একদিন কাঁদবে তুমিও পর্ব-৬০ এবং শেষ পর্ব

0
1251

#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৬০
#শেষ_পর্ব
#Saji_Afroz

বাসায় এসে আরেক দফা জিনিসপত্র ভাংচুর করলো ইনতিসার। তার ফোন বেজে উঠে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো, অফিস থেকে কল এসেছে। রিসিভ করে আরেকটা দু:সংবাদ পেল সে। আর তা হলো, অফিসে অনিয়মিত ও কাজে অবহেলার কারণে তার চাকরি চলে গেছে। ইনতিসার ভীষণ হতাশ হয়ে যায়। এই সময়ে টাকা-পয়সার দরকার ছিল তার। নাহলে আইনের আশ্রয় কিভাবে নেবে আর আজরাকেই বা কিভাবে ফিরে পাবে!
আপাতত তার যা আছে তা দিয়েই শুরু করা যাক এই ভেবে মনকে শান্তনা দেয় সে।
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ কানে বাজে তার।
দরজা খুলে নাবীহাকে বউ সাজে দেখে অবাক হলো সে। ইনতিসার বলল, তুমি?
-হু। আমি!
-এইভাবে এখানে কেন?
-আমি জাদিদ নামক এক ছেলেকে বিয়ে করেছি। এখানে এলাম আপনার সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে। আর টাকাটা আমি আস্তেধীরে শোধ করব। এটা নিয়েও আমার সাইন সহ একটা পেপার নিয়ে এলাম।
সেসব ইনতিসারের দিকে এগিয়ে দেয় নাবীহা। ইনতিসার এসব নিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল-
এসব দিয়ে আমার কী হবে! পারবে আমার আজরাকে ও সন্তানদের ফিরিয়ে দিতে? পারবে আমার সুখের সংসারটা ফিরিয়ে দিতে?
-আমি ফিরিয়ে দেওয়ার কে! সবটা আপনি নিজ হাতে শেষ করেছেন। তাই ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টাটা আপনিই করুন।
এই বলে নাবীহা বেরুলো। জাদিদ তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে।
হুট করেই জাদিদ বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল নাবীহাকে। সবটা ভুলে তার সঙ্গে সামনে এগুনোর প্রস্তাবে নাবীহাও রাজি হয়ে যায়। তারা কাজি অফিসে বিয়েটা সেরে নেয়। নাবীহা জানেনা সে ঠিক করেছে কিনা। তার জীবনের এত ভুলের মাঝে সঠিক কোনটা সে যেন কোনো ভাবেই বুঝতে পারে না এখন!
নাবীহাও বিয়ে করে ফেললো! অথচ ওর জন্য পাগলপ্রায় হয়ে কত কিছুই না ঘটিয়েছিল ইনতিসার। ফলাফল কী হলো! শূন্য! নাবীহা তাকে ছেড়ে গেছে। আজরাও নিজের জীবনে ফিরে পেতে চায় না ইনতিসারকে। একটা বাইরের মেয়ের জন্য নিজের এত সুন্দর পরিবারটা নষ্ট করলো ইনতিসার। কেন করলো সে এসব! ইনতিসারের আফসোসের সীমা রইলো না। চোখ বেয়ে পড়ছে তার অনবরত পানি। নিজের মাথার চুল টেনে একটা চিৎকার দিলো সে। আজরার বলা কথাটি কানে বাজছে তার। আজরা ঠিকই বলেছিল। একদিন কাঁদতে হবে তাকেও!
কিছুক্ষণ নীরব থেকে উঠে পড়লো ইনতিসার। এখুনি সে বের হবে। একজন ভালো উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন। তার পরিচিত রয়েছে কয়েকজন। সিফাত মাহমুদের সাথেই নাহয় আলোচনা করবে। এই ভেবে বেরিয়ে পড়ে ইনতিসার।
গাড়িতে উঠে দ্রুত গতিতে চালাতে শুরু করলো সে। যত দ্রুত সব করা যাবে তত দ্রুত যেন সে শান্তি পাবে মনে। এই মুহুর্তে একটা সেকেন্ডও যে তার কাছে এক কোটি বছরের মতন মনে হচ্ছে। তার আজরা ও সন্তানদের চায়, তার নিজের পরিবারকে আবারও ফিরে পেতে চায়। এর জন্য যা যা করতে হবে সবই করবে সে।
এসব ভেবে ভেবে গাড়ি চালাচ্ছে ইনতিসার। হঠাৎ দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসা একটি ট্রাকের সাথে তার গাড়ির ধাক্কা লাগে। গাড়ি উলটে রাস্তার ধারে এসে পড়লো। কিছু বুঝে উঠতে পারে না ইনতিসার। শুধু বুঝলো, সে কাউকে ফিরে পাওয়া দূরে থাক আর কাউকে শেষ বারের মতো দেখতেও পাবে না। তার অপরাধের সবচেয়ে বড়ো শাস্তিটা পেতে চলেছে সে।

বারান্দায় বসে রয়েছে আজরা। আজরীন ও আযান ঘুমোচ্ছে। ইলারা জামান এসে আজরাকে বিষন্ন ভাবে বসে থাকতে দেখে বললেন, বাচ্চারা যখন ঘুমায় তখন তুমিও একটু শুতে পারো?
-ইচ্ছে করে না মা। বরং ওরা ঘুমোলে আমার মাথায় আজগুবি চিন্তা ভাসতে থাকে। তার চেয়ে ওরা জেগে থাকলেই ভালো। সময়টা পার হয়।
একটু থেমে আজরা বলল, আমি ইনতিসারকে গ্রহণ করছি না বলে কোনো অভিযোগ আছে আপনার?
-মোটেও না। তবে একটা কথা আমার বেশ মনে ধরেছিল। ওটা মিথ্যে শুনে খারাপ লেগেছে।
-কী?
-সাদের বিষয়ে।
আজরা মুচকি হেসে বলল, সাদ এটা নিয়ে কী ভাবছে জানিনা। তাকে সরি জানাতে হবে আমার।
-এমনটা হলে মন্দ হত না।
-কী যে বলেন না মা! আচ্ছা আপনি বাচ্চাদের সঙ্গে বসুন। আমি আসছি।
এই বলে সাদের রুমে আসে আজরা। এসেই তাকে দু:খিত জানায় সে। সাদ হেসে বলল, সত্যি বলতে আমি কিছুই মনে করিনি।
-বাঁচলাম।
আজরা চলে যেতে চাইলে তার পথ আঁটকে সাদ বলল, এটা সত্যি হলেও আমার কোনো সমস্যা নেই।
সাদের কথা শুনে থমকে যায় আজরা। পেছনে ফিরে সাদের দিকে তাকাতেই চোখ নিচে নামিয়ে ফেললো সে। আজরা বলল, আবেগের বশে বলছেন এসব।
-আমার এই বয়সে আবেগ খাটে?
-না খাটলে দুই বাচ্চার মা কে আপনার মতো তাগড়া যুবক এই কথা বলে?
-বিয়ে করলে আমিও বাচ্চার বাবা হয়ে যেতাম।
এই বলে দাঁত ক্যালিয়ে হাসলো সাদ। আজরা বলল, আমার চেয়ে অনেক ভালো মেয়ে আপনি পাবেন।
-হয়তো। কিন্তু সেটা আপনি হবেন না। আমার আপনাকেই চাই।
আজরা কী বলবে ভেবে পায় না। সে একটু ভেবে বলল, ভালোবাসার প্রতি আমার কোনো বিশ্বাস নেই। আমার সন্তানদের মা ও বাবা আমিই হতে চাই। নতুন করে জীবনকে আর কষ্ট পেতে দিতে পারি না আমি। আমার দুনিয়া আমি আজরীন ও আযানকে নিয়েই সাজাতে চাই। প্লিজ নতুন কোনো ভাবনা এতে যুক্ত হতে দেবেন না।
-ফাইন! ভাববেন না। তবে আমি চেষ্টা করে যাব, আবার ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার জন্যে। কারণ সব ভালোবাসা মিথ্যে হয় না। পৃথিবীতে সত্যিকারের ভালোবাসা বলতেও কিছু আছে। আর আমি যে আপনাকে সত্যিই ভালোবাসি তা একদিন ঠিকই প্রমাণ হবে।
আজরা কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। ইলারা জামানের চিৎকার শুনে সেদিকে ছুটে গেল তারা। কী হয়েছে জানতে চাইলে কাঁপা স্বরে তিনি বললেন, ইনতিসারের এক্সিডেন্টে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়েছে!

এক বছর পর…
রেস্টুরেন্টে বসে রয়েছে মানতাশা ও আজরা। মানতাশা তিন মাস দেশের বাইরে ছিল বলে অনেক দিন পর দুই বান্ধবীর দেখা হলো।
-তারপর? আর কী হালচাল?
আজরার কথা শুনে মানতাশা বলল, খুশির খবর আছে।
-বল না!
-আমি প্রেগন্যান্ট।
আজরা খুবই খুশি হয়ে মানতাশাকে জড়িয়ে ধরে অভিনন্দন জানালো৷ মানতাশা ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, অনেক ঘুরাঘুরি হলো। এইবার সংসারে নতুন অতিথির আগমন প্রয়োজন মনে করলাম।
-খুবই ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস।
-তোর বাচ্চারা ভালো আছে? সাথে আনলি না কেন?
-তোর সাথে আরামসে গল্প করার জন্য। দু’জনকে একা সামলানো খুব মুশকিল রে।
-কিন্তু আমি ওদের দেখার জন্য অনেক এক্সাইটেড। তোকে গুড নিউজ জানিয়ে ট্রিট দেব বলে রেস্টুরেন্টে ডাকলাম। ওদের আনবি না জানলে বাসায়ই চলে যেতাম।
-অসুবিধা কী! চল তবে?
-আজ থাক। পরে যাব।
-আচ্ছা।
কথার মাঝখানে আজরা বলল, নাবীহার সঙ্গে কথা হয়?
-চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওর ফোন বন্ধ পাই। অনলাইনেও তাকে পাইনা। এভাবে গায়েব হলো কেন তো জানিনা।
-ওহ!
-তোরও জানার কথা নয়।
-জানিনা। শেষ দেখা হয়েছিল সেই হাসপাতালে। আজরীনের খবর বলেছিল তখন। মেয়ের খবর পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য আবেগপ্রবণ হয়ে সব ভুলে গিয়েছিলাম। একবার ভেবেও ছিলাম আবার দেখা করে ধন্যবাদ দেব। কিন্ত…
-কী?
-ইনতিসারের মৃত্যুর খবর শুনে সেটাও করতে ইচ্ছে করেনি। ওর জন্যই আমার সবকিছু এলোমেলো হলো। যতটা দোষ ইনতিসারের ছিল ততটা নাবীহারও। তাই নয় কী?
-হু। এসব করে লাভটা কী হলো! প্রাণ হারাতে হলো ইনতিসারকে। নাবীহার কী অবস্থা জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে সেও সুখে নেই।
-মানছি নাবীহার জীবনে অনেক দু:খ ছিল। কিন্তু ওর জীবনটা সুন্দর হতে চলেছিল। সেদিকে মনোনিবেশ না করে আমার সংসারে আগুন জ্বালালো সে। বাহানা দিলো আমার কথা কান পেতে শুনেছে। শুনেছেই যখন একটাবার আমায় এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করতো। তা না করে এতদিনের বন্ধুত্ব ভাঙন সৃষ্টি করলো।
এসব বলার সময় ছলছল করে উঠে আজরার দুচোখ। মানতাশা বলল, আমার কেন মনে হচ্ছে তুই নাবীহাকে মিস করছিস?
-আজীবন করব। কিন্তু ক্ষমা করব না। যেমনটা ইনতিসারকে করিনি! তবে হ্যাঁ, আমি ওর খারাপ চাইনা। যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক।
মানতাশা কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি পেছনে কারো চ্যাঁচামেচির শব্দ শুনতে পায়। পেছনে ফিরে নাবীহাকে দেখে দু’জনেই অবাক হলো। কারো সঙ্গে ঝগড়া করছে সে।
-আমাদের অভাবের সংসারে তোমার এসব তামাশা না করলে হয় না?
জাদিদের কথা শুনে ক্ষীণস্বরে নাবীহা বলল, আজ তোমার জন্মদিন। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তোমাকে।
-দামি রেস্টুরেন্টে কেক কেটে, লাঞ্চের আয়োজন করে সারপ্রাইজ? আরে এসব না করে বাসায় একটা ভালো খাবার রান্না করতে। এতেই আমি খুশি হতাম।
-করেছি যখন বাদ দাওনা। সময়টাকে উপভোগ করি আমরা?
-একবার প্রশ্রয় দিলে এমন তুমি বারবার করবে। শোনো নাবীহা, আমরা যতটুকে আছি ততটুকেই থাকতে শেখো।
এই বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল জাদিদ।
বিয়ের পর থেকেই অভাব অনটনের মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে নাবীহার। জাদিদের যে এত পাওনাদার রয়েছে এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তার। জাদিদের সঙ্গে তাকেও সেসব পাওনা শোধ করতে হচ্ছে।
-নাবীহা?
পেছনে ফিরে মানতাশা ও আজরাকে দেখে চমকায় নাবীহা। মানতাশা আবারও তার নাম ধরে ডাকতেই সে ছলছলে নয়নে তাকিয়ে বলল, তোরা! কেমন আছিস?
মানতাশা বলল, ভালো। তোর কোনো খবরই পাওয়া যায় না!
-আছিরে কোনো রকম।
আজরার দিকে তাকিয়ে নাবীহা বলল, তুই কেমন আছিস?
-ভালো। কিন্তু তুই কোনো রকম কেন?
তারা যে সবটা শুনেছে তা ভালো করেই বুঝেছে নাবীহা। তাই না লুকিয়ে বলল সে, অভাব অনটনে। শিক্ষকতা ছেড়ে একটা জব পেয়েছি মোটামুটি বেতনের। তবুও সময় ভালো কাটছে না। তার ধার শোধ করতেই সব চলে যায়।
আজরা ছোট্ট একটা নি:শ্বাস ফেলে বলল-
জীবনে টাকার অভাবে ততটা কষ্ট লাগে না, যতটা প্রিয় মানুষের কাছে ধোঁকা খেলে লাগে। টাকা আজকে নেই কালকে হবে। কিন্তু বিশ্বাস একবার চলে গেলে তা সহজে স্থাপন হয় না। ভালোবাসা থাকলে শত অভাবেও দিন পার করা যায় একে অপরের কাঁধে মাথা রেখে। ভালোবাসা না থাকলে কোটি টাকা দিয়েও কী হবে বলতে পারিস?
আজরার চোখের দিকে তাকাতে পারলো না নাবীহা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে।
আজরা মানতাশাকে বলল, আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি।
সে চলে গেলে মানতাশা বলল, কী হলো এসব করে! এসব না করলে আজকে আমাদের মতন ভালো একটা সময় তুইও কাটাতে পারতি।
-ভালো সময় কাটানোর জন্য যে পথে বেছে নিয়েছিলাম সেটা যে ভুল ছিল আমার!
মানতাশা দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে বলল, অন্যায় আমিও করেছি। তবে সংসার ভাঙার মতো অন্যায় করিনি বলে হয়তো আজ আমার অবস্থাটা তোর মতো হলো না। যাক, আশা রাখছি তুইও ভালো থাকবি। যোগাযোগ রাখ। পর করে দিস না।
-বলছিস?
-হু।
-আজরাও যদি এভাবে বলতো!
এই বলে দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয় নাবীহা।
কিছু সময় কথা বলে মানতাশাও বেরিয়ে পড়লো। সে বেরুতেই জাদিদকে দেখতে পায় নাবীহা। জাদিদ এসে বলল, রাগ করেছ? খুব বেশি বলে ফেলেছি তাইনা?
নাবীহা অভিমান করে কিছু না বলে চুপ করে রইলো। জাদিদ তার হাত ধরে বলল, এতসব কিছু করার জন্য তোমাকে আজ উপহার দেব। যা চাও তাই নিতে পারো। ওইদিন একটা শাড়ি পছন্দ হয়েছে না? চলো আজ সেটা নিয়ে দিই।
নাবীহা হেসে বলল, আগে কেকটা তো কাটো।
দু’জনে মিলে কেক কাটে। আর আপনমনে নাবীহা বলল, আসলেই! টাকার অভাব একদিন চলে যাবে। কিন্তু এই মানুষটাকে আমি যেতে দেব না। সবটা দিয়ে হলেও আগলে রাখব তাকে। আমার পরিস্থিতি আরও বাজে হতে পারতো। অন্যায়ই তেমন করেছি আমি। হয়তো সেদিন আজরার মেয়ের খবর তাকে দেওয়াতে আমার শাস্তি কমেছে! নতুবা ইনতিসারের মতোই ভয়ংকর কিছু আমার সাথেও ঘটতে পারতো!

বাসায় ফিরে এসে আজরা দেখলো, সাদ তার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছে।
সে সেদিকে এগিয়ে যায়। সাদ তাকে দেখে আয়াকে বলল, বাচ্চাদের নিয়ে একটু বাইরে যান। আপনার ম্যাডামের সঙ্গে আমার কথা আছে।
আয়া বাচ্চাদের নিয়ে বেরুলে সাদ একটা ফাইল আজরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
এখন থেকে অফিসের সমস্ত দায়িত্ব আপনার। আমার কাজ শেষ।
আজরা ফাইলটা নিয়ে বলল, গত একটা বছর অনেক কষ্ট করলেন। আর এই কয়েক মাস তো আরও বেশি। এভাবে আমাকে সব না বুঝালে আমি কিছুই বুঝতাম না।
-কী যে বলেন না। এটা করে বরং আমি আনন্দিত হয়েছি। কাউকে বিজনেস তো শেখাতে পারলাম। শেখানো শেষ। এইবার নিজেরটা সামলাতে হবে।
আজরা মৃদু হাদে। সাদ খানিক বাদেই বেরিয়ে পড়ে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে বলল, কাজ শেষ বলে ভুলে যাব না কিন্তু। মাঝেমধ্যেই পিচ্চিদের দেখতে হামলা দেব।
আজরা হাসলো। সে চলে গেলে ইলারা জামান এলেন। তিনি বললেন, সাদের পরিবারও তোমাকে গ্রহণ করতে রাজি। তবে তুমি কেন রাজি হচ্ছ না?
-আমার জন্য এটা সহজ না মা।
-কঠিনও না। তোমার বাচ্চাদের একজন বাবার প্রয়োজন। যখন তারা বড়ো হবে সবার বাবাকে দেখবে, নিজের বাবাকে খুঁজবে না? সাদের চেয়ে কেউ ওদের জন্য যোগ্য বলে তো আমার মনে হয় না৷
আজরাকে নিশ্চুপ দেখে তার হাত ধরে ইলারা জামান বললেন, তোমার মা বাবার একমাত্র সন্তান তুমি। আমারও!
আমাদের বয়স হচ্ছে। চিন্তা হয় তোমার জন্যে।
-বিয়ে করেই যদি সব চিন্তার অবসান হত তবে আজ আমার এই দশা হত না।
তার কথা শুনে খানিকক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন ইলারা জামান। এরপর বললেন, আগে একা ছিলে। এখন দু’টো বাচ্চা রয়েছে। ওদের কথা চিন্তা করে হলেও ভেবো দেখো। আমার বিশ্বাস, সাদ তোমাকে সুখে রাখবে।
এই বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। সাদকে আজরার ভালো লাগে। কিন্তু ভালোবাসার চেষ্টা সে করেনি। তার যে এসবে বিন্দুমাত্র আগ্রহ আসেনা। বাচ্চাদের নিয়েই তার পৃথিবীটা সাজাতে চায় সে। কিন্তু এটাও অস্বীকার করা যায় না, সাদ তার বাচ্চাদের অনেক ভালোবাসে। বাচ্চাদের কথা ভেবে কী সাদকে বিয়ে করার মতন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেবে সে!
নাহ, আবারও একই চিন্তা এসে মাথায় ভর করছে। এই থেকে পরিত্রাণের জন্য একটা বই পড়া জরুরী।
এই ভেবে আজরা ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে এলো। বুকসেল্ফ থেকে সাজি আফরোজের “বান্ধবী” বইটা বের করলো সে। ইদানীং বই পড়া আজরার শখ হয়ে উঠেছে। এই বইটা একদিন আগেই পড়া শুরু করেছে। অনেক খানিই পড়ে ফেলেছে। শেষটা কী হবে তা জানার জন্যে বেশ আগ্রহে আছে সে। আজ শেষটা পড়ে মুগ্ধ হয় আজরা।
ঝুমু ও মুনিয়া দু’জন খুব ভালো বান্ধবী। একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসে তারা। একটুর জন্য মনে হয়েছিল আজরাদের বন্ধুত্ব এর মতন তাদেরটাও ঠুংকো হবে। কিন্তু এমন কিছু হয়নি। বরং এমন নি:স্বার্থ ভালোবাসা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আজরা। নাবীহা যদি এমনটা না করতো, তবে তাদের সম্পর্কটাও এমন সুন্দর হত!
আয়া এসে একে একে বাচ্চাদের বিছানায় শুইয়ে দিলো। অসময়ে ঘুমিয়ে গেছে তারা। আজরারও ঘুম পাচ্ছে প্রচুর। তার শাশুড়ী বলেন, বাচ্চার মায়েদের ঘুমের সময় নেই।
যখন ঘুম পাবে তখনি ঘুমিয়ে যাবে। বাচ্চাদের দেখা শোনার জন্য তিনি ও আয়া আছেন। কিন্তু আজরার বাচ্চারা জেগে থাকলে ঘুম পায় না। সবসময় দু:শ্চিন্তা কাজ করে তাদের নিয়ে। বাবার মতো হোক তারা এটা আজরা চায় না। সে চায় তার বাচ্চারা ভালো মানুষ হোক। যারা কাউকে ঠকানোর কথা কখনো ভাবতেই পারবে না।
তাদের বাবা আজরাকে ঠকিয়ে জীবনে কী পেয়েছে! কান্না আর কান্না! আর শেষমেশ নিজের জীবনটাও হারালো।
নাহ, আর কিছু ভাবতে চায় না আজরা। দিতে চায় তার বাচ্চাদের সাথে একটা শান্তির ঘুম।
এই ভেবে দুচোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো সে। আর প্রতিবারের মতো অবেলায় ঘুমিয়েও দেখলো দারুণ এক স্বপ্ন। যে স্বপ্নে সে ও বাচ্চাদের সঙ্গে খেলছে কোনো পুরুষ৷ কিন্তু তার চেহারা স্পষ্ট নয়। কে সেই পুরুষ!
.
সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে