একান্ত সময়

0
689

(অয়ন)

কি ব্যাপার এবেলায় বাসা অন্ধকার কেন?
‘সুপ্তি এই সুপ্তি, কোথায় তুমি?’ গেলো কোথায় মেয়েটা? ঘুমুচ্ছে নাকি?
নাহ বাসার কোনখান থেকে সাড়া মেলেনা। নিশ্চিত বাজার শেষ। নয়তো এই ভরসন্ধ্যায় অফিস শেষে আর কোথায় যাবে? কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রেখে অয়ন ফোন দিতে নেয় সুপ্তিকে। পরমূহুর্তেই সিদ্ধান্ত পাল্টায়। ফ্রেশ হয়ে এসেই না হয় ফোন দেবে। গোসল সেরে দুকাপ চা বানিয়ে ফোন দেয় সুপ্তির মোবাইলে। কিন্তু একি ফোন যে বন্ধ।

একটু অস্থিরতা পেয়ে বসে অয়নকে। কি ব্যাপার মোবাইলে কি চার্জ নেই? মোবাইল ছিনতাই হলোনা তো? কখন বেরিয়েছে, কোথায় বেরিয়েছে কিছুই যে সে জানেনা। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বেডরুমের দিকে আসতেই চোখ যায় দরজায় আটকে রাখা এক টুকরো কাগজের ওপর।

(সুপ্তি)

কি করছে অয়ন? নিশ্চয়ই বাসায় চলে এসেছে এতোক্ষনে। আচ্ছা চিঠিটা দেখবে তো? নাকি অহেতুক দুঃশ্চিন্তা করবে বসে বসে। মোবাইলে একটা মেসেজ পাঠিয়ে এলে কি বেশী ভালো হতো?

যে ঘর থেকে খানিক মুক্তি পেতে বেরিয়ে আসা সে জায়গাতেই যে কেন ভাবনারা আটকে যাচ্ছে বারবার ভেবে পায়না সুপ্তি। বাসের জানালা গলে আসা চাঁদের আলোয় ভাবতে বসে নিজের জীবনের কথা।

পারিবারিক পছন্দে অয়নের সাথে তার বিয়ে হয় বছর দুয়েক আগে। টোনাটুনির সংসারে ঝুটঝামেলা নেই বললেই চলে। দুজনেই ঘরে বাইরে হাতে হাতে কাজ করে। অয়নের বাবা মা কিংবা সু্প্তির বাবা মা বেশ আধুনিক ঘরানার। ছমাসে ন’মাসে একবার এসে ঘুরে যান ওদের বাসায়। দুচারদিন থেকে চলে যান আবার নিজেদের সংসারে। আর দশটা পরিবারের মতো বিয়ে হয়েছে বাচ্চা নে, বয়স চলে যাচ্ছে এমন ঘ্যানঘ্যান করা ধাঁচের না কোন পরিবারই। আর তাই ওদের সিদ্ধান্তে নাক গলাবার মত কেউ নেই বললেই চলে।

তবু কোথায় যেন কি একটা ঠিক নেই। সুপ্তির শুধু মনে হয় অয়ন বুঝি বড্ড বেশী ফরমাল। সুপ্তি যা বলে তাই ঠিক। সেভাবেই সংসার চলে। কোন ভিন্ন মতামত দেয়না। ভিন্ন মতামত থাকলে সে প্রসঙ্গই এড়িয়ে যায়। কিন্তু মতপার্থক্যগুলো বড় স্পষ্ট। সুপ্তির ভালো লাগে বই পড়তে, অয়নের পছন্দ অনলাইনে সময় কাটানো। সুপ্তি পছন্দ করে ঘুরে বেড়াতে, অয়ন সুপ্তির অনুরোধে বেড়াতে
গেলেও ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে হোটেলের বদ্ধকামরায় শুয়ে বসে থাকতে পছন্দ করে। সুপ্তির ভালো লাগে দেশী খাবার, অয়নের পছন্দ বিদেশী। সুপ্তি টানা বকবক করে যায় আর অয়ন চুপচাপ শুধু হু হা করে যায়। সুপ্তির ধারনা অয়ন তার অর্ধেকেরও বেশী কথা শোনেইনা।

বিয়ের আগে সুপ্তি একা একাই বেশ ঘুরে বেড়াতো। কখনো বন্ধুদের সাথে কখনো বা গ্রুপে। অথচ বিয়ের পরে অয়নকে বলতে গেলে জোর করেই নিয়ে বের হতে হয়েছে। অফিস, বাসা, রান্না, ঘুম এই চক্রে যেন জীবন আটকে গেছে সুপ্তির। অয়নের কাছে ব্যাপারটা যতটা স্বাভাবিক সুপ্তির কাছে যেন তা ততটাই দমবন্ধ করা হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। সেজন্যই বুঝি আজ দুলাইনের একটা চিঠি লিখে বেরিয়ে পরা।

(অয়ন)

অয়ন,
আমি একটু বেড়াতে যাচ্ছি। রাঙ্গামাটিতে যাচ্ছি কয়েকদিনের জন্য। দৌড়ঝাপ দিয়ে নিতে চলে এসোনা। আমি কিছুদিন নিজের মত করে ছুটি কাটাতে চাই। ফোন দিওনা। বন্ধ করে রেখেছি।

– সুপ্তি।

দরজায় লাগানো চিঠিটা পড়ে একটু সময় চুপ করে বসে থাকে অয়ন। কেন কিছু না বলে সুপ্তিকে যেতে হলো? ওকে বললে কি ও না করতো? সুপ্তির কোন ইচ্ছেটার সে প্রাধান্য দেয়নি? সুপ্তি পছন্দ করেনা বলে অনলাইনে সময় কাটানো কমিয়ে দিয়েছে। ও বেড়াতে পছন্দ করে বলে যখনই বের হতে চেয়েছে শতেক ক্লান্তি সত্ত্বেও অয়ন তো কখনো মানা করেনি। সুপ্তি পছন্দ করে নানা পদের দেশী খাবার রাঁধতে যার মধ্যে শুটকী একটা প্রধান আইটেম। অয়ন তো খারাপ লাগলেও খেয়ে নিয়েছে। অন্য বন্ধুরা যখন তাদের বৌয়ের সাথে স্বেচ্ছাচারী আচরণ করে সেখানে সে সুপ্তিকে তার মতো করে থাকার সুযোগ দেয়ার পরও ওকে একাকী বেরিয়ে যেতে কেন হয়?

তবে কি অয়নের সব মেনে নেয়াকে সুপ্তি দূর্বলতা ধরে নিয়েছে? না অয়ন নেবেনা খোঁজ সুপ্তির। আসুক যতদিনে মন চায়। সে এই কয়েকটা দিন বিয়ের আগের মতো ব্যাচেলর জীবন কাটাবে। তার নিজেরও একান্ত সময়ের দরকার আছে সেটা তো বিয়ের পর ভুলতেই বসেছে।

(সুপ্তি)

পর্যটনের হোটেলে পৌঁছতে প্রায় ভোর হয়ে যায়। সুপ্তির রুম থেকে লেকটার অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ভোর সকালের সোনালী আলোয় লেকের জল যেন সোনালী দ্যুতি ছড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থেকে সুপ্তির হঠাৎ মনে হয় সে আসলে জলের সৌন্দর্য দেখছেনা। সে আসলে ভাবছে অয়নের কথা। আজ সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য উঠতে পারবে তো? কি খেয়ে যাবে সকালে? সংসার কি তবে এমনই মায়াজাল একবার জড়িয়ে গেলে এর ভাবনা থেকে সহসা বের হওয়া যায়না?

কোথাও বেড়াতে গেলে সুপ্তি এক মূহুর্তও মিস করতে চায়না ঘোরাঘুরি থেকে। অথচ আজ সকালের নাস্তা খেয়ে সে বিছানায় একটু গড়িয়ে নেই বলে তলিয়ে যায় ভীষণ ঘুমে।
ঘুম ভাঙতে দেখে দুপুর গড়িয়ে গেলো বলে। কি অদ্ভুত বেড়াতে এসে পুরো একটা দিন সে অয়নের মত বিছানায় গড়িয়ে কাটিয়ে দিল?

(অয়ন)

সুপ্তি নেই কাজেই এলার্ম না দিলে ঘুম থেকে উঠতে পারবেনা জেনে কয়েক জায়গায় এলার্ম দিয়ে তবেই ঘুমাতে যায় অয়ন। অদ্ভুত হলেও সত্য সারাদিনের ক্লান্তি সত্ত্বেও ঘুম আসেনা চোখে সেভাবে। অথচ অন্যদিন সুপ্তি যখন সারাদিনের গল্প বলতো ওর ঘুমে দুচোখ বন্ধ হয়ে আসতো।

নাহ সকালে তাকে কোন এলার্ম তুলে দিতে হয়না। কিভাবে যেন ঘুম ভেঙেই যায়। নিজের জন্য একটু চা করে তৈরী হয়ে বেরিয়ে যায় সে। কোন নাস্তা খাওয়ার রুচি হয়না। অথচ সুপ্তি থাকলে তাকে নাস্তা না খেয়ে বের হতেই দিতোনা।
অফিসের হাজারো ব্যস্ততায় কতবার যে মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ রাখে ইস যদি সুপ্তি একটা ফোন দিত। অথচ সুপ্তির নিত্যদিনের অভিযোগ অয়ন অফিসে ঢুকে গেলে অন্যমানুষ। সুপ্তি ফোন না দিলে নিজে থেকে একটা ফোন কখনোই দেয়না।

অফিস থেকে বাসায় ফিরে ফ্রিজ খুলতেই দেখে সুপ্তির রান্না করা শুটকী ভুনা আর করলা ভাজি রাখা। অন্যসময় এমন খাবার হলে সে নির্ঘাত একটা পিজা অর্ডার করে দিত। আজ নিজে রাইস কুকারে ভাত ফুঁটিয়ে দারুন তৃপ্তি করে ঐ ফ্রিজে রাখা বাসী খাবার দিয়েই খেয়ে নেয় সে।

সুপ্তির শুধু এক দিনের অনুপস্হিতিতে অন্যদিন যে ব্যাপারগুলো নিয়ে অয়নের আপত্তি থাকতো সেটা কিভাবে এমন গায়েব হয়ে গেলো? এ কি তবে নিজের মননে দিনদিন করে অজান্তে মিশে যাওয়া অভ্যাস নাকি ভালবাসা?

………………

পরদিন সকালে রওয়ানা দিয়ে রাঙ্গামাটি পৌঁছতে প্রায় বিকেল হয়ে যায় অয়নের। সুপ্তি কোথায় থাকতে পারে তার একটা ধারনা ছিল তার আগে থেকেই। অনেকবার পর্যটনের এই মোটেলটার কথা, লেকের ধারে গোধূলীবেলায় বা জোছনা রাতে বসার গল্প সে করেছে। রিসেপশনে কথা বলে কনফার্ম হয় অয়ন। নিজের রুমে যেয়ে কাপড় পাল্টে বেরিযে পরে সুপ্তিকে খুঁজতে। এদিকে আগে কখনো আসেনি বলে খুঁজে পেতে একটু সময় লাগে তার। লেকের দিকে তাকিয়ে বসে থাকা মানুষটার জন্য যে কতটা উদ্বিগ্নতা নিয়ে অয়ন এতোটা পথ ছুটে এসেছে তা কি সুপ্তি কখনো জানবে?

– হ্যালো ম্যাডাম।

পেছনে পরিচিত কন্ঠ শুনে ঘুরে তাকায় সুপ্তি। অয়ন চলে আসতে পারে এমন একটা ধারনা করলেও সত্যি সত্যি চলে আসবে বুঝতে পারেনি। একটু সরে গিয়ে বেঞ্চিতে বসার জায়গা করে দেয় অয়নের জন্য।

‘ চলে এলে যে?’

– একা থাকতে কষ্ট হচ্ছিল।

এখানে থাকবো কিভাবে বুঝলে?

– অনেকবার বলেছিলে এই জায়গাটার কথা।

তুমি আমার কথা শোন নাকি? আমিতো ভেবেছিলাম তুমি আমার কথা বেছে বেছে শোন।

– দুজনে যদি একসাথে কথা বলি শুনবে কে বলোতো? বেড়ানো শেষ হয়েছে?

হুম হয়েছে। থ্যাংকিউ।

– কেন বলোতো?

অন্য কোন বর হলে এভাবে হুট করে বাড়ি ছেড়ে চলে আসার জন্য হয়তো ছাড়াছাড়িও হয়ে যেতে পারতো।

– তোমাকেও ধন্যবাদ।

কেন বলোতো?

– তুমি নিজের জন্য একান্ত সময়টুকু না চাইলে আমিও হয়তো বুঝতামনা তুমি আদতে আমার কতটা জুড়ে আছো।

বাব্বা এতো সাহিত্য? চলো সারাদিন জার্নি করে এসেছো। রুমে গিয়ে রেস্ট নেবে।

– বেশ লাগছে বসে থাকতে। আরো খানিকক্ষণ থাকি।

ভুতের মুখে রাম নাম?

– আমিও তো বলতে পারি সে কথা, তাইনা। বেড়াতে এসে তুমি বলছো বিশ্রাম নিতে?

গত দুটো দিন একলা থেকে আমি কি বুঝেছি জানো? দুজন মানুষ যখন সংসার করতে পাশাপাশি থাকে তারা চাইলে কিংবা না চাইলেও একে অপরের ইচ্ছে, স্বভাবগুলো ধারণ করে ফেলে। গত দুদিন আমি শুধু ঘুমিয়ে কাটিয়েছি বিশ্বাস হয়?

– খুব বিশ্বাস হয়। আমি নিজেও যে, থাক বাদ দাও; এসো জোছনা দেখি।

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে