‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১০||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
১৯.
‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলমেন্ট! আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ আমাদের যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ডান্স কম্পিটিশনে সামিল হওয়ার জন্য। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হতে চলেছে আমাদের এই কম্পিটিশন। তাই আমি আপনাদের অবগত করতে চাইছি কম্পিটিশনের রাউন্ড সম্পর্কে। আমাদের ফাস্ট রাউন্ড হলো – যেকোনো ধরণের ইস্টার্ন ডান্স অর্থাৎ ভারতনাট্যম, কথক, ওডিশি ইত্যাদি। সেকেন্ড রাউন্ড হলো – বলিউড সং। এবং থার্ড মানে আমাদের ফাইনাল রাউন্ড যা একটু কঠিন হতে চলেছে। এই ফাইনাল রাউন্ডের দুটো ভাগ আছে, প্রথম ভাগে – আমাদের কম্পিটিটররা তাদের পছন্দসই পার্টনারদের সাথে হিপহপ বা সালসা করবে এবং দ্বিতীয় ভাগে – ব্যালে করবে। এই সব রাউন্ড হওয়ার পর জাজেস্টরা ঠিক করবেন কে আমাদের এই কম্পিটিশনের উইনার। আর যদি কোনো পার্টিসিপেন্টএর নাচে অনেক ভুলত্রুটি থাকে তাহলে জাজেস্টরা তাদের এলিমিনেট করতে পারে।’
হোস্টের কথা শেষ হতেই পুরো হল ঘর হাততালির আওয়াজে ভরে উঠলো। হোস্ট হাসি মুখে স্টেজ থেকে নেমে গেলে স্টেজের উপর থাকা স্পট লাইট আবার অফ করে দেওয়া হয়।
‘অ্যানাউন্সমেন্ট তো হয়ে গেলো, তুই রেডি তো?’
আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গয়না ঠিক করছিলাম সে সময় কোয়েল আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করায় আমি ওর দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলাম,
‘আমি অনেক আগেই পুরোপুরি রেডি হয়ে গেছি কোয়েল। এই নিয়ে তুই চার থেকে পাঁচ বার কথাটা জিজ্ঞেস করলি। এত নার্ভাস হচ্ছিস কেন বল তো তুই? কম্পিটিশনে ভাগ আমি না তুই নিয়েছিস মনে হচ্ছে তোর নার্ভাস হওয়া দেখে।’
‘সেটাই তো। যেখানে কম্পিটিশনে নামই দিতে চাইছিলি না তুই, কান্নাকাটি করছিলিস সেখানে আজ কম্পিটিশনের দিন তুই এতো কনফিডেন্ট! কি ব্যাপার? এই কনফিডেন্ট হওয়ার রহস্য কি? আমি যা আন্দাজ করছি তাই নাকি? হম, হম, হম?’
কোয়েল আমাকে কুনুই দিয়ে হালকা গুঁতো মারতে মারতে কথাটা বললে আমি অস্বস্তিতে পরে যাই। ওকে ধমক দিয়ে বলি,
‘এই তুই চুপ করবি? আমাকে আমার ডান্স ফোকাস করতে দে। খালি আজে বাজে কথা।’
কোয়েল কে কাটিয়ে গ্রীন রুম থেকে বেরিয়ে এলাম লাজুক হাসি নিয়ে। কোয়েল যদি এভাবে দেখতো তাহলে আবার উল্টো পাল্টা বলা শুরু করতো। উফ, পারেও বটে মেয়েটা। কোয়েল কে নাহয় বুঝতে দিলাম না যে আমি নার্ভাস কিন্তু আসলে তো তা নয়। আমার তো ভীষণ নার্ভাস লাগছে, আমি পারবো তো?
হঠাৎ কেউ আমার কাঁধে হাত রাখলে আমি পিছন ফিরে তাকাই, অবাক হইনা কারণ এ কদিনে তার স্পর্শ আমি খুব ভালো ভাবেই চিনে গেছি। আমি কিছু বলতে যাবো সেই মুহূর্তে কোয়েল চলে এলো,
‘পরে কথা বলিস এখন চল, গ্রীন রুমে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম এসেছেন।’
কোয়েলের কথা শুনে আমি কোয়েলের সাথে চলে এলাম শুধু একবার পিছন দিকে তাকিয়ে। গ্রীন রুমে আসতেই ম্যাডাম কে দেখে আমি নমস্কার করলাম। তারপর পিছিয়ে এসে দেখলাম আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকে যারা যারা অংশগ্রহণ করেছে তারা সবাই উপস্থিত আছে, জিয়াও! আমি কোয়েলের দিকে তাকাতেই কোয়েল আমার হাত শক্ত করে ধরে আমার পাশে দাঁড়ালো। ম্যাডাম বলতে শুরু করলেন,
‘আমি শুধুমাত্র এখানে তোমাদের এটাই বলতে এসেছি যে আমাদের ইউনিভার্সিটির প্রেস্টিজ তোমাদের হাতে, এইভেবে জানো নার্ভাস হয়ো না। এটা সামান্য একটা কম্পিটিশন, তোমরা এখানে তোমাদের বেস্ট টা দেবে দ্যাট সেট। ইউনিভার্সিটির প্রেস্টিজ কথাটা মাথাতেই রাখবে না, নরমাল কম্পিটিশনের মতো দেখবে তাহলেই লক্ষ্য পূরণ হবে। আর হ্যাঁ, একে অপরকে বিট করার কথা তো মাথাতেও আনবে না কারণ এতে ক্ষতি বই লাভ হবে না। অল দ্য বেস্ট মাই স্টুডেন্টস!’
ম্যাডামের কথায় একটু হলেও কনফিডেন্স আর রিলিফ, দুটোই পেলাম।
‘চিন্তা করিস না সব ঠিক হবে। আর ম্যাডামের লাস্ট কথাটা মনে রাখিস, কাওকে টেক্কা দেওয়ার জন্য এই কম্পিটিশন নয়।’
আমি বুঝলাম কোয়েল কথাটা জিয়াকে টোন করেই বললো কারণ কথাটা বেশ জোরে বলেছে কোয়েল, যার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। আমি তো পাশেই ছিলাম, আস্তে বললেই পারতো। আমি জিয়ার দিকে তাকাতেই ও মুখ ফিরিয়ে নিলো, ওর হাবভাবে বোঝাই যাচ্ছে ম্যাডামের লাস্ট কথার গুরুত্ব ও দেবে না। যায় হোক, সেসব না ভেবে আমার নিজের ডান্সে ফোকাস করা উচিত।
২০.
আমাদের নেক্সট পার্টিসিপেট “মৌমিতা ব্যানার্জী।” উনি আমাদের সামনে পারফরম্যান্স করবেন, ভারতনাট্যম।
‘এ মৌ, যা তোর নাম ডেকেছে।’
আমি স্টেজে উঠবো ঠিক সে সময় দেখলাম জিয়া দাঁড়িয়ে আছে। ওর সামনে দিয়ে যেতেই ও একটা হাত আমার সামনে বাড়িয়ে, রাস্তা আটকে বললো,
‘এখনও সময় আছে, পার্টিসিপেট করিস না। জিততে তো পারবিই না বরং নিজের ক্ষতি হয়ে যাবে।’
‘এই থ্রেড টা কিছুদিন আগে দিলেও ভেবে দেখতাম। এখন আমার ভাবার সময় নেই। স্যরি!’
আমি কথাটা জিয়ার চোখে চোখ রেখে বলে মাথা নিচু করে এগোতেই দেখলাম জিয়া একটা পা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি লাফ দিয়ে ওর পা যে উপেক্ষা করে পিছন ফিরে বললাম,
‘পুরোনো টেকনিক! নিউ কিছু ট্রাই কর।’
কথাটা বলে স্টেজের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম হাত জোড় করে। আড়চোখে দেখলাম জিয়া দাঁত মুখ শক্ত করে চলে গেলো আর কোয়েল দু-হাত দিয়ে অল দ্য বেস্ট বললো। আমি ভারতনাট্যমের প্রণাম দিয়ে স্টেজ ছুঁয়ে মাথায় ঠেকিয়ে নিজের নাচ শুরু করলাম।
‘জিয়া জ্বালে জান জ্বালে
জিয়া জ্বালে জান জ্বালে
ন্যায়নোতালে ধুয়ান চালে
ধুয়ান চালে’
ঘোর কাটলো হাততালির আওয়াজে। নমস্কার করে, নাচের প্রণাম জানিয়ে স্টেজ থেকে নেমে আস্তেই কোয়েল জড়িয়ে ধরলো।
‘ভীষণ, ভীষণ, ভীষণ ভালো হয়েছে। এক্সপ্রেশন, স্টেপস সব একদম ঠিকঠাক।’
‘নেক্সট রাউন্ড কখন?’
‘চিন্তা করিস না দেরী আছে। সব তো প্রোগ্রাম শুরু হলো, এখন সকাল এগারোটা বাজে। আজকেই যেহেতু রেজাল্ট দেবে তাই প্রোগ্রাম শেষ হতে হতে রাত বারোটা হয়ে যাবে। একদিনেই শেষ করার প্ল্যান করেছে আর তাছাড়া খুব একটা বেশি পার্টিসিপেন্টস না তো।’
‘আমি যাই ফ্রেশ হয়ে নেই।’
‘হ্যাঁ।’
২১.
স্টেজ অন্ধকার, হঠাৎই স্টেজের উপর একটা সুর ভেসে এলো এবং তার সাথে নুপুরের শব্দ। আস্তে আস্তে বোঝা যাচ্ছে একটি মেয়ে স্টেজের উপর স্টেপস করছে। স্পট লাইট পরলো তখন যখন গান শুরু হলো,
‘মেরা ঝুমকা উঠা কে লায়া ইয়ার ভে
জো গিরা থা বারেলি কে বাজার মে
মেইন তো ঠুমকা লাগাকে শারমা গায়ি
বলি ঘুঙ্গার বাধা দেঙে মেইন আ গায়ি
মুঝকো নাচাকে নাচলে
আজা নাচলে নাচলে মেরে …
ইয়ার তু নাচলে
ঝানাক ঝানাক ঝাঙ্কার…’
সেকেন্ড রাউন্ডের বলিউড সংগের পারফরম্যান্সও শেষ করলাম কোনো ভুলত্রুটি ছাড়া। মনে কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলতে পারবো যেমন প্র্যাক্টিস করেছিলাম তেমনই নিজের বেস্ট টা দিতে পেরেছি কিন্তু… শেষ রাউন্ডে কি করবো?
‘কি রে? কি ভাবিস এতো?’
কোয়েল কখন চলে এসেছে গ্রীন রুমে টেরই পাইনি। ওকে বললাম,
‘ফাইনাল রাউন্ড নিয়ে ভাবছিলাম।’
‘ভাবা বন্ধ করে কিছু খেয়েনে। দুপুর হয়ে গেছে জানিস না নাকি?’
‘এখন আবার খেতে হবে? আমি পারবো না, নামবেই না গলা দিয়ে কিছু।’
‘ম্যাডাম কি বলেছে মনে নেই? বেশি নার্ভাস হতে না আর পেটে খিদে থাকলে কোনো কাজ ঠিক করে হয় না বুঝলি? চুপচাপ খা।’
কোয়েলের কথায় বাধ্য হয়ে ওর আনা খাওয়ার খেতে শুরু করলাম। ও বললো,
‘তোর ফাইনাল রাউন্ডের ফাস্ট পার্ট বিকেলে আর সেকেন্ড মে বি ওই ৮টা নাগাদ। আর এখন বাজে দুপুর তিনটে। তাই চুপচাপ খা, হজম হয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা আমি একটা জিনিস বুঝলাম না। ফাস্ট রাউন্ডের থেকে সেকেন্ড রাউন্ডের এতটা ডিস্টেন্স মানে চার ঘণ্টা। সেকেন্ড রাউন্ড থেকে পার্ট ওয়ানের ডিস্টেন্স ওটার থেকে একটু কম মানে ছটা আবার পার্ট টুয়ের ডিস্টেন্স আরেকটু কম মানে ৮টা। এমন কেন? চার ঘণ্টা, তিন ঘন্টা আর দু ঘন্টা? সিরিজ চলছে নাকি?’
আমার কথা শুনে কোয়েল হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে গেলো তাও হাসি থামছে না। জল খেয়ে আবার হাসছে। বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি ওর হাসি দেখে।😒
‘বাপ রে বাপ! তুই এতো হিসাবও করে ফেললি? বসে বসে কি এই হিসাব করছিলি নাকি?’
‘বললে বল না হলে বাদ দে।😒’
‘আরে বাবা, শোন শোন বলছি। আসলে প্রথমে যতজন পার্টিসিপেট করেছিলো ততজন তো আর নেই।’
‘মানে?’
‘মানে কয়েকজন ডিসকলিফাই হয়ে গেছে।’
‘অ্যা?’
‘ভয়ের কিছু হয়নি। আসলে কয়েকজনের নাচতে নাচতে ঘুঙুর খুলে গেছে যেটা রুলসের বাইরে। নাচের সময় পা থেকে ঘুঙুর খুলে গেলে ডিসকলিফাই তো হবেই, এটাই তো নিয়ম। নাচের এক্সাম এর সময়েও তো তাই হয়। আর তাছাড়া কয়েকজন আসেনি, তাদের জায়গায় নতুন করে অনেকজন নাম দিয়েছে সোর্স খাটিয়ে। আর যাদের নাচ একদমই জাজেস্টদের পছন্দ হচ্ছে না মানে ভুলভাল স্টেপ বেশি তাদের এলিমিনেট করা হয়েছে। এটা তো বলেইছিলো কম্পিটিশন শুরু হওয়ার আগে। তাই একটু সময়ের গোলমাল হয়েছে।’
‘সব বুঝলাম কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম না।’
‘আবার কি?’
‘তুই জানলি কি করে নাচ করাকালীন ঘুঙুর খুলে গেলে তাকে ডিসকলিফাই করা হয়? এক্সাম এর সময় হলেও সেম রুল। এটা তো নাচের রুলস, তুই তো বলেছিলি নাচ সম্পর্কে তোর কোনো আইডিয়া নেই তাহলে?’
‘ইয়ে, এটা ওই হোস্টটা বলেছিল সেটাই বললাম আর কি। যাই হোক, আমি আসছি হ্যাঁ। বাইরে কি হচ্ছে দেখি। তুই কনসার্নট্রেট কর ভালো ভাবে।’
পড়ি কি মরি করে কোয়েল চলে গেলো। জানো কিছু লুকোচ্ছে, এমনটা কেন? থাক, এখন এসব ভাবার সময় নেই। ওদিকে, গ্রীন রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে কোয়েল বড়ো একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১১||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
২২.
Quien eres tu? (Who are you?)
Donde has estado? (where have you been?)
He removido cielo y tierra y no te encontre (I moved heaven and earth and not find you)
Y llegas hoy (but you arrive today)
Tan de repente (So suddenly)
Y das sentido a toda mi vida con tu querer(and give meaning to my life with your love)
স্টেজের মাঝে লাল পোশাকে জিয়া সালসা ডান্সের স্টেপ করে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো অপেক্ষা করছে নিজের পার্টনারের। শুধুমাত্র জিয়া নয় ওর সাথে আমিও হয়তো অপেক্ষা করছি ওর পার্টনার কে সেটা জানার জন্য। মনটা ভীষণ অস্থির করছে, কিছুতেই ফোকাস করতে পারছি না অন্য বিষয়ে। হঠাৎই ছেলের সুর ভেসে এলো,
Na main samjha, na main jaana
Jo bhi tumne mujhse kahaa hai Senorita
Magar phir bhi, na jaane kyun
Mujhe sunke, accha laga hai senorita
আদিত্য! আদিত্যই জিয়ার পার্টনার। আদিত্য কে দেখার পরে পা নিজে থেকেই কেন জানো পিছিয়ে গেলো। এটাই জানার জন্য মনটা এতটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। ভীষণ করে জানতে ইচ্ছা হচ্ছিলো সত্যিই কি উনি জিয়ার পার্টনার? প্রশ্নের উত্তর তাহলে অবশেষে পেলাম আমি, হাহ!
No desvies la mirada (do not look away)
Quedate cerca de mi (stay close to me)
Mujhko baahon mein tum ghero
Samjhi na senorita
ওদের একসাথে নাচ শুরু হলে আমি চোখের জল আড়াল করতে গ্রীন রুমে চলে এলাম। এসে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। মন চাইছে এই সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে অনেক দূরে চলে যাই। কেন? কেন সব সময় আমার সাথেই এমন হয়? কষ্টগুলো কি শুধু আমার জন্যেই তুলে রেখেছেন ভগবান? পারছি না, কিছুতেই আজ নিজের মনকে মানাতে পারছি না।
‘এই মৌ! কি হয়েছে? তুই এভাবে চলে এলি কেন?’
আমি কোনোমতে কান্না চেপে কোয়েল কে উত্তর দিলাম,
‘আরে কিছুই না। চোখে মুখে জল দিতে এসেছিলাম। তুই যা আমি ঠিক আছি।’
‘আচ্ছা।’
কোয়েল চলে গেলে আমি আরো কিছুক্ষণ বসে রইলাম। চোখে মুখে জল দিয়ে বেরিয়ে এলেও চোখের জল থামার নাম নিচ্ছে না আমার।
‘কি হয়েছে তোর বল তো? কাঁদছিস কেন?’
কোয়েলকে দেখে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। ও কাছে আসতেই ওকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম।
‘কি হয়েছে বলবি তো? কেন কাঁদছিস? কেউ কিছু বলেছে তোকে?’
‘নাহ। বাবা-মার কথা খুব মনে পড়ছে। সবার বাড়ির লোক এসেছে কিন্তু আমার বাড়ির লোক আসতে পারেনি। আসলে আমার সব কম্পিটিশনে আমার বাবা-মা থাকতই তাই ওদের কথা খুব মন..
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। মিথ্যে বলার অজুহাতে কেঁদে মনটা হালকা তো করতে পারবো।
‘দেখ মৌ! একদম কাঁদবি না। আঙ্কেল আন্টি নেই তো কি হয়েছে আমি তো আছি নাকি? বান্ধবী না ভেবে বোন ভেবেনে আমায়। তাহলেই তো হলো।’
কোয়েল আমাকে সোজা করে চোখের জল মুছিয়ে বললো আবারও বললো,
‘কাওর ব্যবহারে কষ্ট পাস না। কেউ কাওর জন্য কখনও অপেক্ষা করে না, সময়ের সাথে সাথে সবাই এগিয়ে যায়। যারা অপেক্ষা করে তারা শুধুমাত্র কষ্টই পায় জানিস তো? অপেক্ষাটা তো তখন স্বার্থক যখন, যার জন্য অপেক্ষা করছিস সেও তোকে পাওয়ার জন্যই অপেক্ষারত। সব কিছুই দুদিক থেকে থাকাটা প্রয়োজন বুঝলি? কোনো কিছু একতরফা হলে সেটার থেকে কোনো আশা রাখতে নেই। আশা জিনিসটা বড্ড খারাপ জানিস নিশ্চই? যা, রেডি হয়েনে ভালো ভাবে। এসব নিয়ে আর ভাবিস না।’
কোয়েল নিজের ফোন নিয়ে চলে গেলো আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে। কিন্তু ওর কথায় বুঝতে পারলাম ও আমার মিথ্যেটা ধরে নিয়েছে। কোয়েলের কথাগুলো মাথায় ঘুরতে থাকার ফলে আমি রেডি হতে শুরু করলাম। ঠিকই বলেছে ও, আমার আশা করাটা ঠিক হয়নি। এতে কষ্টটা তো শুধু আমিই পাচ্ছি, যার জন্য পাচ্ছি সে তো ভালোই আছে কোনো ধারণাও নেই তার এ বিষয়ে। তাহলে কেন আমি তার জন্য নিজের সময় নষ্ট করবো? আমাকেও এইবার নিজের দিকটা বুঝে নিতে হবে।
২৩.
আদিত্য বসার সিটের পাশে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় জিয়া আদিত্যের বাহু একহাত দিয়ে জড়িয়ে কাঁধে মাথা রেখে বললো,
‘আদি! আজ আমি খুব হ্যাপি জানো তো? আজ কতদিন পর তোমার সাথে ডান্স করতে পারলাম। আর এই পারফরম্যান্সটার জন্যে আমরা একসাথে প্র্যাকটিসও করতে পেরেছি।’
‘কথাটা এইটা নয় জিয়া। বল, এই পারফরম্যান্স এর জন্য প্র্যাকটিসের বাহানায় তুই আমার কাছাকাছি থাকতে পেরেছিস। তুই তো চেয়েছিলিস হিপহপে নাম দিতে, যাতে আমার আরো ক্লোজ আসতে পারিস কিন্তু আমার জন্যেই সেটা হলো না কি তাই তো?’
আদিত্যের কথায় জিয়া চুপ করে গেলো। আদিত্য নিজের বাহু থেকে জিয়ার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
‘পারফরম্যান্স শেষ তোর সাথে আমার সম্পর্কও শেষ। তাই আমার কাছে তো দূর, সামনেও আসবি না তুই। তোর বিহেভিয়ারের জন্য আজ তুই আমাকে হারালি জিয়া। বারণ করেছিলাম বাড়াবাড়ি করিস না।’
‘কি এমন করেছি আমি?’
‘আমি মৌমিতার পার্টনার হিসেবে নাম দিতে চেয়েছিলাম এটা তুই জানতিস তাই তুই তাড়াতাড়ি করে আমার সাথে তোর নামটা দিয়ে দিয়েছিস আর আমায় বলছিস প্রিন্সিপাল ম্যাডাম দিয়েছেন। কি মনে করেছিস তুই আমি কিছু জানি না?’
‘তো কেন তুমি মৌমিতার পাইটনার হতে চাইছিলে? কে হয় ওই মেয়েটা তোমার? চেনা নেই জানা নেই হুট করেই কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। শুধুমাত্র কোয়েলের ফ্রেন্ড দেখে তুমি ওকে হেল্প করতে চাইছিলে নাকি অন্য কিছু?’
‘সেটা, সেটা তোর জেনে লাভ নেই। ইউ জাস্ট স্টে আওয়ে ফ্রম মি!’
আদিত্য রেগে অন্য দিকে চলে গেলো। জিয়া ওখানে দাঁড়িয়ে আদিত্যের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
‘থ্যাংক গড আমি আগে ভাগে তোমার আর আমার নাম টা দিয়ে দিয়েছিলাম। নাহলে আজ তুমি ওই ক্ষ্যাত, দুদিনের আসা মেয়েটার সাথে তুমি পার্টিসিপেট করতে। এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছি, ভালোই টেক্কা দিচ্ছিলো আমায় এবার দেখি কার সাথে পার্টিসিপেট করে ফাইনাল রাউন্ডের পার্ট ওয়ানে। আর রইলো বাকি তোমার থেকে দূরে থাকার কথা? হাহ! সেটা তো ইম্পসিবল। তোমার ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, তুমি তো আমারই হবে।’
‘আমাদের নেক্সট পার্টিসিপেন্ট হলো, মৌমিতা ব্যানার্জী!’
হোস্টের ঘোষণা শেষ হতেই জিয়া মনে মনে হাসলো। অন্ধকার হয়ে গেলো স্টেজ, সুর ভেসে এলো একটি ইংলিশ গানের।
‘এইটা তো হিপহপ নাচের গান। একা একা নাচবে নাকি?’
জিয়া মনে মনে কথাটা ভাবতেই দেখতে পেলো স্টেজে মৌমিতাকে। মৌমিতা একাই স্টেপ করছে একটা ব্ল্যাক প্যান্ট আর ব্রাউন কালারের লং গোলগলা ঢিলে ঢালা টি-শার্ট।
Girl, you know I want your love
Your love was handmade for somebody like me
Come on now, follow my lead
I may be crazy, don’t mind me
মৌমিতা একটা দড়ি ধরে টানার মতো স্টেপ করে পিছন দিকে ঝুলে পড়তেই একটা ছেলে এসে মৌমিতাকে ধরে নিলো। তারপর একসাথে স্টেপ করা শুরু করলো। ছেলেটি আসতেই হলে সিটি বেজে উঠলো, হাততালি পড়তে লাগলো।
Say, boy, let’s not talk too much
Grab on my waist and put that body on me
Come on now, follow my lead
Come, come on now, follow my lead
মৌমিতা আর ছেলেটার নাচ যথেষ্ট পরিমাণের ক্লোজ যা আদিত্যের চোখের সামনেই হচ্ছে। আদিত্য মৌমিতার নাচ শুরু হতেই যেখানে ছিলো সেখানেই জমে গেছিলো। ছেলেটাকে দেখার পরেই আদিত্যের চোয়াল ও হাতের মুঠ শক্ত হয়ে গেছে। দাঁতে দাঁত চেপে আদিত্য শুধু বললো,
‘অঙ্কিত!’
আদিত্য আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে ব্যাকস্টেজে চলে গেলো। এদিকে জিয়া হা করে মৌমিতা এবং অঙ্কিতের নাচ দেখছে।
I’m in love with the shape of you
We push and pull like a magnet do
Although my heart is falling too
I’m in love with your body
And last night you were in my room
And now my bedsheets smell like you
Every day discovering something brand new
I’m in love with your body
ব্যাকস্টেজে পৌঁছনোর পরেই আদিত্য দেয়ালে সজোরে একটা ঘুষি মারে যা দেখতে পেয়েই কোয়েল ছুটে এসে আদিত্যকে আটকায়। আদিত্য রাগী চোখে কোয়েলের দিকে তাকালে কোয়েল ভয় পেলেও নিজেকে শক্ত রাখে।
Oh-I-oh-I-oh-I-oh-I
I’m in love with your body
Oh-I-oh-I-oh-I-oh-I
I’m in love with your body
Oh-I-oh-I-oh-I-oh-I
I’m in love with your body
Every day discovering something brand new
I’m in love with the shape of you
আদিত্যর জানো মাথা ফেটে যাচ্ছে অঙ্কিতকে মৌমিতার এতটা কাছে দেখে। যখনই মৌমিতা যে অঙ্কিত টাচ করছে তখনই আদিত্যের হাত, মুখ শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কোয়েল মনে মনে ভাবছে,
‘এতো দেখে মনে হচ্ছে অঙ্কিত স্টেজ থেকে নামলে ওকে গিলেই খেয়ে ফেলবে। কিন্তু আদিত্যদা এতোটা রিয়াকট কেন করছে? তখন জিয়ার সাথে আদিত্যদা কে দেখে মৌ রিয়াক্ট করলো আর এখন মৌয়ের সাথে অঙ্কিত কে দেখে আদিত্যদা রিয়াক্ট করছে। ব্যাপার টা কি? আমি যা ভাবছি সেটাই সত্যি না তো?’
কোয়েলের ভাবনা শেষ হওয়ার আগে মৌমিতার পারফরম্যান্স শেষ হয়ে যাওয়ায় হাততালির রোল পরে যায়, আর সেই আওয়াজের কোয়েলের ঘোর কাটে।
‘এই রে, এইবার কি হবে?’
আমি নীচে নেমে আসছি অঙ্কিতের সাথে তখন দেখলাম কোয়েলের সাথে আদিত্য দাঁড়িয়ে আছেন। কিছুক্ষণ আগের কথা মনে পড়তেই আমি অঙ্কিতকে ওনার সামনে দাঁড়াতে দিলাম না। অঙ্কিতের হাত ধরে ওনার সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে চলে এলাম।
‘ও আমার সামনে দিয়ে অঙ্কিতের হাত ধরে নিয়ে গেলো? এতো বড়ো সাহস?’
‘কেন সাহস হবে না ওর? আর এখানে সাহসের কি আছে? ওর ইচ্ছে ও কার হাত ধরবে আর কার না। তুমি এখানে বলার কে আদিত্যদা? তোমার কি অধিকার ওর উপর? এতোই যখন রাগ তাহলে জিয়ার সাথে কেন পারফরম্যান্স করলে?’
কোয়েল চলে গেলো আর আদিত্য চুপ করে ওখানে দাঁড়িয়ে রইলো। কোয়েল ও মৌমিতার কাছে গ্রীন রুমে গিয়ে ফাইনাল রাউন্ডের জন্য মৌমিতা কে রেডি করতে লাগলো, অঙ্কিত চলে যাওয়ার পর।
২৫.
নেক্সট অর্থাৎ ফাইনাল রাউন্ডের পার্ট টুতে সব পার্টিসিপেন্টস ব্যালে করবে। জিয়া ফাস্ট পারফরম্যান্স দিতে ওঠে। নাচ যখন প্রায় শেষের দিকে তখনই জিয়া পা মচকে পরে গেলো। সবাই বসা থেকে উঠে পড়লো, কয়েকজন জিয়াকে ধরে তুলতে গেলে জিয়া ঠিক করে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারলো না। জিয়া আদিত্যের দিকে তাকালে আদিত্য মুখ ফিরিয়ে নেয় অন্যদিকে। জিয়াকে নিয়ে চলে গেলে জাজেস্টরা ঘোষণা করে যে জিয়া নাচতে পারবে না তাই এই রাউন্ডের পয়েন্টস সে পাবে না।
জিয়া পার্টিসিপেট না করায় আমার নাম ডাকা হলো। ভগবানের দয়ায় আমি আমার নাচটা ভালোভাবেই কমপ্লিট করেছি। এইবার পালা রেজাল্টসের। আমি সহ সব পার্টিসিপেন্টসেরা স্টেজের সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, আমার পাশেই অঙ্কিত আর কোয়েল। সবার প্রথম সেকেন্ড রানার-আপ ঘোষণা করা হলো, সেখানে আমার নাম নেই। টেনশন আরো বেড়ে গেলো, এরপরই নাম নিলো ফাস্ট রানার-আপ জিয়ার।
‘মাই গড, জিয়া ফাস্ট রানার-আপ?’
কোয়েলের কথা শুনে আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। সত্যি তো, জিয়া ফাস্ট রানার-আপ? অঙ্কিত আমাকে বললো,
‘টেনশন নট!’
‘আমাদের কম্পিটিশনের উইনার হলো, মৌমিতা ব্যানার্জী!’
এক মিনিটের জন্য আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কোয়েল আমাকে ধাক্কা দিতেই অঙ্কিত আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার বিস্ময়তা জানো কাটতেই চাইছে না, আমিও অঙ্কিত কে জড়িয়ে ধরলাম কারণ ও না থাকলে আমি পারতাম না জিততে। অঙ্কিতকে ছেড়ে কোয়েলকে জড়িয়ে ধরার পর কোয়েল আমাকে স্টেজে পাঠালো। আমি ট্রফি নিতেই দেখলাম কোয়েলের পিছনে আমার বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানো বিশ্বাসই করতে পারছি না, যে আমার চোখের সামনে আমার বাবা-মা দাঁড়িয়ে? প্রথমত, কম্পিটিশন জেতা আর এখন বাবা-মা।
অন্যদিকে যে কেউ মৌমিতাকে খুব ভালো ভাবে নজরে রাখছে তা মৌমিতা জানেও না। কিছুক্ষণ আগের ঘটনার জন্য কিছুক্ষন পরে মৌমিতার সাথে কি হতে চলেছে সেটা ও কল্পনাও করতে পারছে না।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~১২||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
২৬.
‘বাবা, মা? তোমরা এখানে কীভাবে এলে? কে খবর দিলো? কি করে কি আমি তো কিছুই…
‘আচ্ছা আগে তুই শান্ত হ একটু। তারপর সব বলছি।’
আমি বসতেই মা বললো,
‘তোর বান্ধবী কোয়েল আমাদের আগে দিয়েই ফোন করে জানিয়েছিল। আমরা ভেবে ছিলাম আসবো না তারপর তো বেয়াই মশাইরা এমন ভাবে বললেন যে আমরা না করতে পারলাম না।’
আমি আমার শ্বশুর শাশুড়ির দিকে তাকালাম। হ্যাঁ, আমার বাবা-মার পিছনে তারাও উপস্থিত ছিলেন। তারাও তো আমার বাবা-মা। সত্যি আমি ধন্য এমন আরেকটা বাবা-মা পেয়ে। আমি গিয়ে শাশুড়ি মা কে জড়িয়ে ধরলাম। তারপর আস্তে করে বললাম,
‘মা, আপনার ছেলে তো আমাকে পরিচয় দিতে বারণ করেছে। এখন যদি কেউ এসে পড়ে তাহলে কি হবে? আর বাবা-মাও তো সবটা জেনে যাবে।’
‘চিন্তা করো না আমরা এখানে থাকতেই পারি তার কারণ আমাদের ছেলেও পার্টিসিপেট করেছে। তাই কেউ কোনোরকম সন্দেহ করবে না। গ্রীন রুমে সব পার্টিসিপেন্টসদের গার্জেন আসতে পারে।’
আমি আশ্বস্ত হলাম শ্বশুরমশাইয়ের কথা শুনে। একটু পরেই কোয়েল এলো গ্রীন রুমে, তখন। আমি আমার বাবা-মায়ের সাথেই কথা বলছিলাম। কোয়েল গিয়ে শ্বশুরমশাই আর শাশুড়ি মাকে নমস্কার করতে গেলেই ওরা ওকে জড়িয়ে ধরে।
‘তারমানে ওনার বাবা-মায়ের সাথেও কোয়েলের আলাপ আছে। হবে নাই বা কেন? এই জন্যেই পিছন থেকে কলকাঠি টা নেড়েছে। হচ্ছে তোর, চল হস্টেলে।’
আমি মনে মনে কথাটা বলে নিলাম। কোয়েল আমার বাবা-মা কে প্রণাম করে কিছুক্ষণ ওদের সাথে কথা বলে বেরিয়ে গেলো। কোয়েল বেরোতে না বেরোতেই উনি আসলেন। শ্বশুরমশাই মুখ ফিরিয়ে নিলেও শাশুড়ি মা ওনাকে জড়িয়ে ধরলেন। উনি শ্বশুরমশাইকে ডাকলেন,
‘ড্যাড, কথা বলবে না আজও?’
উনি শ্বশুরমশাইয়ের হাতটা ধরতেই উনি ওনাকে বুকে টেনে নিলেন। আমিও এটাই চেয়েছিলাম, আমার জন্য ওনাদের সম্পর্কে জানো কোনো চিড় না ধরে। শ্বশুরমশাইকে ছেড়ে বাবার দিকে উনি তাকাতেই আমিও বাবার দিকে তাকালাম, দেখলাম বাবা-মা একটু ইতস্তত বোধ করছে। মিথ্যে হাসি দিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞেস করবে ওনাকে তার আগেই উনি এগিয়ে গিয়ে বাবা-মাকে প্রণাম করেন।
‘কেমন আছেন আপনারা? আসলে আমি এখানে চলে আসার পর আর যোগাযোগ করার সুযোগ হয়নি।’
‘না না বাবা ঠিক আছে। আমরা ভালো আছি। তুমি ভালো আছো তো?’
‘হ্যাঁ। আছি কোনোরকম।’
কথাটা আমার দিকে তাকিয়ে বলতেই আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। ওনার তো ভালো থাকার কথা, জিয়ার সাথে পার্টিসিপেট করেছেন। ওহ, জিততে পারেননি তাই ভালো নেই?
‘আচ্ছা, তোমরা কথা বলো। আমরা আসছি।’
বাবা-মা, শ্বশুরমশাই শাশুড়ি মা বেরিয়ে গেলে আমিও পিছন ফিরে ওয়াশরুমে চলে যেতে নিই কিন্তু পারি না। পিছন থেকে আমার হাত ধরে টেনে আমাকে দেয়ালে শক্ত করে চেপে ধরলেন উনি। ওনার চোখে চোখ পড়তেই আমি কিছু বলার সাহস পাইনা। ওনাকে দেখলে কেউ বলবে না, কিছুক্ষণ আগে উনি এত ভালোভাবে কথা বলছিলেন। মুহূর্তেই আমার উপর এত কেন রেগে গেলেন বুঝতে পারছি না। চোখগুলো দেখে মনে হচ্ছে গিলেই ফেলবেন আমাকে। এতক্ষন নীরব থাকার পর উনি সরব হলেন, বললেন,
‘অঙ্কিতের সাথে পার্টিসিপেট কেন করেছো?’
‘আমি কার সাথে পার্টিসিপেট করবো না করবো সেটা তো আমার ব্যাপার তাই না?’
‘আচ্ছা?’
‘হ্যাঁ। আমি আপনাকে আগেও বলেছি এখনও বলছি…
‘একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও খুব ভালো ভাবে। অঙ্কিতের সাথে জানো তোমাকে নেক্সট দিন থেকে না দেখি। তাহলে ফল ভালো হবে না।’
কথাটা বলে উনি সরে গেলেই আমি বলি,
‘কেন? কেন আমি আপনার কথা শুনবো? কে হন আপনি আমার? কি অধিকার আপনার আমার উপর?’
আদিত্য আমার দিকে ফিরলেন। ওনার তাকানো দেখে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। এত করুন ভাবে কেন তাকাচ্ছেন উনি আমার দিকে? আমি তো ভুল কিছু বলিনি। উনিই তো আমাকে প্রথম থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন তাহলে? আমি জানো আর পারলাম না নিজের মনের ভিতর আমার প্রশ্নঃ গুলো আটকে রাখতে। ওনার সামনে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘আপনি তো দিব্যি অন্য একটা মেয়ের সাথে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমি কি কিছু বলেছি তাতে? সেই মেয়েটা আপনার সামনে আমাকে বারবার অপমান করেছে, আপনি কিছু বলেননি, কোনোরকম প্রতিবাদ করেননি কারণ আপনি আমায় স্ত্রী হিসেবে মানেননা। বিয়ের কনসেপ্টটাকেই মানেন না। আপনি যদি জিয়া কে কিছু বলতেন তাহলে ও এরকমটা করার সাহস পেত? আপনি বলুন আমি সেটা চাইও না। আমি আপনার কথাটাই মেনে নিয়েছি। না আমি আপনার কোনো বিষয়ে মাথা ঘামাবো আর না আপনি। তাই আমি কার সাথে কথা বলবো, থাকবো সেটা আমার ব্যাপার আপনি না করার কেউ না। আপনি যদি একটা অন্য মেয়ের সাথে নাচতে পারেন তাহলে আমিও পারি। আপনি যখন চাইলেই আটকাতে পারতেন জিয়ার সাথে পারফরম্যান্স তখন তো আপনি সেটা করেননি, কেন? কোনো উত্তর আছে আপনার কাছে?’
আমার কথা শেষ হতেই অঙ্কিতের আওয়াজ পেলাম পিছন থেকে। অঙ্কিত এগিয়ে এলে আদিত্য আর অঙ্কিত একে অপরের দিকে তাকায় এরপর আদিত্য আমার দিকে একনজর তাকিয়ে চলে গেলেন।
‘কি রে এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা ফ্রেশ হয়েনে।’
অঙ্কিতের কথায় ওর দিকে তাকালাম, জিজ্ঞেস করলাম,
‘কিসের এতো শত্রুতা তোমার ওনার সাথে?’
‘উনি বলতে? আদিত্য?’
‘হম।’
‘ওইসব নিয়ে পড়ে কথা হবে। কেন? আদিত্য কিছু বলছিলো তোকে এই নিয়ে?’
‘নাহ। কিন্তু আমি এখনই জানতে চাই।’
‘আচ্ছা তুই আগে ফ্রেশ হয়েনে। তারপর আমি তোকে সবটা বলবো।’
আমি অঙ্কিতের কথামতো ফ্রেশ হতে চলে গেলাম আর মনে পরে গেলো সেইদিনের কথা যেদিন …..
ফ্লাশব্যাক…..
‘এই কোয়েল? কি করবো এখন?’
কোয়েল নিজের মতো পায়চারি করেই চলেছে। আমি বাধ্য হয়ে উঠে গিয়ে ওকে একটা ঠেলা মেরে বললাম,
‘আরে কি রে! টেনশন হচ্ছে তো নাকি?’
‘উফ! তা আমারও তো টেনশন হচ্ছে নাকি? ভাবতে দে না আমাকে একটু শান্তিতে।’
কোয়েলের কথা শুনে আমি গিয়ে বসলাম আর ওকে বললাম,
‘এই জন্য বলেছিলাম আমার নাম দিতে না। এখন দেখ, হিপহপ বা সালসা করার জন্য আমার পার্টনার প্রয়োজন যেটা নে…
‘পেয়েছি!’
আমি কোয়েলের দিকে অবাক হয়ে তাকালাম। ওর চোখে মুখে আনন্দের ছাঁপ।
‘কাকে পেলি?’
‘চল।’
কোয়েল আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে এলো ভার্সিটির সে জায়গায় যেখানে আদিত্যরা থাকেন। আমি তো বুঝতেই পারছি না কোয়েল কি চাইছে। আদিত্য দেয়ালে ঢেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বই পড়ছিলেন এমন সময় কোয়েল ওনার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘আদিত্যদা!’
‘হম বল।’
আদিত্য বই থেকে মুখ তুলে কোয়েলের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন একবার। আমি মাথা নিচু করে নিলে উনি আবার কোয়েলের দিকে তাকান যা আমি আড় চোখে দেখতে পেলাম।
‘তুমি কি কম্পিটিশনে কাওর সাথে পার্টিসিপেট করছো?’
‘কেন? হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
‘না, আসলে মৌয়ের কোনো পার্টনার নেই তাই তুমি যদি…
‘তা তোর ফ্রেন্ডের পার্টনার দরকার যখন সে কেন কিছু বলছে না? তার নিশ্চই আপত্তি আছে?’
আমি ওনার কথা শুনে ওনার চোখের দিকে তাকালে আমার মনে পড়ে যায় শেষ দিনের ওনার সাথে করা ব্যবহারের। আমি কোনো উত্তর না দিলে উনি আমার দিকে তাকিয়েই কোয়েল কে বলেন,
‘তোর ফ্রেন্ডের আপত্তি না থাকলে আমারও…
‘তোমারও কিছু করার নেই আদিত্য।’
আমরা সবাই দেখলাম জিয়া এসে আদিত্যের পাশে দাঁড়ালো। বললো,
‘তুমি আমার সাথে পার্টিসিপেট করছো আদি। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বলেই দিয়েছেন।’
‘হোয়াট?’
‘ইয়াহ!’
‘ইম্পসিবল। আমাকে না জানিয়ে ম্যাডাম আমার নাম কম্পিটিশনে কিছুতেই দিতে পারেন না।’
‘কিন্তু উনি দিয়েছেন। আর তুমিও তো আমার সাথেই পার্টিসিপেট করতে চাও তাই ন…
আদিত্য চলে গেলেন। কোথায় গেলেন জানি না। আমিও কোয়েলের হাত ধরে ওকে ওখান থেকে নিয়ে চলে এলাম।
‘কি দরকার ছিল তোর ওনার কাছে যাওয়ার যেখানে তুই জানিস যে জিয়া পার্টিসিপেট করছে?’
‘মৌ, আদিত্যডা জিয়া যে পছন্দ করে না। দেখলি না কীভাবে চলে গেলো। সব শুধুমাত্র ওর বাবার জন্য। ওর বাবার কথায় ম্যাডাম চলেন এই জন্য…
‘প্লিজ! আমি এব্যাপারে কিছুই শুনতে চাইছি না। বাদ দে। চল এখান থেকে।’
‘দাঁড়া। আমার সাথে চল।’
‘আবার কোথায়?’
‘চল তো।’
অন্যদিকে,
‘ম্যাডাম এবার কিন্তু এটা বেশি বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আমার অনিচ্ছায় আমি কেন এই কম্পিটিশনে অন্য একজনের সাথে পার্টিসিপেট করব? আমার যার সাথে ইচ্ছা তার সাথেই আমি পার্টিসিপেট করবো। দ্যাটস ফাইনাল!’
‘এরকম করো না আদিত্য। তুমি তো জানো আমার হাত-পা বাঁধা। উনি আমাদের ভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের হেড আর সি.এম. এর সাথে ওনার কানেকশনের কথাও তো কাওর অজানা নয়। শুধুমাত্র উনি একজন সফল বিজনেসম্যান তাই জন্যে ওনার এতোটা পাওয়ার। আমাকে উপরমহল থেকে প্রেসার দেওয়া হয়েছে আদিত্য, আমার কিচ্ছু করার নেই। একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ?’
‘ওনাকে তো আমি দেখে নেবো। অনেক অহংকার না নিজের পাওয়ারের প্রতি? ওনার দম্ভ যদি আমি না ভেঙেছি তাহলে আমার নামও আদিত্য ব্যানার্জী না।’
আদিত্য চলে গেলে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম বলেন,
‘আমিও তাও চাই আদিত্য। তুমি আমাদের ইউনিভার্সিটির একজন ব্রাইট স্টুডেন্ট। পারলে তুমিই পারবে এই কাজটা করতে।’
এদিকে,
‘কি রে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস, বলবি তো?’
‘চুপ।’
কোয়েল আমাকে নিয়ে এলো একটা ছেলেদের দলের সামনে। আমি তো বুঝতে পারছি না এই মেয়েটা কি চাইছে। কোয়েল দাঁড়াতেই ওদের মধ্যে দিয়ে একটা ছেলে কোয়েল কে দেখতে পেয়ে ওর সামনে চলে এলো। কোয়েল আমার হাত ছেড়ে দিয়ে ছেলেটাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরতেই ছেলেটাও জড়িয়ে ধরলো কোয়েলকে। এদিকে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কোয়েল ছেলেটাকে বললো,
‘একটা হেল্প চাই? করবে?’
‘তোর কথাই তো কোনোদিন ফেললাম না তুই আবার হেল্পের কথা জিজ্ঞেস করছিস? সাহস তো কম না তোর।’
কোয়েল লাজুক হেসে ছেলেটি কে নিয়ে সাইডে চলে গেলো। আমার বেশ ভালোই লাগলো ছেলেটাকে। কথাবার্তা খারাপ না। কিন্তু কোয়েলের সাথে কি সম্পর্ক? কিছুক্ষণ পর কোয়েল আর ছেলেটি এসে দাঁড়ালো, কোয়েল বললো,
‘ও অঙ্কিত। তোর হিপহপ ডান্সের পার্টনার।’
আমি অবাক হয়ে তাকালাম অঙ্কিতের দিকে। ও আমার দিকে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়ালে আমিও হ্যান্ডশেক করি।
প্রেসেন্ট…..
এরপর থেকেই কদিনের মধ্যে অঙ্কিতের সাথে বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। ও আদিত্যের বয়সই। দুজনেই MBA করছে। বাট ওকে আপনি বলা বারণ আর দাদা বলাও। যাই, এইবার জানতে হবে শত্রুতা টা ঠিক কি কারণে। আমি ফ্রেশ হয়ে হলে এলাম দেখলাম অঙ্কিত বসে আছে একা হলরুমের সিটে, সবাই চলে গেছে। আমি গিয়ে ওর পাশে বসতেই ও তাকালো আমার দিকে হেসে…..
[চলবে]