‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৪||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৯.
‘জিয়া যা করেছে ঠিকই করেছে, আমি এখানে কোনো ভুল দেখতে পাচ্ছি না কোয়েল। স্যরি টু সে দ্যাট!’
কোয়েল বিস্ময় নিয়ে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে আছে আদিত্যের কথা শুনে যার ভ্রূক্ষেপ আদিত্য করছে না। সে নিজের মনে ফোন ঘাটছে। আজকে জিয়া যেই ব্যবহারটা মৌমিতার সাথে করেছে সেটা আদিত্য কে জানানোটা ঠিক মনে করেছিল কোয়েল তাই জানাতে এসেছে কিন্তু ভাবেনি আদিত্য এরকম কথা বলবে। কোয়েল নিজের রাগ সংযত করে আদিত্য কে বললো,
‘আমি তোমার থেকে এরকম প্রতিক্রিয়া আশা করিনি আদিত্য দা। আমি ভেবেছিলাম তুমি জিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে কিন্তু না! আমি ভুল ছিলাম। আসলে ভুলে গিয়েছিলাম জিয়া তোমার গার্লফ্রেন্ড তাই ওর বিরুদ্ধে তুমি কোনো কথাই বলবে না।’
কোয়েল কথাটুকু বলে চলে যাচ্ছিলো সেসময় আদিত্য কোয়েলের হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো, কোয়েল সমানে আদিত্যের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে, সেই দেখে আদিত্য হেসে বললো,
‘তুই শুধরাবি না তাই না? এতো কিসের জেদ তোর?’
‘ছাড়ো আমার হাত আমার সময় নেই।’
‘আচ্ছা? তো এতক্ষন কীভাবে কথা বলছিলিস? তখন অনেক সময় ছিলো নাকি?’
কোয়েল চেষ্টা থামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। আদিত্য ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি নিয়ে, কোয়েলের হাত ছেড়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি এমন দেখেছিস বল তো তুই মেয়েটার মধ্যে যে আসার প্রথম দিন থেকে ওকে সাপোর্ট করছিস? যেই তুই কি না কাওর সাথে কথা বলতি না প্রয়োজনের বেশি সেই তুই সারাক্ষন ওর সাথে থাকছিস। কি ব্যাপার?’
‘আমি যা দেখেছি, তুমি যদি সেটা দেখতে পেতে তাহলে আজ জিয়া কে সাপোর্ট করতে পারতে না আদিত্য দা। মেয়েটার সাথে মিশে দেখো, বুঝতে পারবে মেয়েটা কতটা সাধারণ। এইসব বড়লোকের মাঝে না শুধু অহংকার, হিংসে, স্বার্থপরতা, ইগোর লড়াই আছে যা ওর মধ্যে ছিঁটেফোঁটাও নেই। সাধারণ একটা মেয়ে ও, যে কি না শুধুমাত্র পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের স্বপ্নপূরণ করতে চায়। কি অস্বাভাবিক মনের ইচ্ছে শক্তি যে, এতো অল্প বয়সে বিয়েটাও ওকে হার মানাতে পারেনি।’
‘ব..বিয়ে?’
‘হ্যাঁ, বিয়ে হয়ে গেছে ওর।’
‘কার সাথে কিছু জানিস?’
‘না। সেসব কিছু বলেনি, বলেছে বর নাকি মেনে নেয়নি বিয়েটা।’
‘ওহ।’
কোয়েলের কথা শুনে আদিত্য জানো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। প্রথমে কোয়েলের মুখে মৌমিতার বিয়ের কথা শুনে শ্বাস আটকে গেছিলো আদিত্যের। ভেবেছিল মৌমিতা হয়তো ওর কথা রাখেনি, বলে দিয়েছে কোয়েল কে সবটা। কিন্তু না, এখন ও আশ্বস্ত হলো যে মৌমিতা কথা রেখেছে, কিছুই বলেনি কোয়েল কে। কৌতূহল বশত আদিত্য কোয়েল কে জিজ্ঞেস করে বসলো,
‘আর কি কি জানিস ওর ব্যাপারে তুই?’
কোয়েলও সব বলতে লাগলো আদিত্য কে যা মৌমিতা কোয়েলকে বলেছে। সবটা শোনার পর আদিত্যের মধ্যে তীব্র অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করলো যা হয়তো আদিত্য কাওকে বোঝাতে পারবে না। আদিত্য কে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কোয়েল জিজ্ঞেস করলো,
‘হঠাৎ কি হলো তোমার?’
‘হ..হমম? না, কিছু না। তুই যা, আমি জিয়ার সাথে কথা বলবো। তোকে যেমন কেউ ডিস্টার্ব করে না মৌমিতা কেও করবে না আজকের পর থেকে।’
‘ও হ্যালো! তোমার জন্য আমাকে কেউ ডিস্টার্ব করে না এমনটা নয় ওকে? ওই তো এসেছিলো আজকে তোমার একটা ফ্রেন্ড আমাকে টোন করতে…
‘কে করেছে? নামটা বল, কে করেছে?’
হঠাৎ করেই আদিত্য কে রেগে যেতে দেখে কোয়েল হকচকিয়ে গেলো। ভুলেই গেছিলো সে আদিত্য কেমন রিয়াক্ট করতে পারে কোয়েল কে টোন করার কথাটা শুনে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বললো,
‘আদিত্য দা কাম ডাউন! একবার জেনে নিয়ো আমি কি উত্তর দিয়েছি। তোমার জিয়াও হাসছিলো। সো…
‘কোয়েল প্লিজ, তুই খুব ভালো ভাবেই জানিস আই ডোন্ট লাইক জিয়া! তারপরেও কেন সব সময় “তোমার জিয়া” বলতে থাকিস?’
‘তাহলে কেন তুমি ওর সাথে কথা বলো? আমার একদম পছন্দ না তোমার ওর সাথে কথা বলা।’
আদিত্য মুচকি হেসে বললো,
‘তো তোর কি পছন্দ?’
‘জিয়া কে এভয়েড করো নাহলে আমি তোমাকে এভয়েড করবো।’
‘আমি নিজে থেকে যাই না ওর সাথে কথা বলতে জানিসই তো তুই। ও নিজেই বেহায়ার মতো পরে থাকে আমার পিছনে কি করবো বল? আর ও কার মেয়ে জানিসই তো। ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করলে উৎপাত আরো বেশি করবে ও।’
‘তা কতদিন তুমি এই নাটক টা করবে জিয়ার সাথে?’
‘দেখা যাক। ও যেমন নিজের স্বার্থের জন্য আমার পিছনে পরে আছে তেমন আমিও আমার স্বার্থ যতদিন ততদিন ওকে রাখবো। এর মধ্যে যদি ও ভুলেও তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করার কথা মাথায় আনে না তাহলে ওটাই ওর শেষ দিন হবে।’
‘আ..আচ্ছা তুমি শান্ত হও। আমাকে কেউ টিজ করেছে এসব শুনলে এতো হাইপার হয়ে যাও কেন বলো তো তুমি? আমি আমার দিকটা ম্যানেজ করতে জানি আদিত্য দা। যেটা মৌও শিখে যাবে। শুধু সময়ের প্রয়োজন। আমি বললাম তো মেয়েটা ব্রিলিয়ান্ট!’
‘ঠিক আছে ঠিক আছে। ওর তারিফ করা বন্ধ কর আর যা নিজের ক্লাসে যা।’
‘আগে বলো, কেন এতটা হাইপার হয়ে যাও তুমি?’
আদিত্য কোয়েলের চোখে চোখ রেখে তাচ্ছিল্য সুরে বললো,
‘তুই কি সত্যি জানিস না? তোর খেয়াল আমি কেন রাখ..’
‘দরকার নেই আমার খেয়াল রাখার। নিজের খেয়াল নিজে রাখতে আমি জানি। সো প্লিজ, আগেও বলেছি এখনও বলছি তুমি ভুল করছো আদিত্য দা। নিজের জায়গা টা নষ্ট করো না তুমি।’
এটুকু বলেই কোয়েল গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। আদিত্য শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু-হাত পকেটে গুঁজে বললো,
‘আর কতদিন এভাবে অবুঝ হয়ে থাকবি বল তো কোয়েল? না জানি কি অপেক্ষা করছে ভবিষ্যতে।’
কিছুক্ষন আগে কোয়েলের কথাগুলো মনে করে আদিত্য দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেঁকে বসে পড়লো। তাকালো কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে।
১০.
‘কি রে কোয়েল? কোথায় গায়েব হয়ে গেছিলি তুই? কতক্ষন ধরে খুঁজছি আমি তোকে।’
কোয়েল আদিত্যের কাছ থেকে এসে মৌমিতার কাছে এসে ক্যান্টিনে বসলো আর বললো,
‘একটু কাজ ছিলো। তুই কি করছিস এখানে?’
‘এই একটু বই পড়ছিলাম। আজকে আর ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না।’
‘কেন? ঘুরতে মন চাইছে না কি?’
মৌমিতা হেসে দিলো কোয়েলের কথা শুনে, হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করলো,
‘তুই কীভাবে বুঝলি?’
‘আরে স্বাভাবিক ব্যাপার। নতুন জায়গায় এসেছিস ঘুরতে তো মন চাইবেই। আর এখন সবে পড়া শুরু তাই চাপটাও কম। ব্যাস, আইডিয়া করে ফেললাম। শুধু কি তুই ব্রিলিয়ান্ট নাকি?’
‘কে বললো আমি ব্রিলিয়ান্ট?’
‘ওমা? নাচতে জানিস, ড্রয়িং করতে জানিস, পড়াশোনায় এতো ভালো, ঘরের কাজ জানিস। এত কিছু জেনেও বলছিস তুই ব্রিলিয়ান্ট না?’
‘ধুর! বাদ দে এসব আর আমাকে ঘুরতে নিয়ে চল।’
‘যো হুকুম ব্রিলিয়ান্ট সাহেবা স্যরি রানী সাহেবা।’
‘ধ্যাৎ! মারবো একটা গাট্টা!’
আমি আর কোয়েল হালকা খুনসুটিতে মেতে উঠে বেরিয়ে গেলাম যাদবপুর ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে। যাক, এটুকু কপাল ভালো আমার যে প্রথমদিন থেকেই ভার্সিটিতে এসে একজন মনের মতো বান্ধবী পেয়েছি। কিন্তু এই মেয়েটার মনটা বুঝে উঠতে পারছি না আমি এখনও। কেন যে সবার থেকে এতো আলাদা হয়ে থাকে, জানতে হবে আমায়।
আমি আর কোয়েল ভার্সিটি থেকে বেরোলে, কোয়েল আমায় রাস্তা চেনাতে শুরু করে। ভার্সিটির পাশে থাকা ওলি-গলি চিনতে চিনতে ঝালমুড়ি খাওয়া শুরু করি আমরা দুজন। কিন্তু…
‘এই কোয়েল, আমার কেমন জানো মনে হচ্ছে কেউ আমাদের পিছু করছে।’
‘কি? কোথায়?’
কোয়েল হুট করেই পিছন ঘুরে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ ওকে ওদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি আলতো ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কাওকে দেখতে পেলি নাকি? একভাবে তাকিয়ে রয়েছিস যে?’
কোয়েল চমকে উঠে আমাকে বললো,
‘ক..কই না তো। তোর ভুল মনে হয়েছে। কেউ নেই আমাদের পিছনে। চল, চল।’
কোয়েল সামনে এগিয়ে গেলো কথাটুকু বলে কিন্তু আমার কেমন জানো মনে হলো ও কিছু লুকিয়ে গেলো আমার থেকে। তাই কোয়েল যেদিকে তাকিয়ে ছিলো সেদিকে উঁকি ঝুঁকি করতে লাগলাম আর সে সময় কোয়েল ডাকলো। যেহেতু কাওকে দেখতে পেলাম না তাই কোয়েলের কাছে চলে গেলাম।
‘হমম, কিছুক্ষন আগের কথাগুলোতে কাজ হয়েছে তাহলে। ভালো লাগলো দেখে।’
‘কি রে, আমাকে ডেকে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একা একা হাসছিস কেন?’
কোয়েলের কাছে এসে কোয়েলকে হাসতে দেখে ওকে জিজ্ঞেস করতেই ও বললো,
‘আরে না রে তেমন কিছু না। ওই একটা হাসির কথা মনে পড়ে গেছিলো তাই।’
আমরা আবার হাঁটতে শুরু করলাম। বেশ কিছুক্ষণ পর কোয়েল বললো,
‘তোকে তো একটা কথা বলাই হয়নি। সামনেই কলেজে ফ্রেশারস পার্টি আছে।’
‘তাই নাকি? কবে?’
‘এই তো দু-সপ্তাহ পর। আমার মনেই হয়েছিলো তুই জানবি না তাই বললাম। আসলে এইবার তেমন বড়ো করে ফ্রেশারস পার্টি হচ্ছে না কমপিডিশনের জন্য।’
‘কিসের কমপিডিশন আবার?’
‘নাচ নিয়ে। এইবার নাকি ফার্স্ট টাইম যাদবপুর ইউনিভার্সিটি তে এটা হচ্ছে। তাই ফ্রেশারস পার্টিটা একটু ছোটো করে করছে। শুনলাম ফ্রেশারসের কয়েকদিনের মধ্যেই কমপিডিশন।’
‘বাহ।’
‘এই মৌ! কমপিডিশনে নাম দিবি? তুই তো খুব ভালো নাচ করিস।’
কোয়েল বেশ উত্তেজিত হয়ে আনন্দের সাথে আমাকে প্রস্তাব দেওয়ায় আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। মুহূর্তেই নিজেকে স্বাভাবিক করে উত্তর দিলাম,
‘মাথা খারাপ হলো নাকি তোর? এসব কমপিডিশনের মধ্যে আমি নেই। চল চল, হস্টেলে ফিরে চল।’
আমার কথা শোনার পর এক নিমিষেই কোয়েলের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো এটা দেখে আমার খারাপ লাগলেও কিছু করার ছিলো না আমার। এখন শুধু পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই ব্যাস, আর কোনো স্বপ্ন বা ইচ্ছে নেই। কেন জানো সবটা শেষ হয়ে গেছে, আসলে আমিই শেষ হয়ে গেছি ভিতরে ভিতরে।
আমি আর কোয়েল হোস্টেলে ফিরে এলাম। ফ্রেশ হয়ে বই নিয়ে বসলাম ঘন্টাখানেক মতো তারপর উঠে জানলার সামনে দাঁড়ালাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম স্থির ভাবে, কেন জানি ভীষণ অস্থিরতা কাজ করছে মনের ভিতর। কিসের জন্য এই অস্থিরতা বুঝতে পারছি না। বাধ্য হয়ে চোখটা বুজলাম, সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যের মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে। তৎক্ষনাৎ চোখ খুলে ফেললাম। এটাই কি আমার অস্থিরতার কারণ? হয়তো তাই! আচ্ছা আমার জীবনটাও তো বাকি বিবাহিত মেয়েদের মতো হতে পারতো? কেন হলো না? কেন আমার স্বামী আমাকে মেনে নিলো না? আমি কি খুব খারাপ? অযোগ্য? জানি না। হয়তো কপালে ছিলনা তাই।
‘কি রে কি ভাবছিস এত?’
কোয়েলের স্পর্শে আর গলার আওয়াজ ঘোর কাটলো। শুধু না বোধক মাথা নাড়লাম, কোয়েল চলে গেলো। একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে মনকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, যার জন্য আমার অস্থিরতা সে তো আমাকে নিয়ে ভাবেই না তাই আমাকেও তাকে ভুলতে হবে।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৫||
@কোয়েল ব্যানার্জী (আয়েশা)
১১.
‘আদি! তুমি এভাবে মুখ ঢেকে, এখানে কেন বসে আছো? কি হয়েছে? এনিথিং রং?’
‘হম এভরিথিং ইজ রং হেয়ার বিকজ অফ ইউ।’
আদিত্যের এরকম শান্ত গলার স্বরে জিয়া বিচলিত হয়ে পড়লো। জিয়া মনে মনে ভাবতে লাগলো,
‘আদির এসব কি বলছে? আমি আবার কি ভুল করেছি?’
জিয়া কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আদিত্য কে আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘কি হয়েছে আদি? আমি কি করেছি?’
‘কি করছিস না তুই সেটা আমাকে বল। যারাই নতুন আসবে, দুর্বল হবে তাদের বিরক্ত তোকে করতেই হবে তাই না? নিজেও তো তুই এই ইউনিভার্সিটির ফ্রেশার তাহলে কীভাবে অন্য ফ্রেশারকে হ্যারাস করিস? আমার নাম ভাঙিয়ে?’
আদিত্য রেগে, জোরে কথাগুলো একনাগাড়ে বললে জিয়া ঘাবড়ে যায়। সে ভাবেনি আদিত্য এতটা রেগে আছে। এদিকে আদিত্য রীতিমতো রাগে ফুঁসছে।
‘কি হলো বল? কেন ফ্রেশারদের হ্যারাস করিস? স্কুলেও এই কাজটা করতিস তুই আর এখানে এসেও। আমার থ্রুতে, আমার বন্ধুদের গ্যাংএর সাথে মিলে এই কাজ করিস তাই না? এসবই যদি করার থাকে তাহলে আমার সাথে আর কোনোদিন কথা বলার চেষ্টা করবি না জিয়া।’
আদিত্যের শেষের কথা শুনে জানো জিয়ার টনক নড়ল। সে বুঝতে পারছে না আদিত্য কেন এতো রিয়াক্ট করছে তাই রেগে জিজ্ঞেস করলো,
‘তুমি এতো কেন রিয়াক্ট করছো আদি? স্কুল লাইফে তো করোনি, তখনও তো জানতে।’
‘তখন বলিনি এখন তো বলছি? ভালোভাবেই জানিস আমি এসব পছন্দ করি না।’
‘আমি তো সেটাই জানতে চাইছি। তখন কিছু বলেনি কিন্তু এখন কেন বলছো? তাও আবার ওরকম একটা ক্ষ্যাত মেয়ের জন্য? ওহ হো, এখন বুঝলাম। মেয়েটা কোয়েলের ফ্রেন্ড তাই জন্যে?’
আদিত্য জিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে পকেটে দু-হাত গুঁজে বললো,
‘হ্যাঁ তাই। অবশ্য তোর এতো কিছু জেনে কাজ নেই, তোর কাজ আমি যেটা বললাম সেটা মাথায় রাখা। আজকের পর থেকে মৌমিতাকে জানো কেউ না বিরক্ত করে, ওকেই?’
‘নোওও! ইটস নট ওকেই! তুমি সব সময় আমার সাথে এরকম বিহেভ করতে পারো না। সেই স্কুল লাইফ থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার পিছনে ঘুরছি আর তুমি? তুমি ওই কোয়েলের জন্য আমার সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করে আসছো?’
জিয়ার মুখে কোয়েলের নাম শুনে আদিত্যের চোয়াল নিমিষে শক্ত হয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
‘আমি তোর মুখে কোয়েলের সম্পর্কে কোনো কথা শুনতে চাই না। আর একটা কথা শুনে রাখ, জোর করে কিচ্ছু পাওয়া যায়না। আমি এসব ভালোবাসা, বিয়ের কনসেপ্টে বিশ্বাসী নই সো ভালোবাসার দাবী আমার কাছে করিস না কিছুই পাবি না তুই। যেটা বললাম সেটা মাথায় রাখবি, মৌমিতা কে জানো আর বিরক্ত করা না হয়। হলে, সেটা তোর জন্য ভালো হবে না।’
আদিত্য কথাগুলো বলে জিয়ার দিক থেকে পিছন ফিরে একটা নিশ্বাস ফেলে চলে যেতে নিলে জিয়া ফের জিজ্ঞেস করে,
‘তাহলে তোমার কোয়েলের প্রতি এই চিন্তা, যত্ন এসব কি? ভালোবাসা নয়?’
আদিত্য জিয়ার দিকে ফিরে এক গালে তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
‘তুই সেটা বোঝার ক্ষমতা রাখিস না। বোঝার হলে নিজেই বুঝে যেতি।’
কথা শেষ করে আদিত্য চলে গেলো হনহন করে। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বাইকে বসার আগে ফোন বার করে কল করলো,
‘হস্টেল পৌঁছেছে?’
ওপাশ থেকে উত্তর আসলে আদিত্য বলে,
‘অলওয়েজ নজর রাখবি এবার থেকে। হস্টেল থেকে বেড়ানোর পর থেকে নিয়ে হস্টেলে ফেরা অবধি এক মিনিটের জন্য জানো চোখের আড়াল না হয় তোর। আর স্পেশালি ইউনিভার্সিটিতে প্রতিটা মুহূর্তে নজর রাখবি, যাতে কেউ বিরক্ত না করে।’
আদিত্য ফোন পকেটে রেখে বাইক স্টার্ট দিতে গিয়েও দিলো না। বাইকের উপর দু-হাতের কুনুই রেখে হাতের উপর কপালটা ঠেকিয়ে বসে রইলো।
‘আজ যদি মম-ড্যাড আমাকে জোর করে বিয়েটা না দিতো তাহলে এসব কিছুই হতো না। শুধু শুধু আমার জন্য এখন মৌমিতা সাফার করছে। কি বা বয়স, এখনই কি বিয়ে দেওয়ার খুব দরকার ছিল? মম-ড্যাড ভেবেছিল আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলেই আমি কনসেপ্টটাকে মেনে নেব, একবার ভাবলো না এটার নেগেটিভ রেজাল্ট কি হতে পারে। শিট!’
আদিত্য নিজের মাথাটা একটু ঝাড়া দিয়ে নিজের বাংলোর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। এদিকে কোয়েল আর মৌমিতাও হস্টেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে। কোয়েল বাইরে গেছে এমন সময় মৌমিতা পড়ার বইটা রেখে জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরের পরিবেশ দেখতে দেখতে হঠাৎ ওর চোখ এক ব্যক্তির উপর পড়লো।
‘সন্ধ্যে হয়ে গেছে তাও লোকটা এখানে দাঁড়িয়ে কি করছে? হয়তো হোস্টেলের কাওর সাথে দেখা করতে এসেছে। তাই হবে হয়তো, নাহলে এনাকে দেখে কোনো ডেলিভারী বয় তো মনে হচ্ছে না…’
‘এই মৌ, এগুলো ধর! আমি একা পারছি না।’
কোয়েলের গলার আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি ও দু-হাতে ফুচকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ওকে ওভাবে দেখে ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে, ওর হাত থেকে প্লাস্টিক নিতে নিতে বললাম,
‘এসবের কি দরকার ছিলো বল তো? আর যাওয়ার হলে আমাকে বলতি, একা গেলি কেন?’
‘তুই তো বিকেল বেলা ফুচকার দিকে তাকিয়ে বললি যে তোর ফুচকা খেতে ভালো লাগে। তখন যেহেতু ঝালমুড়ি খাচ্ছিলাম তাই আর খেতে গেলাম না। ভাবলাম সন্ধ্যেতে খাবো। খাওয়াও হবে আর সারপ্রাইজ দেওয়াও হবে। হিহিহি!’
কোয়েলের হাসি দেখে আমিও হেসে ফেললাম। তারপর প্লেটে বেড়ে নিয়ে একসাথে খেতে বসলাম। খেতে খেতে কোয়েল বললো,
‘ফুচকা, মোমো আমার ফেভারিট। মাঝে মধ্যেই আমি খাই, এখন একটা সঙ্গীও পেলাম। নেক্সট দিন স্টলে দাঁড়িয়ে খাবো ওকে?’
‘একদম। স্টলে দাঁড়িয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। কিন্তু তুই একা একা কেন খেতিস? আমি তো দেখলাম তুই হস্টেলের সবার সাথেই প্রায় কথা বলিস তাহলে?’
‘আসলে, আমি সবার সাথে মিশি না রে। যে আমার মনের মতো হয় তার সাথেই মিশি আর বাকি সবার সাথে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই কথা বলি।’
‘বাপ রে! আমিই তাহলে তোর মনের মত হলাম? তা কি এমন দেখলি আমার মধ্যে যে অন্যদের মধ্যে দেখিসনি?’
কোয়েল খাওয়া থামিয়ে স্মিত হেসে বললো,
‘অনেক কিছু। তোর না আছে কোনো কিছুর অহংকার, না আছে মনে কোনো হিংসা। সবসময় যেটা সত্যি সেটা মুখের উপর বলিস আর কোনো ইগোও নেই তোর মধ্যে। এরকম সাধারণ মনের একটা সঙ্গীরই আমার প্রয়োজন ছিলো যা আমি আল্টিমেটেলি পেয়ে গেছি।’
কোয়েলের কথা শুনে হেসে ফেলি আমি আর তারপর আবার খাওয়া শুরু করি সাথে নানান রকমের গল্প তো আছেই।
১২.
ক্যান্টিনে বসে বই পড়ছি আমি এমন সময় আমার সামনে এসে একজন বসলো। বই থেকে মাথা তুলে তাকাতেই দেখলাম আমার সামনে জিয়া বসে আর পিছনে ওই ছেলেগুলো মানে জিয়ার গ্যাং। সেদিনের পর প্রায় দেড় সপ্তাহ কেটে গেছে। এই দেড় সপ্তাহে আমাকে কাওর দ্বারা কোনো বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়নি তাহলে আজ আবার হঠাৎ এরা এলো কেন? আমি এতো না ভেবে চুপচাপ আবার বইয়ের দিকে তাকালাম। ঠিক সেই সময় জিয়া বলে উঠলো,
‘আর কদিন পরেই ফ্রেশারস পার্টি। তুমি তো জানোই আমিও তোমার ডিপার্টমেন্টে সো আমিও একজন ফ্রেশারসই।’
‘হ্যাঁ জানি। কিন্তু এগুলো তুমি আমাকে কেন বলছো?’
‘বন্ধুত্ব করার জন্য।’
আমি অবাক হলাম জিয়ার কথা শুনে। যে কিছুদিন আগে আমায় এতো অপমান করলো, আমাকে সহ্য করতে পারছিলো না সে কি না আমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইছে? আমার এইসব প্রশ্নের উত্তর জিয়া কে না চাইতেই জিয়া দিয়ে দিলো,
‘দেখো প্রথম প্রথম আমরা সবার সাথেই একটু খারাপ বিহেভ করি দ্যান ভালো বন্ধু হয়ে যাই। ওগুলো জাস্ট মজা করার জন্যই করি। সো ফ্রেন্ডশিপ করবে? তাহলে তুই করে বলবো।’
‘ওকে। বাট ওরা?’
জিয়া আমার কথা শুনে পিছন ফিরে ছেলেগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ওরা তোকে ইনভাইট করতে এসেছে। বিকজ ওরা আমাদের সিনিয়র, আয়োজন তো ওরাই করছে তাই ইনভাইটও ওরাই করবে। আমি চললাম, পরে দেখা হচ্ছে।’
জিয়া আমার সাথে হ্যান্ডশেক করে, হেসে চলে গেলো। এরপর ওই ছেলেগুলোর মধ্যে যেই ছেলেটা কোয়েলকে টোন করেছিলো সে আমার সামনে বসে বললো,
‘যা বলার তো বলেই দিলো জিয়া। আর তুমি যখন জিয়ার ফ্রেন্ড তখন আমারও…
ছেলেটা কথাটা বলতে বলতেই আমার হাতের উপর হাত রাখলো আর শক্ত করে ধরলো। আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই ছেলেটার মুখভঙ্গি পাল্টে গেলো,
‘আমারও বোন, আমারও বোন বুঝলে? জিয়া কে যেমন বোনের নজরে দেখি তোমাকেও তাই দেখবো কারণ তুমি জিয়ার ফ্রেন্ড। এই, তোরাও ওকে বোনের নজরে দেখবি আর হেল্প করবি।’
‘হ..হ্যাঁ হ্যাঁ সৌভিক।’
বাকি ছেলেগুলোও ভয়ে ভয়ে তাল মিলালে সৌভিক দা বলে,
‘আচ্ছা আমরা আসি হ্যাঁ? আরো অনেককে ইনভাইট করতে হবে। আরে, আদি! আমরা সবাইকে ইনভাইট করা শুরু করে দিয়েছি। চললাম।’
এই বলেই সৌভিকদারা চলে গেলো, বলা যায় একপ্রকার কেটে পড়লো। আমি পিছন ফিরে ওনাকে দেখে আবার সামনে ফিরলাম।
‘তাহলে কি ওনাকে দেখেই সৌভিকদার এমন ভোলবদল? নাহলে উনি যেভাবে আমার হাতটা ধরেছিল তাতে মনে তো হলো না উনি…
‘কেমন আছো?’
আমি চমকে উঠলাম ওনার গলার আওয়াজে। ভাবিনি আদিত্য আমার সাথে কথা বলবেন। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি উনি আমার সামনেই বসে আছেন। ওনার প্রশ্নের উত্তর দিলাম স্বাভাবিক ভাবে,
‘চলে যাচ্ছে। আপনি?’
‘সেম। পড়াশোনা কেমন চলছে? কোনো প্রবলেম হচ্ছে না তো?’
‘না নাহ। কোনো প্রবলেম হচ্ছে না, পড়াশোনা ভালোই চলছে।’
‘গ্রেট। ওরা ইনভাইট করে দিয়েছে তো ফ্রেশারসের জন্য?’
‘হ্যাঁ।’
‘আসতেই হবে কিন্তু। বাই দ্য ওয়ে, কোয়েল কোথায়? ওকে দেখতে পাচ্ছি না তো।’
‘আসলে ওর শরীরটা ভালো না তো তা…
‘হোয়াট? শরীর ভালো না মানে? কি হয়েছে ওর? কোথায় আছে এখন? ঠিক আছে তো নাকি বাড়াবাড়ি হয়েছে? ওহ শিট, আমার আগে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিলো।’
‘আ..আপনি শান্ত হন। কোয়েলের ভাইরাল ফিভার হয়েছে। কালকে রাতে জ্বর এসেছিল এখন ঠিক আছে আপাতত।’
‘ডক্টর দেখিয়েছে?’
‘হ্যাঁ। আজকে সকালে দেখিয়েছে।’
‘আজকে সকালে? তারমানে সারারাত ও জ্বরে কাতরেছে? শিট, শিট, শিট!’
ওনাকে কোয়েলের জন্য এতটা উদ্বিগ্ন হতে দেখে কেন জানো খারাপ লাগতে শুরু করলো। কিছু বললাম না, কি বা বলবো আমি? কোয়েল তো সেদিন বলেছিল ওর তেমন কিছুই নেই ওনার প্রতি কিন্তু ওনারও যে কোনো ফিলিংস নেই সেটা তো নয় তাই না। তাহলে জিয়া? জিয়াকে কি উনি ভালোবাসেন না? থাক, আমার এসব ভেবে কাজ নেই। আমি স্বামী মানলেও উনি তো আর আমাকে স্ত্রী মানে না যে আমাকে কৈফিয়ত দেবে। হে ভগবান, আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি? কেন কষ্ট হচ্ছে আমার ওনার অন্য মেয়ের প্রতি কেয়ার দেখে। আমার তো কষ্ট হওয়ার কথা না, ওনার সাথে তো আমার তেমন কোনো সম্পর্কই নেই। তাহলে..??
‘লিসেন, তুমি আমার ফোন নাম্বার নোট করো। যদি কোনো বাড়াবাড়ি হয় আমাকে ফোন করবে ইমিডিয়েটলি, সে যতই রাত হোক না কেন ওকে?’
ওনার কথায় হুঁশ এলে আমি সঙ্গে সঙ্গে ওনার কথায় তাল মেলাই। ফোন নাম্বার নোট করা হয়ে গেলেই উনি হন্তদন্ত হয়ে উঠে বেরিয়ে যান। আমি একটা নিশ্বাস ফেলি।
‘ইশ, এরকম ভালোবাসা যদি আমিও পেতাম তাহলে কতই না ভালো হতো। কিন্তু সবার কপালে কি আর সব থাকে? হাহ!’
নিজের উপরেই নিজে হাসলাম। হঠাৎ মনে একটা প্রশ্নঃ এলো,
‘কোয়েল তাহলে সেদিন ওনার ব্যাপারে এড়িয়ে গেলো কেন? তাছাড়া এও তো বললো যে প্রেম-ভালোবাসায় বিশ্বাসী না। কাউকে বিশ্বাস করে না। এদিকে আজকে ওনার কোয়েলের প্রতি চিন্তা দেখে বোঝা গেলো উনি ওকে কতটা ভালোবাসেন। নাহলে এরকম রিয়াকট করতেন না সামান্য একটা ফিভার নিয়ে। ব্যাপারটা কি? কিছুই তো বুঝতে পারছি না আমি।’
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৬||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
১৩.
‘কেমন আছিস এখন?’
‘উফ আদিত্যদা কতবার এই এক কথা জিজ্ঞেস করবে বলো তো? আসার পর থেকে একই কথা বারবার জিজ্ঞেস করছো। বললাম তো ঠিক আছি।’
‘সেই, ওইজন্যেই তো আমি আজকে না আসলে তুই ঘরে মাথা ফাটিয়ে পরে থাকতিস আর কেউ টেরও পেতো না।’
কোয়েল চুপ করে গেলো আদিত্যের কথা শুনে। কিছুক্ষণ আগে আদিত্য হোস্টেলের ম্যাডামের সাথে কথা বলে পারমিশন নিয়ে, কোয়েলের রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই দেখে কোয়েল একহাতে নিজের মাথা আরেক হাতে পড়ার ডেস্ক ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। সেই দেখে আদিত্য কোয়েলের দিকে এগোতে না এগোতেই কোয়েল নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আদিত্য এগিয়ে আসায় সে কোয়েলকে ধরে নিয়ে বেডে শুয়ে দেয়। ডক্টরকে ফোন করে আস্তে বলে, ডক্টর ওষুধ দিয়ে চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর কোয়েলের জ্ঞান ফেরে। আর সেই থেকেই আদিত্য কোয়েলকে জিজ্ঞেস করে চলেছে সে ঠিক আছে কি না। বেশ কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আদিত্য জিজ্ঞেস করলো,
‘এই জন্য বলি নিজের খেয়াল রাখ। একটাবার আমাকে ফোন করতে পারিসনি তুই? এতো শরীর খারাপ তোর আর আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না।’
‘কেন করো আমার জন্য এতো চিন্তা? করো না। আমি তো বলিনি করতে। আমাকে আমার অবস্থায় ছেড়ে দাও প্লিজ!’
কোয়েল মুখ ঘুরিয়ে নিলে আদিত্য কোয়েলের হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বললো,
‘কেন এরকম অবুঝের মতো কাজ করছিস বল তো? এভাবে একা একা থাকলে কি জীবন চলবে?’
‘দৌঁড়াবে। আমি নিজের জীবনে কাওকে চাই না। কাউকে না। বুঝেছো? তাই এভাবে আমার খেয়াল রাখা বন্ধ করো তুমি, সবাই ভুল ভাবে আমাদের নিয়ে।’
‘ভাবতে দে। যার যা ভাবার ভাবুক আমার বা তোর তাতে কোনো যায় আসবে না। বুঝলি?’
কোয়েল কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিত্য কে বিড়বিড় করতে শুনলো,
‘তোর খেয়াল না রাখলে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।’
‘কি? কি বললে?’
‘ক..কিছু না। আমি আসছি, তুই নিজের খেয়াল রাখবি ওকেই?’
কথা শেষ করেই আদিত্য পিছন ফিরে চলে যেতে নিলে কোয়েল বলে ওঠে,
‘তাকে বলে দিও এসব করে কোনো লাভ নেই।’
‘এই যাহ, ঠিক শুনে ফেলেছে। কেন যে তুই বিড়বিড় করিস আদি? খালি ধরা পড়ে যাস।’
আদিত্য মনে মনে কথাটা বলে জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে কোয়েলের দিকে ফিরে বললো,
‘তোর প্রাণের মায়া না থাকলেও আমার প্রাণের মায়া আছে।’
আদিত্য একনাগাড়ে কথা শেষ করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলে কোয়েল সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে সামান্য হাসলো। তারপর আস্তে আস্তে শুয়ে পড়লো।
‘তুমি? তুমি কখন এসেছো?’
ভার্সিটি থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছিলাম কোয়েলের খেয়াল রাখবো বলে। কিন্তু এসেই দেখি আদিত্য ওর কাছে বসে কথা বলছে তাই আর সাহস পাইনি ভিতরে যাওয়ার। ভেবেছিলেন ওনার বেড়ানোর আগে সরে যাবো কিন্তু উনি যে এমন হুট করে বেরিয়ে আসবেন সেটা ভাবিনি।
‘কি হলো টা কি? এভাবে এখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘ন..না আসলে, আপনারা কথা বলছিলেন তাই আর ভিতরে যাইনি।’
মাথা নিচু করে কথাটা বলার পর ওনার যখন কোনো উত্তর পেলাম না তখন ওনার মুখের দিকে তাকাতেই দেখি উনি চোখ ছোটো ছোটো করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি আবার চোখ নামিয়ে নিতেই উনি বললেন,
‘আসো আমার সাথে। কোয়েল সবে শুয়েছে, তোমাকে দেখলে আবার এখন উঠে বসবে। ওর রেস্ট নেওয়াটা দরকার।’
উনি কথা শেষ করে হাঁটা ধরলে আমিও কথা না বাড়িয়ে ওনার পিছন পিছন যাই। বাইরে বেরিয়ে এসে ওনার বাইকের সামনে আসতেই উনি বলেন,
‘বসো।’
আমি অবাক চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। মনে মনে ভাবছি, বসবো মানে? উনি আমাকে ওনার বাইকে বসতে বলছেন? মাথা আমার খারাপ হয়েছে নাকি ওনার?
‘এরকম হা করে তাকিয়ে থাকার কিছুই হয়নি। আমার বাংলো থেকে তোমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসতে যাবো। আর কিছুই না।’
‘আমাদের জন্য খাবার আনতে যাবেন কেন?’
‘বাইকে বসো, যেতে যেতে বলছি।’
মন তো কিছুতেই চাইছিলো না ওনার বাইকে বসতে। কাচুমাচু মুখ করে ওনার দিকে তাকাতেই উনি আবার চোখ ছোটো করেন আর আমি একপ্রকার বাধ্য হয়ে বসে পরি। উনি বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে বললেন,
‘ধরে বসো। পরে গেলে আমার খাটনি বাড়বে। একদিকে কোয়েল আরেক দিকে তুমি।’
ওনার কথা শুনে অনেক কষ্টে কাঁপা হাতে ওনার কাঁধে হাত রাখলাম। কেন জানো একটা দ্বিধাবোধ কাজ করছিল, হয়তো বিয়ের প্রথম রাতে ওরকম ব্যবহারের জন্য। আমার এসব ভাবনার মাঝেই উনি বললেন,
‘আমি হোস্টেলের ম্যাডামের সাথে কথা বলেই কোয়েলের সাথে দেখা করতে গেছিলাম। তখনই ওনাকে বলি যতদিন কোয়েলের জ্বর থাকবে ততদিন আমি খাওয়ার পাঠাবো। আর একাজে আমাকে তুমিই হেল্প করতে পারবে।’
‘আমি?’
‘হ্যাঁ তুমি। কোয়েল যদি জানতে পারে আমি খাবার পাঠাচ্ছি তাহলে তুলকালাম করবে তাই তুমি বলবে এটা হোস্টেলেরই খাওয়ার, তুমি ম্যাডামকে রিকুয়েস্ট করে বানাতে বলেছো।’
‘নাহ, আমি এটা বলবো না।’
‘দেখো, প্লিজ তুমি আমার কথাটা রাখো। আমার উপর যদি তোমার রাগ থাকে তাহলে সেটা কোয়েলের উপর প্লিজ বাড় ক..
‘আমি বলবো ম্যাডামকে বলে আমি ওর জন্য এই খাওয়ারগুলো বানিয়েছি। তাহলে ওর কোনো সন্দেহই থাকবে না।’
‘সিরিয়াসলি?’
আদিত্য এতো উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে অনেক জোরে ব্রেক কষেন আর আমি টাল সামলাতে না পেরে ওনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি যার ফলে ওনার শরীরের সাথে আমার শরীরের কোনো বিভেদ থাকে না। উনিও পিছন দিকে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আর আমিও ওনাকে শক্ত করে ধরে ওনার দিকে তাকিয়ে আছি। ঘোর কাটলো একজন বয়স্ক লোকের গলার স্বরে যিনি ওনার নাম নিয়ে ওনাকে ডাকছেন।
‘আদি বাবা, ও আদি বাবা? কোয়েল পাখির খাওয়ার তৈরী হয়ে গেছে।’
আদিত্যের কথা জানি না, আমি সঙ্গে সঙ্গে লোকটার কথা শুনে বাইক থেকে নেমে পড়ি। নেমে ওনার দিকে তাকাতেই দেখি উনি এখনো আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন, সেই দেখে আবার চোখ ঘুরিয়ে নিলাম আমি লোকটার দিকে। একের পর এক লজ্জা পেয়েই চলেছি আমি। লোকটা আদিত্যকে আবার ডাকলো আর আমিও ওনার দিকে তাকালাম,
‘আদি বাবা?’
‘তুমি খাবারটা নিয়ে এসো।’
এই কথাটাও উনি আমার দিকে তাকিয়েই বললেন। কি হয়েছে ওনার? এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকার মানে টা কি?
‘থ্যাংক ইউ সো মাচ।’
‘ক..কি জন্য?’
‘তোমার এই ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নেওয়ার জন্য।’
‘মানে?’
আমার অবাক হয়ে যাওয়া দেখে উনি সামান্য হেসে বললেন,
‘তুমি যদি এই ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন না নিতে তাহলে কোয়েল তোমাকে পেতো না সঙ্গী হিসেবে। আর তোমাকে সঙ্গী হিসেবে না পেলে ও ভালো থাকতো না। আমি যদি জানতাম না, তোমাকে পেলেই কোয়েল ভালো থাকবে তাহলে কবেই তোমাকে কোয়েলের কাছে এনে দিতাম।’
ওনার কথাগুলো শুনে কেমন জানি বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। না চাইতেও বলে ফেললাম,
‘এতো ভাবেন ওকে নিয়ে? খুব ভালোবাসেন তাই না?’
কথাটা বলার পর খেয়াল এলো কি বলে ফেলেছি। উনি কাকে ভালোবাসেন না বাসেন এটা নিয়ে আমার কি দরকার? তাই কথা সামাল দেওয়ার জন্য কিছু বলবো তার আগেই উনি বললেন,
‘আমার থেকেও বেশি অন্য কেউ ভাবে। সবসময় আমরা যা দেখি তা সত্যি হয় না।’
‘কি বলতে চাইছেন আপ..??
আমি কথা শেষ করার আগেই বয়স্ক লোকটা খাবার নিয়ে এসে হাজির হলেন আর আমি চুপ করে গেলাম। আদিত্য ওনাকে বললেন,
‘মৌমিতাকে খাবারটা দিয়ে দাও হারু কাকা।’
‘মৌমিতা? মৌমিতা নাম তো আমাদের বউমার তাই না আদিত্য বাবা? উনি, উনি আমাদের বউমা?’
আমার ভিতরটা ভয়ে শুকিয়ে গেলো এই ভেবে যে উনি যদি ফুলশয্যার রাতের মতন রিয়াকট করেন এখন? তাহলে কি হবে? আমি এখন কি কর..
‘হ্যাঁ। ও তোমাদের বউমা। দাও, ওকে খাবারটা দিয়ে দাও এখন ওর ফিরতে দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
আমি কেমন রিয়াকট করবো সেটাই ভেবে পাচ্ছি না। কেমন জানো ভাবলেশহীন হয়ে পড়েছি। হারু কাকা বললেন,
‘বউমা প্রথমবার এলো এখানে, ভিতরে যাবে না?’
‘পরেরবার নিয়ে আসবো তখন বরণ করে ঘরে তুলো। এখন তাড়াতাড়ি করো দেরী হয়ে যাচ্ছে।’
‘আচ্ছা, এই নাও বউমা।’
আমি খাওয়ারের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ওনার পা ছুঁয়ে নমস্কার করতেই উনি বাঁধা দিয়ে বললেন,
‘খুব খুব খুশি থাকো, সুখে সংসার করো এই আশীর্বাদ করি।’
আমি আদিত্যের দিকে তাকাতেই উনি স্মিত হাসলো আমার দিকে আমিও হারু কাকাকে হেসে বিদায় জানিয়ে ওনার বাইকে এসে বসলাম। মাথাটা কেমন জানো ঝিম ঝিম করছে। কিছুক্ষন আগে ওনার ব্যবহার জানো আমি মেনেই নিতে পারছি না। সব কিছু কেমন জানো ওলট পালট লাগছে আমার।
‘মম-ড্যাড হারু কাকাকে তোমার সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছিলো তাই আর মিথ্যে বলতে চাইনি কোনো।’
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করছে। উনি আমাকে হস্টেলে নামিয়ে দিয়ে বললেন,
‘সাবধানে থাকবে আর কোয়েলেরও খেয়াল রাখবে।’
‘আব, আপনিও সাবধানে যাবেন।’
উনি আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হেসে বললেন,
‘তুমি যাও। আসছি আমি।’
আমি চলে এলাম ঘরে আর প্ল্যানিং মতো কোয়েলকে বললাম যে খাবারটা আমি বানিয়েছি। ও প্রথমে মানতে না চাইলেও পরে ম্যাডামের সাথে কথা বলার পর মেনে গেছে। ভাগ্যিস ম্যাডামের সাথে কথা বলে ঘরে গেছিলাম। খাওয়া-দাওয়া সেরে কোয়েলকে শুয়ে আমিও শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করতে আজকের ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো আর ওনার কথাগুলো কানে বাজতে লাগলো। না চাইতেও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো আমার।
অন্যদিকে,
‘অফ ও! আমি পড়ায় ফোকাস কেন করতে পারছি না? শিট ইয়ার।’
আদিত্য মুখ দু-হাত দিয়ে ঢেকে বসতেই কিছুক্ষন আগে ঘটনা মনে পড়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো মৌমিতার জড়িয়ে ধরার কথা। আদিত্য কখনোই কোনো মেয়ের এতো কাছে কখনও যায়নি। জিয়া আসতে চাইলেও তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে বিরক্ত হয়ে। কিন্তু মৌমিতা কে দূরে সরাতে মন চায়নি বরং ভালোই লাগছিলো। কথাটা ভেবেই আদিত্য উঠে নিজের কাবার্ডের কাছে গিয়ে আজকের পড়া শার্টটা বের করলো। শার্টটা নাকের কাছে আনতেই একটা লেডিস পারফিউম পেলো।
‘উমম, নাইস স্মেল।’
আদিত্য নিজেই নিজের কথায় ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসলো আর মাথায় চাটি মেরে বললো,
‘পড়ায় ফোকাস কর আদি! কি সব ভাবছিস তুই।’
চলবে।