#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫৮
#Saji_Afroz
বাসায় এসে ভাংচুর শুরু করে ইনতিসার। আজ হাসপাতালে একটাবার তার সন্তানদের দেখতে যায় সে। কিন্তু কেউ তাকে সন্তানদের দেখতে অনুমতি দিলো না। বরং তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলো। ওদিকে সাদ তার বাচ্চাদের কোলে নিয়ে দিব্যি হেসে চলেছে। সাদের অধিকার কী তার চেয়েও বেশি হয়ে গেল যে সবার সাথে সাথে সাদও তাকে অপমান করলো! আচ্ছা! সাদের এত আগ্রহ কেন এসবে? সম্পত্তির জন্যে? না না! তার নিজের কম নেই। তবে? আজরা!
এটা ভেবে অস্থির হয়ে উঠে ইনতিসার। সাদ কী তবে আজরার প্রেমে পড়লো! নাহ, এটা হতে দেওয়া যায় না। আজরার ইনতিসারের কাছে ফিরে আসতেই হবে। সেটা যেভাবেই হোক।
গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল আজরা। হঠাৎ ঘুম ভাঙতেই পাশ ফিরে দেখলো, সাদ তার একটি সন্তানকে কোলে নিয়ে হাঁটছে।
আজরা অবাক হয়ে বলল, আপনি এখানে? আপনি না বাসায় গেছেন?
-সোনা পাখিদের রেখে বাসায় মন বসছিল না। তাই চলে এলাম আবার।
আজরার সঙ্গে ছিল তার মা ও ইলারা জামান। পাশের সিটে আজিজা বানু ঘুমোচ্ছে। ইলারা জামানকে না দেখে তিনি কোথায় জানতে চাইলে সাদ বলল, আমি আসার পর বাসায় গেছেন। খালামনির শরীরটা ভালো লাগছিল না।
-সে কী! কী হলো?
-অস্থির হওয়ার কিছু নেই! ভালোভাবে রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে।
-হু। কিন্তু আপনি ওকে নিয়ে হাঁটছেন কেন?
-কান্না করছিল। কান্নার শব্দে যদি আপনার ঘুম ভেঙে যায়?
আজরা হেসে বলল, ভাঙলেই ভালো। আরে ওর খিদে পেয়েছে বলে কাঁদছে।
-তাই!
-জি তাই।
আজরার পাশে এসে তাকে উঠে বসতে সহায়তা করলো সাদ। এরপর কোলে তার ছেলেকে দিলো। সাদ বেরুনোর সময় কেঁদে উঠে মেয়েটিও। সাদ আবার এসে মেয়েকে কোলে তুলে নেয়। আজরাকে বলল, আমি সামলে নিচ্ছি।
এই বলে মেয়েকে নিয়ে বেরুলো সে।
সকালে ইলারা জামান আসলে সাদ অফিসের উদ্দেশ্যে বেরুই। যদিও আজ তার মোটেও অফিস যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু অফিসের সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো দরকার বলে বের হয় সে।
ইলারা জামানকে আজিজা বানু বললেন, মাঝরাতে উঠে দেখি সাদ বাচ্চাদের সামলাচ্ছে। বড়ো ভালো ছেলে সে।
ইলারা জামান আপনমনে বললেন, আজরার প্রতি টান আছে বলেই তার বাচ্চাদের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে সাদের মনে। এই টান আর ভালোবাসা যেন বাড়তে থাকে ক্রমাগত!
দুপুর হয়ে যায়। ইলারা জামান খাবার আনতে হাসপাতালের উপরে থাকা রেস্টুরেন্টে গেলেন। এদিকে বাচ্চারা ও আজরাকে ঘুম দেখে আজিজা বানু গেলেন ওয়াশরুমে।
এরইমধ্যে আগমন ঘটে ইনতিসারের। এমন নীরব পরিবেশ সে আশা করেনি। একবার আজরাকে ডাকতে চেয়েও ডাকেনি সে। বাচ্চাদের দু-চোখ ভরে দেখে নিলো সে। তাদের রেখে যেতে মন মানছে না তার। হঠাৎ ইনতিসারের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। যাকে কুবুদ্ধিও বলা যায়! এতে করে যদি আজরাকে তার কাছে ফিরতে আবারও রাজি করানো যায়!
আশেপাশে তাকিয়ে মেয়ে বাবুকে কোলে তুলে নেয় ইনতিসার। এরপর হনহনিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায় সে। ইনতিসার চলে যাওয়ার পরেই সেখানে আগমন ঘটে ইলারা জামানের। তার ফোন এলে খাবার গুলো টেবিলের উপরে রেখে কেবিনের বাইরে আসেন তিনি। এদিকে ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আজরার। সে পাশ ফিরে দেখলো, পাশের বেডে কেবল তার একটি সন্তান রয়েছে। আশেপাশে তাকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আজরা। আজিজা বানু গোসল সেরে এসেছেন। আজরাকে দেখে বললেন, কী খুঁজছিস?
-বাচ্চা একটা কেন মা?
তিনি টেবিলের উপরে খাবার দেখে বললেন, ইলারা আপা নিয়েছেন হবে। নিশ্চয় কান্না করছিল বলে বাইরে বেরিয়েছেন তোর ঘুম নষ্ট হবে বলে।
-হোক না! কাঁদলে আমায় দেবে।
-তোরও রেস্ট এর প্রয়োজন।
আজরা একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তিনি বললেন, কী হলো?
-মা যতই বলুক তিনি ভালো আছেন। আসলে নেই।
-আমিও বুঝি।
-আমি চাচ্ছি সবকিছু ইনতিসারকে ফেরত দিতে বলব। সে অনুতপ্ত। তারও সুযোগ পাওয়া উচিত জীবনে।
-ক্ষমা করে দিবি? কী চাইছিস!
-আমি করব না। তার মা কে বলব করতে। আমি নিজে কিছু করতে চাই। আমার বাচ্চাদের দায়িত্ব আমি নেব।
ইলারা জামান এসব শুনে ভেতরে আসতে আসতে বললেন, আমার নাতী নাতনী কোনো কষ্ট পাক তা আমি চাইনা। তুমি আমার মেয়ে। সেই হিসেবে ওরা আমার আপনজন। ইনতিসার আগে আপন ছিল। যবে থেকে ওর জন্য আমার আপনজন দূরে সরেছে তবে থেকে সেও পর হয়ে গেছে। এত সহজে আমি তাকে ক্ষমা করব না। করলেও কিছু ফিরিয়ে দেব না। তুমি না চাইলে সেসব নাতী নাতনীর নামে লিখে দেব। এতটুকু অধিকার আমিও রাখি।
ইলারা জামানের কোল খালি দেখে তার সন্তান কোথায় জানতে চায় আজরা। তিনি জানেন না জানালে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। কেবিনের কোথাও মেয়েকে না পেয়ে নার্স ও ডাক্তারকে ডাকে তারা। সাদও দ্রুত ছুটে আসে এই খবর পেয়ে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হলে ইনতিসারকে দেখতে পেল তারা। যে কিনা মেয়েকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। এই দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারায় আজরা। সাদ ইলারা জামানের উদ্দেশ্যে বলল, আজরাকে সামলান! আমি এখুনি থানায় যাচ্ছি। মনে হয় না ইনতিসার তার ফ্ল্যাটে রয়েছে।
একটা হোটেলে তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে ইনতিসার। আনার পর থেকে প্রচন্ড কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে সে। ইনতিসার তাকে রেখে বাইরে যেতে পারছে না বলে, দুধ ও ফিডারও আনতে পারছে না। কোনোমতে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে শান্ত করলো ইনতিসার।
বাচ্চাটি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলে দুধ আনতে বাইরে গেল সে। দ্রুত ফিরে এসে দেখলো, আবারও বাচ্চাটি কান্না করছে। তার ডায়াপারও বদলানো প্রয়োজন। কিন্তু ইনতিসার ডায়াপার আনেনি। সে আগে দুধ তৈরী করে বাচ্চাকে তা খাওয়ালো। বাচ্চা শান্ত হলে ডায়াপার আনতে বেরুলো। ডায়াপার খোলার পর ভেতরের অবস্থা দেখে মনে পড়লো সে টিস্যু আনেনি। কী আর করার! নিজের পকেটে থাকা শুকনো টিস্যু দিয়েই পরিষ্কার করে ডায়াপার পরিয়ে দিলো সে। এতটুকুতেই ঘাম ঝরে ইনতিসারের কপাল বেয়ে। কিন্তু শেষ এখানেই হয় না! হয় খানিক বাদে যখন বাচ্চার গায়ের রঙ হলুদবর্ণ হতে শুরু করে।
প্রথমে বিষয়টা এতটা গুরুত্ব দেয় না ইনতিসার। ভাবে এটা স্বাভাবিক কোনো বিষয়। সে ভাবতে শুরু করে অন্য বিষয়ে। আর তা হলো, কিভাবে এই বাচ্চাকে হাতিয়ার বানিয়ে আজরাকে হাসিল করা যাবে।
এদিকে মানতাশার কাছে সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছে নাবীহা। কী করতে চায়ছে ইনতিসার! কেন সে আজরার মেয়েকে নিয়ে চলে গেল! তার এই কাজে আজরার অবস্থা নিশ্চয় বেহাল হয়েছে। আফসোস! এসবের জন্য নাবীহা নিজেও দায়ী। তাইতো ভুল বুঝার পরেও আজরার সামনে যাওয়ার সাহস তার মধ্যে নেই!
রাত হয়ে যায়। ইনতিসারের কোনো হদিস পায় না তারা। সকলে বাসায় চলে আসে। মেয়ের চিন্তায় ছেলের ভালো করে যত্ন নিতে পারছে না আজরা। সে ঠিক আছে তো! কী করতে চায়ছে ইনতিসার!
এদিকে ইনতিসার খেয়াল করলো মেয়ে বাচ্চাটি জোরে জোরে নি:শ্বাস ফেলছে। সাথে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। এছাড়াও শরীরের হলুদবর্ণ আরও বেড়ে গেছে। এইবার ঘাবড়ায় ইনতিসার। বাচ্চার কান্নাও যে থামছে না! সিদ্ধান্ত নেয় তাকে হাসপাতালে নেওয়ার। এই ভেবে বাচ্চাকে নিয়ে বেরুলো সে। বাচ্চা নিয়ে ড্রাইভ করতে পারবে না বলে গাড়ি ভাড়া করে নিলো। রওনা হলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। পথিমধ্যে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেলে তাকে নামতে হয়। এদিকে বাচ্চার কান্না হতে থাকে তীব্র। ইনতিসার বাচ্চা কোলে নিয়ে গাড়ি ঠিক করতে অস্থির হয়ে উঠে। ঠিক তখনি নাবীহার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে।
-আপনি?
ইনতিসার তাকে দেখে কথা না বাড়িয়ে বলল, প্লিজ ওকে একটু নাও! আমি একটা গাড়ি ঠিক করি।
নাবীহা বাচ্চা কোলে নিয়ে তাকে শান্ত করতে থাকে। বাচ্চাটি শান্তও হয়ে যায়। আজরার মেয়েকে দেখে ছলছল করে উঠে নাবীহার দুচোখ! এভাবে যে আজরার মেয়েকে দেখতে হবে কখনো ভাবেনি।
ইনতিসার গাড়ি ঠিক করে। বাচ্চাকে নিয়ে সেখানে উঠে পড়লে নাবীহাও পাশে এসে বসে পড়ে।
ইনতিসার বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
-আপনি ওকে সামলাতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে? ওকে দেখে মনে হচ্ছে জন্ডিস হয়েছে। আরও আগে নিতে পারলেন না হাসপাতাল?
গাড়ি চলতে শুরু করে। ইনতিসার মেয়ের চিন্তায় কোনো কথা বলতে পারলো না। তারা হাসপাতাল এলে ডাক্তার বাচ্চাকে দেখে জানায়, তার ঠান্ডা লেগেছে। সাথে জন্ডিসও হয়েছে। এখুনি চিকিৎসা শুরু করতে হবে।
ইনতিসার অনুমতি দিলে বাচ্চাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
নাবীহা বলল, এটা কী করলেন আপনি! হুট করে বাইরের দুধ দেওয়ার কারণে হয়তো ঠান্ডা চলে এসেছে।
আজরাকে খবর দিন।
-না না। ওকে বলা যাবে না!
-এই সময় মা কে প্রয়োজন বাচ্চার!
-বাবা আছে। তাতেই হবে। তুমি প্লিজ কাউকে কিছু জানাবে না।
-এসব কেন করছেন আপনি?
-মেয়ে আমার কাছে থাকলে আজরাও ফিরে আসবে।
-আর মেয়ের কিছু হয়ে গেলে?
নিশ্চুপ হয়ে যায় ইনতিসার।
এরইমধ্যে ডাক্তার এসে জানালো, শিশুর মা কে আনতে। এই সময় ঘনঘন বুকের দুধের প্রয়োজন।
ইনতিসার কিছু না ভেবেই বলল, মা! মা কে তো আনা সম্ভব না।
-কেন?
-না আনলে হয়না?
-বাচ্চার অবস্থা এখনো খারাপ হয়নি। দ্রুত ঠিক করতে হলে মা কে আনুন। আর নাহয় অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
-তাই করুন!
ডাক্তার গেলে নাবীহা এসে বলল, কেন মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছেন? কতকিছু সহ্য করতে হবে এখন মেয়েটাকে!
ইনতিসার কিছু একটা ভেবে বলল, তুমি চুপ থাকো। বিনিময়ে তোমার থেকে যে টাকা পাই সেসব ক্ষমা করে দেব। সাথে যেই জমিটা তোমার নামে নিয়েছিলাম সেটাও চাইব না। আরও দুই লক্ষ টাকা দেব। টাকার প্রয়োজন না তোমার?
একথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় নাবীহা। ইনতিসার বলল, এই সময়ে আজরা এসব জানলে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে আর যেটা আমি চাই না। আমি ডাক্তারের কাছে গেলাম। প্লিজ চুপচাপ বাসায় যাও। টাকা পেয়ে যাবে।
জীবনে সুযোগ নাকি খুব কমই আসে নিজেকে শুধরে নেওয়ার জন্য। নাবীহা একবার ভুল করেছে। আজ ইনতিসারের কথা শুনলে তার পাপ হবে৷ এই ছোট্ট শিশুটার এতবড়ো ক্ষতি সে হতে দিতে পারে না। এই ভেবে আজরার নাম্বারে অনেক দিন পর ডায়াল করলো সে। আজরাকে সব জানিয়ে দ্রুত আসতে বলল এখানে।
.
চলবে
#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫৯
#Saji_Afroz
করিডোরে হঠাৎ আজরা ও সাদকে দেখে চমকে উঠলো ইনতিসার। আজরা তার কাছে আসতেই সে আমতাআমতা করে বলল, শরীর ঠিক আছে তো?
আজরা কিছু না বলে ইনতিসারের গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিলো। যা উপস্থিত সবারই কল্পনার বাইরে ছিল।
ইনতিসার নিজের গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নাবীহা এখনো যায়নি। সে এদিকে এগিয়ে আসে। তাকে দেখে ইনতিসার বলল, খবরটা তুমি দিয়েছ? আর কত ঠকাবে আমাকে! তোমার কাছে এতটুকু শান্তি কী আমি পাব না? নিজেও আমার জীবনে আসোনি। যখন আজরাকে চাইছি বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছ। খুব প্রয়োজন ছিল ওকে জানানোর? না জানালে তোমাকে টাকাও দেব বলেছিলাম।
-এইবার যদি আমি ওকে কিছু না জানাতাম তবে নিজেকে একটা সুযোগ কিভাবে দিতাম বলেন? আজরার সাথে অন্যায় করে যে মনের মাঝে অশান্তি আমি অনুভব করছিলাম তা অনেকাংশেই কেটে গেছে।
আজরা আবেগপ্রবণ হয়ে নাবীহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। তাকে শান্তনা দেয় নাবীহা। তাকে ছেড়ে ইনতিসারের দিকে তাকিয়ে আজরা বলল, আমার সঙ্গে যা করার করেছেন। আমার বাচ্চাদের নিয়ে কিছু করলে আমি ক্ষমা করে দেব ভাবলেন কিভাবে? চড়টা ছিল সামান্যতম শাস্তি। সামনে আরও ভয়ংকর শাস্তি অপেক্ষা করছে আপনার জন্য।
এই বলে নাবীহাকে সে বলল, আমার মেয়ের কাছে নিয়ে যা আমায় প্লিজ!
-হুম চল।
আজরা ও নাবীহা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যায়। ইনতিসারের কাছে এসে সাদ বলল, বাচ্চাদের জন্য ভালো কিছু করতে পারতে। তা না করে কিডন্যাপ করে ফেললে! এটা করে কী হাসিল করতে চেয়েছ তুমি?
ইনতিসার কিছু না ভেবেই বলল, আজরাকে।
-ওহ তাই! কিন্তু পরিশেষে কী হলো?
-এখনো পরিশেষ হয়নি। শুরু হয়েছে। আর ওকে আমি হাসিল করেই ছাড়ব।
এই বলে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে গেল ইনতিসার।
মেয়ের কাছে আজরাকে রেখে বেরিয়ে এল নাবীহা। তাকে
দেখে সাদ বলল, আজ ইনতিসার ভাই এর প্রস্তাব মেনে নিলেন না কেন?
-আর কত অন্যায় করব ভাই! অন্তত বাচ্চাটার কথা চিন্তা করে এই অন্যায়টা করলাম না। একবার অন্যায় করে প্রিয় বান্ধবীকে হারিয়েছি। তার কলিজার টুকরার কিছু হলে কখনো ক্ষমাও যে করতো না আমায়!
-আপনার প্রতি যত রাগ ছিল আজ তা গায়েব হয়ে গেল৷ অনেক ধন্যবাদ।
এদিকে জাদিদ তার এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে হাসপাতালে এসেছিল। আড়াল থেকে এসব দেখে, শুনে বুঝলো নাবীহা নিজেকে কতটা পরিবর্তন করতে পেরেছে! যা দেখে সে একটা সিদ্ধান্ত নেয়। জানেনা নাবীহা বিষয়টা কিভাবে নেবে।
সপ্তাহ খানেক কেটে যায়। আজরার সন্তানেরা সুস্থ আছে। তবে সেদিনের পর থেকে ইনতিসারের আনাগোনা বন্ধ হবে ভেবেছিল আজরা। এমনটা হয়নি। বরং ইনতিসার ক্ষমা চাওয়ার অজুহাতে নিত্যদিনই তার বাসায় এসে হাজির হয়। আর বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটাতে চায় যা আজরার একেবারেই অপছন্দ। খুব দ্রুত এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে করে ইনতিসারের এসব থেকে সে মুক্তি পায়। কারণ ইনতিসারের জন্য যে এক বিন্দুও ভালোবাসা তার মনে নেই!
ছেলেকে কোলে নিয়ে হাঁটছে ইনতিসার। মেয়ে রয়েছে আজরার কোলে। ইনতিসার ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ও দেখতে তোমার মতন হয়েছে।
আজরা বলল, আর ও হয়েছে তোমার মতো।
ছেলে কেঁদে উঠলে তাকে নিয়ে আজরার কাছে আসে ইনতিসার। মেয়েকে সে নিয়ে আজরার কোলে ছেলেকে দিলো। ইনতিসারের কোলে মেয়েও কেঁদে উঠে। ইনতিসার মুখটা ফ্যাকাসে করে বলল, ওরা কী আমায় পছন্দ করে না? আমার কোলে থাকলেই কেঁদে উঠে কেন!
আজরা হেসে বলল, এমন কিছু নয়! খিদে পায় বলে কাঁদে।
ইনতিসার মেয়েকে শান্ত করে বলল, ওদের নাম কী রাখা যায় বলো তো?
-আপনি যা চান।
-আমি রাখব?
-হু।
একথা শুনে ইনতিসার খুশি হলেও পড়ে যায় ভাবনায়। কী নাম রাখা যায় নিজের ছেলে-মেয়ের!
ঘুমটা ভেঙে যায় ইনতিসারের। অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। কখন কী করে নিজেও জানেনা। সারাক্ষণ নিজের পরিবারের কথা ভেবে মনটা আনচান করে।
এইতো এখনো ওদের কথা ভেবে ঘুম ভেঙে গেল তার। ওহহো! আজ তো নাম রাখবে শুনেছে তার ছেলে মেয়ের। ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করবে শুনেছিল ড্রাইভারের কাছে। সেও দাওয়াত পেয়েছে।
ইনতিসারকে একথা কেউ জানায়নি! না জানালেও সে যাবে। তার সন্তানদের উপর পূর্ণ অধিকার আছে তার। এই ভেবে ইনতিসার বেরুলো। শপিংমল থেকে বাচ্চাদের জন্য উপহারসামগ্রী নিয়ে ও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো সে।
এদিকে আজ অনেকদিন পর শাড়ি পরেছে আজরা। সেজেছেও সে। খোপা করে চুলে দিয়েছে বেলী ফুল। আজ তার মন খুব ভালো। সবাই বলেছে, বাচ্চাদের নাম তাকেই রাখতে। তার লড়াই এর ফসল এরা। আর তাই তার অধিকার সবচেয়ে বেশি। আজরা দু’টো নাম ঠিক করে রেখেছে।
হঠাৎ আগমন ঘটে সাদের। সে বলল, পুচকি পুচকু তৈরী হলো?
আজরাকে দেখে থেমে যায় সে। এই প্রথম তাকে সাজসজ্জা ও শাড়ি পরা দেখে হা হয়ে যায় সাদ। মেয়েটা সবসময় এমন পরিপাটি হয়ে থাকে না কেন! অবশ্য ভালোই হলো। নতুবা বেহায়ার মতন ফ্যালফ্যালে চোখে সবসময় তার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হত।
আজরা বলল, হু রেডি। সাথে আমিও।
-দারুণ লাগছে!
-তাই না? নিজের পছন্দের পোশাক পরালাম আজ ওদের।
সাদ আর বলতে পারলো না, কথাটি তার জন্যে বলেছিল।
সে মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল, আসুন নিচে। হুজুরদের বাচ্চাদের নাম বলবেন। ঠিক করেছেন?
-হু।
-যাই ঠিক করুন। আমি কিন্তু পুচকু পুচকিই ডাকব।
এটা শুনে হাসে আজরা। নাহ, এভাবে একা আজরার পাশে আর দাঁড়ানো যাবে না। এভাবে তাকিয়ে থাকলে কী মনে করবে সে!
দু’জনে নিচে নেমে আসে। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আজরার দিকে তাকিয়ে থাকে বাচ্চাদের নাম শোনার জন্য। অবশেষে মুখ খুললো আজরা-
ছেলের নাম হলো আযান ও মেয়ের নাম আজরীন।
সবাই বেশ খুশি হলো নাম শুনে। কিন্তু ইনতিসারকে দেখে সবার হাসি হয়ে গেল গায়েব।
ইনতিসার বলল, আমাকে ছাড়াই তোমরা নাম ঠিক করো কিভাবে?
উপস্থিত সকলে দাঁড়িয়ে পড়ে। হুজুরদের চলে যেতে বলা হয়। তারা চলে গেলে ইলারা জামান বললেন, মানে কী! তোকে নিয়ে নাম ঠিক করবে কেন?
-কারণ আমি ওদের বাবা।
-যে বাবা জন্মের আগেই তাদের হত্যা করতে চেয়েছিল!
-মানুষ মাত্রই ভুল।
-তোর ভুলের পরিমাণ সীমাহীন। এটা মানিস না?
ইনতিসার চ্যাঁচিয়ে বলল, না মানি না! আমি আমার বাচ্চাদের নিয়ে একসঙ্গে থাকতে চাই। থাকতে চাই আজরাকে নিয়ে! ডিভোর্স কার্যাকর হওয়াকালীন ও প্রেগন্যান্ট আমি জানতাম না। আবারও সবটা ঠিক করার সুযোগ আছে।
আজরা বলল, জানার পর কী করেছেন? বাচ্চা মেরে ফেলার পক্ষে বলেছেন।
-সেটা তো তোমার বাবাও বলেছিল।
-বলেছে বলেই কোনো অধিকার তিনি খাটান না। আপনি কেন খাটাতে আসেন?
ইনতিসার নরমস্বরে বলল, আজরা প্লিজ চলো সবটা ঠিক করে নিই। আমরা ভালো থাকব অনেক।
সাদ এসে বলল, ভাইয়া প্লিজ থামো। তুমি যাও এখান থেকে। আমাদের এত সুন্দর মুহুর্তটা নষ্ট করো না।
-আমাদের! তোর কিসের মুহুর্ত রে! সব আমার। তুই কে আমাকে বাঁধা দেওয়ার!
-আমি আজরার শুভাকাঙ্ক্ষী।
উচ্চস্বরে হেসে ইনতিসার বলল, তাই! নাকি অন্যকিছু? তুই যে আজরাকে নিয়ে অন্যকিছু ভাবিস তা আমি বুঝি না?
আজরা তাকে থামতে বললে ইনতিসার বলল, তুমিও ভাবো নাকি অন্যকিছু?
আজরা ছোট্ট একটা নি:শ্বাস ফেলে বলল, হু ভাবি।
ইনতিসার বলল, কী?
-খুব দ্রুত আমি সাদকে বিয়ে করব। আমরা দু’জনে মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ইনতিসার একটু থেমে বলল, তুমি এটা করতে পারো না।
-আমি পারি। অনেক ভেবে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
ইনতিসার রাগান্বিত হয়ে সাদের শার্টের কলার ধরে বলল, আমার সর্বনাশ করে শান্তি হলি তুই?
আজরা তাকে ছাড়িয়ে বলল, আপনার সর্বনাশ আপনি নিজে করেছেন। অন্য কেউ নয়!
ইনতিসার কাঁদতে শুরু করে। সে নরমস্বরে বলল-
আমার ভুল হয়ে গেছে আজরা! ক্ষমা করে দাও আমাকে।
আজরা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইলো। ইনতিসার বলল-
তুমি আমি আর আমাদের সন্তানেরা! কত সুন্দর পরিবার আমরা। জীবনটা অনেক সুন্দর হবে আজরা। ওদেরকে ওদের বাবার পরিচয়ে বড়ো হতে দাও প্লিজ!
ইনতিসারের দিকে তাকিয়ে আজরা বলল, বাবার পরিচয়! আর সেই বাবা তাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল শুনে…
ইনতিসার তাকে থামিয়ে বলল, সব ভুলে আবার সবটা শুরু করা যায় না?
আজরা বলল, নাহ।
ইনতিসার গম্ভীরমুখে বলল, আমিও দেখব সাদকে কিভাবে বিয়ে করো তুমি! আইনের আশ্রয় নেব আমি।
এই বলে ইনতিসার হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়ে। সবাই উৎসুকভাবে আজরার দিকে তাকিয়ে রইলো। আজরা বলল, এটা আমার আর সাদের একটা প্লান মাত্র। বিয়ে আমরা করছি না।
এই বলে আজরা উপরে চলে গেল।
তার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো সাদ। হতে পারে এটা মিথ্যা ছিল। কিন্তু সত্য হলেও যে তার কোনো আপত্তি নেই! কারণ আজরাকে যে সে ভালোবেসে ফেলেছে!
.
চলবে