#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২
“তুমি আমাকে নিহিলার ব্যাপারে এতকিছু তো বলোনি!নিজের দোষ লুকিয়ে শুধু মেয়েটার কথাই বলেছিলে!” রুমে ঢুকেই মিলি কথাগুলো সাফাতের উদ্দেশ্যে বলে উঠল।
“উফ, মিলি এখন আবার তুমিও এসব শুরু করিও না তো। এমনিতে অনেক ধকল গেছে এইবার একটু শান্ত হতে দাও আমায়।”
“ওহ!এতক্ষন নিচে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলে আর এখন আমি বলাতে তোমার শান্ত হওয়া দরকার তাই না?”
“আমার মাথা খারাপ করিও না।” বলেই সাফাত ব্যালকনিতে চলে গেল।
আর মিলি খাটে বসে পড়লো। সাফাতকে বিয়ে করেছিল একটু শান্তির জন্য আর সেখানে হয়ে গেল হিতে বিপরীত! এই বাসায় থাকলে তো তার মাথা মিনিটে মিনিটে গরম হবে। তবুও প্রথমে মন জয় করার চেষ্টা তো করা লাগবেই। তারপরে নাহয় অন্য ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এমনিতেও পরিবারের সবার ব্যবহারে সাফাতের বিপরীতে চলে গিয়েছে সবাই। তাই মিলিও তার মনে যায় আসে তাই করবে।
———-
নিহিলা ব্যালকনির মেঝেতে হাটুমুড়ে বসে রইল। প্রতিদিনকার মতো আজকের আকাশ তেমন একটা সুন্দর না। চাঁদও স্পষ্ট না। চারদিকে চাঁদের আলোয় একটু আলোকিত হলেই কিছুসময় পরে পরে একগুচ্ছ মেঘপুঞ্জ এসে চাঁদকে ঘিরে নিয়ে আবারো চারদিক অন্ধকারে ঢেকে দিচ্ছে। ক্ষনে ক্ষনে হালকা হালকা বাতাস এগিয়ে আসছে। রাতের আঁধারে হাল্কা বাতাস। ঐ যে সামনের ঐ বিল্ডিংনের আলোগুলো আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে। কারো ঘরের আলো আগে নিভছে আর কারোর ঘরে পরে। এরই মাঝে আস্তে আস্তে সব আলো নিভে গেল। নিহিলা উঁকি দিয়ে পাশের ব্যালকনিটার দিকে তাকালো। ভেতরে আলো জ্বলছে। হয়ত ঘুমায়নি। এতদিন সাফাত ভাইয়ের সাথে এই ব্যালকনিতে বসে বসে গল্পঃ করতো। স্বপ্ন বুনেছিল ঐ ব্যালকনিটা একদিন তার সংসারের অংশ হবে। আচ্ছা? সাফাত ভাইয়ের কী একটুও মনে নেই! সেই ভাবনা মনে আসতেই নিহিলা নিজেই উত্তর বের করে নিল। মনে থাকবেই বা কেন! উনি তো মনে থাকার জন্য করেনি। নিহিলাকে নিয়ে শুধুই খেলেছিল। এতো এতো সময় সব মিথ্যে ছিল! নিহিলা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। রাস্তায় শরগোল ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আজকের আগে থেকে এভাবে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা হয়নি তা ভেবেই নিহিলা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসলো। চাঁদটাও ঠিক তারই মতো।
আচ্ছা!পাশের রুমে এতো সময় আলো কেন জ্বলছে!এখনো গল্প করছে! ভাবতেই নিহিলা নিজের বোকামো দেখে হাসলো। তাঁরা যাই করুক ওর কী! ওর তো কিছু যায় আসে না কিন্তু আসলেই কী তাই! সে তো সহ্য করতে পারছে না। প্রতিটা মুহূর্তে তাঁদের ছায়া এভাবে পড়লে সে তো এগিয়ে যেতে পারবে না! পর মুহূর্তে কী যেন মনে পড়তেই সে দ্রুত রুম থেকে মোবাইল নিয়ে আসলো। মোবাইলে তড়িঘড়ি করে কিছু একটা দেখে খুশি হয়ে গেল। তার একটা স্বপ্ন যে বাকী আছে! এতদিন সাফাত ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল বিধায় ইচ্ছেটা নিজের মনের মধ্যেই পোষণ করে রেখেছিল কিন্তু এখন তো সে মুক্ত! এখন শুধু বড়ো বাবাকে বলার পালা।
————
সকালে উঠেই মিলি রান্নাঘরে প্রবেশ করলো। এই বাড়িতে তাকে খুব কথা শুনতে হবে সেই মানসিকতা নিয়েই সে রুম থেকে বেরিয়েছে। এই বাড়িতে নয় সেটা যেকোনো বাড়িতে এমন ঘটনা ঘটলে এমন পরিস্থিতি হবে। মিলি নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো। রান্নাঘরে আমেনা বেগম আর রেহেনা বেগম একসাথেই নাস্তা বানাচ্ছেন। উনাদের কথার মাঝে মিলিকে তাঁরা খেয়াল করলো না। মিলি অস্বস্তিতে কিছু বলতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইল।
“তুমি এখানে কী করছো?”
সাফাতের ছোট বোন রিহি রান্নাঘরের দরজায় মিলিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কথাটা বলে উঠতেই আমেনা বেগম আর রেহেনা বেগম দুজনেই মিলির দিকে তাকালো।
মিলির অস্বস্তি আরো বেশি করে ঘিরে ধরেছে। সে হাসার চেষ্টা করে বলে উঠল,
“আসলে ভাবলাম মা আর চাচীকে একটু কাজে সাহায্য করি। তাই আসলাম।”
রিহি মিলির কথার জবাব দিবে তার আগেই আমেনা বেগম মিলির উদ্দেশ্যে থমথমে গলায় বলে উঠল,
“এতো ভালো বউ হওয়ার অভিনয় করতে হবে না। নিজের পরিবারের কথাও ভাবলে না, সেই মেয়ে কেমন বউ হবে সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পারছি।”
শাশুড়ির কথায় মিলি চুপসে গেল। মিলির মুখের দিকে তাকিয়ে আমেনা বেগম নিজেকে শান্ত করলেন,
“এসেছো যখন তোমাদের নাস্তাগুলো নিয়ে যাও। কিছুক্ষনের মধ্যে সাফাতের বাবা নাস্তা করতে আসবেন। উনি নাস্তা শেষ করে অনেকক্ষন পত্রিকা পড়বেন। ততক্ষন তোমরা উপোস থাকতে পারবে না। উনার সামনে পড়ার দরকার নেই। একেবারে নাস্তা নিয়ে রুমে চলে যাও। উনি বের হয়ে গেলেই রুম থেকে বের হয়ো।’ বলেই রেহেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
“রেহেনা, ওকে নাস্তার প্লেটগুলো দিয়ে দে। সাফাতের বাবা চলে আসবে।”
“জি আপা।” বলেই রেহেনা বেগম নাস্তার দুটো প্লেট মিলির হাতে ধরিয়ে দিতেই মিলি প্লেটগুলোর দিকে তাকালো। তার আত্মসম্মানে লাগছে কথাগুলো কিন্তু কিছুই করার নেই। কাজ যখন করেছে ফল ভোগ করতেই হবে। সে তো প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলো তবুও এতো খারাপ লাগছে কেন!
“কী হলো? দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত রুমে যাও। সাফাতের বাবা চলে আসলে কথা আরো শুনবে। আরো কথা শোনার ইচ্ছে হলে দাঁড়িয়ে থাকো। আমাদের সমস্যা নেই।” বলেই আমেনা বেগম কাজে লেগে পড়লো।
মিলি প্লেটগুলো নিয়ে উপরে রুমে আসার আগে আরেকটা রুম চোখে পড়লো। যখন উপরে এসেছে তখনো এই রুমের দরজা বন্ধ ছিল আর এখনো। বোধহয় এটাই নিহিলা মেয়েটার রুম।
রুমে প্লেটগুলো নিয়ে ঢোকার আগে মিলি নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। সে রুমে ঢুকেই বসে পড়লো।
সাফাত সবেমাত্র ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে মুখ মুছছিলো। মিলিকে ঐভাবে বসে পড়তে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
“কী হয়েছে?”
মিলি চুপ রইল। তার চুপ থাকাতে সাফাত এগিয়ে এলো।
“এই মিলি? কী হয়েছে? নিচে কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?”
“আসলে কথাটা বললে তোমার হয়ত খারাপ লাগবে।”
মিলির কথা শুনে সাফাত তাচ্ছিল্য হাসলো। খারাপ লাগা আর সে! আর কিছু খারাপ লাগার বাকী আছে না-কি সেটাই ভাবলো সে।
“বলো?”
“আমি রান্নাঘরে গিয়েছিলাম তোমার মাকে কিছু সাহায্য করবো বলে কিন্তু উনি আর তোমার ঐ চাচী আমাকে অপমান করে বের করে দিয়েছে। এই প্লেটগুলো এমনভাবে দিয়েছে মনে হয়েছে কোনো মানুষকে দেয়নি, এগুলো প’শু’র জন্যই দেওয়া।”
মিলির কথা শুনে সাফাত বেরিয়ে যেতে গেলে মিলি পথ আটকে দিল।
“এখন তুমি গিয়ে কিছু বললে আবারো কথা উঠবে। আর কয়েকদিন সময় নাও।”
———
আমান শেখ চা শেষ করেই নিহিলা এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করে আজ উপরে চলে গেল। এই প্রথম তিনি চা শেষ করে পত্রিকা না পড়েই চলে গিয়েছে। উনাকে উপরে নিহিলার রুমের দিকে যেতে দেখে আমেনা বেগম ছোট জা রেহেনা বেগমের দিকে তাকালো। উনি তো নিহিলা রিহির রুমে কোনোদিন যায়নি!
নিহিলা আর রিহি বসেই ছিল। মূলত রিহি নিহিলাকে এটা ওটা বলে হাসাচ্ছে। ওদের সামনে ভিডিওতে কেউ একজনও চেষ্টা করছে নিহিলার মন ভালো করতে। নিহিলাও ওদের কথায় সাঁই জানাচ্ছে। তখনই রুমের বাইরে থেকে দরজায় ঠোকা পড়লো।
নিহিলা আর রিহি অপরের দিকে তাকালো। তাঁদের রুমে আসলে কেউ তো ঠোকা দেয়না কিন্তু পরবর্তীতে ‘আসবো’ কথাটি শুনতেই তাঁরা দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়লো। বড়ো বাবা !তাওবা এরুমে! কেমনে সম্ভব সেটাই ভাবছে তারা।
রিহিলাও অবাকের চরম পর্যায়ে। নিহিলা ভেতরে আসতে সম্মতি দিতেই আমান শেখ ভেতরে এসে খাটের একপাশে বসলো। নিহিলাকেও বসতে বললেও সে দাঁড়িয়েই রইল। তারা একে অপরের দিকে বারবার তাকাচ্ছে।
আমান শেখ আবারো বসতে ইশারা করতেই ওরা বসে পড়লো। তিনি দু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
“দেখতে দেখতে করো বড়ো হয়ে গেল আমার পরী দুটো!ভাবতেই পারছি না!”
নিহিলা রিহি দুজনেই আজকে অবাকের পরে অবাক হচ্ছে। তারা চোখ তুলে বটগাছ নামক ছায়াটির দিকে তাকালো। উনার চোখ দেখেই নিহিলা বুঝতে পারলো উনাকে অপরাধবোধে ঘিরে ধরেছে। তিনি যে এ মেয়ে দুটোকে কত ভালোবাসে তা উনার চোখ দেখলেই যে কেউ বলে দিতে পারবে কিন্তু ছোটবেলা থেকেই ব্যাবসার দিকে মন দিতে গিয়ে একটা দুরুত্ব সৃষ্টি হয়েছে সেই বাধার কারণে দেয়াল তৈরী হয়েছে। যে দেয়ালটি টপকিয়ে মেয়েদের কাছে আসতে পারেন না।
“তোমার কোনো ইচ্ছে আছে মা?”
নিহিলার পরমুহূর্তে বিষয়টি মনে পড়তেই সে তাকাতেই আমান শেখ তার ভাষা বুঝে নিলো।
“আজ রাতে ডিনার একসাথেই করবো। তখন বলিও। তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করবো।” বলেই তিনি উঠে চলে যেতে নিতেই নিহিলার ডাকে থেমে গেল। সে এক দুঃসাহসিক কাজ করে বসলো। গিয়ে আমান শেখকে জড়িয়ে ধরতেই রিহিও দৌড়ে বাবার কাছে এগিয়ে গেল । নিহিলার মনে হচ্ছে এতো এই বটগাছ নামক মানুষটির সাথে ভয়ের দেয়ালটা ভেঙে গিয়েছে। এতো শান্তির জায়গা!
আমান শেখ প্রথমে কিছুসময় স্তব্ধ ছিল। পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে মেয়ে দুটোকে দুহাতে আগলে নিল। অবশেষে তাদের সম্পর্কের এই সংকোচ কাটলো হয়ত!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।