‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১৩||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
এরপর থেকেই কদিনের মধ্যে অঙ্কিতের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ও আদিত্যের বয়সই। দুজনেই MBA করছে। বাট ওকে আপনি বলা বারণ আর দাদা বলাও। যাই, এইবার জানতে হবে শত্রুতা টা ঠিক কি কারণে। আমি ফ্রেশ হয়ে হলে এলাম দেখলাম অঙ্কিত বসে আছে একা হলরুমের সিটে, সবাই চলে গেছে। আমি গিয়ে ওর পাশে বসতেই ও তাকালো আমার দিকে হেসে….আমার হাতটা ধরলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘আপসেট?’
‘নাহ। আমরা মানে আমি আর আদিত্য ইউনিভার্সিটিতে আসার শুরুতেই ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলাম কিন্তু যে যার মতো। আদিত্য আর আমার আগে থেকে কোনো পরিচয় ছিলো না কিন্তু ইউনিয়নে ঢোকার পর আলাপ ভালোই হয়েছিলো। সব ঠিক ছিলো কিন্তু তারপরেই জিয়া আসে ভার্সিটিতে। তোর কিছুদিন আগেই ভর্তি হয়েছিল জিয়া, বলতে পারিস সবার প্রথম তখনও আদিত্যের সাথে রিলেশনটা আমার ভালোই ছিলো কিন্তু তারপর…
‘তারপর? তারপর কি এমন হলো যে তোমরা একে অপরের শত্রু হয়ে গেলে?’
‘শত্রু ঠিক নয়। আসলে জিয়া আসতে না আসতেই একপ্রকার উৎপাত শুরু করে। ওর যাকে ইচ্ছা তাকেই বিরক্ত করতে থাকে, অপমান করতে থাকে। এটা আমার ঠিক লাগে না কারণ জিয়া নিজে ফ্রেশার হয়ে অন্য একটা ফ্রেশারের সাথে এমন ব্যবহার করতে পারে না। ফ্রেশার কি বলছি? ও তো ওর থেকে যারা সিনিয়র তাদের সাথেও এরকম বিহেভ করতো শুধুমাত্র…
‘শুধুমাত্র আদিত্য ওনার বয়ফ্রেন্ড এই জন্য। তাই তো?’
অঙ্কিত আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো আর বললো,
‘একদিন আমি জিয়াকে কাজটা করতে বারণ করি বাট ও কথা শোনেনা। সে সময় আদিত্য এলে আমি মনে করি আদিত্য আমাকে সাপোর্ট করবে কিন্তু নাহ, ও বললো “তোর এ বিষয়ে কথা না বলাটাই বেটার অঙ্কিত।” সেদিন থেকেই আমি ওকে পরিষ্কার জানিয়ে দেই যে আমার গ্রূপ আলাদা আর ওর গ্রূপ আলাদা। ব্যাস, তারপর থেকেই আমাদের মধ্যে আর কথা হয় না।’
‘তুমি জানো জিয়ার পরিচয়?’
‘হ্যাঁ। বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে জিয়া। শুধু টাকা ভালোবাসে, যে ছেলের টাকা আছে সেই ছেলের সাথেই ও আটকে যায়। আজ যদি আদিত্যের থেকে কোনো বড়লোক ছেলেকে পায় তাহলে আদিত্যকে ভুলতে দু-মিনিট লাগবে না। আর ওর বাবা? ওর বাবা আর কদিনের মধ্যেই হয়তো ভার্সিটির ডিরেক্টর হয়ে যাবেন। তাই তো এতো বাড়াবাড়ি করে। কেউ ওর কথা না মানলেই ও ইচ্ছে মতো স্টেপ নিতে পারে মিথ্যে বলে।’
‘আদিত্যের কোনো দোষ নেই, উনি যা করেছেন ঠিকই করেছেন।’
‘হোয়াট? তুই এটা বলছিস? আনবিলিভিবেল। কি করে এটাকে সাপোর্ট করছিস তুই?’
আমি অঙ্কিতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,
‘তোমার প্রশ্নের উত্তর তুমি নিজেই দিলে একটু আগে। ভেবে দেখো।’
অঙ্কিত আমার কথা শুনে চুপ করে গেলো। একটু ভাবার পরেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘কোয়েলের সাথে কি করে পরিচয় হলো? তোমরা কি একে অপরকে আগে থেকে চেনো?’
অঙ্কিত চুপ করে গেলো আমার প্রশ্নে। হয়তো বলতে চায় না তাই আমি উঠে চলে আসব ভাবলাম। কিন্তু যেই না উঠতে যাবো অঙ্কিত আমার হাতের উপর হাত রেখে বললো,
‘আসলে আমরা সবাই এক স্কুলে ছিলাম। আমরা মানে জিয়া, কোয়েল, আদিত্য, আমি আর…
‘সবাই হল থেকে তো কি ভার্সিটি থেকেও বেরিয়ে গেছে। আপনারা কখন বেড়াবেন সেটা কি বলা যাবে?’
অঙ্কিতের কথার মাঝখানে পিছন থেকে একটা গলার স্বর পেলাম। পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম আদিত্য আমাদের দিকেই এগিয়ে আসছেন। ওনার নজর আমাদের হাতের দিকে এটা দেখতেই আমি হাত সরিয়ে নিলাম অঙ্কিতের হাতের থেকে। আমরা উঠে দাঁড়ালাম যখন আদিত্য আমাদের সামনে এসে দু-হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়ালেন।
‘তুই যা আমরা ঠিক বেরিয়ে যাবো।’
‘হ্যাঁ আমি জানি তোরা ঠিক বেরিয়ে যাবি। এখানে রাত কাটাবি না।’
‘আদিত্য তুই একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।’
আদিত্য অঙ্কিতের দিকে এক-পা এগিয়ে অঙ্কিতকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘আচ্ছা? তো কি বাড়াবাড়ি করছি আমি?’
অঙ্কিত এগোতেই আমি ওদের দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে দু-হাত ওদের বুকে রেখে সরিয়ে দিলাম। আদিত্যের দিকে তাকাতেই উনি আমার হাতের দিকে তাকালেন তাই আমি হাত সরিয়ে অঙ্কিতের দিকে ঘুরে বললাম,
‘রাত হয়ে গেছে অনেক। চলো, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।’
আমি আর চোখে দেখলাম আদিত্যের চোখমুখ এখনও শক্ত। কি যে হয়েছে আজ ওনার বুঝতে পারছি না। কেন এরকম ব্যবহার করছেন উনি? আমি এগোতেই অঙ্কিত আমার হাত ধরে বললো,
‘আমি তোমাকে পৌঁছে দেবো হস্টেল, চলো।’
কেন জানো বুকটা কেঁপে উঠলো আদিত্যের সামনে অঙ্কিতের হাত ধরায়। আমি আস্তে আস্তে আদিত্যর দিকে তাকালে দেখলাম উনি একবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন আরেকবার আমাদের হাতের দিকে। আমি হাত ছাড়াবো তার আগেই অঙ্কিত আমাকে টেনে নিয়ে যেতে শুরু করলো। আমি যাচ্ছিলাম ঠিকই কিন্তু সামনের দিকে তাকিয়ে নয়, আদিত্যের দিকে তাকিয়ে। আলাদাই একটা ভয় কাজ করছে। মনে হচ্ছে বাজে কিছু একটা ঘটবে।
২৭.
‘কেন আদি কেন? কেন এতটা রিয়াক্ট করছিস তুই? তোর তো এতটা রিয়াক্ট করার কথাই নয়। তুই তো জীবনে কোনোদিনও কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাবিসনি তাহলে আজ কেন? আজ কেন তোর এতটা অস্বস্তি হচ্ছে মৌমিতাকে অন্য একটা ছেলের সাথে দেখে। কেন মনে হচ্ছে মৌমিতাকে টেনে ওই ছেলেটার থেকে দূরে সরিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসতে। হোয়াই আদি? হোয়াই?’
আদিত্য নিজের মনে মনে কথাটা ভেবেই সজোরে একটা ঘুষি মারলো ওর সামনে থাকা সিটের পিছনে। মৌমিতা আর অঙ্কিত বেরিয়ে যাওয়ার পর আদিত্য হলেই বসে পড়ে। আদিত্যের মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে এই মুহূর্তে। সে বুঝতে পারছে না তার সাথে কেন এমন হচ্ছে। হঠাৎ করে আদিত্য চোখ বুজতেই কিছুক্ষণ আগে অঙ্কিতের মৌমিতাকে হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আদিত্য ঝট করে চোখ খুলে ফেললো,
‘এই দৃশ্যটা দেখার পর আমার এমন কেন অনুভব হচ্ছে যেন কেউ আমার থেকে আমার অনেক মূল্যবান কিছু কেড়ে নিচ্ছে? কেন? ওই, ওই অঙ্কিতকে আমি দেখে নেবো। ওর সাহস কি করে হয় আমার বউয়ের দিকে হাত বাড়ানোর। ড্যাম ইট!’
আদিত্য সিটে আবার একটা ঘুষি মেরে উঠে বেরিয়ে গেলো হল থেকে। রাগের মাথায় কি করছে, কি বলছে কিছুই জানে এখন সে। আদিত্যের সারা শরীরটা কেন জানো জ্বলে যাচ্ছে। এই কেনর উত্তরটাই সে খুঁজে পাচ্ছে না।
অন্যদিকে,
রাত ২টো,
কিচ্ছু ভালো লাগছে না। সারা ঘরে পায়চারি করছি সমানে। ভীষণ ভাবে একটা অস্বস্তি কাজ করছে আমার মধ্যে। মনে হচ্ছে, কোনো একটা ভুল করে ফেলেছি কিন্তু কি ভুল? আমি ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। পাশে তাকিয়ে দেখলাম কোয়েল ঘুমোচ্ছে, উঠে জানলার কাছে চলে গেলাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে আদিত্যের মুখটা ভেসে উঠলো যখন অঙ্কিত আমাকে টেনে নিয়ে আসছিলো। তার চোখে কোনো কিছু হারানোর কষ্ট, তার জিনিস কেড়ে নেওয়ার রাগ স্পষ্ট ছিলো। চোখ খুলে ফেললাম তাড়াতাড়ি।
‘হল থেকে আসার পর থেকেই এই দৃশ্যটা চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছে। কেন আমার এমন মনে হচ্ছে? উনি তো, উনি তো আমাকে স্ত্রী হিসেবেই মানেন না। তাহলে কেন এভাবে রাগ করছেন, অধিকার ফলাচ্ছেন? কেন ওনার চোখে মুখে কষ্টের ছাঁপ? উফ মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আমার। আচ্ছা মনটা এতোটা অস্থির কেন করছে? কেন ওনাকে একটাবার দেখতে ইচ্ছে করছে?’
আমি আবার আমার বিছানায় গিয়ে বসলাম। চোখের জল আটকাতে পারছি না। আদিত্য! আপনি তো আমার সাথে ফুলশয্যার রাতে ওরকম ব্যবহারটা নাও করতে পারতেন? যদি ওমনটা না করতেন তাহলে আজ হয়তো আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো। কেন আজ এমন ব্যবহার করছেন? যাতে আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছেন? কিন্তু এটা আর সম্ভব নয়। আপনার ধারণা নেই সেদিন রাতে আমি কতটা পরিমাণ কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি তাও আপনাকে মেনে নিতাম যদি আপনি আমায় ওভাবে বিয়ের পরের দিন একা ফেলে না আসতেন, এখানে এসে আপনাকে জিয়ার সাথে না দেখতাম।
চোখের জল মুছে বিছানার পাশে থাকা টেবিলের ড্রয়ার থেকে ঘুমের ওষুধ বার করে একটা খেয়ে নিলাম। আর ভাবতে চাইনা আমি এসব নিয়ে, মুভ অন করতে চাই। বিছানায় শরীর এলাতেই চোখে ঘুম নেমে এলো।
সকালে,
আমি আর কোয়েল ভার্সিটিতে চলে এলাম। ভার্সিটিতে আসতেই সবাই আমাকে কংগ্রাচুলেট করতে থাকে কম্পিটিশন জেতার জন্য। আমি সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে, কোয়েলের সাথে ক্লাসে চলে যাই। ক্লাস শেষ করে বেরোতেই অঙ্কিত আসে, ওর সাথে আমরা গল্প করতে করতে এগোতে থাকি। গল্প করছি ঠিকই কিন্তু চোখ দুটো শুধু আদিত্যকে খুঁজছে।অন্যান্য দিন তো ঠিকই এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করেন, কোয়েলের সাথে কথা বলতে আসেন। তাহলে আজ কি হলো? কোথায় উনি?
‘কি রে? তুই হঠাৎ চুপ করে গেলি কেন?’
কোয়েল ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করতেই আমি হকচকিয়ে বললাম,
‘না, না। কিছু না। এমনি। আমি একটু আসছি।’
‘আরে কোথায় যাচ্ছিস? আজকে তো ম্যাডাম হোমওয়ার্কটা দেখে দেবেন। সবাইকে প্রেসেন্ট থাকতে বলেছেন।’
‘ওহ! হ্যাঁ। চল।’
ধুর, ভাবলাম একটু ওনাকে খুঁজবো। তা আর হলো না। ইশ আজ ক্লাস টা না থাকলে ভালো হতো। ক্লাসে এসেছি বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে, ম্যাম খাতা দেখছেন আর বকছেন ভুল হওয়ায়। আমার মন চাইছে বেরিয়ে যাই কিন্তু এখনও তো আমার খাতা দেখা শুরুই করেননি উনি। এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ করে কোয়েল আমাকে ধাক্কা দিতেই টের পাই ম্যাম আমার নাম ডেকেছেন। আমি তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়াই।
‘এসব কি মৌমিতা? এটা কিসের কপি তুমি সাবমিট করেছো? কম্পিটিশনে এতটাই মগ্ন ছিলে যে টেরই পাওনি কোন সাবজেক্ট এর কপি সাবমিট করেছো আমাকে? আবার ক্লাসেও তোমার মন নেই। বাহ! এক্ষুনি বেরিয়ে যাও আমার ক্লাস থেকে। আমি আজই কমপ্লেইন করবো প্রিন্সিপালের কাছে।’
‘ম্যাম আমি তো ঠিক কপিই…
‘শাট আপ! মুখে মুখে একদম তর্ক নয়। বেরিয়ে যাও বলছি।’
আমি অবাক হয়ে ভাবছি এসব কি করে হলো? আর চোখে দেখলাম জিয়া হাসছে। বুঝতে বাকি রইলো না কে কাজটা করেছে। আমি বেরোচ্ছি না দেখে ম্যাম আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরতে যাবেন এমন সময়……..
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১৪|| (বোনাস পার্ট)
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
আমি অবাক হয়ে ভাবছি এসব কি করে হলো? আর চোখে দেখলাম জিয়া হাসছে। বুঝতে বাকি রইলো না কে কাজটা করেছে। আমি বেরোচ্ছি না দেখে ম্যাম আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরতে যাবেন এমন সময়….
‘এক মিনিট ম্যাডাম।’
আমরা সবাই দরজার দিকে তাকাতেই দেখলাম আদিত্য একহাতে ভর করে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার কপালে গোল করে ব্যান্ডেজ করা।
‘একি আদিত্য? তুমি এখানে কি করছো?’
ম্যাডামের কথা শুনে আদিত্য এগিয়ে আসতে শুরু করে ম্যাডামের দিকে। উনি একটু খুঁড়িয়ে হাঁটছেন দেখে ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন,
‘একি আদিত্য? তোমার এমন অবস্থা কি করে? এই অবস্থায় কেন এসেছো তুমি?’
উনি ম্যাডামের কথায় মুচকি হেসে ডান হাতে একটা কপি ম্যাডামের দিকে এগিয়ে দিলেন। ওনার ডান হাতেও ব্যান্ডেজ করা। উনি আমার দিকে তাকালেন কিন্তু আজ আমি চোখ সরালাম না। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে ম্যাডামকে বললেন,
‘আমি চাই না আমার জন্য আর কোনো ক্ষতি হোক কাওর। তাই চলে এসেছি।’
ম্যাডাম কপি টা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘এটা তো মৌমিতার কপি। তোমার কাছে কি করে গেলো?’
‘ম্যাডাম মৌমিতা যখন আপনাকে কপিটা সাবমিট করেছিল তখন এই কপিটাই করেছিলো। কিন্তু পরবর্তীকালে ওটা চেঞ্জ করে দেওয়া হয়। সবাই কম্পিটিশন নিয়ে ব্যস্ত ছিলো তাই কাওর চোখে পড়েনি, আমার চোখে ভাগ্যবশত পরে গেছিলো।’
‘কি বলছো এসব? কে করেছে এমন কাজ?’
আদিত্য ম্যাডামের কথা শুনে একটু পিছিয়ে গিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘কাজটা যে করেছিস সে এই ক্লাসেই আছিস এখন। আমি চাই সে নিজের মুখে স্বীকার করুক তাহলে হয়তো শাস্তিটা কম হবে আর যদি তার নাম আমাকে বলতে হয় তাহলে পরিণাম ভালো হবে না।’
‘আদিত্য এসব কি বলছো তুমি?’
ম্যাডামের প্রশ্ন শুনে আদিত্য অনেকটা রেগেই উত্তর দিলো,
‘ম্যাডাম অনেকে হয়তো ভুলে গেছে আমি কে, কি করতে পারি। সহ্য করছি বলে যে যা ইচ্ছে তাই করবে সেটা এবার থেকে আর হবে না। তাই আবারও বলছি, শাস্তি কম পেতে চাইলে নিজেই স্বীকার করুক নাহলে…
‘আ..আমি! আমি করেছি।’
আমি অবাক হয়ে গেলাম জিয়া কে দাঁড়াতে দেখে। আমি ভাবিনি জিয়া স্বীকার করে নেবে। কিন্তু এখন আমার চোখ আর মন শুধুমাত্র আদিত্যের দিকেই তাকিয়ে থাকতে চাইছে আর কথা বলতে চাইছে। উনি এখনও উত্তর দিলেন না কিভাবে এরকম অবস্থা হলো ওনার। জিয়া উঠে দাঁড়াতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলেন যাতে আমার বুকের ভিতর টা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো।
‘আমার কাজ শেষ ম্যাডাম, আমি আসছি।’
‘দাঁড়াও, আমি সাহায্য করছি। তুমি বললে না কি করে হলো এমনটা?’
‘না না ম্যাডাম আমি ঠিক আছি। সামান্য একটা একসিডেন্ট হয়েছিল দ্যাট সেট।’
‘কোনো কথা শুনছিনা। আমি এগিয়ে দিচ্ছি।’
ম্যাডাম আদিত্যের দিকে হাত বাড়ালে উনি ম্যাডামের হাতের উপর হাত রেখে একবার আমার দিকে তাকালেন তারপর জিয়ার দিকে তাকালেন। দরজার কাছে গিয়ে ম্যাডাম কে কিছু একটা বলতে লাগলেন,
‘ম্যাডাম আমার হয়ে শাস্তিটা আপনিই বলে দিন।’
‘কিন্তু আদিত্য আমি কি শাস্তি দেবো বলো?’
‘আমি ভাবতেও পারছি না ভার্সিটির সব থেকে রাগী ম্যাডাম এই কথাটা বলছেন?’
‘বলছি তার কারণ জিয়ার বাবা মোটেও ভালো মানুষ নন। যে কাওর ক্ষতি করে দিতে পারেন উনি। আর কদিনের মধ্যেই ডিরেক্টর হবেন আমাদের ভার্সিটির।’
‘এমন শাস্তি দিন যাতে সাপ ও মরে আর লাঠিও না ভাঙে।’
ওনারা কি কথা বলছেন শোনা যাচ্ছে না। আমি শুধু অপেক্ষা করছি কখন ম্যাডাম ছুটি দেবেন আমি ওনার কাছে যাবো। সেই কাল রাত থেকে হওয়া অস্বস্তির কারণ বোধহয় এটাই। ওনার ক্ষতি হয়েছে বলেই হয়তো মনটা এতো অশান্ত হয়ে উঠেছিল। ইশ, একটা ফোন করতে পারতাম আমি। কেন যে…
‘সো স্টুডেন্টস, আমি বাকি কপিগুলো নেক্সট ডে চেক করে তোমাদেরকে ফেরত দেবো। আজকে আমি নিউ একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছি তোমাদের যেটা তোমাদের করতে হবে না।’
‘মানে? ঠিক বুঝলাম না ম্যাম।’
‘মানে এটাই যে তোমাদের সকলের অ্যাসাইনমেন্ট জিয়া কমপ্লিট করে আনবে। এটা ওর দায়িত্ব বলতে পারো। তা জিয়া, তুমি করে আনবে তো? নাহলে কিন্তু পানিশমেন্ট পেতে হবে।’
ম্যামের কথা শুনে বুঝলাম এটা নিয়ে আদিত্যের সাথে কথা বলছিলেন উনি। আমার জানো আর তর সইছে না বাধ্য হয়ে ম্যামকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘ম্যাম, আমি কি যেতে পারি? আসলে ওনাকে থ্যাংক ইউ বলা হয়নি তাই…
‘অফকোর্স! তুমি যেতে পারো আর হ্যাঁ, আমার ব্যবহারে কিছু মনে করো না।’
‘ইটস ওকে ম্যাম।’
আমি নিজের ব্যাগটা নিয়ে পড়ি কি মরি করে ছুটলাম আদিত্যের কাছে যাবো বলে। কিন্তু উনি কোথায়? নিশ্চই ভার্সিটির বাইরের দিকে গেছেন। যেভাবে হাঁটছিলেন তাতে মনে হয় না ভার্সিটির বাইরে যেতে পেরেছেন বলে তাই আমি আগে পৌঁছে যাবো যদি অন্যদিক দিয়েও যান। যেই ভাবা সেই কাজ ছুটলাম ভার্সিটির গেটের দিকে।
২৮.
আদিত্য রীতিমতো খোঁড়াচ্ছে। শরীরটা জানো চলছে না তার। পায়ে জোরই পাচ্ছে না এগিয়ে যাওয়ার জন্য। একটু করে হাঁটছে তো একটু করে দাঁড়াচ্ছে। অসহ্য ব্যাথা শুরু হয়ে গেছে হেঁটে আসার ফলে। ডক্টর বলেই দিয়েছিল হাঁটাচলা করতে না কয়েকদিন। চোটটা বেশ ভালোই লাগে মাথায় আর পায়ে। কিন্তু মৌমিতার কথা মনে হতেই ডাক্তারের সব কথা সে ভুলে গেছে, শুধু এটাই মনে হয়েছে মৌমিতাকে হ্যারাস হতে দেওয়া যাবে না, কোনোমতেই না! তাই তো সে কোনো কিছুর পরোয়া না করেই ছুটে এসেছে। এসবই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ভাবার পর আদিত্য পা বাড়াতে নিলে কেউ পিছন থেকে ধাক্কা মারে।
আমি ছুটে আসছিলাম এমন সময় দেখলাম আদিত্য দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ওনার দিকে এগোতে শুরু করলেই দেখলাম একটা ছেলে ওনাকে ধাক্কা মারলো তাই সঙ্গে সঙ্গে ওনার সামনে গিয়ে ওনাকে ধরে নিলাম।
‘আদিত্য! আপনি ঠিক আছেন?’
ঠিক সময়ে আমি আদিত্যকে না ধরলে উনি পরেই যেতেন। উনি আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকালে দেখলাম মুখটা লাল হয়ে গেছে। উনি সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, তাতেও যে কষ্ট হচ্ছে সেটা মুখভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারলাম।
‘আমি ঠিক আছি। থ্যাংক ইউ।’
‘থ্যাংক ইউ তো আমার বলার কথা।’
‘কি জন্য? তোমার কপি টা ঠিক সময় সাবমিট করেছি তার জন্যে?’
‘না। আমাকে নিয়ে এতটা ভাবার জন্যে।’
আমার কথা শুনে উনি আমার দিকে তাকালেন। আমিও ওনার দিকেই তাকিয়ে রয়েছি। জানি না কেন এই কথাটা আমি বললাম। নিজের আনমনেই বলে ফেলেছি কথাটা কিন্তু ভুল কিছু বলিনি। আমার জন্য ভাবেন বলেই তো এই অবস্থায়, এতটা কষ্ট সহ্য করে আজ এখানে এসেছেন। উনি আমার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ইতস্তত করে বললেন,
‘আমি, আমি বাড়ি যাচ্ছি। পরে কথা হবে।’
আদিত্য আমার হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলে আমি আরও শক্ত করে ওনার হাতটা ধরলাম। উনি আমার দিকে সেটা দেখে তাকালে আমি বললাম,
‘আমি জানি আপনার কষ্ট হচ্ছে। আর ক্ষতি করার লোকের তো অভাব নেই বলুন? আমি সাহায্য করছি চলুন।’
আমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে উনি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে সামনের দিকে তাকালে আমিও সেদিকেই তাকাই, উনি হেসে বলেন,
‘ক্ষতি করার লোক যতই থাকুক, এভাবে শক্ত করে হাত ধরে থাকার লোক থাকলে কোনো কিছুই কেউ করতে পারবে না। তুমি খুব লাকি যে প্রথম থেকেই ভালো বন্ধু পেয়ে এসেছো।’
কথাটা উনি সৌভিকদার দিকে তাকিয়ে কোয়েল আর অঙ্কিতের উদ্দেশ্যে বললেন তা বুঝতে বাকি রইল না। ওনাকে ধাক্কাটা সৌভিকদাই মেরেছে। ফ্রেশার পার্টিতে আদিত্য যে ব্যবহার করেছিলেন সেটারই হয়তো প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন আদিত্যের এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে। আমি কথা না বাড়িয়ে আদিত্যকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলাম। ভার্সিটির বাইরে আসতেই আদিত্য বললেন,
‘তুমি ক্লাসে চলে যাও। আমি যেতে পারবো, গাড়ি এনেছি।’
আমি ওনার কথা শুনে অবাক হয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ড্রাইভার এনেছেন?’
‘না। একাই পারবো যেতে। তুমি যাও।’
‘আপনার কি মাথায় চোট লেগে মাথা খারাপ হয়ে গেছে? না মানে এই অবস্থায় আপনি নিজে গাড়ি চালিয়ে এসেছেন আবার এখন নিজে গাড়ি চালিয়ে যাবেন? সত্যি কি যে বলবো আপনাকে সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। চুপ! চুপ একদম, চলুন আপনার গাড়ির সামনে।’
উনি কিছু বলতে গেলে ওনাকে থামিয়ে দিয়ে ওনার গাড়ির সামনে যেতে লাগলাম। যেতে যেতে উনি দাঁড়িয়ে গেলেন হঠাৎ করেই।
‘কি হয়েছে? মাথা ঘুরছে নাকি?’
কোনো কিছু না বলেই উনি আমার কাঁধে ডান হাত রেখে আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরলে, আমিও বাঁ হাত দিয়ে ওনার কোমর ধরে নিলাম। ওনার কানের কাছে বললাম,
‘খুব কষ্ট হচ্ছে?’
উনি এখনও কিছু বলছেন না। চোখে জল চলে এসেছে আমার ওনার এই অবস্থা দেখে। কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যেই আমরা ওনার গাড়ির কাছে পৌঁছালাম।
‘অনেক হয়েছে মৌমিতা। এবার তুমি ক্লাসে যাও। নাহ আর নয়, অনেক হেল্প করেছ তুমি আমার। আমি চাই না আমার জন্য তোমার আর কোনো ক্ষতি হোক। একটা কথা কি বলো তো, মানুষ নিজের অজান্তে কোনো ভুল করলে সেটাকে ভুল বলে মেনে নেওয়া যায় আর জেনে বুঝে ভুল করলে সেটাকে অন্যায় বলা হয়। আর আদিত্য ব্যানার্জী না কোনোদিন নিজে অন্যায় করেছে আর না কোনো অন্যায় সাপোর্ট করেছে। তুমি চলে যাও। কোয়েল আর তোমার অঙ্কিত খুঁজছে হয়তো তোমায়।’
আমাকে কোনো কথা না বলতে দিয়ে উনি নিজের কথা শেষ করে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠতে গেলে আমি বাঁধ সাধলাম।
‘চুপচাপ এখানে বসুন। বসুন বলছি!’
‘আরে, কিন্তু কেন?’
‘বসতে বলেছি বসবেন আর একটাও বাড়তি কথা নয়। কি হলো বসুন!’
ধমক দিতেই উনি চুপচাপ উঠে বসলেন আর আমি সামান্য হেসে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলাম। সিট বেল্ট লাগিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন,
‘চাবি টা দিন। এভাবে কি দেখছেন?’
‘তুমি ড্রাইভিং জানো?’
‘কেন? মিডিল ক্লাস মেয়েরা বুঝি ড্রাইভিং জানতে পারে না?’
ওনার থেকে চাবিটা নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতেই উনি বললেন,
‘জিয়ার সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলোনা। আমি মানুষকে ইম্পরটেন্স দি, তার ক্লাসকে নয়।’
আমি হাসলাম ওনার কথা শুনে কারণ এটা আমি অনেক আগেই জানি যে, উনি জিয়ার মতন নয়। ইনফ্যাক্ট উনি কাওর মতোই নন। সবার থেকে আলাদা উনি।
‘একসিডেন্ট টা হলো কীভাবে?’
উনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
‘ভুলবশত রাগের মাথায় বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেছিলাম। রাগের মাথায় ড্রাইভ করলে একসিডেন্ট আমার হয়ই। বাট রাগ এতটাই ছিলো যে কি করছিলাম, কি বলছিলাম কোনো রকম হিতাহিত জ্ঞানই কাজ করছিল না আমার।’
‘এতো রাগের কারণ?’
আমার এই প্রশ্নে আদিত্য চুপ করে গেলেন। কিছু একটা ভাবছেন মনে হচ্ছে,
‘সেটাই তো জানি না আমি মৌমিতা। কেন কালকে আমি তোমার সাথে অঙ্কিতকে দেখে নিজেকে ঠিক
রাখতে পারিনি আমি জানি না। শুধু এটুকু জানি তোমার সাথে অঙ্কিতকে সহ্য করাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমার সাথে অঙ্কিতের কথা বলা, ওর টোনার হাত ধরাতেই আমি রেগে গেছিলাম। আমার মাথার ঠিক ছিলো না, কিন্তু কেন এই রাগ আনার হয়েছে আমি জানি না। সত্যিই জানি না!’
‘আমার সাথে অঙ্কিতের সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বের।’
আমার কথা শুনে উনি আমার দিকে তাকালেন যা আমি ড্রাইভ করতে করতে লক্ষ্য করলাম। জানলার দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন,
‘সেটুকু থাকলেই ভালো।’
মনে মনে হাসলাম ওনার কথা শুনে। কালকে থেকে যে অস্বস্তিটা হচ্ছিল তা ওনার সাথে থাকার ফলে চলে গেছে তা ভালোই বুঝতে পারছি। দেখতে দেখতে ওনার বাড়ির সামনে এসে পড়লাম। ওনাকে নামতে বারণ করে আমি নিজে নেমে ওনাকে নামতে সাহায্য করলাম। কিছুক্ষন আগের মতোই ওনার ডান হাত নিজের কাঁধের উপর নিয়ে, এক হাতে ওনার কোমর জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে ওনার বাম হাত শক্ত করে ধরলাম।
‘হরি কাকা, ওনার রুমটা খুলে দাও তো।’
হরি কাকা আসতেই হরি কাকে বলে দিয়ে আসতে আসতে ওনাকে নিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলাম। সিঁড়ি দিয়ে অনেক ধীরে ধীরে উঠলাম ওনাকে, প্রচুর কষ্ট হচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে বোঝাই যাচ্ছে। না জানি কীভাবে নেমেছিলেন। ওনার ঘরে গিয়ে ওনাকে বিছানায় বসিয়ে দিতেই হরি কাকা এলেন।
‘কাকা, আপনি ওনার খেয়াল রাখবেন। উনি জানো এক পা ঘরের বাইরে না ফেলেন পুরোপুরি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত।’
‘আমি কেন, তুমিই তো ওনার খেয়াল রাখতে পারো বউমা।’
হরি কাকার কথা শুনে আমি চুপ করে গেলাম। আড় চোখে দেখলাম আদিত্য আমার দিকে করুন ভাবে তাকিয়ে আছে কিন্তু কেন?
‘কাকা তোমার বউমার পড়াশোনা আছে। তার আমার জন্য সময় নেই।’
আদিত্যের কথায় আমি ওনার দিকে চোখ বড়ো করে তাকাতেই আদিত্য মাথা নিচু করে ঠোঁট উল্টে ফেললেন বাচ্চাদের মতো। ওনার উপর রাগ দেখাবো না কি করবো আমি বুঝতে পারছি না এই মুহূর্তে। হরি কাকাকে বললাম,
‘তুমি ওর জন্যে একটু সুপ নিয়ে আসো। আমি খাইয়ে চলে যাবো।’
এরপর আদিত্যর দিকে তাকাতেই দেখলাম আদিত্য হাসছেন, আমি তাকাতেই চুপ করে গেলেন। আমি ছোটো ছোটো চোখ করে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘মতলব টা কি হম?’
‘আরেকটু থাকো না।’
খুবই আস্তে কথাটা বললেও আমি শুনতে পেলাম কিন্তু উনি কথাটা আমায় শুনতে দিতে চাইনি বলে ভান করে থাকলাম না শোনার। তাহলে কি ওনারও আমার মতোই অনুভব হয়? আমার যেমন ওনার সাথে থাকতে, সময় কাটাতে ভালো লাগে তেমন কি..?? ধুর, কিসব যে ভাবছি। নিজে নিজেই এসব ভাবছি আর লজ্জা পাচ্ছি, ধ্যাৎ!
কিছুক্ষণ পর হরি কাকা সুপ দিয়ে গেলে আমি সেটা ওনাকে খাওয়াতে খাওয়াতে অনেকরকম গল্প করতে থাকলাম। সব শেষে আমি যখন বেরোতে যাবো তখন উনি হঠাৎই আমার হাত পিছন থেকে টেনে ধরলেন। ওনার দিকে তাকাতেই উনি বললেন,
‘আমি যে কদিন ভার্সিটি যেতে পারবো না সে কটাদিন খুব সাবধানে থাকবে। জিয়া আর সৌভিক একা তোমাকে পেলে অনেক কিছুই করতে পারে তাই কোয়েল আর, আর অঙ্কিতের সাথেই থাকবে। বন্ধুর মতো, ঠিক আছে?’
ওনার শেষের কথাটা শুনে না হেসে পারলাম না। এদিকে উনি আমার হাসি দেখে বাচ্চাদের মতো গাল ফুলালে আমি আরো জোরে হেসে ফেললাম। উনি ফোন হাতে নিয়ে কাওকে ফোন করে বললেন,
‘ম্যাডাম নীচে যাচ্ছে। ওনাকে ওনার হস্টেলে ঠিক ভাবে পৌঁছে দিয়ে তারপর আসবে।’
‘আপনার ড্রাইভার থাকা স্বত্বেও নিজে পাকামী মেরে ড্রাইভ কেন করেছেন এই অবস্থায়?’
আমার প্রশ্ন শুনে উনি একটা ক্যাবলা হাসি দিলে আমি নিচে চলে আসি।
নিচে নামতেই আমার ফোনে মেসেজ আসে, “সাবধানে যাবে।” হে ভগবান! একসিডেন্ট হয়েছে ওনার আর খেয়াল রাখছে উনি আমার। কেন এত খেয়াল রাখছেন আমার? এটা নিয়ে আর না ভেবে আমি হস্টেলে চলে এলাম। কিন্তু ওনাকে এভাবে একা ছেড়ে আসতে কেন জানো মন চাইছে না।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১৫||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
২৯.
মৌমিতা চলে যাওয়ার পর আদিত্যের কিছুক্ষণ আগের ঘটনাগুলো মনে পড়তে থাকলো। যতটুকু সময় মৌমিতা তার সাথে ছিলো ততটুকু সময় একটা আলাদাই অনুভূতি হচ্ছিল আদিত্যের।
‘আজ কেন এমন হচ্ছে? মন চাইছিলো আজ মৌমিতাকে এখানেই রেখে দি। ওর সাথে মেশার পর থেকেই মনে হয় সবসময় ওর আশে পাশে থাকি যেটা আগে কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে মিশে হয়নি। বরং সব মেয়েদের থেকেই দূরে থাকতে পছন্দ করতাম আমি। এখনও তাই শুধু মৌমিতা ছাড়া, ও কাছে থাকলে মনে হয় সময়টা থেমে গেলে ভালো হতো। তাই হয়তো আজকে হরি কাকার সামনে বলেই ফেলেছিলাম ওকে থেকে যাওয়ার কথা। হোয়াট ডাজ দিজ মিন? ইজ শি স্পেশাল টু মি?’
আদিত্য কথাটা ভাবতেই ব্লাশ করতে করতে শুয়ে পড়লো। আজকাল সারাক্ষণ আদিত্যের মাথায় মৌমিতার কথা ঘুরতে থাকে। আদিত্য টের পাচ্ছে তার এই অনুভূতি বদলের কিন্তু পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না। এতো কিছু ভাবতে ভাবতে আদিত্যের চোখটা লেগে এলো।
অন্যদিকে,
আমি হস্টেলে ফিরে ড্রাইভারকে বলে দিলাম যাতে আদিত্যকে বলে দেয় আমি ঠিক ভাবে পৌঁছে গেছি আর ঠিক ভাবেই থাকবো। আমাকে নিয়ে না ভেবে নিজেকে নিয়ে ভাবতে। রুমে আসতেই দেখলাম কোয়েল নেই, তার মানে এখনো ভার্সিটিতেই আছে। বিকেল হতে চললো, তাহলে কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে। আমি ফ্রেশ হয়ে নিয়ে একটা বই নিয়ে বসলাম। কিন্তু পড়ায় মন বসলো না, বারবার খালি আদিত্যের কথা মনে পড়ছে। আর যতবার ওনার কথা মনে পড়ছে ততবার মনে হচ্ছে ওনাকে এভাবে একা ছেড়ে আসাটা ঠিক হলো না। যেভাবে ওই অবস্থায় নিজে ড্রাইভ করে গেছেন তারপর আবার হেঁটেছেন তাতে যদি জ্বর আসে? গা-টা তো কেমন জানো গরম ছিলো।
‘এই মৌ! তুই কোথায় গেলি তখন ওরকম ছুটে? আদিত্যদার সাথে দেখা হয়েছিল?’
‘ওহ তুই এসে পড়েছিস? হ্যাঁ ওনার সাথে দেখা হয়েছে কিন্তু…
‘কিন্তু কি?’
‘তুই ফ্রেশ হয়ে আয় আগে। তারপর সবটা বলছি।’
কোয়েল ফ্রেশ হতে চলে গেলো আমার কথা শুনে। ওর ফ্রেশ হয়ে আসার পর আমি ওকে সবটা বলতে শুরু করলাম। সব শোনার পর ও বললো,
‘তুই আদিত্যদার বাড়ি গেছিলি?’
‘আব, হ্যাঁ। ওনাকে ওভাবে ড্রাইভ করতে দেওয়াটা ঠিক হবে না মনে হলো তাই।’
‘না না ঠিক করেছিস। কি জানি রাতে মনে হয় জ্বর আসবে।’
কোয়েল কথাটা আনমনে আস্তে করে বললেও আমি সেটা শুনতে পেয়ে যাই।
‘কি? ওনার জ্বর আসবে?’
‘আ..আব, হ্যাঁ। আদিত্যদার এরকম একসিডেন্ট অনেকবার হয়েছে। আসলে আদিত্যদা ব্যাথা ঠিক সহ্য করতে পারে না তাই জ্বর চলে আসে। সেখানে আজ ওরকম অবস্থায় ড্রাইভ করেছে, হেঁটেছে। আমি তো বুঝতে পারছি না আদিত্যদার মধ্যে এতটা চেঞ্জ কিভাবে হলো। মানে যেই ছেলেটা নিজের ছাড়া আর নিজের আপনজন ছাড়া অন্যকাওর কথা কোনোদিন ভাবেনি সে আজকে এতো…?’
কোয়েল থেমে গেলে আমার মাথায় কোয়েলের কথাগুলো ঘুরতে লাগলো। সত্যি তো আজ আমারও এটাই বারবার মনে হচ্ছিলো, কেন উনি এভাবে ছুটে এলেন? কি এমন হতো কপিটা সাবমিট না করলে? যত দিন যাচ্ছে ততো বেশি জটিল হয়ে যাচ্ছে আমাদের সম্পর্কটা।
‘কি রে তুই আবার কোথায় হারিয়ে গেলি?’
‘ন..না না। বল।’
‘দেখলি, আজ আদিত্যদা জিয়াকে কিভাবে শাস্তি দিলো? আমি বলেছিলাম না আদিত্যদা জিয়াদের মতো না। শাস্তিটা বেশ ভালোই পেয়েছে জিয়া। ম্যাডাম দারুন শাস্তি দিয়েছে তাই না?’
‘নাহ।’
‘মানে?’
‘মানে এটাই যে শাস্তিটা আদিত্য দিয়েছেন ম্যাডাম না। ম্যাডাম তো নিমিত্ত মাত্র। আমি দেখেছি ম্যাডাম আর আদিত্য কথা বলছিলেন আর তারপরেই ম্যাডাম জিয়াকে বলেন সবার অ্যাসাইনমেন্ট করে আনতে।’
‘ওয়াও! জীবনে প্রথম একটা ভালো কাজ করেছে আদিত্যদা।’
কোয়েলের কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম সাথে কোয়েলও। এরপর পড়তে বসলেও আমি মনে লাগাতে পারলাম না। রাত যত বাড়ছে আমার ধৈর্য জানো ততো হারাচ্ছে। রাতের খাবারটা কোনোমতে খেয়ে কোয়েলকে আস্তে করে বলেই ফেললাম,
‘শোন না, কোয়েল। বলছিলাম যে…
‘কি হয়েছে?’
‘না মানে, আদিত্যকে একবার ফোন করে খবর নিলে ভালো হতো না?’
‘হ্যাঁ, সেটাই করতে যাচ্ছিলাম আমি।’
‘তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কর না তাড়াতাড়ি। না মানে, উনি আমার জন্য এতো কিছু সহ্য করছেন আমার তো খবর নেওয়া উচিত তাই না? তাই বলছি আর কি।’
কোয়েল আমার দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকালে আমি কোনোরকম সামাল দেওয়ার জন্য কথাটা বলি। ও কিছু না বলে কল করে আদিত্যকে। এটা তো আমিও করতে পারতাম, নাম্বার তো ছিলো কিন্তু করাটা ঠিক হবে না ভেবে আর করিনি। হরি কাকার নাম্বারটা নিয়ে আসলে ভালো হতো বা ড্রাইভারটার..
‘কি? জ্বর এসেছে? ডাক্তার ডেকেছিলে?’
কোয়েলের কথা শুনে আমিও ঘাবড়ে গেলাম। ও ফোন রাখতেই বললো,
‘আদিত্যদার খুব জ্বর এসেছে মৌ। ডাক্তার দেখে গেছেন কিন্তু জ্বরটা নামছে না কিছুতেই। জানতাম এমনটা হবে।’
‘কোয়েল চল। আমরা ওনার বাড়িতে যাই, আমি চিনি ওনার বাড়ি।’
কোয়েল আমার হাত ধরে আটকে বললো,
‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোর? এতো রাতে আমরা দুটো মেয়ে আদিত্যদার বাড়ি গেলে লোকে কি বলবে বল তো? যা করার কালকে সকালে করবো। এখন চাইলেও কিছু করতে পারবো না এখন। বোঝার চেষ্টা কর।’
কোয়েলের কথাটা ফেলতে পারলাম না কিন্তু আমার মনও তো মানছে না। আজ আমার জন্য এই অবস্থা ওনার, ওনাকে ওই অবস্থায় রেখে কি করে আমি ঘুমাবো?
৩০.
‘এই কোয়েল, কোয়েল। ওঠ, সকাল হয়ে গেছে।’
কোয়েল চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুই, তুই ঘুমাসনি?’
‘এসব কথা পরে হবে। তুই আগে যা ফ্রেশ হ। আদিত্যের বাড়ি যেতে হবে তো?’
‘ওহ, হ্যাঁ।’
কোয়েল রেডি হয়ে নিলে আমরা বেড়িয়ে পড়ি আদিত্যের বাড়ির উদ্দেশ্যে। অসুবিধা হয়নি কারণ আমি আর কোয়েল দুজনেই ওনার বাড়ি চিনি। ওনার বাড়ি আসতেই হরি কাকা এলে আমি কোয়েলকে উপরে যেতে বলেদি।
‘আরে বউমা…
‘চুপ, চুপ, চুপ। হরি কাকা কোয়েল জানো জানতে না পারে আমি আদিত্যের স্ত্রী। ঠিক আছে?’
‘কিন্তু কেন?’
‘সব পরে বলব। আগে বলুন উনি কেমন আছেন?’
‘একদম ভালো না। জ্বর রাতের দিকে নামলেও মাঝরাত থেকে ধুম জ্বর।’
‘কি?’
আমি কথাটা শুনেই দৌঁড়ে উপরে উঠে গেলাম। ঘরে ঢুকে দেখলাম কোয়েল আদিত্যের মাথার পাশে বসে আছে। আমি এগোতেই ও উঠে গেলো।
‘আরে উঠছিস কেন? তুই বস।’
‘নাহ। তুই বস, তোকে খুঁজছে আদিত্যদা।’
আমি কোয়েলের কথা শুনে অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। কোয়েল বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে, ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো ও ব্যাপারটা ভালো ভাবে নেয়নি। যাই হোক, এখন এসব নিয়ে ভাবলে হবে না। আমি ওনার মাথার পাশে বসতেই দেখলাম উনি গোঙাচ্ছে। ওনার কানের কাছে মুখ নিতেই শুনলাম,
‘ম..মাম! মাম।’
ওহ, আমার না শাশুড়ি মায়ের নাম নিচ্ছিলেন উনি। কোয়েল তাহলে হয়তো ভুল…
‘ম..মৌ..
আমি তৎক্ষনাৎ উঠে বসলাম। আমি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। উনি আমার নাম নিচ্ছেন? কিন্তু কেন? হয়তো, কালকে আমি ছিলাম ওনার সাথে তাই। হ্যাঁ, তাইই হবে।
‘আদি বাবা কালকে রাত থেকে মাম মানে কর্তামা আর মৌ, মানে তোমার নাম নিচ্ছে বউমা। এতদিন অবধি শুধু আমাদের কর্তামার নাম নিতো, খুব ভালোবাসে তো তাই। এখন তোমার নামও নিচ্ছে তারমানে তোমাকেও…
‘হরি কাকা তুমি এক বাটি জল আর একটা কাপড় নিয়ে আসুন। ওনাকে জলপট্টি দেবো।’
‘আমি দিয়েছিলাম রাতে ডাক্তার বাবু ওষুধ দেওয়ার পরে আর দেইনি।’
‘ঠিক আছে, এখন নিয়ে আসুন।’
উনি যেতেই কোয়েল এলো। আমি আলতো করে ওনার কপালে হাত রাখতেই বলে উঠলাম,
‘ওনার তো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।’
‘চিন্তা করিস না। আমি ডাক্তারবাবু কে ফোন করেছি উনি আসবেন বলেছেন। এখন তো অনেকটা সকাল, এখনই হয়তো পারবেননা কিন্তু চলে আসবেন।’
আমি ওনার গায়ে কম্বলটা ভালো ভাবে দিয়ে দিলাম। হাতটা ধরে কম্বলের ভিতরে রাখবো ঠিক তখনই দেখলাম উনি আমার হাতটা ধরে রেখেছেন। আমি সেটা দেখে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে কোয়েল বললো,
‘থাক না। জ্বরের ঘোরে ধরেছে। থাকতে দে। কিছুক্ষণ পর এমনিই ছেড়ে দেবে।’
‘তুই এতো কি করে জানলি?’
‘হ্যাঁ? আ..আমি? ইয়ে, আমারও তো এমন হয়, তাই বললাম।’
‘ওহ।’
‘হ্যাঁ। আমি আসছি, হরি কাকার থেকে জলের বাটিটা নিয়ে আসি আর বলে দি একটু সুপ করে দিতে।’
আমি বসে রইলাম ওনার পাশে। আস্তে আস্তে ওনার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে গেলো কোয়েলের কথা মতো। কোয়েল এতটা ভালো কিভাবে চেনে আদিত্য কে?
‘এনে।’
কোয়েল জলের বাটিটা নিয়ে এলে আমি জলপট্টি দেওয়া শুরু করি। প্রায় অনেকক্ষণ জলপট্টি দেওয়ার পর কোয়েল বললো,
‘আমি আরেকবার ডাক্তারবাবু কে কল করছি।’
আমি শুধু মাথা নাড়লাম কোয়েলের কথায়। এখন অনেকটা ঠিক লাগছে আদিত্যকে। জ্বরটা সামান্য কমেছে।
‘কালকে রাত থেকে আদিত্যদার খবর পাওয়ার পর থেকে সারাটারাত মৌ ছটফট করেছে। ও যে ঘুমাইনি তা আমি বুঝতে পেরেছি ভালোভাবে,সারারাত পায়চারি কিংবা এদিক ওদিক করে কাটিয়েছে। সকাল হতে না হতে ছুটে এলো এখানে। এদিকে আদিত্যদাও মৌয়ের নাম করছিলো। এছাড়া আসার পর থেকে মৌকে চোখে চোখে রাখছে। ব্যাপার টা কি? সবটাই কি স্বাভাবিক নাকি আমি যেটা ভাবছি সেটাই সত্যি?’
চলবে