কেন বিক্রি করতে চাননি?”
ইমাদ চুপ করে রইল। উত্তরটা দিলো মুবিন, বিস্ময়ে, “আপনি আমার জন্য উনার কাছে বিক্রি করতে রাজি হননি!”
ইমাদ তখনও চুপ।
“কেন?”
“কষ্ট পেতে।”
“আপনি অনেক টাকা পেতেন।”
মুবিন স্তব্ধ হয়ে রইল। পরে বলল, “আমি ঐ নিলয়কে খুঁজে বের করে জানে মেরে ফেলব।”
ইমাদ বলল, “অসম্ভব।”
কড়ি বলল, “খুঁজে বের করা সম্ভব।”
ইমাদ বলল, “আমি খুঁজব না।”
“কেন?”
“ভুলে যান।”
“এটা ছোট কোনো ইস্যু না। চাইলেই বাদ দেয়া যায় না।”
“ইস্যুটা আমার আর আমার বন্ধুর।”
“বন্ধু! ও আপনার বন্ধু! এখনও বন্ধু বলছেন?” কড়ি অবাক।
মুবিন বলল, “আপনাকে পাগলাগারদে আর আপনার বন্ধুকে পুলিশে দেয়া উচিত।”
“তোমাদের কি সমস্যা মুবিন? বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত৷ আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে আমি তোমাদের হস্তক্ষেপ পছন্দ করব না।”
মুবিন বলল, “উনি আপনার গার্লফ্রেন্ড। উনি অবশ্যই কথা বলবেন।”
কড়ি বলল, “মুবিন আপনার স্টুডেন্ট। ওরও উচিত আপনার জন্য চেষ্টা করা। এটা একটা গুরুদক্ষিণা হতে পারে।”
ইমাদ বলল, “না আপনি আমার গার্লফ্রেন্ড, না মুবিন আমার স্টুডেন্ট। মুবিন কখনও আমাকে টিচার ভাবেনি। আপনিও কখনও আমাকে নিয়ে অন্যভাবে ভাবেননি। ওর কোনো বিষয়ে আমাকে নাক গলাতে দেয়নি। বলো মুবিন দিয়েছো? না আমি হস্তক্ষেপ করেছি? ও আমাকে টিচার হিসেবে গণ্য করে না।”
মুবিন বলল, “আপনার গার্লফ্রেন্ডের কথা শুনোন।”
ইমাদ বলল, “আমাদের মাঝে কিছু নেই।”
মুবিন বলল, “আপনাদের ব্রেকআপ?”
ইমাদ আর একটা কথাও না বলে নিজের ঘরে গিয়ে ওদের মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দিলো। কড়ি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। সে মুবিনের দিকে একবার তাকাল। মুবিনের চোখ মুখ রাগে লাল। হাতের পেশি শক্ত হয়ে আছে। সে বলল, “তোমার স্যারকে তোমার কেমন লাগে, মুবিন?”
“আমার কাউকেই ভালো লাগে না।”
“ইমাদকে খারাপ লাগে?”
“না।”
“মুবিন সাহেব আপনার কি মনে হয়? আপনার স্যারের সাথে আমার প্যাচআপ করে ফেলা উচিত?”
“কোনো হাফ মেন্টাল মেয়েই হবে যে সুযোগ হাতছাড়া করবে।”
“ক্যান ইউ গিভ মি লজিকস?”
“স্যার কখনো ঝগড়া করবে না। ঝগড়া একটা ফ্যামিলিতে অনেক বড় ইস্যু। ছেলেমেয়েরা অনেক চাপে থাকে। স্যারের সাথে ঝগড়া করা ইম্পসিবল। আমি যেহেতু পারিনি জগতের কেউই পারবে না। স্যারের বউ যত যাই বলুক স্যার বলবেন আচ্ছা। ঝগড়া হবে কি করে?”
“সব মেনে নিয়ে তো আচ্ছা বলে না।”
“হ্যা, করবে যেটা উনার ইচ্ছা সেটাই। তবে নিজের পার্টনারকেও ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে দিবে। সহ্য ক্ষমতা ভালো। ঠান্ডা মাথার মানুষ। পরোপকারী। অন্যের কথা ভাবে খুব। প্রায়োরিটি নিজে না৷ তাঁর প্রায়োরিটি ফ্যামিলি, পার্টনার, ফ্রেন্ডস। আর ক্যারেকটার ভালো। ম্যাসেজের বিষয়টা একতরফা। স্যার ওসবে জড়িত না। আমার বোনকে পড়িয়েছে, আমি এদিকটা খেয়াল করেছি। আত্মসম্মানবোধ আছে৷ ট্যালেন্ট আছে, পড়াশুনা আছে, পটেনশিয়াল আছে। ফ্যামিলি কেমন জানি না। তবে স্যার জোস।”
“সব পজিটিভ বললে। নেগেটিভ বলো।”
মুবিন সোজাসুজি বলল, “বলব না।”
“কেন? তোমার স্যার কি একশোতে একশো?”
মুবিন ফিচেল হেসে বলল, “আপনি একশোতে একশো?”
কড়িও হাসল, “তোমার স্যারেরটা জানি না৷ তবে তোমাকে যে বিয়ে করবে তার খবর হবে।”
মুবিন চোখ উল্টে বলল, “হোয়াটএভার।”
.
মানুষের জীবনে কখনো কখনো এমন রাত আসে যে রাতে ঘুম আসে না, প্রেমিকা কথা বন্ধ করে দেয়, প্রেমিক প্রেম ভুলে যায়৷ মানুষের জীবনে এমন অনেক ভালোবাসা আসে যেসব ভালোবাসা রাতের পর রাত সৃষ্টিকর্তার কাছে কেঁদেও হারিয়ে ফেলতে হয় অথবা, কখনও পাওয়াই হয় না। আবার কখনও কখনও এমন রাত আসে যেখানে ভালোবাসা যেন না আসে আমরা নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে প্রার্থনা করি। জীবনে আর প্রেম না আসুক। যাকে ভালো লাগে তার চেহারাও দেখতে চাই না। আমরা আর ভালোবাসা চাই না। কেবল চাই একটু শান্তি। যে ভালোবাসা ভালোবাসা করে পাগল করে দেয় তার কাছ থেকে দূরে চলে যাই। এই প্রার্থনাও কাজে আসে না। আমরা আবার প্রেমে পড়ি। ভালোবাসার দিকে হেঁটে যাই। সৃষ্টিকর্তা কেন আমাদের প্রার্থনার উল্টোটাই করেন, কড়ি বুঝে পায় না। খুব ভোরে নাস্তার টেবিলে গিয়ে সে খুব সহজ গলায় বলল, “আমার একজনকে পছন্দ হয়েছে। তাকে বিয়ে করতে চাই।”
কাদের সাহেব থতমত খেয়ে গেলেন। রিমা নড়েচড়ে বসল। কায়েস বলল, “তুই প্রেম করিস!”
কাদিনের গুরুগম্ভীর জিজ্ঞাসা, “কবে থেকে?”
কাইয়ূম প্রশ্ন করল, “কাকে?”
কড়ি জবাব দিলো দাঁড়িয়ে থেকেই, “ইমাদকে। তবে প্রেম না।”
“দীপার বন্ধু ইমাদ?” কাদিনের চোখেমুখে বিস্ময়। কড়ি বলল, “হ্যাঁ।”
রিমা একটু কড়া গলায় বলল, “এসব কখন হলো?”
“গতকাল সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
“গতকাল কি এমন হয়েছে?”
“ইমাদের ব্যক্তিগত বিষয়। বলা যাচ্ছে না।”
“সিমপ্যাথি!” কায়েস ফোঁড়ন কাটল।
“রেসপেক্ট।” কড়ির জবাব।
“তুই কি আমাদের ডিসিশন জানাতে এসেছিস?” কাইয়ূম গমগমে গলায় বলল।
কড়ি বলল, “আমার পছন্দ জানালাম।”
“দুটোর মাঝে পার্থক্য কোথায়, কড়ি?” কাদের সাহেব প্রশ্ন করলেন।
কড়ি চুপ করে রইল। কাদের সাহেব আবার বললেন, “ছেলে কি করে?”
“আমি ওকে একদিন আসতে বলব। তুমি সরাসরি কথা বলো।”
একেকজন নাশতা না করেই উঠে চলে যাচ্ছিল। কারো মনে ক্রোধ, কারো দুশ্চিন্তা, কারো বিস্ময়। কড়ি ওদের থামাল, “কথা শেষ করে যাও তোমরা।”
কাদিন ধমকে উঠল, “কথা বলার মত কোনো জায়গা রেখেছিস তুই? তন্ময়ের চাইতে ইমাদকে বেশি পছন্দ হলো তোর?”
কড়ি অকপটে স্বীকার করল, “হ্যাঁ।”
“দীপা জানতো এসব?”
কড়ি বলল, “জানে না। জানলে খুশি হবে।”
কায়েস মুখ বিকৃত করে বলল, “পছন্দ করেছে! প্রেম করেনি! শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায়?”
কাইয়ূম বলল, “মিথ্যে কথা কেন বলছিস? প্রেম তুই করিসনি?”
কড়ি কম্পিত গলায় বলল, “করেছি। তবে ইমাদের সঙ্গে না। তোমরা একটু শান্ত হয়ে বসো। তোমাদের সবকিছু বলছি।”
সবকটা চোখ বিস্ময়ে দিশেহারা। কড়ি জানে এখন সে যা যা বলতে যাচ্ছে তা শুনে এই চোখগুলো ক্রোধে লাল হবে।
তবু সে বলবে। আজ সে সব বলবে। কেন বলবে? ইমাদের জন্য? বোধহয়। ইমাদকে বিয়ে করতে চাইলে সবাইকে সত্য বলে, প্রায়শ্চিত্ত করেই সে বিয়ে করবে। আর কোনো মিথ্যে নয়। কড়ি বলল। সেই প্রেমিক, পালানো, গয়না, কিছুই বাদ দিলো না।
.
দীপা প্রতিদিন বিছানার চাদর, বালিশের কভার পাল্টায়। বুয়ার ঝাড়ু দিয়ে যাওয়া ঘর আবার ঝাড়ু দেয়, নিজের কাপড় নিজে ধোয়, বুয়ার রান্না করা খাবার খাবে না বলে নিজে রাঁধে। একই প্লেট, গ্লাস হাজারবার ধুতে থাকে। এসব দেখে দীপার মায়ের বিপি হাই। ভাই ডেকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি পাগল হয়ে যাওনি তো?”
দীপা বলে, “আমি তো পাগল’ই।”
“স্যরি আপু।”
দীপা একটু অবাক হয়ে বলে, “কেন?”
“সেদিন তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছি খুব।”
“কিচ্ছু হবে না।”
“তোমার খারাপ লাগে না?”
“লাগে। কিন্তু যখন তোরা আমায় বকিস তখন খারাপ লাগে না।”
“তাহলে?”
“তোদের বারবার বিরক্ত করি তাই খারাপ লাগে। আই অ্যাম আ ম্যাস।”
“তুমিও এতটাও বিরক্ত করো না। স্যরি আপু। তুমি এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন?”
“কেমন হয়ে যাচ্ছি?”
“দাদী নানীদের মত শুচিবায়ুগ্রস্ত!”
“শুচিবাই না, ভালেবাসাবাই।”
“অ্যাহ!”
দীপা হকচকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে হাসে। বিস্মিত হয়। ওর কোনো শুচিবাই নেই। ওর হলো ভালোবাসার বাই। কাদিনকে সারাক্ষণ কাছে চায়, কাদিন এলে তাড়ায়, চলে গেলে তড়পায়। তাই আশেপাশে কাদিনের মত একটা পরিবেশ তৈরী করে রাখে সবসময় ইচ্ছে করেই। তাতে কাদিনের একটা ইলিউশন তৈরী হয়। মনে হয় এই তো কাদিন এখানেই, আছে আশেপাশেই। আরো নানাবিধ এমন কাজ সে করতেই থাকে। কিছু সবার চোখে পড়ে, কিছু পড়ে না। মেহেদীর ডাকে দীপা সম্বিৎ ফিরে পেল।
“কি হলো? কোথায় হারালে আপু?”
দীপা ডানে বায়ে মাথা নাড়ে, “কিছু না।”
সে নিয়ম করে প্রতিদিন একবার বিয়ের অ্যালবাম নিয়ে বসে। মেহেদী উঠে গেলেই সে বিয়ের অ্যালবাম নিয়ে বসবে। বিয়ের ছবি দেখতে ওর ভালো লাগে। আমরা যখন ভালোবাসি, তখন সারাক্ষণ ভাসার মানুষকে নিজের আশেপাশে বন্দী করে রাখতে চাই। নতুবা, নিজেরাই কয়েদী হয়ে যাই। কাদিনকে বন্দী করতে সে কখনই পারবে না। তাই নিজেই কাদিনের কয়েদী হয়ে আশেপাশে একটা জেলখানা বানায়। যে জেলখানায় সবসময় গুছানো থাকতে হয়। বারবার পরিস্কার জিনিসকে আবার পরিস্কার করতে হয়। সবসময় অন্যরা কি ভাবল তা নিয়ে তটস্থ থাকতে হয়। একটুও ভুল করা যায় না।
একটু পরই কাদিনের কলটা এলো। দীপা ধরল না। কাদিনের কল দীপা ধরে না।
কলিংবেল পাখির শিষ দেয়। কাদিন চলে আসে। মেহেদী হেসে সম্ভাষণ জানাল, “আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছেন?”
কাদিন কোনো খুব ঠান্ডা গলায় বলল, “ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
মেহেদী বলল, “ভাইয়া আপনি বসেন। মা আমাকে ডাকছেন। আমি যাই।”
মেহেদী চলে গেলে কাদিন বলল, “কড়ি ইমাদকে বিয়ে করতে চায়।”
“কিহ্!” দীপা আকাশ থেকে পড়ল। কাদিন প্রশ্ন করল, “ তুমি কড়ির ব্যাপারে সব জানতে?”
দীপা একটু ভড়কাল, “কোন ব্যাপার?”
“আমি কোন ব্যাপারে বলছি তুমি খুব ভালো করেই জানো।”
“না আমি বুঝতে পারছি না।
“কড়ি যার সাথে প্রেম করেছে সে ইমাদ না৷ অন্য কেউ। সে বাসা থেকে পালিয়েছিল। তোমার ভাগের গয়না তোমাকে বুঝিয়েও দিয়েছে। গয়না চুরি হয়নি। কিছু তোমার কাছে আছে। কিছু কড়ির কাছে আর কিছু কড়ির ওই প্রতারক প্রেমিক নিয়ে পালিয়েছে।”
দীপা আতঙ্কে নীল হয়ে গেল। কি বলবে ভেবে পেল না। কাদিন কাছে এসে কড়া চোখে দীপার দিকে তাকাল, আর কি কি লুকিয়েছ তুমি?”
দীপা বলল, “কড়ির গোপন কথা তোমাকে আমি কীভাবে বলব?”
“তোমাকে যেমন ভাবতাম তুমি তেমন না। তোমাকে আমি চিনতে পারিনি।”
“রাগ করো না, প্লিজ।” দীপা ভয়ে ভয়ে কাদিনের হাত ধরল।
কাদিন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “তুমি এত সহজ না। সত্যি কথা বলো। আর কি কি গোপন করেছো?”
দীপা বলল, “আর কি বলব?”
“তুমি আর কিছু লুকাওনি?”
দীপা ঢোক গিলে বলল, “না।”
“শিউর?”
দীপা বুঝতে পারছে না কি বলবে। কি করা উচিত। সে আকাশ পাতাল ভাবতে লাগল। কাদিন বলল, “চুপ করে থাকবে না। কথা বলো।”
“কিছু লুকাই নি।”
দীপার নীরবতা ও চোখমুখ দেখেই কাদিন স্পষ্ট টের পেয়েছে দীপা আরো অনেককিছু গোপন করেছে। সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “বিয়ের আগের তোমার প্রেম, কড়ির প্রেম, কড়ির পালিয়ে যাওয়া, গয়না লুকিয়ে নিজের কাছে রাখা আর কত দীপা? আর কত? তোমার আর একটাও মিথ্যে আমি অন্যের মুখ থেকে শুনলে, কোনোদিন তোমার চেহারা দেখতে ইচ্ছে করবে না।”
দীপা এবার কেঁদে ফেলল, “তুমি এমন করছো কেন আমার সাথে?”
কাদিন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। সে হাত দিয়ে সাইড টেবিলে রাখা টেবিল ল্যাম্প ফেলে দিয়ে বলল, “একদম ভিক্টিম প্লে করবে না। উল্টো কথা বলবে না।”
ল্যাম্পটা পড়ে ভেঙে যেতেই কাদিন নিজেকে সংযত করে ফেলল। ঝুঁকে ল্যাম্পটা তুলে টেবিলে রেখে বলল, “তোমার কাছ থেকে আমি বারবার ডিজাপয়েন্টেড হই। কড়ি, তুমি তোমরা দুজনেই প্রতারণা করেছো।”
দীপা বলল, “এভাবে বলো না। বিশ্বাস করো..”
কাদিন থামিয়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে আমি আর বিশ্বাস করতে পারব বলে মনে হয় না।”
কাদিন ভাঙা ল্যাম্পটা হাতে নিয়ে বের হয়ে গেল, “ঠিক করে পাঠিয়ে দিবো।”
“শুনো কাদিন তুমি বসো। মাথা ঠান্ডা করো। বাসায় কি হয়েছে আমাকে একটু বলো।”
কাদিন আর একটা কথাও বলল না৷ দীপার কথা শুনলও না। ভয়াবহ অন্ধকার চেহারা করে যাওয়ার আগে শাশুড়ির ঘরে গিয়ে বলে এলো, “মেহেদীকে একবার পাঠাতে পারবেন বিকেলে? আমার হাত থেকে পড়ে গিয়ে ল্যাম্পটা নষ্ট হয়েছে। ঠিক করে দিব।”
দীপার মা বললেন, “তোমার ঠিক করতে হবে না বাবা। এটা রাখো। তোমার জন্য খাবার বেড়েছি। তুমি হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হও।”
“কাজ আছে।” কাদিন চলে গেল। দীপা ইমাদকে কল করল। কি হয়েছে জানার জন্য। ইমাদ সব শুনে হতবাক। সে এখনও জানেই না কড়ি তাকে বিয়ে করতে চায়। বাসায় সবার সাথে তার জন্য যুদ্ধ করছে কড়ি। ইমাদ বলল, “তুই রাগ করেছিস, দীপু?”
দীপা বলল, “না আমি না। রাগ হয়েছে কাদিন। আমি কেন রাগ করব?”
“কড়ির আর আমার বিষয়টা নিয়ে?”
“আমি খুব খুশি, ইমাদ। তুই কেন রাগ করার কথা বলছিস আমি সেটাই বুঝতে পারছি না।”
“কড়িকে পছন্দ করি তোকে যে জানাইনি।”
“বলে কি! ধুর আমি কবে এত প্যাঁচ ধরতে শিখলাম? আমি এত প্যাচ বুঝি?”
“নিলয়ও জানতো। তোকে জানাইনি কষ্ট পাস নি?”
“আরে না। তুই আর কড়ি একসাথে আমি তো ভাবতেই খুশিতে পাগল। তোদের কি যে মানাবে। মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ।”
“আমার জন্য তোর শ্বশুরবাড়িতে না কোনো সমস্যা হয়। কাদিন ভাইয়া আর তোর মাঝে ঝামেলা হোক চাই না।”
“আমার কথা বাদ দে আমার জীবনটাই ঝামেলা।”
ইমাদ বাদ দিলো নিলয়ের কথাটাও। সে দীপুকে পর্যন্ত বলে নি। ভালোবাসা হারানোর চেয়ে বন্ধু হারানোর ক্ষত অনেক বেশি। সে চায় না নিলয়কে কেউ চোর বলুক। ভালোবাসো চলে গেলে আত্মসম্মানে লাগে, আর বন্ধু গেলে বুকে লাগে।
#একা_তারা_গুনতে_নেই
— লামইয়া চৌধুরী
শেষ পর্ব : বাকি অংশ।
দীপা একবার ভাবলো ঐ বাসায় যাবে। বাসার অবস্থা কি, কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সবাই কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করছে। সবাই ঠিক আছে তো? কড়িকে কয়েকবার করে কল করেছে। কড়ির মোবাইল সুইচড অফ। কাদিনকে কল করেছে। কাদিন কল ধরেনি। রিমা আপু কিংবা বাসার অন্য কাউকে কল করবার সাহস দীপার নেই। দুদিন ধরে পাগলের মতো কি করবে ভেবেছে সে। এত বড় একটা ঘটনায় সে যুক্ত। প্রথম থেকেই সব জানতো অথচ, গোপন করে রেখেছে। কি জবাব দিবে ওদের? রিমাই ফোন করলো তাকে। রিমার কাছ থেকে বাসার গুমোট পরিস্থিতি জেনে খুব কষ্ট হলো দীপার। বাবা কড়ির সাথে কথা বলা বন্ধ দিয়েছেন। কাইয়ূম, কাদিন, কায়েস কড়িকে উঠতে বসতে কঠিন কঠিন কথা শুনাচ্ছে। রিমা নিজেও রাগ। রিমা দীপাকে বলল, “কাদিন সবচেয়ে বেশি ক্ষেপেছে। তোমার উপরেও ক্ষ্যাপা। আর ওখানে পড়ে থেকো না। যা হওয়ার হয়েছে, চলে এসো।”
দীপা বলল, “আমি আসতে পারব না, আপু।”
“কেন আসতে পারবে না?”
“আপনাকে বলতে পারব না।”
“আমাকে কিছু বলো আর না বলো, কাদিনের কাছ থেকে আর কিছু লুকিয়ো না তুমি। ও খুব জটিল। আর যা যা লুকিয়েছো বলে দিও।”
টেবিল ল্যাম্পটা ঠিক করে কাদিন নিজেই ফেরত দিতে এলো। যেহেতু সে ভেঙেছে, তারই এটা ঠিক করা দিয়ে যাওয়া উচিত। সামজিকতা তার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। দীপার মা জোর করে তাকে খেতে বসালেন। ভদ্রতার কারণে কাদিনকে বসতে হলো। কোনোমতে দু লোকমা মুখে নিয়ে সে উঠল। খাওয়া শেষে বেসিনে হাত ধোয়ার সময় দীপা বলল, “কড়িকে মাফ করে দাও।”
কাদিন বলল, “লজ্জা থাকলে এ কথা বলতে না। নিজেকে নিজের কাছে ছোট মনে হচ্ছে। তোমরা দুজনেই আমাকে ঠকিয়েছ। আমার বোন, বউ দুজনেই আমাকে বোকা বানিয়েছে।”
দীপা বলল, “তুমি কি কখনই আর আমাদের বিশ্বাস করবে না?”
কাদিন মুখের উপর বলল, “না। তুমি আমার কাছে আরো অনেককিছুই লুকিয়েছ, লুকাবে। তোমাকে আমার চেনা হয়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম তোমার মনে যা, মুখেও তা। ঘটনা কিন্তু তা না।”
“ঘটনা কি?”
“ঘটনা হলো আমি একটা ইডিয়ট। আর কিছু না।”
দীপা কান্নার দলা গলায় আটকে বলল, “তোমাকে কখনো বলতে চাইনি। আজ বলব। জানি শোনার পর যেটুকু বিশ্বাস বাকি আছে সেটুকুও আর থাকবে না। তবু বলে দিয়ে শেষ করি। তোমাকে ইডিয়ট ভেবে কোনোকিছু লুকাইনি। আমি ননসেন্স তাই আমার কান্ডকীর্তি তোমাকে বলতে চাই না।”
কাদিনের ভ্রু কুঁচকাল, “কি বলতে চাইছো?”
“ঘরে এসো।”
দীপা চোখে মুখে কান্না নিয়ে ঘরের দিকে গেল। কাদিনও পেছন পেছন গেল। দীপা দরজা বন্ধ করে এক নিশ্বাসে
বলল, “তোমার বন্ধু তাহমিদ আমার এক্স। ও আমাকে ডিচ করে। কড়ি এটা জানতো। বলতে নিষেধ করেছিল।”
কাদিন কতক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো। সে যা শুনছে সত্যিই দীপা তা বলছে তো? দীপা বলল, “কিছু বলবে?”
কাদিন বলল, “আর কি লুকিয়েছো?”
“তাহমিদ একদিন তোমার সাথে দেখা করতে বাসায় এসেছিলো। তুমি ছিলে না।”
“তারপর?”
“আমাকে সুযোগে কিছু কথা বলেছে।”
“কি কথা?”
“ছোটবেলা থেকেই তুমি ওর থেকে, সবার থেকে সবকিছুতে এগিয়ে ছিলে। পড়াশুনা, রেজাল্ট, গুড ইমেজ, চাকুরী। শেষ বেলায় এসে আমাকে বিয়ে করে ঠকে গেলে। যে মেয়েকে ও বিয়ে করতে রাজি হয়নি, সে মেয়েকে শেষ পর্যন্ত তোমার বিয়ে করতে হলো।”
“কবে বলেছে?”
দীপা তারিখ বলল। কাদিন মিলিয়ে দেখলো সেদিনই দীপা অন্য একটা ঝগড়ার ছুঁতোয় রাগ করে চলে এসেছে। কাদিন সাথে সাথে পকেট থেকে মোবাইল বের করল। দীপা বলল, “কাকে কল করছো তুমি?”
কাদিন বলল, “বোন, বউ, বন্ধু সবাই মিলে আমার সাথে কানামাছি খেললে। তোমাদের ধরেছি, তাহমিদকে ধরব না?”
তাহমিদ কল রিসিভ করল, “আরে বন্ধু কেমন আছিস তুই?”
কাদিন বলল, “ছোটবেলা থেকেই তুই আমার মত হতে চাইতিস। তোর সব জিনিস কেবল আমার হয়ে যায় চেয়েও কখনো কিছুই অর্জন করতে পারিস না। একাডেমিকালি, ফিনানশিয়ালি, গুড ইমেজ সবকিছুতে তুই আমার সাথে অযথা টক্কর দিতিস এবং
সব কিছুতে পিছিয়ে ছিলি। সব সময় তোর মাঝে ইনফিরিউরিটি কমপ্লেক্স কাজ করতো। তুই হীনমন্যতায় ভুগেছিস। আমাকে হিংসে করেছিস। রেজাল্ট, পড়াশোনা, চাকুরী সব আমার মত চাইতিস। যে অফিসে এখন চাকুরি করছি এখানেও দুজনে মিলে একসাথে ইন্টারভিউ দিলাম। আমার হলো, তোর হলো না। সবসময় আমার সাথে প্রতিযোগিতা করিস। আমি কখনো তোর সাথে প্রতিযোগিতায় নামিনি। আমার সাথে তোর কম্পিটিশনটা আমি বুঝি। কিন্তু কম্পিটিশনের দরকারটা কি আমি আজো বুঝিনি। তোর মত করে ভাবতে পারি না আমি। আমি কখনো তোর মত ভাববোও না, তোর মত হবোও না।
আর তুই চাইলেও আমার মত হতে পারবি না। আমার সাথে প্রতিযোগিতা করিস না, তাহমিদ। সবসময়ের মত হারবি। আজও তুই হারলি। দীপা তোর গার্লফ্রেন্ড ছিল। অথচ, দীপাকে বিয়ে করে ফেললাম আমি। দীপা তোর পিছনে পাগল ছিল। আমাকে পেয়ে তোকে ভুলেই গেল। তাই খুব লাগছে তাইনা? যার মত তুই আজীবন হতে চেয়েছিস, নকল করেছিস, হিংসে করেছিস, পেছনে পেছনে শত্রুতা করেছিস দীপা তাকেই বিয়ে করে ফেলল। যে দীপাকে তুই বিয়ে করিসনি তার বর আসলে তোর আইডল। একদিকে বুকে ছুড়ি বসল। যে বন্ধু সবসময় তোর থেকে সবকিছুতে এগিয়ে সে বন্ধু শেষ পর্যন্ত তোর গার্লফ্রেন্ডকেও বিয়ে করে নিলো। দীপাকেও রাখতে পারলি না। আরেকদিকে পিঠে তীর। দুদিকেই জ্বলছিস। তোর বুকে এখন শিখা অনিবার্ণ। বৃত্তি, চাকুরী, দীপা সব আমার। তুই আজীবন আমার মত হতে চেয়েছিস কিন্তু কখনো পারিস নি, পারবিও না। তোর দ্বারা আমার মত হওয়া সম্ভব না। যা তোর দ্বারা সম্ভব না তা কেন করতে চাস?”
তাহমিদ বলল, “অহঙ্কার করছিস?”
কাদিন হাসলো, “আমি কখনো অহঙ্কার করিনি। আজ করছি। দীপার মত এত লয়্যাল একটা মেয়েকে আল্লাহ তোর ঝুলি থেকে তুলে এনে আমার করে দিয়েছে। তুই দীপাকে যা বলেছিস, করেছিস সবটাই করেছিস হিংসায়। হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। এজন্যই তোর দ্বারা কখনো ভালো কিছু হয় না। তুই জীবনে কিছুই করতে পারিসনি।”
তাহমিদ বলল, “দীপার মত আহাম্মককে আমি ছুঁড়ে ফেলেছি। তুই টোকাইয়ের মত ঘরে তুলেছিস।”
কাদিন জবাবটা দিলো তীরের ফলার মত,
“দীপা হাই মেনটেনেন্স। তোর মত আহাম্মকের দ্বারা সামলানো সম্ভব না। দীপাকে সামালাতে নিজে আহাম্মক হলে হয় না। বুদ্ধি লাগে। দীপার মত ব্র্যান্ড কেবল আমাকেই মানায়। তোর সাধ্যের বাইরে, ব্রো।” বলতে বলতেই কাদিন দীপাকে কাছে টেনে নিজের বাহুডোরে নিয়ে নিলো। যেন তাহমিদ ফোনের ওপাশেই দেখতে পাচ্ছে। বউকে নিয়ে খুব প্রাউড কাদিন।
তাহমিদ বলল, “আমি ভালো বলেই তোকে দীপার আর আমার পুরোনো প্রেম নিয়ে কিছু জানাইনি। আন্দাজ করছি দীপার কাছে থেকেই জেনেছিস। দীপা তোর কাছে ইনোসেন্ট সাজতে চায়। আজ বুঝতে পারলাম যতটা ইনোসেন্ট ওকে ভাবতাম ততটা ইনোসেন্ট ও না। তুইও একদিন বুঝবি।”
কাদিন দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “তোকে আমি ল্যাংটাকাল থেকে চিনি। তুই আমার বন্ধু। হাজারটা মেয়েকে তুই ঘুরিয়েছিস। হাজারটা মেয়েকে তুই নিজের ইশারায় নাচিয়েছিস, কষ্ট দিয়েছিস। অনেক না করেছি, বুঝিয়েছি। শুনিস নি। কখনো কারো সাথে সিরিয়াস হোসনি। তুই যদি পারতিস, দীপার নামে আমার কাছে অবশ্যই, অবশ্যই
উল্টাপাল্টা বদনাম করতিস। তুই এসব করিসনি কারণ জানিস আমি বিশ্বাস করব না। আমি তোকে হাড়ে হাড়ে চিনি। কত কত মেয়েকে কষ্ট দিয়েছিস আমি জানি। আমাকে বলে লাভ হবে না, তাই দীপাকে ফালতু, হাস্যকর একটা কথা বলে আমাদের মাঝে দূরত্ব তৈরী করার চেষ্টা করেছিস। হিংসায় জলে পুড়ে শয়তানি করেছিস। তুই যে আমার হিংসা করতিস ছোটবেলা থেকেই বুঝতাম। বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকতাম। তোকে আমি বারবার ক্ষমা করেছি। তবু নানান ভাবে, নানান সময়ে তুই আমার সাথে শত্রুতা করেছিস। অযথা, ভালো সাজার চেষ্টা করিস না। আমি দীপা না যে, তুই যা বলবি ওটা শুনেই প্রভাবিত হয়ে যাব৷ আমি কাদিন। আমার সাথে ভেবেচিন্তে, হিসেব করে কথা বলবি। আমি তোর পালস ওঠানামাও ধরতে পারি। আর কোনোদিন আমার সামনে আসবি না। তোকে চোখের সামনেও দেখতে চাই না।”
তাহমিদ বলল, “আমিও।” তারপর রাগে কলটা কেটে দিলো। মেবাইলে রেখে কাদিন এবার দীপার উপর ক্ষ্যাপল, “তুমি এ কারণে চলে এসেছো? এজন্যই তো আমি মিলাতে পারি না। তোমাকে কতবার৷ কতকিছু বকেছি, কত দোষ ধরেছি তুমি রাগ করোনি। তাহমিদের একটা কথায় চলে এলে? ওর কথায় উঠবস চলবে না।”
“ও বলেছে তোমার জন্য নাকি ওর আফসোস হয়। আমাকে বিয়ে করে তুমি ঠকেছো।”
কাদিন বলল, “ওর মাথা আর তোমার মুন্ডু। তোমাকে বিয়ে করে আমি জিতেছি।”
দীপা মুখ ঘুরিয়ে কান্না করে দিলো, “মিথ্যে কথা।”
কাদিন দীপার চিবুক ধরে নিজের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে বলল, “ব্যাগ গুছাও।”
দীপা বলল, “না, আমি যাব না। ইউ ডিজার্ভ বেটার।”
কাদিন দীপার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, “আই স্যুয়ের, ইউ আর দ্যা বেস্ট অ্যাওয়ার্ড। অ্যান এবসিলিউট ট্র্যাজার। প্লিজ ব্যাগ গুছাও।”
দীপা নিজেকে কাদিনের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “একটু বসো।”
তারপর লাগেজ বের করল। আলমারি থেকে কাপড় বের করতে গিয়ে ভাঁজ করা কাপড় এলোমেলো করে ফেলল। সব নীচে পড়ে গেল। দুহাতে যতটুকু সম্ভব কাপড় আগলে ধরে তুলতে তুলতে কাদিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “স্যরি, স্যরি আমি ঠিক করে নিচ্ছি।”
কাদিন এগিয়ে এসে দীপার হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে বলল, “তুমি বসো। আমি ভাঁজ করছি।”
দীপা বলল, “না, না আমি পারব। আমি পারি।”
কাদিন বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে তুমি পারো। কিন্তু বসো চুপচাপ। আমি করছি।”
দীপাকে কাদিন জোর করে টেনে বসিয়ে রেখে নিজে কাপড় ভাঁজ করে করে সুন্দর করে লাগেজ গোছাচ্ছে। দীপা লাফিয়ে উঠে বলল, “ধুর, আমাকে তো ধরতেই দিচ্ছে না। আমি তাহলে তোমার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে আসি।”
কাদিন বলতে যাচ্ছিলো, “আচ্ছা।”
কিন্তু দীপা বলতে আর দিলো কই? তার আগেই বাচ্চাদের মত একটা দৌড় দিলো রান্নাঘরের দিকে। কাদিন প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও শেষে সেদিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। সে ঠিক করেছে, দীপাকে গুছালো হতে হবে না। সে নিজে সব গুছিয়ে রাখবে। দীপাকে টিভির শব্দ কমাতে হবে না। সে কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে ঘুমাব। কাপড় বদলাবার আগে দীপার ঘরের পর্দা টানার কথা মনে রাখতে হবে না। সেই টেনে দিবি। বিড়বিড় করল সে, “দীপা তুমি অগোছালোই সুন্দর।”
.
এসএসসি পরীক্ষা শেষ হবার পর থেকেই মিলা ইন্টারের পড়াশুনা শুরু করে দিয়েছে। ধুমসে পড়ছে। একটা কোচিংয়েও ভর্তি হয়ে গেছে। সেই কোচিংয়ে অভ্রও পড়ে। অভ্র একদিন এসে বলল, “আমাকে ভেক্টর বুঝিয়ে দিয়ো তো।”
মিলা বলল, “তার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো পারো।”
অভ্র বলল, “তোমার মত পারি না।”
“সবসময় তো আমার চেয়ে বেশি নম্বর পাও।”
“তুমি বুঝিয়ে দাও বলেই পড়তে সহজ হয়। ভালো করি।”
মিলা বলল, “দেখো, তুমি যা চাইছো তা হবে না।”
“আমি আবার কি চাইলাম?” অভ্র চোখ বড় বড় করে খুব অবাক হবার ভান করল।
মিলা সুন্দর করে বলল, “তুমি কি চাইছে সেটা খুব ভালো করেই জানো। অযথা আমার কাছে পড়া বুঝতে আসবে না।”
অভ্রর মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরদিন মিলা তার খাতায় অভ্রর একটা লেখা পেল। তার খাতা কখন নিলো অভ্র? আবার কখন ফেরত দিলো? ক্লাসের ফাঁকেই হবে। অভ্র লিখেছে,
রোদমিলা,
তুমি ঠিক বলেছো আমার তোমার কাছে পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমার সাথে ভাব জমানোর জন্য তোমার কাছে পড়া বুঝতে যাই। সরাসরি আজকে বলেই দিলাম। আমি জানি তুমি মুবিন গুন্ডার বোন, তোমার মা – বাবার ডিভোর্স হয়ে গেছে, তোমার জীবনে নানা সমস্যা কিন্তু আমি তোমাকে বড় হয়ে বিয়ে করতে চাই। এইতো আর মাত্র কয়েক বছর। তোমার জীবনের সব সমস্যা আমি ছুমন্তর করে নাই করে দিব। দুজন একসাথে অনেক ভালো কিছু করব। উই বোউথ আর শার্প এন্ড ব্রিলিয়ান্ট। আমাদের একসাথে খুব যায়। উই উইল বি আ পার্ফেক্ট কাপল।”
লেখাটা একবার পড়েই মিলার মুখস্থ হয়ে গেল। তার মাথা ভালো। সে সাথে সাথে কাগজটা খাতা থেকে ছিঁড়ে সুন্দর করে একটা কাগজের প্লেন বানালো। তারপর সেটা হাওয়া উড়িয়ে দিলো। সে হবে পাইলট। স্বপ্ন তার ভালোবাসা, পড়াশুনা তার প্রেম। সফলতাই তার গন্তব্য। মা – বাবা একদিন সবাইকে গর্ব করে বলবে, আমার মেয়ে রোদমিলা দেশসেরা। তার পরিচয়ে পরিচিত হবে সবাই। পাইলট রোদমিলা।
এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট পেয়ে মুবিন সবাইকে ট্রিট দিলো। তার কোনো বন্ধু নেই। সুতরাং সে ট্রিট দিয়েছে মেসের সবাইকে। সবার হাতে হাতে ধরিয়ে দিলো হাজী বিরিয়ানীর প্যাকেট, ডায়নার হালিম আর ২৫০ মিলির কোকা কোলা। সবাই খুশি হয়ে জানতে চাইলো, “আরে গোল্ডেন নাকি? গোল্ডেন নাকি?”
মুবিন একগাল হেসে বলল, “না ফেইল।”
সবাই এ কথা শুনে হা হা করে হাসল৷ মুবিনের পিঠ চাপড়াল। কারণ কেউ ভাবতেই পারে না ফেইল করেও কেউ কেউ এভাবে সেলিব্রেট করতে পারে? এ পৃথিবীর কোথাও ব্যর্থতার কোন উদযাপন নেই। আসলেই নেই। মুবিনও তার ব্যর্থতাকে সেলিব্রেট করছে না। সে যে তার বাবা মায়ের নাম একটু হলেও ডোবাতে পেরেছে – এই তার আনন্দ, এই তার জয়। আজ তার ই সেলিব্রেশন!!
কেবল ইমাদ বুঝলো মুবিন সত্যি বলছে৷ সে নিজ চোখে মুবিনের রেজাল্ট না দেখলে অন্যদের মতোই ভাবতো মুবিন মজা করে এসব বলছে। কিন্তু সে মুবিনের রোল নাম্বারটা জানতো। চেক করে খুব দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু হতাশ হয়নি। ইমাদ জানে না সে সত্যিকার অর্থে ঠিক কতটা ভালো শিক্ষক, কিন্তু সে শিক্ষক তা সে জানে। তার সে শিক্ষকের চোখ তাকে বলছে, “মুবিন জিনিয়াস। ওর সহজে থামা নাই।”
ওর হাতে বিরিয়ানির প্যাকেট, হালিমের বাক্স আর কোক দিয়ে চলে যাচ্ছিলো মুবিন। ইমাদ ডেকে বলল, “মুবিন, শুনে যাও।”
মুবিন চুপচাপ এসে দাঁড়ালো। এতক্ষণ হাসলেও এখন মাথা নিচু করে আছে,চোখেমুখে কষ্ট বা অনুতাপ নাই, কিন্তু আছে জেদ!!
ইমাদ শুধু বলল, “তুমি একদিন না চাইতেও হুট করে অনেক বড় কিছু হয়ে যাবে। তোমার মত জীবন সেলিব্রেট করতে পারা মানুষরাই পৃথিবী জয় করে।”
মুবিন ইমাদের কথায় ইমাদের মতো স্থির চোখে বলল, “আচ্ছা।”
তারপর শিষ বাজাতে বাজাতে চলে গেল। তার জীবনে কিচ্ছু হতে হবে না। কেবল মা – বাবার নাম ডুবাতে পারলেই, ওদের লজ্জায় ফেলতে পারলেই সে খুশি। কচু হবে সে। স্যার বললেই হলো! সে কিছু হতেই চায় না। জীবনে কিছু করতে চায় না। সে হবে বাউন্ডুলে, টো টো কোম্পানির সিইও। ইমাদ বুঝলো মুবিন তার কথা বিশ্বাস করেনি, কিন্তু ইমাদের তার উপর বিশ্বাস আছে।
.
কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে মুবিনের রোল নাম্বারটা বসিয়ে রেজাল্ট শিট বের করে শিল্পী কষ্টে কেঁদে ফেলল। ছেলেটাকে মানুষ করতে পারলো না কোনোমতেই। শেষ পর্যন্ত ফেইল করলো? কোনো চেষ্টার কমতি তো সে রাখে না। ছেলের ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠল। গালে হাত দিয়ে দোকানেই একটা টুলে অনেকক্ষণ যাবত মূর্তির মত বসে রইল সে। ছেলেটার দ্বারা কি শেষ পর্যন্ত পড়াশুনা হবেই না? মুবিনের চিন্তায় হাহাকার করা বুক নিয়েই মিলার রোল নাম্বারটা দোকানীকে দিলো সে। মিলার রেজাল্ট দেখে চমকায়নি। গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। এটা তো হওয়ারই ছিল। মিলা পড়াশুনায় খুব ভালো। তবে মার্কশীট দেখে হতভম্ব হয়ে গেল সে। এতো এভারেস্টের সমান নম্বর! শিল্পীর দুঃখ কমলো। মেয়েটা তার খুব ভালো করছে। ফিউচার ব্রাইট। মায়ের মনটা লিলুয়া বাতাসে জুড়ালো। কিছু সময় যেতে না যেতেই জানা গেল, মিলা শুধু গোল্ডেন এ প্লাস পায়নি, পুরো কুমিল্লা বোর্ডে ফার্স্টও হয়েছে! আর সারা বাংলাদেশে তার স্থান নবম! শিল্পী খুশিতে কি করবে ভেবে পেল না। আত্মীয় – স্বজন, পাড়া – প্রতিবেশী, অফিসের কলিগ সবাইকে ফোন করে করে মেয়ের ফার্স্ট হবার কথা জানালো। পরদিন অফিসে তো মিষ্টিও নিয়ে গেল। সবাইকে মিষ্টিমুখ করালো। আর মিলাকে জড়িয়ে ধরে চুমুর পর চুমু খেল। মিলা এত আদর পেয়ে মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে রইল। মা তাকে আদর করছেন। তার ভালো লাগছে৷ খুব ভালো লাগছে। মায়ের এমন আদরের জন্য সে শত রাত জেগে পড়তে পারবে। সে যদি জানতো এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের দিন সে এত আদর পাবে তবে আরো দু বছর আগেই দুই ক্লাস টপকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট হয়ে যেত। এই এটুকু আদরই তো সে আজীবন চেয়ে এসেছিল। মাকে সে খুব ভালোবাসে। সবচেয়ে বেশি। সবার চেয়ে বেশি।
মিলাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিল মঈনও। মিলাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শিল্পীকে বলল, “যা হয়েছে, হয়েছে। মিলার জন্য পেছনের কথা আমরা ভুলে যাই। আবার নতুন করে সব শুরু করি।”
মিলা উঠে চলে গেল। শিল্পী বলল, “মিলার দোহাই দিও না, মঈন। মিশেল তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার কাছে এখন কি চাও? দুদণ্ড শান্তি? দেবদাস হলেই তোমার কেবল আমাকে লাগে। জোহরার পর একবার তোমার চন্দ্রমুখী হয়েছি৷ আর না৷ এইবার আমি পারু৷ আমাকে তুমি দেবদাস আর কখনো পাবে না।”
চন্দ্রমুখীরাও একটা সময় পারু হতে বাধ্য হয়। দেবদাসের জন্য মায়া হলেও ফিরে আর যায় না। দেবদাস মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। বেঁচে থাকলে চন্দ্রমুখীও একটা না একটা সময় পারুর মত নিজের অধিকার চাইতো। একতরফা ভালোবাসারও সংবিধান থাকে। ভালোবাসবে, জীবন দিবে, কিন্তু বিনিময়ে সম্পর্কের মৌলিক অধিকার চাই। ভালোবাসা নিলে, অধিকার দিতে হয়।
.
লোহার গেইটটা সরালেই সামনে ছোট ছোট ঢেউয়ের কুঞ্চন, স্বচ্ছ জলরাশি। গেটের দু’ধারে কিছু গাছ। এইতো কয়েক কদম এগুলোই জলে ডুব দেয়া যায়। ওপারে ধীরেন্দ্রনাথ স্টেডিয়াম। সাথে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে কুমিল্লার নাক উঁচু বিল্ডিংগুলো। জায়গাটা পৌর পার্ক আর ধমর্সাগর সংলগ্ন কুমিল্লা নজরুল ইন্সটিটিউট। ইন্সটিটিউটের পেছন দিকের এই মনোহর দৃশ্য চোখের প্রশান্তি। কড়ি আর ইমাদ নজরুল ইন্সটিটিউটের পেছনের এদিকটায় এসে কিছুক্ষণ বসেছিল। পাশাপাশি। পুরো আঙিনা জুড়ে ধাপে ধাপে টাইলস দেয়া বসার জায়গা তৈরী করা। চারিপাশে বড়, ছোট টবে সবুজের রাজত্ব। বড় বড় গাছ অভিভাবকের মতন ছায়া দিয়ে রেখেছে। তার উপর আকাশ। ইনস্টিটিউটের ভেতরে সাহিত্য অনুষ্ঠান চলছে। সেখান থেকে ভেসে এলো নজরুলের অমর সৃষ্টি,
“বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে
দিসনে আজই দোল,
আজও তার
ফুল কলিদের ঘুম টুটেনি
তন্দ্রাতে বিলোল।”
ইমাদ গেটটা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কড়ি দাঁড়ালো গেটে চিবুক ঠেকিয়ে। ওভাবেই সে ইমাদকে দেখছে। অনেকক্ষণ। ইমাদও তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ইমাদ তাকিয়ে থেকেই বলল, “প্রেমে পড়ে গেলেন নাকি?”
কড়ি পাল্টা প্রশ্ন করল, “কার?”
“আমার।”
“না তো।”
“আচ্ছা।”
“আপনাকে দেখছি বলে বললেন?”
“জি।”
“দেখছি কারণ আপনাকে আমি বিয়ে করব।”
“কেন?”
“অনেকগুলো কারণ।”
“শুনি?”
কড়ি হাসল, “এবার আর আচ্ছা বললেন না?”
ইমাদ নিরবে হাসলো। কড়ি বলল, “আমার জন্য আপনি আপনার এত বছরের, এত সাধনার খোদাই করা মূর্তিটা বিক্রি করতে গেছেন।”
“এজন্য বিয়ে করবেন?”
“আরো একটা কারণ আছে।”
“আপনি আপনার চোর বন্ধুকে এত ভালোবাসেন, বউকেও ভালোবাসার কথা।”
“বাসায় আপনি সব সত্যি বলে দিলেন কেন? না বললেও হতো।”
“আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই।”
“আচ্ছা।”
“ভেবেছিলাম ওদের পছন্দে বিয়ে করে প্রায়শ্চিত্ত করব। তা তো আর হচ্ছে না। তাই সব বলে দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলাম। বিবেক বলেও তো একটা কথা থাকতে হয়।”
“আপনার সাথে আঙ্কেল এখন কথা বলেন?”
“হ্যাঁ, এখন একটু আধটু বলেন। প্রথম দিকে অনেকদিন কথাই বলেননি।”
“আর ভাইয়ারা?”
“বড় ভাইয়ার মায়া বেশি। ভাইয়া ঠিক হয়ে গেছেন। ছোট ভাইয়া এখনও খোঁচা মারে।”
“কাদিন ভাইয়া?”
“মেজো ভাইয়ার রাগ কঠিন। সময় লাগবে।”
“আমার জন্যই আপনার বিপদ হলো।”
“কি রকম?”
“আমাকে বিয়ে করবেন বলেই সবাইকে সব বলেছেন। আমি না থাকলে বলতেন না। ওদের পছন্দে বিয়ে করতেন। সব ঠিক থাকতো।”
“কিছু পেতে হলে, সবকিছু হারাবার সাহস রাখতে হয়।”
“আপনি সত্যিই আমার প্রেমে পড়েননি?”
“উঁহু।”
“তাহলে?”
“আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। প্রেমে পড়া এত সহজ নাকি?”
“কঠিন কেন?”
“অনুভূতি ক্ষত হয়ে আছে।”
“আচ্ছা।”
“আপনার মত এত ভালো একটা মানুষ আমি কোথায় পাব বলুন?”
“আমি ভালো কে বলল?”
কড়ি উত্তরটা ইচ্ছে করেই দিলো না, “দেরি হচ্ছে। আজ আসি।”
ইমাদ বলল, “এক মিনিট।”
কড়ি প্রশ্নাতুর চোখে তাকাল। ইমাদ বলল, “আপনার গয়না এনেছি।”
কড়ি বিস্মিয়ে বলল, “পাথরের খোদাই করা মূর্তি কি আরেকটা বিক্রি করলেন?”
“না আর নেই।”
“তাহলে?”
ইমাদ পকেট থেকে গয়নাটা বের করে হাত বাড়িয়ে দিলো, “আপনার জন্য কড়ির গয়না।”
কড়ি হাত বাড়িয়ে গয়নাটা ছুঁলো। তবে হাতে নিলো না। মুক্তার মালায় কড়ি বসানো। নিজের নামের কারণেই হোক কিংবা যে কারণেই হোক কড়ি তার খুব পছন্দ। সমুদ্রের ছোট ছোট সামুদ্রিক শামুকের শক্ত খোলসটাকে কড়ি বলে। অনেকটা পোর্সেলিনের মত। পোর্সেলিন শব্দটিও এসেছে ইতালিয়ান শব্দ পোর্সেলিনা থেকে। যার অর্থ কড়ি।
কড়ি মুগ্ধ হয়ে বলল, “কোথায় পেলেন?”
“মুক্তো, আর কড়ি সমুদ্র থেকে চুরি করেছি।”
“তারপর?”
“বানিয়েছি।”
“কোথা থেকে বানালেন?” ইমাদের মুঠো খোলা হাতে ছড়িয়ে থাকা কড়ির গয়নায় কড়ি নরম আঙুলে ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল। গয়না ছুঁতে ছুঁতেই আচমকা লেগে যাচ্ছে ওদের আঙুলে আঙুল। ইমাদ কড়ির আঙুল আর নিজের হাতের দিকে মনোনিবেশ করে বলল, “আমি বানিয়েছি।”
“আপনি? আপনি আর কি কি পারেন?”
ইমাদ হাসলো। কড়ি বলল, “আপনি কি ফ্রুট কার্ভিংও পারেন?”
“আপনি কীভাবে জানলেন?”
“মেজো ভাইশা ভাবির হলুদের ডালার সাজানো ফলের ডিজাইন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন।”
“আপনার বুদ্ধি ভালো।”
“ফ্রুট কার্ভিং, পাথরে মূর্তি খোদাই, গয়না বানানো, ইংরেজী কবিতা লেখা আর কি কি জানা বাকি আমার?”
ইমাদ দুষ্টু গলায় বলল, “ফ্লার্টও তো করতে জানি।”
কড়ি শব্দ করে হেসে ফেলল। ইমাদ ঘুরে কড়ির পেছন দাঁড়িয়ে গয়নাটা কড়ির গলায় পরিয়ে দিলো। কড়ি বলল, “থ্যাঙ্কস।”
ইমাদ শুনালো তার লেখা আরেকটা ইংরেজী কবিতা,
“Do you know how to dance in the rain?
How to love in the pain?
Do you know how pretty stars are?
how to love beyond fear?
I can give you the clue
From dark to blue.
Are you ready to fall in love?
Follow me,
I’ll show you how to be
I am in love with you already.
Are you ready to fall
And rise in love with me?”
সমাপ্ত।