একদিন তুমিও ভালোবাসবে পর্ব-৭+৮+৯

0
2288

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৭||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

১৪.
‘জিয়া, জিয়া? কোথায় তুই?’

আদিত্য বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে জিয়া কে খোঁজার চেষ্টা করছে কিন্তু খুঁজে পাচ্ছে না। জিয়াই ওকে টেক্সট করলো যে ইউনিভার্সিটির ওয়াশরুমের আগে যে ফাঁকা করিডোরটা আছে ওখানে আস্তে। কি জানো খুব দরকার কথা আছে। এমনিতেই জিয়া ঠিক নেই তার উপর যদি এখন ওর কথা না শোনা হয় তাহলেই হয়েছে! তাই আর আদিত্য দেরী করেনি, টেক্সট পেয়েই চলে এসেছে।

‘কোথায় গেলো এই মেয়েটা, যা অবস্থা করেছে নিজের তাতে না কিছু বাঁধিয়ে বসে।’

আদিত্য এক হাত কোমরে আরেক হাত মাথার পিছনে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় কেউ পিছন দিয়ে ওর শার্ট টেনে, যে হাত কোমরে ছিলো সেই হাত ধরে ফেরালো। ব্যক্তিটির দিকে ফিরতেই আদিত্য কিছু বলবে তার আগে ব্যক্তিটি ওর বুকে ঢলে পড়লো।

‘জিয়া, জিয়া? তুই ঠিক আছিস? কি হয়েছে?’

হ্যাঁ, ব্যক্তিটি আর কেউ নয় জিয়া। জিয়া ধীরে ধীরে শক্ত করে আদিত্য কে জড়িয়ে ধরলো কোনো কথা না বলে কারণ জিয়া ঠিক মতো দাঁড়ানোর অবস্থাতেই নেই।

আমি আদিত্য কে খুঁজতে খুঁজতে ওনার পিছু নিয়েছিলাম কিন্তু জিয়ার সাথে ওনাকে এভাবে দেখবো ভাবিনি। জিয়ার অবস্থা এমন কেন? এটাই ভাবছেন তো? তাহলে চলুন জেনে আসা যাক।

কিছুক্ষণ আগে,

ভার্সিটির হল রুমে ফ্রেশারস পার্টি আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় ভালোই স্টুডেন্টসদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। আমি পার্টির এক কোণে একা দাঁড়িয়ে আছি। এমন নয় যে আমি একা এসেছি, আমার সাথে কোয়েল এসেছে কিন্তু ওর দরকারি কল আসায় ও একটু অন্যদিকে গেছে। ভাগ্যিস ফ্রেশারস পার্টির আগেই কোয়েল সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছে নাহলে আমি যে কীভাবে একা একা থাকতাম কে জানে? এখনই তো কেমন একটা বোর লাগছে।

‘কি ম্যাডাম? এখানে একা দাঁড়িয়ে আছেন যে?’

আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম সৌভিক দা আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হয়তো উত্তরের আশায়, আমি উত্তর দিলাম,

‘কোয়েল একটু অন্যদিকে গেছে তাই অপেক্ষা করছি ওর।’

‘সারাটা সময় কোয়েলের সাথে থাকলে হবে? আমাদেরকেও তো একটু চান্স দিতে হবে তাই না? আব, শুধু আমাকে দিলেই হবে।’

‘আপনি কি কোয়েলকে লাইক করেন?’

আমার প্রশ্নে উনি বাঁকা হেসে বললেন,

‘বুঝে গেছো তাহলে? কিন্তু তোমার বান্ধবী তো আর পাত্তা দেয় না তাই তুমিই দাও। আমার তো মেয়ে হলেই হলো।’

শেষের কথাটা সৌভিকদা বিড়বিড় করে বললেও কথাটা আমার কানে ঠিকই এসেছে। ওনার কথার উত্তর মৃদু হেসে বললাম,

‘আপনি যেমন ধরণের মেয়ে খুঁজছেন সেই ধরণের মেয়ে আমি নই আর কোয়েলও না। তাই চান্স টা অন্য জায়গায় নিন, বেটার হবে।’

‘আচ্ছা তা তুমি কেমন ধরণের মেয়ে? বলো একটু। তোমার ধরণের কথা শুনে হয়তো আমার টেস্ট চেঞ্জ হয়ে গেলো।’

হঠাৎ করেই সৌভিকদা আমার দিকে এগোতে শুরু করলে আমি পিছতে থাকি। পিছতে পিছতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে উনি আমার মাথার দু-পাশে হাত রেখে আমার সামনে ঝুঁকে দাঁড়ান। বুঝতে পারি উনি নেশা করে আছেন।

‘কি হলো কিছু বলো?’

উনি আমার মুখের দিকে আরো এগিয়ে এলে আমি ওনাকে ধাক্কা দিতে যাবো এমন সময় ওনার কলার ধরে কেউ পিছন থেকে টেনে নিলো। উনি পুরোপুরি সরে যেতে দেখলাম আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে আর আদিত্যের পিছনে কোয়েল। কোয়েল আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

‘কোনো অসভ্যতামি করেছে নাকি? আদিত্যদা কে বল তাহলে।’

কোয়েল বেশ জোরে কথাটা বলায় উনিও শুনতে পেয়েছেন আর তাই কোয়েলের কথা শেষ হতেই উনি আমার দিকে তাকালেন উত্তরের আশায়,

‘করতে চেয়েছিল।’

এটুকু বলতেই আদিত্য ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো সৌভিকেদার গালে। আমি অবাক হয়ে মুখ ঢাকলাম কিন্তু কোয়েলের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।

‘তোকে সাবধান করেছিলাম আমি যে, এইসব অসভ্যতামির থেকে দূরে থাকতে নাহলে ফল ভালো হবে না। কিন্তু তুই শুনলি না।’

‘আদি! আদি কি করছোটা কি তুমি? সৌভিকদা তোমার ছোটবেলার বন্ধু আর তুমি ওর গায়ে হাত তুলে তাও আবার এই মিডল ক্লাস মেয়েটার জন্য?’

‘জাস্ট শাট ইউর মাউথ জিয়া, নাহলে তোকেও পস্তাতে হবে।’

আদিত্যের কথা শুনে জিয়া প্রায় তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। সৌভিকদা কে আদিত্যের হাত থেকে জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

‘এখন এই মিডল ক্লাস মেয়েগুলো তোমার জন্য ইম্পরট্যান্ট হয়ে গেছে তাই না? আগে তো শুধু কোয়েল ছিলো এখন এই মৌমিতা এসে জুটেছে। তুমি কি ভুলে যাচ্ছ তুমি কোন বাড়ির ছেলে? কী তোমার স্টাটাস? তোমার, আমাদের স্ট্যাটাস দেখো আর এই মেয়েগুলোর স্ট্যাটাস দেখো। তাহলেই বুঝতে পারবে তুমি কি করছো।’

‘আমি খুব ভালো ভাবেই জানি আমি কি করছি। তুই প্লিজ তোর স্ট্যাটাসের সাথে ওদের স্ট্যাটাসের তুলনা করে ওদের অপমান করিস না। তোর স্ট্যাটাসের মেয়েদের সাথে থাকা তো দূর কথা বলতেও আমার ঘেন্না করে। সারাদিন ক্লাব, পার্টি, টাকা উড়ানো, ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়ানোর ছাড়া আর কিছু জানিস? ওহ হ্যাঁ, বাবার টাকায় ফুটানি মেরে অন্যদের হ্যারাস করাটা সবথেকে বড় ট্যালেন্ট তোর। আর স্বভাব হলো যেসব ছেলেদের তোর থেকে বেশি টাকা আছে তাদের পিছন পিছন ঘোরা, তারা পাত্তা না দিলেও তাদের গায়ে পরে ঘোরা যেটা কি না তুই আমার সাথে করিস। যেই কথাগুলো বললাম সেগুলো মাথায় রেখে দ্বিতীয় বার আমার সাথে কথা বলতে আসবি না। যদি নিজেকে চেঞ্জ করতে পারিস তাহলেই আসবি।’

আদিত্য জিয়ার পিছন থেকে আবার সৌভিকের কলার ধরে বললো,

‘আজকে বেঁচে গেলি পার্টির জন্য। নেক্সট দিন থেকে যদি আবার এমন কিছু দেখেছি তো তুই শেষ।’

সৌভিকদা এতটা সময় ধরে মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও করেনি। আদিত্য সৌভিকদার কলার ঝাড়া মেরে ছেড়ে দিয়ে আমাদের দিকে ফিরলে সৌভিকদা বলে,

‘তা কোনটা তোর প্রেমিকা? নাকি দুটোই…

‘সবাইকে নিজের মতো মনে করিস না সৌভিক। লোককে অপমান করার আগে নিজের ভুলগুলো শুধরানোর চেষ্টা কর নাহলে পস্তাবি।’

আদিত্য আমাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে অন্যহাতে কোয়েলের হাত ধরে ওখান থেকে চলে আমাদের নিয়ে চলে এলেন। হলের অন্যপ্রান্তে এসে আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে রেখে উনি চলে গেলেন সেই দেখে আমি কোয়েলকে বললাম,

‘কোয়েল আমি আসছি একটু।’

কোয়েলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমি ওনার পিছনে চলে এলাম। ওনার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল উনি কতটা রেগে আছেন। ওনার পিছন করে ব্যালকনিতে এসে দেখি উনি দেয়ালে সজোরে একটা ঘুষি মারলেন।

‘আরে আপনি কি করছেন টাকি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার?’

আমি সঙ্গে সঙ্গে এসে ওনার হাত ধরে আমার দিকে ঘুরিয়ে নিলে উনি আমার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,

‘আমাকে একা ছেড়ে দাও। তুমি যাও এখান থেকে।’

আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম,

‘আমার জন্য নিজের বন্ধুদের সাথে এভাবে ঝগড়া করবেন না। আমি আপনার তেমন কেউ হইনা যে আমার জন্য আপনার সম্পর্ক নষ্ট করবেন। উনি কোয়েলকে নিয়ে তেমন খারাপ কথা বলেননি আর ওর সাথে তো কোনো অসভ্যতাও করেনি তাহলে কেন এভাবে রিয়াকট করলেন? আমার সাথে অসভ্যতামি করেছিলো আমি বুঝে নিতাম, আমার জন্য আপনি কেন..??

‘তোমার জন্য নয়। তোমার জায়গায় যেই মেয়েই থাকতো তার জন্যেই আমি এটা করতাম। সত্যি তুমি আমার কাছে স্পেশাল কেউ নও কিন্তু তারমানে তো এই না যে সব দেখে অন্ধ হয়ে থাকবো। অন্যায় যে করে অন্যায় যে সহে, দুজনেই সমান দোষে অপরাধী। সৌভিক আমার বন্ধু বলে কোনো ছাড় পাবে না, অন্যায় যখন করেছে শাস্তি তো পেতেই হতো।’

হয়তো ওনার প্রথম কথায় কষ্ট পেয়েছি কিন্তু শেষের কথাগুলো শুনে ভালো লাগলো। ওনার মন-মানসিকতা যে এত ভালো ভাবিনি। আমি কথা না বাড়িয়ে কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি ব্যালকনিতে রেলিংএ দু-হাত ভর করে, ঝুঁকে বলতে লাগলেন,

‘সৌভিক আমার ছোটবেলার বন্ধু জানো? ওর আর আমার একসাথে বড়ো হওয়া। সেই ছোটো থেকে স্কুল আর এখন ইউনিভার্সিটি, সব সেইম। শুধু চিন্তা-ধারাটাই সেইম হলো না, হলে হয়তো আজ এই দিন আসতো না। অনেক আগে থেকেই ওকে আমি বারণ করেছিলাম, শোনেনি। আমি জানি আজ ও শুনবে না ও আমার দেওয়া ওয়ার্নিং। ও জানে না এর ফল কতটা ভয়ানক হতে পারে।’

কথা শেষ করে আদিত্য একটা নিশ্বাস ফেলে আমার দিকে ঘুরে কিছু বলবেন তার আগেই আমি ওনার হাত দেখে বললাম,

‘আপনার হাতটা তো লাল হয়ে গেছে।’

আমার কথা শুনে উনি নিজের হাতের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে আমাকে বললেন,

‘ও কিছু হবে না, একটু বরফ দিয়ে নেবো। তুমি যাও, কোয়েল ওখানে একা আছে।’

উনি আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত নিজের হাতের মাঝে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। আমাকে কোয়েলের কাছে রেখে উনি ওনার বন্ধুদের কাছে যাবেন সে সময় আমি বললাম,

‘বেশি মাথা গরম করবেন না। রাগের বশে ক্ষতি হয় শুধু, লাভ না।’

আগের দিনের মতো আমার কথা শুনে শুধুই হাসলেন। উনি যাবেন ঠিক সেই সময় জিয়া টলমলে পায়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরলো।

‘জিয়া? তুই, এভাবে?’

‘ইয়েস! আমি, এভাবে। আমি ছাড়া তোমার কাছে তো দূর আশেপাশেও কেউ আসতে পারবে না, আমি দেবো না। তুমি শুধু আমার বুঝেছো? শুধু আমার। এইসব মিডল ক্লাস মেয়েরা তোমার জন্য নয়, শুধুমাত্র আমি ডিসার্ভ করি তোমাকে।’

কথাটা বলেই আদিত্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে জিয়া চলে যায়। কোয়েল আদিত্যের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,

‘নাও, আবার একটা ঝামেলা।’

‘এই মেয়েটাকে নিয়ে যে আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারিনা।’

‘ছেড়ে দাও। সব ঝামেলার শেষ।’

‘পারছি আর কোথায় ছাড়তে? আর মনেও হয়না পারবো বলে।’

‘মান..??

কোয়েলের প্রশ্ন শোনার আগেই আদিত্য চলে গেলেন। আমি কোয়েলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম,

‘বাদ দে। ওনাদের ব্যাপার ওনারা বুঝে নেবেন।’

‘তাই বলে জিয়া তোকে এভাবে সবসময় অপমান করবে সেটা তো হতে পারে না তাই না?’

‘বেকার ঝামেলা করিস না। আস্তে আস্তে হয়তো সবটা ঠিক হয়ে যাবে। আজকে উনি যেভাবে জিয়াকে অপমান করেছেন তাতে ওর এমন রিয়াকট করাটা স্বাভাবিক।’

বর্তমান সময়ে,

জিয়া আদিত্যকে ছেড়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘কেন এতটা প্রটেক্টিভ তুমি ওদের জন্য? কই আমার জন্য তো এরকম রিয়াকট করো না কোনো সময়। শুধু অপমান করো আর দূরে সরিয়ে দাও আমায়।’

‘জিয়া এসব কথা পরে হবে। এখন তুই বাড়ি চল, কে বলেছিল এভাবে ড্রিংক করতে?’

‘তোমার জন্য করেছি। তুমি আমাকে অনেক অনেক হার্ট করেছো আজকে ওই মিডল ক্লাস মেয়েটার জন্য।’

‘ওকে ফাইন তুই চল এখন।’

‘নোও! আগে বলো তুমি আমাকে ভালোবাসো? তা নাহলে আমি কোথাও যাবো না। কিছুতেই না, আজকে তোমাকে বলতেই হবে।’

জিয়ার কথা শুনে আমার মনটা কৌতূহলে ভরে উঠলো। আমার মনও হয়তো আদিত্যের উত্তরের অপেক্ষা করছে।

‘ইয়াহ, আই লাভ ইউ!’

আদিত্যের কথা শুনে আমি দু-কদম পিছিয়ে এলাম। যেই দেয়ালটার আড়ালে ছিলাম সেখান থেকে ভুলবশত বেরিয়ে এলাম যার ফলে জিয়া আমাকে দেখে ফেললো। ও আদিত্যকে ছেড়ে আমার দিকে এগোতেই আদিত্য আমায় দেখতে পেলেন। জিয়া আমাকে এসে বললো,

‘খুব ভালো হয়েছে তুমি এখানে এসেছো। শুনেছো আদি কি বললো? হি লাভস মি! অনলি মি। তাই ওর থেকে দূরে থাকো ওকেই?’

জিয়ার কথার উত্তর না দিলে জিয়া পিছিয়ে গিয়ে একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘হেই আদি, ওর দিকে একবার তাকিয়ে দেখো। ওর ড্রেস আপটা একবার দেখো জাস্ট! ফ্রেশারস পার্টিতে বেহেনজিদের মতো চুড়িদার পরে এসেছে তাও সস্তার। ওহ মাই গড! এরকম একটা ক্ষ্যাত মেয়ে তোমাকে ডিজার্ভই করে না ব..বুঝলে? তোমাকে শুধু আমি.. আমি ডিজার্ভ ক..

কথা শেষ করার আগেই জিয়া পরে যেতে নেয় আর আদিত্য ওকে ধরে ফেলে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে জিয়াকে কোলে তুলে নেন আদিত্য, আর চলে যান। এতক্ষন নিজেকে সামলে রাখতে পারলেও আর পারিনি নিজেকে সামলে রাখতে। দু-হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। কাঁদতে কাঁদতে ওখানে বসে পড়ি। ফোনের রিংটোনে ঘোর কাটলে দেখি কোয়েল কল করেছে। কল কেটে দিয়ে উঠে বেরিয়ে যাই ভার্সিটি থেকে, গন্তব্য কোথায়? জানা নেই।

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৮||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

১৫.
আদিত্য জিয়ার বাড়ির সামনে এসে নিজের গাড়ি দাঁড় করালো। একটা নিশ্বাস ছেড়ে পাশে ঘুমন্ত জিয়ার দিকে তাকিয়ে নিয়ে নিজের ফোন বার করে কল করলো। কল রিসিভ হতেই আদিত্য বললো,

‘আমি বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দুজন মেইডকে পাঠান, রাইট নাও!’

আদিত্য কথাটুকু বলেই কল কেটে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। একবার ঝুঁকে যেই দেখতে পেলো মেইন গেট দিয়ে দুজন মেইড আসছেন, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো আদিত্য। গাড়ির দরজাটা খুলে দিয়ে বললো,

‘ম্যাডামকে সাবধানে নিয়ে যান।’

‘এতই যখন চিন্তা তাহলে তো তুমিই নিয়ে যেতে পারতে, তোমার তো আর আমাদের বাড়িতে আসতে কোনো মানা নেই তাই না?’

আদিত্য পুরুষালী গলার স্বর শুনেই বিরক্ত হয়ে গেলো, তবুও সেটা প্রকাশ না করে পিছন ফিরলো। যা ভেবেছিলো তাই, জিয়ার বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। জিয়ার বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে আদিত্য উত্তর দিলো,

‘আপনার মেয়ের জন্য এতক্ষন অবধি যতটুকু করেছি এতটাই যথেষ্ট। এর চাইতে বেশি করে ফেললে আবার আপনার মেয়ে উৎপাতটা বেশি করে করবে। এমনিতেই তো কম উৎপাত করে না আপনার মেয়ে। আপনি আপনার মেয়ের সব বাঁদরামি সহ্য করতে পারেন কিন্তু আমি করবো না। আজ যদি আপনার জায়গায় আমি থাকতাম না, তাহলে জিয়াকে চাপকে সিধা করে দিতাম নাকি এভাবে লাই দিতাম।’

‘আদিত্য!’

‘আওয়াজ নিচে! আমার সাথে আওয়াজ নিচে করে কথা বলবেন। আদিত্য ব্যানার্জীর সাথে জোর গলায় কেউ কথা বলে না কারণ আদিত্য ব্যানার্জী কখনও কোনো ভুল করে না। পারলে নিজের মেয়েকে শাসন করুন, আপনার টাকা আছে বলে একটু বেশিই লোককে নিচু করে। একটা কথা মাথায় রাখবেন, টাকায় কাওর নাম লেখা থাকে না, যার হাতে যায় তার হয়ে যায়। আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে। গুড নাইট!’

আদিত্য নিজের গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলে জিয়ার বাবা পরেশবাবু চোয়াল শক্ত করে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন।

‘আজ জিয়ার জেদের জন্য তুমি বেঁচে যাচ্ছ আদিত্য। নাহলে আমাকে যতবার তুমি অপমান করেছো তার শাস্তি তুমি পেতে। শুধুমাত্র আমার মেয়ের জন্য কিছু বলছি না আমি সেখানে তুমি আমার মেয়েকেও অপমান করছো? কালকেই জিয়ার সাথে কথা বলব আমি।’

মনস্থির করে পরেশবাবু হনহনিয়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন। এদিকে আদিত্য ড্রাইভ করে ইউনিভার্সিটিতে এসে পৌঁছেছে। গাড়ি থেকে নেমে যেই না আদিত্য ইউনিভার্সিটিতে ঢুকবে এমন সময় ওর কাছে একটা কল এলো। আদিত্য নিজের ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করলো।

‘এনিথিং রং?’

ওপাশ থেকে যা উত্তর এলো তাতে আদিত্যর মাথায় হাত পরে গেলো। আদিত্য উত্তর দিলো,

‘থ্যাংক ইউ জানানোর জন্য।’

আদিত্য গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো তখন আবারও কল এলো। এইবার কলটা কোয়েলের।

‘বল।’

‘মৌ কে খুঁজে পাচ্ছি না আমি কোথাও। তুমি দেখেছো?’

‘আমি দেখছি। তুই রাখ আর নিশ্চিন্তে থাক।’

ফোন রাখতেই আদিত্যের কিছুক্ষণ আগের ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। যখন আদিত্য জিয়ার কথায় তাল মিলিয়ে ওকে ”আই লাভ ইউ” বলেছিল।

‘মৌমিতা কি তাহলে আমাদের পুরো কনভারসেশনটাই শুনেছিলো? হয়তো তাই। কাজটা ঠিক করিনি আমি কিন্তু আমি কি করে জানবো মৌমিতা আমাদের কথা শুনছে? তখন জিয়ার মন রাখার জন্য কথাগুলো না বললেও হতো না। শিট!’

আদিত্য নিজের গাড়িতে একটা ঘুষি মেরে, উঠে পড়লো গাড়িতে।

‘আমার কেন এতো খারাপ লাগছে? আমি তো আর কিছু ইচ্ছে করে করিনি। সবটাই তো পরিস্থিতির চাপে হয়ে গেছে। ওহ গড কি হচ্ছে আমার সাথে?’

আদিত্য আর কিছু না ভেবে ড্রাইভ করা শুরু করলো ফোনে গুগল ম্যাপ খুলে। মাঝে মধ্যেই কপাল ডলছে দু-আঙ্গুল দিয়ে কারণ মাথা যন্ত্রণা করছে আদিত্যের। গুগল ম্যাপ ফলো করে একটা নির্জন মাঠের সামনে এসে দাঁড়ালো আদিত্য। পাশে ছোটো একটা শিব মন্দির আছে আর বসার বেঞ্চ তার পাশে। পুরো অন্ধকার জায়গা হলেও মন্দিরের আলোয় বসার জায়গাটা ঠিকই দেখা যাচ্ছে। আদিত্য গাড়ি থেকে নেমে ওইদিকেই এগিয়ে গেলো কারণ ওই বসার জায়গায় একটা মেয়ে চুপচাপ বসে আছে।

১৬.
‘আমি কেন এতো বোকা? শুধুমাত্র কালকের কয়েকটা ঘটনা, কিছু কথার কারণে আমি কি করে ভেবে নিলাম উনি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছেন? আমাকে মেনে নেবেন? উনি তো আমাকে বলেননি যে উনি আমাকে মেনে নেবেন তাহলে আমি কেন ভাবতে গেলাম? কেন বারবার ভুলে যাই আমি যে আমার কপালে এতো সুখ লেখাই নেই। শুধুমাত্র নিজের কারণে আজ আমি কষ্ট পাচ্ছি, শুধুমাত্র নিজের কারণে। কিন্তু আর না, এরপর থেকে আমি শুধু নিজেকে নিয়ে ভাববো অন্য কাউকে নিয়ে না।’

চোখের জল হাত দিয়ে মুছতেই একটা হাত আমার দিকে রুমাল বাড়িয়ে দিলো যা দেখে আমি চমকে উঠলাম। এই নির্জন জায়গায় হঠাৎ কে আমার পাশে বসলো এটা ভেবে ভয় পেয়ে সেদিকে তাকালাম। আদিত্য? উনি এখানে কি করছেন? তাও আবার এই সময়? আর জানলেনই বা কি করে আমি এখানে আছি?

‘রুমালটা নাও। তখন থেকে কি এভাবেই কেঁদে চলেছো নাকি?’

আমার প্রশ্নগুলোর মাঝেই উনি প্রশ্ন করলে আমি আর কিছু বললাম না। ওনার সাথে কথা বলার ইচ্ছাটাই হারিয়ে ফেলেছি। অনিচ্ছায় বললাম,

‘লাগবে না। ধন্যবাদ।’

‘দেখো মৌমিতা আমি জানি না তুমি কতটা কি শুনেছো। আমি শুধু এটাই বলবো আমি জিয়াকে যা বলেছি ওর মন র…

‘আপনি আমায় কেন কৈফিয়ত দিচ্ছেন? আমি তো আপনার কেউ হইনা। আপনার আমাকে কোনোরকম কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমার কোনো প্রয়োজন নেই এসব শোনার।’

আমি ওনাকে থামিয়ে কথাগুলো বললে উনি আমার দিকে করুন ভাবে তাকিয়ে রইলেন চুপ করে। আমি তা দেখেও না দেখার ভান করে উঠে দাঁড়ালাম, বললাম,

‘আজকের পর থেকে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো আপনার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলার। আপনি তো প্রথম দিনেই বলে দিয়েছিলেন আমি জানো নিজের আসল পরিচয় না দেই, আমি সেটাই মেনে চলবো। সত্যি তো, আপনরা বড়লোক মানুষ আপনাদের সাথে আমার মতো মেয়েদের যায় না। এইটাও হয়তো একটা কারণ বিয়েটা অস্বীকার করার। যাক, আমি সেসব কথায় আর যাচ্ছি না। আসি!’

আমি এগোতেই উনি পিছন থেকে বললেন,

‘অনেক রাত হয়ে গেছে। আমার গাড়িতে বসো আমি হস্টেল ছেড়ে দেবো।’

‘আমি যখন একা আসতে পেরেছি তখন একা যেতেও পারবো। আপনার হেল্প তো দূর, আমি আপনার সাথে কোনোরকম সম্পর্কই রাখতে চাইছি না মিস্টার আদিত্য ব্যানার্জী। অনেক অনেক ধন্যবাদ আমার জীবনটা নরক করে দেওয়ার জন্যে। আমি সারাজীবন আপনার কাছে এর জন্যে ঋণী থাকবো।’

কথাটুকু বলে আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম না জোর পায়ে হেঁটে চলে এলাম। ওনার সাথে কথা বলার মতো কোনোরকম ইচ্ছাটাই আমার মরে গেছে।

অন্যদিকে,

মৌমিতা আপন মনে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে আর আদিত্য তার পিছন পিছন গাড়ি নিয়ে আসছে যা হয়তো মৌমিতা টেরও পাচ্ছে না। মৌমিতা হোস্টেলে পৌঁছে গেলে আদিত্য হোস্টেলের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। গাড়িতে হেলান দিয়ে কোয়েল কে ফোন করলো,

‘মৌমিতা হস্টেলে পৌঁছে গেছে। তুই ওখানেই আছিস তো? আমি আসছি তোকে নিতে।’

‘আচ্ছা। কিন্তু মৌ কে পেলে কোথায়?’

‘গিয়ে বলছি।’

‘ফাইন। তাড়াতাড়ি এসো আমার এখানে আর ভালো লাগছে না একা একা।’

‘কামিং!’

ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো আদিত্য। আজ প্রথমবার জিয়ার ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে। মন চাইছে উচিত শিক্ষা দিতে।

‘কালকে জিয়ার কপালে বহুত দুঃখ আছে। আজ ড্রান্ক ছিলো বলে কিচ্ছু বলিনি মানে এই না যে অন্যদিনও ছেড়ে দেবো। সাহস হয় কি করে মৌমিতাকে এইভাবে বারবার ইনসাল্ট করার?মৌমিতাকে ইনসাল্ট করার শাস্তি ও পাবে। ও আমার ওয়াইফ…

আদিত্য থেমে গেলো। দু-হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে উপরের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সে বুঝতে পারছে না হঠাৎ তার মধ্যে এই পরিবর্তন কেন? যেই মেয়েটাকে বিয়ের রাতে ঠিক করে দেখে পর্যন্তনি আজ তাকে কেউ অপমান করলে রাগ হচ্ছে, তার মন খারাপ হলে নিজের খারাপ লাগছে আবার মুখ ফসকে ওয়াইফও বলে ফেলছে। কেন হচ্ছে এমন? ও তো মানে না বিয়ের কনসেপ্ট তাই তো মেনে নেয়নি এই হুটহাট করা বিয়ে। গ্রহণ করেনি নিজের স্ত্রী হিসাবে মৌমিতাকে।

‘পাগল হয়ে যাবো এবার আমি এসব নিয়ে ভাবতে থাকলে।’

আদিত্য গাড়িতে উঠতে যাবে এমন সময় উপরের দিকে তাকালে মৌমিতাকে জানলার সামনে দেখতে পায়। মৌমিতা সরে গেলে আদিত্য হতাশ হয়ে পড়ে কিন্তু কিছু করার নেই তার। এভাবেই আদিত্য ইউনিভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে। কোয়েলকে হস্টেলে ড্রপ করে নিজের বাড়ি চলে যায় আর ওয়াশরুমে ঢুকে পরে। মাথাটা ঠান্ডা করা প্রয়োজন কিন্তু কোনোমতেই মাথা থেকে মৌমিতা বা তার ভাবনাকে বার করতে পারছে না সে। ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছে আদিত্য।

এদিকে কোয়েল হস্টেলে ফিরে এসে দেখে মৌমিতা শুয়ে পড়েছে তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। আদিত্যও তেমন ভালো ভাবে কিছুই বলেনি। কোয়েল সেই বিষয়ে না ভেবে চলে গেল ফ্রেশ হতে।

সকালে,

কোয়েলের ঘুম ভাঙতেই কোয়েল ঘরে চোখ বুলিয়ে মৌমিতাকে দেখতে পায়না। ওয়াশরুমেও চেক করে পায়না। ঘরে এসে পড়ার ডেস্কে চোখ গেলে একটা সাদা কাগজের উপর চোখ পড়ে। সেটায় লেখা আছে,

‘কোলু,
আমি কয়েকদিনের জন্য কলকাতা যাচ্ছি। কিছু দরকার আছে আমার। তুই চিন্তা করিস না আমি কলে কন্টাক্ট করবো তোর সাথে। দুদিনের মধ্যেই ফিরে আসবো, আসলে কিছু ইম্পরট্যান্ট কাজ হঠাৎ করে পরে গেছিলো তাই এভাবে চলে এলাম। তুই ঘুমাচ্ছিলিস তাই আর ডাকিনি। চিন্তা করিস না কিন্তু এর নিজের খেয়াল রাখিস, সবে জ্বর থেকে উঠলি।

কোয়েল চিঠিটা পরে মনে মনে ভাবলো,

‘ভালোই করেছিস। তোর একটা রিফ্রেশমেন্টের দরকার। আমি জানি তুই মুড ঠিক করার জন্যই গেছিস।’

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৯||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

১৭.
ঘড়িতে দুপুর ২টো,
কোয়েল ভার্সিটির ক্যান্টিনে বসে সাদা কাগজে কিছু একটা লিখছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো কিছুর ফর্ম ফিলাপ করছে। আমি ধরাম! করে কোয়েলের সামনে বই রাখলাম আর বসলাম। ও প্রথমে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকালেও, আমাকে দেখার পর আবার নিজের কাজে মন দিলো। আমি আশ্চর্য হলাম, আমাকে দেখে কোনোরকম রিয়াক্ট করলো না কেন কোয়েল? রাগ করলো নাকি? এতো সেতো না ভেবে কোয়েলকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কি রে? কি করিস তুই?’

কোয়েল কোনো উত্তর দিলো না। ব্যাপারটা তো বেশ চিন্তার হয়ে গেলো, কথা বলছে না কেন আমার সাথে?

‘এই কোলু! কথা বলিস না কেন? রাগ করেছিস আমার উপর?’

আমার প্রশ্ন শুনে কোয়েল মাথা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘কেন? রাগ কেন করবো?’

আবার কোয়েল নিজের কাজ করতে শুরু করলো।

‘উফ! কি এমন কাজ করছিস দেখি তো।’

কোয়েলের কাছ থেকে ফর্মটা টেনে নিয়ে দেখতে শুরু করলাম। আস্তে আস্তে ফর্মটা পুরো পড়ার পর কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে কোয়েলের দিকে তাকাতেই কোয়েল আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,

‘ক্যায়সা লাগা মেরা সারপ্রাইজ?’

কথাটা বলে কোয়েল আমায় চোখ মারলো। আমি এসেছিলাম কোয়েলকে সারপ্রাইজ দিতে আর এখানে এসে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে গেলাম? কোয়েলকে জিগ্যেস করলাম,

‘এটা কি? আমার নাম কেন দিয়েছিস ডান্স কমপিডিশনে?’

‘কারণ তুই ডান্সার তাই।’

‘ডান্সার মানে? কোয়েল তোর মাথা ঠিক আছে তো? এটা আমাদের ইউনিভার্সিটির অ্যানুয়াল ফাংশন। কত বিখ্যাত, নামি লোক আসবে জানিস? ওখানে আমি ভুল করলে ভার্সিটির সন্মানটা কোথায় যাবে বল তো?’

আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে কোয়েল আমার হাত থেকে ফর্মটা টেনে নিয়ে নিলো। ফর্ম ফিলাপ করার পুরোই শেষ কোয়েলের।

‘দেখ কোয়েল, আমি পারবো না কম্পিটিশনে কম্পিট করতে ব্যাস! অসম্ভব আমার পক্ষে। আমি সামান্য একটা ডান্সার…

‘তো তোর কি মনে হচ্ছে আমাদের ভার্সিটি তে মাধুরী দীক্ষিত আসছে তোর সাথে? নাকি নোরা ফাতেহি আসছে বেলি ডান্স দিতে? আজব কথাবার্তা তো।’

‘আমি পারবো না। আমার ভীষণ ভয় লাগছে।’

‘শোন, এই ফর্ম আমি জমা দেবই। তুই যদি পার্টিসিপেট না করিস সেটা তোর ব্যাপার। কিন্ত তারপর থেকে আর কোনোদিন আমার সাথে কথা বলবি না। ওকেই?’

থ্রেডটা দিয়েই কোয়েল উঠে গেলো আর আমি মাথায় হাত দিয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সোজা হয়ে বসলাম তখন যখন আদিত্য ওর সামনে এসে দাঁড়ালো। ওদের মধ্যে কি কথা হলো কিছুই শুনতে পেলাম না শুধু আদিত্য একবার আমার দিকে তাকালেন তারপর কোয়েলের কাছ থেকে ফর্মটা নিয়ে চলে গেলেন। উনি চলে যাওয়ার পর আমি কোয়েলের কাছে দাঁড়িয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘ওনাকে দিলি কেন ফর্মটা?’

‘আদিত্যদা ইউনিয়নের হেড তাই জন্যে। ওই জিয়ার দলবলের কাছে দেওয়ার থেকে আদিত্যদাকে দেওয়াটাই মাচ বেটার, তাই না?’

আমি কোয়েলের প্রশ্নে শুধু ওর দিকে করুন ভাবে তাকিয়ে রইলাম। ও আমার হাত ধরে টেবিলের কাছে নিয়ে গিয়ে, ব্যাগটা নিয়ে বাইরের দিকে হাঁটা ধরলো।

‘এবার বল, কেমন ঘুরলি নিজের বাড়িতে?’

‘ভালোই।’

‘তোর অ্যাবসেন্সে আদিত্যদা তোর খোঁজ করছিলো।’

কোয়েলের কথাটা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আমার খোঁজ করছিলেন? কিন্তু কেন?’

‘এতো অবাক হচ্ছিস কেন? ক্লাসে চল দাঁড়িয়ে না থেকে, যেতে যেতে বলেছি।’

কোয়েলের কথা শুনে ক্লাসের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। ও বলতে শুরু করলো,

‘তুই যেদিন গেলি সেদিন আমি ভার্সিটি আসিনি। আদিত্যদা হঠাৎই আমার রুমে আসে আর এসেই তোর কথা জিজ্ঞেস করে। আমি বলি যে তুই বাড়িতে গেছিস তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমার খবর নিয়ে চলে যায়। এই দু-তিন দিন আমার সাথে যখনই দেখা হয়েছে তোর খোঁজ নিয়েছে আর জিজ্ঞেস করেছে তুই কবে ফিরবি।’

কোয়েল কথা শেষ করতেই ক্লাসে ঢুকলাম। এই বিষয়ে আর কোনো কথা বাড়ালাম না। কিন্তু উনি কেন আমার বিষয়ে এতো খোঁজ খবর নিচ্ছেন এটাই বুঝতে পারছি না। আমি তো ওনাকে বলেই দিয়েছি আমি আর ওনার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না। উনি যেমনটা বলেছিলেন তেমনটাই হবে, উনি ওনার রাস্তায় আর আমি আমার। তাহলে কেন উনি এমন ব্যবহার করছেন? উনি কি কোনোভাবে আমার সাথে জড়িয়ে… না না না। এবার আর আমি এক ভুল করবো না, আগের বার এই আশাই আমাকে অনেক যন্ত্রনা দিয়েছে এবার আর নয়। ওনার কথা না ভাবাই ঠিক হবে আমার জন্য।

১৮.
ক্লাস শেষ করে আমি ম্যাডামের সাথে কথা বলবো সেই জন্যে প্রিন্সির রুমের দিকে যাচ্ছি, সেসময় দেখলাম আদিত্য আসছেন তাও আবার আমার দিকে তাকিয়েই। উনি আমাকে কিছু বলবেন সেই জন্য দাঁড়ালে আমি ওনাকে পাশ কাটিয়ে প্রিন্সির রুমে ঢুকে গেলাম। ওনাকে বোঝাতে হবে আমি ওনাকে এড়িয়ে চলতে চাই। ম্যাডামের সাথে কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম উনি বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎই ম্যাডামের রুমে ঢুকে পড়লেন উনি,

‘আরে আদিত্য! তুমি এখানে? কোনো দরকার ছিলো?’

ম্যাডামের কথার উত্তর উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘ম্যাম আপনার সাথে দরকার নেই। দরকার ওর সাথে, আপনাদের কথা বলা শেষ নিশ্চই?’

আমি ইচ্ছে করেই দেরী করছিলাম যাতে উনি চলে যায় কিন্তু এখানে তো উল্টো হয়ে গেলো। বাধ্য হয়ে আমাকে ওনার সাথে বেরিয়ে আসতে হলো। বেরিয়ে এসে এক মুহূর্ত আমি দাঁড়ালাম না, দ্রুত হাঁটা শুরু করলাম। পিছন থেকে উনি সমানে আমার নাম ধরে ডেকে চলেছে তা আমি শুনতে পেলেও উপেক্ষা করছি। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না, ভার্সিটির মাঠে আসতেই উনি আমার হাত পিছন থেকে টেনে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন।

‘কখন থেকে ডেকে চলেছি আমি আর তুমি শুনতেই পাচ্ছো না? নাকি না শোনার ভান করছিলে?’

‘বুঝতেই যখন পেরেছেন না শোনার ভান করছি তাও কেন এসেছেন কথা বলতে?’

‘আমার কথা বলাটা দরকার তাই।’

‘আপনার এমন কি দরকার পরলো আমার সঙ্গে যে, যাকে আপনি স্ত্রী বলে মানেন না, পরিচয় দিতে চান না তারই হাত ধরে সবার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন?’

আমার কথায় উনি চারিপাশে তাকিয়ে দেখলেন আমাদের দিকে প্রায় অনেকেই তাকিয়ে আছে। উনি একটা জোরে নিশ্বাস নিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে অন্য দিকে চলে এলেন।

‘কেন এভয়েড করছো আমাকে?’

‘আপনার সাথে কথা বলার কোনো উদ্দেশ্য বা কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘বাড়াবাড়ি করছো এবার তুমি। আমি যখন কথা বলতে চাইছি তখন কেন এইভাবে এভয়েড করছো?’

‘সেটা কেউ দেখতে যাবে না যে, কে কথা বলতে চাইছে। দেখবে শুধু এটাই যে একটা মিডল ক্লাস মেয়ে টাকার জন্য একটা বড়লোক ছেলের পিছনে পরে আছে। বিশ্বাস করুন, এই কথাটা আমি শুনতে চাইছি না। এইখানে আসার পর থেকে সব সহ্য করে নিয়েছি কিন্তু আমার চরিত্রের উপর কেউ কথা বললে সেটা আমি কিছুতেই মেনে নেব না। তাই প্লিজ স্টে আওয়ে ফ্রম মি মিস্টার আদিত্য ব্যানার্জী।’

কথাটা বলেই আমি চলে এলাম। যেই সম্পর্কের কোনো পরিণতি নেই সেই সম্পর্ক থেকে দূরে থাকাই ভালো হবে আমার মতে। আমি পিছন ফিরে না তাকিয়েই চলে এলাম ভার্সিটি থেকে হস্টেলে।

অন্যদিকে,

‘ফাইন! তুমিই যখন চাওনা আমার সাথে কথা বলতে তাহলে আমিও আর যেচে পরে তোমার সাথে কথা বলতে যাবো না। আমিই বোকা যে কি না সবটা ঠিক করতে চেয়েছিলাম। ডোন্ট নো কি হয়েছে আমার কদিন ধরে, এই মেয়েটার চিন্তা আমার মাথা থেকে বেরোচ্ছেই না। আগে কোনোদিন কোনো মেয়েকে নিয়ে ভাবিনি আমি কিন্তু… ড্যাম ইট!’

আদিত্য পিলারের মধ্যে একটা ঘুষি মারলো সজোরে। পিছন থেকে সে সময় জিয়ার চিৎকার এলো আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জিয়া আদিত্যের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘আদি কি হয়েছে তোমার? এভাবে রিয়াকট করছো কেন?’

আদিত্য জিয়ার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে জিয়া ভয় পেয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে আদিত্য বলে,

‘জাস্ট স্টে আওয়ে ফ্রম মি!’

আদিত্য চলে গেলে জিয়া বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আদিত্য কি কারণে ওর উপর রাগ দেখালো জিয়া বুঝলো না কারণ রাতের কথা ওর কিছুই মনে নেই। সে বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে জিয়া চলে গেলো।

পরেরদিন,

আমি আর কোয়েল ক্লাস করে বেরোচ্ছি সে সময় জিয়া এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো। আমাদের দিকে তাকিয়ে বাঁ হাতে একটা কাগজ আমাদের চোখের সামনে ধরে। আমি আর কোয়েল তাকিয়ে দেখি এটা আমার কম্পিটিশনের ফর্ম।

‘আমি তোর দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ালাম কিন্তু তোর সেটা পছন্দ হলো না তাই তো তুই সেই আমার বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ালি আমার কম্পিটিটর হয়ে।’

জিয়ার কথা বুঝে আমি আর কোয়েল একে অপরের দিকে তাকালাম। আমি বললাম,

‘আমি জানতাম না তুইও পার্টিসিপেট করছিস আর তাছাড়া বন্ধুত্বের কথাটা তোর মুখে মানাচ্ছে না ফ্রেশারস পার্টির ঘটনার পর। তুই সেদিনই বুঝিয়ে দিয়েছিস তুই কি ভাবিস আমাকে নিয়ে সো প্লিজ…

আমি কোয়েলের হাত ধরে ওখান থেকে চলে আসতে নিলে জিয়া আবার বলে ওঠে,

‘তা পারবি তো আমার সাথে কম্পিট করতে? একটু ঠিক ঠাক ড্রেস পরে আসিস যাতে নাচতে সুবিধা হয়। নাহলে দেখা গেলো জাজেস্টরা হয়তো তোর ড্রেস দেখেই তোকে ডিসকলিফাই করে দিলো।’

জিয়া হাসতে হাসতে চলে গেলে কোয়েল আমাকে বললো,

‘ভালো ডান্সার জিয়া। স্পেশালি ওয়েস্টার্ন/হিপহপে।’

‘আর ভারতনাট্যম, কথক, ক্লাসিক্যালে?’

‘ক্লাসিক্যালেও ভালোই বাট ভারতনাট্যম আর কথক, ওডিশিতে একটু উইক।’

‘কদিন জানো বাকি কম্পিটিশনের? চারদিন তো?’

‘হ্যাঁ। ওকেই। চল হস্টেলে।’

আমি আর জিয়া ফিরে এলাম হস্টেলে আর কোয়েল হঠাৎ করেই বললো শপিং করতে যাবে। আমিও অমত করলাম না, একটু ঘোরাও হয়ে যাবে এই ফাঁকে।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে