#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৪৯
#Saji_Afroz
-এসব কোনো রান্না হলো? ভালো কিছু করতে না পারলে বাইরে থেকেই আনতে পারেন খাবার!
তাসফিয়ার কথা শুনে সাজেদা বেগম বললেন, ঘরে তিনটা মেয়ে থাকতে বাইরে থেকে কেন খাবার আনব? আমাদের রান্না ভালো না লাগলে তুমি তো করতে পারো নাকি?
-আমি করব রান্না? কখনো করিনি করবও না। আমার টাকায় আমি বাইরে থেকে নিজের জন্য আনাব খাবার। আপনারা যা খুশি খান।
এই বলে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেল তাসফিয়া। সাজিরকে ডেকে কেঁদে বুক ভাসিয়ে এসব বোঝালেন সাজেদা বেগম। সাজির বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বলল, তোমার পছন্দেই বিয়ে করেছি। এরপরেও অভিযোগ করছ? আমি এসব অভিযোগ শুনে কী করব বলো তো?
তিনি অবাক হয়ে বললেন, আসলেই কিছু করার নেই তোর?
-নাহ। তাছাড়া তোমাদের কথা শুনবে এমন বউ তো দরকার ছিল না। এখন এত অসুবিধা কেন?
সেকথার জবাব তিনি দিতে পারলেন না। সাজিরও কোনো কথা না বলে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল।
.
.
.
ইলহাম শেখ এমন সংবাদ শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলেন। তিনি বললেন, আজরা মা কে সঙ্গে নিয়ে আসোনি কেন?
ইলারা জামান বললেন, বাবার শরীর খারাপ বলে আসলো না।
-দেখা হলো ভাই সাহেবের সঙ্গে? আমি ক্লান্ত ছিলাম বলে যেতে পারলাম না। তা জানিয়েছ?
-এখন আগের চেয়েও ভালো। তবুও আজরা থাকতে চাইলো।
-ইচ্ছে হলে থাকুক। ইনতিসার? সে জানে?
-আজরা জানাবে বলেছে। তাই বলা হয়নি।
-দেখবে আজ দ্রুত বাড়ি চলে আসবে। আর আসার সময় মিষ্টির দোকানই নিয়ে আসবে।
.
.
.
এমন একটা খুশির মুহূর্ত জীবনে এসেছে। অথচ খুশি হতে পারছে না আজরা। বরং দুশ্চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
ইনতিসার এখন তার স্বামী নয়। এদিকে সে মা হতে চলেছে। এই বাচ্চার ভবিষ্যৎ কী! আজরার মা বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তাকে বাচ্চাটিকে পৃথিবীর আলো না দেখানোর জন্য। আজহার শেখ কড়া ভাবে বলেছেন, ইনতিসারের বিষয়ে তিনি কিছু না বললেও এই বিষয়ে বলবেন। ইনতিসারের বাচ্চাকে যেন আজরা পৃথিবীতে না আনে। কী সিদ্ধান্ত নেবে আজরা? মা বাবার কথা শুনবে? নাকি নিজের মনের কথা!
.
.
.
অফিস থেকে ইনতিসার আসতেই তার কাছে এলেন ইলারা জামান। তিনি অবাক হয়ে বললেন,আমি ভেবেছিলাম তুই আজ তাড়াতাড়ি আসবি। সাথে থাকবে অনেক মিষ্টি। এভাবে এলি কেন?
ইনতিসার অবাক হয়ে বলল, মানে?
ইলারা জামান তার চেয়েও বেশি অবাক হয়ে বললেন, কারণ বুঝি জানিস না?
-না তো!
-আজরা বলেনি কিছু?
-নাহ।
-সে কী! এত বড়ো খুশির সংবাদ তোকে এখনো জানায়নি আজরা?
তিনি নাবীহার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি তার বেস্ট ফ্রেন্ড। তুমিও জানো না?
না সূচকভাবে মাথাটা নাড়লো নাবীহা। ইনতিসার বলল, তুমিই বলে দাও ঘটনা কী?
ইলারা জামান এক গাল হেসে বললেন-
নিশ্চয় আজরা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলো।
-কিন্তু কী?
-আরে তুই বাবা হতে চলেছিস!
এক মুহুর্তের জন্য সবকিছু ভুলে যায় ইনতিসার। খুশিতে সে বলে বসলো, সত্যি বলছ মা?
-হু।
সে মা কে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি বাবা হতে চলেছি! ইয়েস! আজরার কার্টুন দেখার সঙ্গী চলে আসতে চলেছে।
ইলহাম শেখ এসে বললেন, আর তোর কিসের সঙ্গী শুনি?
-আমার সবকিছুর।
ইনতিসারের এমন কাণ্ড দেখে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো নাবীহা। ইলহাম শেখ বললেন, বউ মা কে নিয়ে তো আসবি নাকি?
-এখুনি যাচ্ছি।
এই বলে পা বাড়ায় ইনতিসার। পরমুহূর্তেই বিচ্ছেদের কথা মনে হতেই থেমে গেল সে। আড়চোখে তাকালো নাবীহার দিকে।
ইলহাম শেখ বললেন, থেমে গেলি কেন?
-এই সংবাদ তোমাদের কে দিলো?
-তোর মা আজ গেল আজরার কাছে। আজরার শরীর খারাপ হলে সেখানে ডাক্তার আসে। উনিই বলল।
-ও আচ্ছা। ওর বাবারও তো শরীর খারাপ। থাকুক কিছুদিন সেইখানে। নিয়ে আসব আমি পরে।
এই বলে ইনতিসার নিজের রুমে চলে যায়। নাবীহা চলে যায় গেস্ট রুমে।
ইনতিসারের হুট করে চুপসে যাওয়াটা ভালো লাগলো না ইলহাম শেখের। তিনি ইলারা জামানকে বললেন, ছেলে মেয়েদের মাঝে কিছু একটা ঠিক নেই! আজরা তাকে সংবাদ জানায়নি। ইনতিসার জেনেও কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। কেমন যেন লাগছে আমার।
ইলারা জামান বললেন, অহেতুক চিন্তা করো না তুমি।
খানিকবাদে নাবীহা ও ইনতিসার ফ্রেশ হয়ে খেতে আসে। নাবীহাকে এখনো এখানে দেখে ইলারা জামান বললেন, তুমি এখনো এইখানে? না মানে আজরা নেই অথচ তুমি আছ। কোনো সমস্যা কিনা জানতে চাচ্ছি?
নাবীহা আমতাআমতা করে বলল, আমার বাসার সবাই বাইরে আছেন। আর আজরার বাসায় এখন রোগী। তাই ওখানে থেকে ডিস্টার্ব করছি না। আজরাই আমাকে এখানে থাকতে বলেছে।
একথা শুনে তিনি কিছু বললেন না।
.
.
.
মধ্যরাতে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে ভ্রই কুচকালো নাবীহা। এত রাতে কে এসেছে! দরজা খুলে ইনতিসারকে দেখে বিরক্ত হলো সে। নাবীহা বলল, বলেছি না বিয়ের আগে এভাবে হুটহাট আমার রুমে আসবেন না?
-একটা কথা বলতে এসেছি।
-কী?
-কটা দিনের জন্য তোমার বাসায় ফিরে যাবে?
নাবীহা অবাক হয়ে বলল, কেন?
-মা বাবাকে ম্যানেজ করে তোমাকে ডাকব আবার।
-নাকি সিদ্ধান্ত বদলাতে চাচ্ছেন?
-আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তুমি নিজেও জানো এটা সম্ভব না।
-মন কী চায়ছে আপনার?
-আমার মন কিছু চায়ছে না। তুমি অন্যকিছু ভেবো না প্লিজ!
-আমাকে চলে যেতে বলছেন আবার অন্যকিছু না ভাবতে বলছেন। আসলে চায়ছেন কী আপনি? ক্লিয়ার করে বলুন না!
-আমি চাইছি ঠান্ডা মাথায় সবটা হ্যান্ডেল করতে।
-তাই!
-তোমার কী মনেহয়?
-আমার মনেহয় বাচ্চার কথা শুনে আপনি অনেক বেশি খুশি হয়েছেন। কী? হোননি?
নাবীহার কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় ইনতিসার। কারণ এই কথা সত্য। কিন্তু এটাও সত্য যে সে নাবীহাকে তার জীবনে চায়।
-কী হলো? বলুন?
ইনতিসার বলল,প্লিজ কথা টেনোনা! আমার কথা শোনো। দু’জনেরই ভালো হবে।
কর্কশভাবে নাবীহা বলল, আমি কোথাও যাচ্ছি না।
ইনতিসার রাগে আর কিছু বলল না। নিজের রুমে ফিরে এসে পায়চারি করতে থাকলো সে। এটা ঠিক যে বাচ্চার কথা শুনে খুশি হয়েছে সে। কিন্তু এটাও ঠিক যে, সে নাবীহাকে হারাতে পারবে না। তাই অন্যসব ভাবনা তাকে একপাশে রেখে নাবীহাকে কিভাবে বিয়ে করবে সেদিকে মনোনিবেশ করতে হবে। আর এই মুহুর্তে সবচেয়ে কষ্টকর হচ্ছে তার মা বাবাকে রাজি করানো। এখন তাদের নাতি/নাতনি আসতে চলেছে। এখন তো বিষয়টা আরও বেশি জটিল হয়ে গেল। কী যে করবে ইনতিসার!
.
.
.
পরেরদিন ইলহাম শেখ প্রিয় পুত্রবধূকে দেখতে গেলেন। সাথে করে হরেক রকমের মিষ্টি নিয়ে আসলেন।আর আজরার জন্য অনেক গুলো উপহার। তার ঘর যে আলো করবে তার জন্য এতটুকু করাই যায়!
আচমকা ইলহাম শেখকে দেখে অবাক হলো আজরা। সে তাকে সাদরে প্রবেশ করালো। তিনি আজরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, এত খুশির একটা সংবাদ দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ তোমাকে।
আজরা কিছু বলতে পারলো না। ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো সে। তিনি আরও বললেন, কবে যাবে বলো বাসায়? এখন তো তোমার অনেক বেশি কেয়ারের প্রয়োজন। আরও দু’জন মহিলা নিয়োগ করব শুধুমাত্র তোমার দেখভাল করার জন্যে।
কথার মাঝে আজহার এসে বললেন, আজরা যাবে না।
হঠাৎ এমন কথা শুনে দাঁড়িয়ে পড়লেন ইলহাম শেখ। ভাবলেন তিনি মজা করছেন। তিনিও বললেন, হুম আজরা মা একা যাবে না। সাথে তার অনাগত সন্তানও আছে।
-যে সন্তান পৃথিবীর আলো কখনো দেখবে না।
এইবার অনেকটা অবাক হয়ে ইলহাম শেখ বললেন, কীসব বলছেন?
-ঠিকই বলছি। আজই ডাক্তারের কাছে গিয়ে সেই ব্যবস্থা করব।
ইলহাম শেখ গম্ভীরমুখে বললেন, আমার ছেলের বউ এর সাথে আপনি এমনটা করবেন কেন?
-সে আপনার ছেলের বউ নয়।
-মানে?
-আপনার ছেলেকেই জিজ্ঞাসা করুন না! আপনার ছেলে তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এর আগেই সে আরেকটি বিয়ে করে।
এই কথা শুনে পা এর নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল ইলহাম শেখের।
তবে তিনি কথার পিঠে কোনো কথা বললেন না। ইনতিসারকে ফোন করে বাসায় আসতে বললেন। এবং তিনিও বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
.
.
.
মা-বাবার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ইনতিসার। অফিস থেকে বাবার ফোন পেয়ে চলে এসেছে সে। কিন্তু তারা যে সবটা জেনে গেছে এই বিষয়ে সে জানেনা।
ইলহাম শেখ ইনতিসারের কাছে সত্যিটা জানতে চাইলে সে মাথা নিচু করে বলল-
এটা সত্যি।
ইলারা জামান বিস্ময়ভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, কীসব বলছিস?
-আমি কী করব মা? যাকে ভালোবাসতাম তাকে নিজের করে নিয়েছি। আর কত নিজেকে দমিয়ে রাখব বলতে পারো?
ইলারা জামান কিছু না বলেই ইনতিসারের গালে কষে একটা চড় মারলেন। ইলহাম শেখ বললেন, কার জন্য? কার জন্য আমার এত ভালো বউ মা টা কে তুই কষ্ট দিলি?
ইনতিসার কোনো জবাব দিলো না। এইবার প্রায় চ্যাচিয়ে একই কথা বললে ইনতিসার বলল, প্লিজ তোমরা শান্ত হও! আমার কথাটা শোনো?
-কোনো কথা শুনব না। আজরাকে তুই নিয়ে আসবি। আমার নাতি বা নাতনিকে নিয়ে আসবি। এছাড়া আমি বুঝিনা কিছু।
-আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে বাবা!
-আরে তুই ওকে ফিরিয়ে না আনলে ওর সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেবে না আজরার বাবা।
ইনতিসার একটু থেমে বলল, এটাই মনেহয় আমাদের সকলের জন্য ভালো। তারা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ইনতিসারের কথা শুনে তারা অবাক চোখে তাকালো ওর দিকে। ইনতিসার আরও বলল, ডিভোর্স এর পর সেই বাচ্চার কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নেই। তাই আমিও তাদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছি।
ইলারা জামান কর্কশ কণ্ঠে বললেন, তুই কী মানুষ? নিজের বাচ্চাকে…
আর কিছু বলার আগেই ইলহাম শেখকে মেঝেতে পড়ে যেতে দেখলো তারা। ইনতিসার দ্রুত ছুটে এলো তার কাছে।
ইলারা জামান কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বোকার মতো নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ড্রাইভার কে ফোন করে গাড়ি বের করতে বললো ইনতিসার। দারোয়ানের সহায়তায় তাকে গাড়িতে তোলা হয়। এরপর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো তারা।
হাসপাতালে পৌঁছালে ডাক্তার তাকে দেখে মৃত ঘোষণা করেন। যা শুনে ইলারা জামান জ্ঞান হারান। ইনতিসার তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলল, এ কী হয়ে গেল! এ কী করে ফেললাম আমি!
.
.
.
তাসফিয়া কারও সাথে ফোনে কথা বলছে। সাজিরকে দেখে ফোন তাড়াহুড়ো করে রেখে দিলো সে। তাসফিয়া বলল, এই সময়ে আপনি?
-একটা জরুরী কাগজ রেখে গেছি। এটা নিতে আসলাম।
-ওহ!
ড্রয়ার খুলে কাগজ নিতে নিতে সাজির বলল, ইদানীং কারো সাথে ফোনে কথা বলছ। খেয়াল করলাম!
আমতাআমতা করে তাসফিয়া বলল, কোনো সমস্যা?
-নাহ।
সাজির এক কদম পা ফেলে থেমে যায়। পেছনে ফিরে বলল, তুমি চাইলে ছেড়ে দিতে পারো আমায়। আমার তরফ থেকে কোনো অসুবিধা নেই।
এই বলে সাজির চলে যায়। তাসফিয়া আনমনে বলল, অসুবিধা নেই বলেই আমার অসুবিধা। এভাবে কী থাকা যায়! তার চেয়ে বরং বিচ্ছেদই শ্রেয়!
.
চলবে#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫০
#Saji_Afroz
ইলহাম শেখের মৃত্যু হয়েছে বেশকিছুদিন হলো। সেই থেকে আজরা এই বাড়িতে রয়েছে। শুধুমাত্র ইলারা জামানের জন্যে সে এখানে থাকে। নাবীহাও এখানে আছে। কিন্তু ইলারা জামান এখনো জানেনই না যে, তার সংসারের সর্বনাশের কারণ এই নাবীহা!
ইলারা জামানের জন্য তার পছন্দের রাতের খাবার তৈরী করছে আজরা। নাবীহা রান্না ঘরে এসে তাকে দেখে বলল, কী করছিস?
এই বাড়িতে থাকাকালীন কেউ কারো সঙ্গে এতদিন কথা বলেনি। আজ নাবীহাই প্রথম কথা বলল। আজরা মরিচ কাটতে কাটতে বলল, মা এর জন্য রান্না করছি।
-উনার সবচেয়ে পছন্দের খাবার কী?
-গরুর মাংস।
-জেনে নিলাম। ভবিষ্যতে এসব তো আমাকে করতে হবে। তাই!
সে কথার পিঠে কোনো কথা না বলে আজরা নিজের কাজ করতে থাকলো। নাবীহা বলল-
খুব তো মানতাশাকে বলতি, নিজের কিছু সহজে ছাড়তে নেই। পর নারীতে আসক্ত হলেও নিজের প্রতি ফিরাতে চেষ্টা করবি স্বামীকে। তবে এখন এত সহজেই হার মেনে নিলি কেন?
কিছু না ভেবেই আজরা বলল, যেটা আমার ছিল না সেটার জন্য কী লড়াই করব বলতে পারিস? আর মানতাশার সঙ্গে তার আপন কেউ বিশ্বাস ঘাতকতা করেনি। আমার সঙ্গে করেছে। আমার প্রিয় বান্ধবী! আচ্ছা, কেন করলি তুই এমনটা?
দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে নাবীহা বলল-
যখন কেউ নিজে সুখে থাকে না, তখন অন্যের সুখ কিভাবে সহ্য করবে? তাও এমন কারো! যে কি না দুমুখো আচরণ করে বেড়ায়।
আজরা ভ্রু কুচকে বলল, দুমুখো আচরণ?
-অবাক হচ্ছিস কেন? আমার সঙ্গে দুমুখো আচরণ তুই করিসনি?
আজরা কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি তার বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে। ছুটে আসে সে ড্রয়িংরুমে। আজহার শেখ তাকে দেখেই বললেন, অনেকদিন হলো। এইবার চল।
আজরা শান্তস্বরে বলল, বাবা আর ক’টা দিন থাকি?
-নাহ। বরং এখান থেকে সোজা হাসপাতালে যাব আমরা৷ সব ব্যবস্থা করে এসেছি।
আজরা কী বলবে ভেবে পায় না। কারণ সে চায়না এই বাচ্চাটিকে হারাতে। গর্ভে থাকা ছোট্ট প্রাণ টিকেই সবচেয়ে বেশি আপন মনে হয় তার কাছে। হতে পারে ওর বাবা তাকে ঠকিয়েছে। কিন্তু নিষ্পাপ প্রাণটির কী দোষ! সে কেন পৃথিবীর আলো দেখবে না!
-কী হলো? চল।
আজরা কিছু বলার আগে সেখানে উপস্থিত হোন ইলারা জামান। তিনি বললেন, আজরা মা কোথাও যাবে না।
আজহার শেখ বললেন, কোন পরিচয়ে সে এখানে থাকবে বলতে পারেন?
-এভাবে ডিভোর্স হয় নাকি! আজরার হয়ে আমি লড়ব। কেইস করব ইনতিসারের নামে। আবার সবটা ঠিক হয়ে যাবে ভাই সাহেব।
পেছনে নাবীহাকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আজহার শেখ বললেন-
এই মেয়েটিকে এখানে রেখে দিয়েছেন। আবার বলছেন সব ঠিক হবে। বিষয়টা হাস্যকর হয়ে গেল না?
তিনি অবাক হয়ে বললেন, নাবীহার সঙ্গে এসবের কী সম্পর্ক?
-আপনি কিছু জানেন না?
-কী?
-আরে এই নাবীহাই তো ইনতিসারের নতুন স্ত্রী।
একথা শুনে তার দিকে বিস্ময়কর চোখে তাকালেন ইলারা জামান। তিনি বললেন, এই মেয়ের জন্য কিনা করেছে আজরা! শেষমেশ সেই ওকে ঠকালো!
নাবীহা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। ইলারা জামান এসে তাকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, এখুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে তুমি। যদি জেলের ভাত খেতে না চাও তবে ভালোই ভালোই চলে যাও!
এই বলে তিনি নাবীহার হাত ধরে তাকে টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে আসে। তখনি নাবীহার অন্য হাত ধরে তাকে আটকায় ইনতিসার। সে বলল, বাবাকে হারিয়েছি। আর কাউকে আমি হারাতে চাইনা মা।
তিনি ছলছল নয়নে তাকিয়ে বললেন, মানে?
-আমি নাবীহাকে ছাড়া ভালো থাকব না। ওকে হারাতে চাই না।
-আর আমাকে?
-তুমি প্লিজ আমাকে বোঝো! আমার ফিলিংসটা বোঝার চেষ্টা করো!
-বাবা হতে চলেছিস। এই নিয়ে কোনো ফিলিংস নেই তোর মধ্যে?
-আছে বলেই আজরার বাবার সাথে সহমত পোষণ করেছিলাম। তুমিই বলো? আজরা কী সেই বাচ্চা আমাকে দেবে? দেবে না! বাবা ছাড়া একটা সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তার চেয়ে বরং আজরার বাবা যেটা ভালো করছেন করুক!
এইবার ইনতিসারে গালে কষে থাপ্পড় মারলেন ইলারা জামান। কর্কশ কণ্ঠে বললেন, এই কথার জন্য বাবাকে হারিয়েছিস। আমার দিকটাও একটু ভাববি না?
ইনতিসার বলল, তুমি ভেবেছ আমার দিক? আর ভাববেও কেন! নিজের মা হলে অবশ্যই ভাবতে৷ ওভাবে নিজের পছন্দে বিয়ে করতে বলতে না।
একথা শুনে থমকে গেলেন ইলারা জামান। আজ ইনতিসার এতবড়ো কথাও বলে ফেললো!
এদিকে আজহার শেখ মৃদু হেসে বললেন, আপনাকে সে মা বলেই মানেনা। আর আপনার ভরসায় আমি মেয়ে রেখে যাব! প্রশ্নই আসেনা। আমার কাজ আমি করতে যাচ্ছি।
এই বলে আজরাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। নাবীহাকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় ইনতিসার। ইলারা জামান মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়লেন।
এটা সত্যি যে ইনতিসার তার নিজের সন্তান নয়! তার চেয়েও বড়ো সত্যি হলো, তিনি এমনটা কখনো ভাবেননি।
ইলহাম শেখের প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর ইলারা জামানকে বিয়ে করেন তিনি। ইলারা জামানেরও আগে বিয়ে হয়েছিল৷ তার স্বামীও ক্যান্সারে মারা যান। পরবর্তীতে পরিবারের কথাতে ইলহাম শেখকে বিয়ে করেন। ইলহাম শেখের ছেলে ইনতিসার। তার জন্মের সময়ই মা মারা যায়। কিন্তু ইলারা জামান কখনোই তাকে মা এর অভাব বুঝতে দেয়নি। আজ সে কী না এতবড়ো একটা কথা বলল! বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে ইলারা জামানের। এতদিন কার জন্য কী করেলন তিনি!
.
.
.
আজ হাসপাতালে আজরার সঙ্গে দেখা হয় সাজিরের। বাবার সাথে ঝগড়া করে সে বাড়িতে চলে যেতে চায়। তখনি সাজিরের সাথে দেখা হয়। কী হয়েছে জানতে চাইলে সে কিছু না বললেও আজহার শেখ সব খুলে বলেন। সবটা শুনে সাজির অনেক বেশি অবাক হয়। এই নাবীহা কী সেই নাবীহা! যাকে সে ভালোবাসতো!
নাবীহার এমন রূপ সম্পর্কেও জানবে, কখনো ভাবেনি সে। তার সাথে অন্যায় হয়েছে। তাই বলে কী অন্যের সংসার ভাঙবে সে? তাও নিজের প্রিয় বান্ধবীর!
বাইরে চ্যাঁচামেচির শব্দ শুনে বেরুলো সাজির। সাজেদা বেগম বলছেন-
নষ্টা একটা মেয়েকে ছেলের বউ বানিয়ে বিপদে পড়লাম।
তাসফিয়া বলল-
মুখ সামলে কথা বলুন!
-সারাদিন নষ্টামি করে অন্য ছেলের সাথে ফোনে ফুসুর ফুসুর করো। আর আমরা বললেই দোষ?
-না করে কী করব? আপনার ছেলে করে না তাই বাইরে সুখ খুঁজে বেড়াই।
সাজিরকে দেখে তিনি বললেন, ছি ছি! মুখ কেমন খারাপ দেখ এই মেয়ের। কীসব বলছে!
সাজির তাসফিয়াকে নিয়ে রুমে চলে আসে। সে বলল, তোমার এসবের কী প্রয়োজন? চলে যেতে হলে চলে যাও! অহেতুক ঝামেলা করো না।
-যাবই তো! আমারও এমন কারো সঙ্গে থাকার ইচ্ছে নেই। শুধুমাত্র বাবার কথাতে বিয়েটা করেছিলাম। কই সুখী হলাম!
এই বলে কাঁদতে শুরু করলো তাসফিয়া। সাজির দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার পাশে বসে বলল, তোমার বাবা আমায় একটা অফার দিয়েছিল। যা আমি গ্রহণ করিনি।
-দেশের বাইরের যাওয়ার?
-হু। ভাবছি গ্রহণ করব। তোমাকে নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাব।
তাসফিয়া অবাক চোখে সাজিরের দিকে তাকালো। সাজির বলল, পথ চলতে চাও আমার সঙ্গে?
তাসফিয়া হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নেড়ে বলল, বাকি সব ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।
-তবে তাই হোক!
বৈবাহিক সম্পর্কটাকে গুরুত্ব দিতে চায় সাজির। যার জন্য নারাজ ছিল সে, সেইতো অন্যের সংসার নষ্ট করে দিব্যি ভালো আছে! যদিও এর পেছনে সাজিরও দায়ী কম নয়। হতে পারে হতাশায় ভুগে তার মতো তাসফিয়াও এমন বিগড়ে গেল! এমনটা চায় না সাজির। তার চেয়ে বরং নিজের পরিবার থেকেই আলাদা হয়ে যাবে সে। এখানে থাকলে যে নাবীহাকে না পাওয়ার যন্ত্রণাটা বারবার তাড়া দেবে তাকে!
.
.
.
-তোমাদের কথা শুনে বিয়ে করেছিলাম। তাই এখানে আমার কোনো দোষ তোমরা দিতে পারবে না। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র আমার হবে যে আমি বাচ্চাটা রাখব কী রাখব না!
আজরার কথা শুনে আজহার শেখ বললেন, অমানুষের বাচ্চাটাকে কেন তুই জন্ম দিবি?
-কারণ সে আমারও সন্তান। এই নিয়ে তোমাদের যদি কোনো আপত্তি থাকে তবে বলতে পারো! আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
আজহার শেখ আর কিছু বললেন না। আজরা ভেতরে এসে নিজের পেটের উপরে হাত রেখে বলল, আমি তোর কিছু হতে দেব না! কিছু না!
এদিকে আজিজা বানুর কাছে সবটা শুনে আজরার জন্য ভালোবাসা আরও বেড়ে গেল ইলারা জামানের। তিনি ভেবেছিলেন নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আজরা বাবার সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। কিন্তু সে এমনটি করেনি!
ইনতিসারকে এত ভালোবাসা দিয়েও মানুষের মতো মানুষ করতে পারলেন না। অন্যদিকে আজরা! তাকে যত দেখে তত অবাক হচ্ছেন ইলারা জামান।
শুনেছেন ভালো দের জীবনে পরীক্ষা বেশি দিতে হয়। আজরার পরীক্ষার সমাপ্তি হবে। আর এই কাজ করবেন ইলারা জামান নিজেই!
আজরা, ইনতিসার ও নাবীহা এদের তিন জনের জীবনের নতুন মোড় আসবে তার হাত ধরেই। এই সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। সামনে যা হবে তার জন্য কেউই প্রস্তুত নয়!
.
চলবে
#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৫১
#Saji_Afroz
ইলারা জামান বারান্দায় বসে আছেন। আজ স্বামীর কথা বড্ড মনে পড়ছে তার। এত তাড়াতাড়ি তাকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবেননি কখনো। পৃথিবীতে তার আপন বলতে কে আছে এখন! একটা সন্তান। ইনতিসার। কিন্তু সেও তাকে পর করে দিলো একটা অবৈধ সম্পর্ক এর জন্যে।
ইলারা জামান জানতেন, তিনি কখনো মা হতে পারবেন না।এটা জেনেও ইলহাম শেখ তাকে বিয়ে করেন। আর কোনো সন্তান হবে না বলে নিজের সবটা উজাড় করে ইনতিসারকে ভালোবেসেছিলেন তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে উপলব্ধি করেছিলেন, যদি তার সন্তান হত তবুও ইনতিসারের স্থানটা থাকতো আলাদা। কারণ সে তার প্রথম সন্তান!
অথচ হায়! এভাবে করে ইনতিসার কখনো ভাবেনি। ভাবলে অতি সহজে এমন একটা কথা সে বলে ফেলতে পারতো না।
এসব ভেবে ইলারা জামানের চোখ ছলছলে হয়ে উঠে।
নাবীহা আসলো তার কাছে চা নিয়ে। ট্রে হাতে নাবীহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও কোনো কথা তিনি বললেন না। নাবীহাই বলল, চা এনেছি আপনার জন্য।
গম্ভীরমুখে তিনি বললেন, নিয়ে যাও।
-আপনি এই সময়ে চা খান।
-অবশ্যই। কিন্তু সেটা তোমার হাতের চাই না। কোনো বুয়াকে দিয়ে পাঠাও।
বেশ কয়েক দিন একই বাড়িতে একই ছাদের নিচে থাকার পরেও ইলারা জামানের মন জয় করতে পারছে না নাবীহা। ইলারা জামানের পছন্দের খাবার রান্না করেছে, তার জন্য পছন্দের রঙের শাড়ি এনেছে, তাকে তাদের সঙ্গে ঘুরতে যেতে বলেছে আরও কত কী! কিন্তু ইলারা জামান নাবীহার সবকিছুই প্রত্যাখান করেছেন। ইলারা জামানকে শ্রদ্ধা করে নাবীহা। অসময়ে স্বামী হারিয়েছে বলে ইলারা জামানের জন্য তার মনও কাঁদে। একসঙ্গেই বাকিটা পথ চলতে হবে। তবে কেন তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে! এই ভেবেই তাকে সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল নাবীহা। কিন্তু তার প্রতি ইলারা জামানের এরূপ আচরণ দেখে হতাশ সে। আজ বাধ্য হয়ে বলেই বসলো, বুয়ার হাতে খাবেন তবুও আমার হাতে নয়!
-হু। কেন জানো? তোমার হাতে কিছু খেলে মনে হবে আমি বিষ খাচ্ছি! এতটাই জঘন্য লাগে তোমাকে আমার।
একথা শুনে কান্না আঁটকে রাখতে পারলো না নাবীহা। চা এর ট্রে টা রেখে ছুটে চলে যায় সে। পথিমধ্যে ধাক্কা লাগে তার ইনতিসারের সঙ্গে। তাকে এভাবে দেখে ইনতিসার বিচলিত হয়ে জানতে চাইলো, কী হলো তোমার?
কান্নাজড়িত কণ্ঠে নাবীহা তাকে সব জানায়। ইনতিসার বারান্দায় এসে মা কে বলল, নাবীহার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে তুমি ভালো থাকবে ভেবেছ?
ইলারা জামান দাঁড়িয়ে বললেন, আচ্ছা তাই! তা কী খারাপ থাকব আমি?
-দেখো মা! বাবার অবর্তমানে তোমার সব দায়িত্ব আমার। তাই এমন কিছু করো না যাতে করে আমি সেই দায়িত্ব টুকুও পালন না করতে পারি!
আজকের আচরণের জন্য অবাক হলেন না ইলারা জামান। বরং তিনি কোনো কথাই বললেন না। মৃদু হেসে আবারও বসে পড়লেন চেয়ারে।
ইনতিসার তাকে এভাবে নিশ্চুপ দেখে বেরিয়ে পড়ে৷ নাবীহা এসে বলল, আপনাকে আমি বলেছি উনাকে কিছু বলতে! আমার খারাপ লাগাটা শেয়ার করাটাও কী ভুল?
-আমি তোমার জন্যই…
-ওহ প্লিজ! সম্পর্ক গুলোকে আর বেশি জটিল করবেন না।
এই বলে নাবীহা রুমে আসলো৷ ইলারা জামান যাতে সন্দেহ না করেন তাই তাদের একই রুমে থাকতে হচ্ছে। যদিও ইনতিসার সোফায় থাকে। তবুও এসব নাবীহার ভালো লাগছে না। মাঝেমধ্যে মনেহয় সে অনেক বেশি খারাপ কাজ করছে। আবার মাঝেমধ্যে মনেহয় মোটেও এমনটা না! তার সাথে যখন ভালো কিছু হয়না সে কেন অন্যের ভালোটা দেখবে! তাই যেটা যেমন চলছে চলুক।
এখন শুধু ইলারা জামানের অপেক্ষা। তিনি একবার নরম হলেই বিয়েটা সেরে নেবে। একেবারে সবটা পাকাপোক্ত করে তবেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা সারতে চায় নাবীহা।
.
.
.
ইদানীং পড়ন্ত বিকেলে ছাদে এসে সময় কাটায় আজরা। এই সময়টা ভালোই উপভোগ করে সে। তার কাছে মনেহয় দিনের এই শেষ অংশটা খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কিন্তু গোধূলি মাখা এই সময়টাই যে তার বেশ ভালো লাগে!
আজও ছাদে বসে গাঢ় কমলা রঙের অস্তায়মান সূর্যটা দেখছে আজরা। সূর্যের তাপ কমে গেছে বিধায়
চোখে বিন্দু মাত্র আঁচ লাগছে না ওর। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে এর সৌন্দর্য অবলোকন করলো আজরা৷ এরপর চোখ ঘুরিয়ে মনযোগ দিলো এক ঝাক ঘরে ফেরায় ব্যাস্ত পাখিদের দিকে । যারা উড়ে চলেছে নিজ গন্তব্যে ! পাখিদের জীবনের নিয়মটা কত সুন্দর! ভোর হতেই জেগে উঠে, খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে, এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে এরপর নিজ গন্তব্যে ফিরে যায়।
আজরাও জীবনও এমন গোছালো ছিল। অথচ এখন! সামনে কী হতে চলেছে এ নিয়ে সে হতাশায়। জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন মুহুর্তটা সে পার করছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ অন্ধকার জেনে সারাক্ষণ মনমরা থাকতে হয় তাকে৷
কেন ইনতিসার এমনটা করলো! নাবীহার মাঝে কী রয়েছে যা আজরার মধ্যে নেই! বরং আজরা তার সবটা দিয়েই ভালোবেসেছিল তাকে। এরপরেও ইনতিসারের মন নাবীহাতেই আঁটকে ছিল! আজরা এটা কখনো বুঝতে পারেনি। পারলেও কী এই সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচাতে পারতো নিজেকে!
হঠাৎ আজরার খারাপ লাগে। প্রচুর বমি হয় তার। বমি অবস্থা কাহিল হওয়ায় ছাদের মেঝেতেই বসে পড়লো সে। আজিজা বানু এসে তার এমন অবস্থা দেখে বললেন, ঠিক আছিস?
হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়ে আজরা। আজিজা বানু বললেন, তোর বাবার কথা শুনলেই পারতি! এই পথ একা চলবি কিভাবে?
-তোমরা আছ না?
-তাও!
-তুমিও তো একজন মা। তবুও এটা বলো কিভাবে?
এই প্রসঙ্গে কথা বলে লাভ নেই জেনে আর কথা বাড়ালেন না তিনি। শুধু বললেন, নিচে চল। আচার খেলে ভালো লাগবে।
.
.
.
-দেখো তো খালামনি? রুমের সবকিছু ঠিক আছে কিনা?
সাদের কথা শুনে ইলারা জামান বললেন, একদম পারফেক্ট। তুই বাচ্চাদের এতসব কিছু চিনিস কিভাবে?
-ইউটিউব দেখে! তোমাকে বললাম কী আনব। নিজের জন্য কিছু চাওনি। চেয়েছ নাতি বা নাতনির জন্য। তাই সামান্য কিছু নিয়ে এলাম।
-সামান্য কিছু! আমার তো মনে হচ্ছে পুরো একটা দোকান নিয়ে এসেছিস!
-কী যে বলো না।
সাদ আবারও রুম গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ইলারা জামানের বোনের ছেলে সাদ। ইনতিসারের পিঠাপিঠি তার বয়স। ইনতিসারের বিয়ের সময় সে দুবাই ছিল। এরপর অন্যদেশে। ভ্রমণ করা ওর পেশা।
দেশে এসেছে কিছু দিন হলো। ইলারা জামানকে আজ দেখতে আসার কথা জানায়। সাথে কী আনবে জিজ্ঞাসা করে। তিনি বাচ্চার রুম সাজানোর জন্য কিছু জিনিস আনতে বলেন। আর সাদ কিনা কতকিছু নিয়ে হাজির হলো! শুধু তাই নয়। সে নিজে পুরো রুমটা সাজিয়ে দেয় সেসব জিনিস দিয়ে।
সন্ধ্যা হতেই অফিস থেকে বাসায় আসে নাবীহা ও ইনতিসার। সাদের সঙ্গে নাবীহাকে পরিচয় করিয়ে দেয় ইনতিসার। সাদ বলল, ভাবীর এই সময়ে অফিসে যাওয়ার কী প্রয়োজন? রেস্ট নেবে সারাক্ষণ।
দু’জনেই অবাক হয় তার কথা শুনে। ইনতিসার বলল, কোন সময়?
-বারেহ! ভাবী না প্রেগন্যান্ট?
-তোকে কে বলল?
-খালামনি। আমি ভাবীর জন্য অনেক উপহার এনেছি। পুরো রুমটা সাজিয়েছি তার।
নাবীহা রুম দেখতে চাইলে সেখানে তাকে নিয়ে যায় সাদ। সে এসব দেখে দাঁতে দাঁত চেপে ইনতিসারকে বলল-
এসবের মানে কী? আমি তো প্রেগন্যান্ট নই! তবে কী আপনার মা আজরাকে ফিরিয়ে আনবে?
তার কথার মানে বুঝতে না পেরে সাদ বলল, বুঝলাম না? আজরা কে?
ইলারা জামান এসে বললেন, আজরা হলো ইনতিসারের প্রথম স্ত্রী। যাকে ঠকিয়ে নাবীহাকে বিয়ে করে সে। আর আজরাই প্রেগন্যান্ট।
সাদ অবাক হয়ে বলল, কীসব বলছ?
-হ্যাঁ। শুধু ইনতিসার নয়। নাবীহাও তাকে ঠকায়। ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল নাবীহা।
ইনতিসার গম্ভীরমুখে বলল-
সেসব পুরাতন কথা কেন তুলছ? তাছাড়া এই রুমটাও বা কেন সাজালে তুমি?
নাবীহা বলল, বুঝতে পারছেন না কেন? আজরাকে আনবে বলে।
ইলারা জামান শান্তস্বরে বললেন, তাই করব!
ইলারা জামানের প্রতি নাবীহার যা সহমর্মিতা ছিল সবই নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল এসব দেখে। বরং তার প্রচন্ড রাগ হলো। সে বলে বসলো, এই বাসায় কে আসবে না আসবে আপনি ঠিক করার কে? কী অধিকার আপনার! এসব ঠিক করবে ইনতিসার।
তিনি হেসে বললেন, তাই! ও ঠিক করবে?
-অবশ্যই! বাবার মৃত্যুর পর সবকিছু তো তারই। তাইনা?
তিনি হেসে ইনতিসারের দিকে তাকালেন। সে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ইনতিসারকে এভাবে দেখে নাবীহা বলল, কিছু বলছেন না কেন? আজরার সঙ্গে একসাথে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ইলারা জামান বললেন, তবে চলে যাও! তুমি আর ইনতিসার দু’জনেই চলে যেতে পারো।
-আপনার কথাতে সব হবে?
-হ্যাঁ হবে!
নাবীহা ইনতিসারের দিকে তাকালে সে বলল, ওই আজরার জন্য নিজের ছেলের সঙ্গে এমন করছ?
-কে নিজের ছেলে! তুই আমার ছেলে না। চলে যেতে পারিস তোরা এই বাড়ি ছেড়ে।
তার কথা শুনে নাবীহা বলল, আমরা যাব না। যাবেন আপনি। বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিলে মজা বুঝবেন।
সাদ বলল,এসব কী ইনতিসার ভাই? তোমার সামনে খালামনির সাথে কিভাবে কথা বলছেন উনি?
ইনতিসার নাবীহার হাত ধরে তাকে অন্যরুমে নিয়ে যায়। নাবীহা বলল, আপনি কিছু বলছেন না কেন? এই বাড়ি যেমন তার স্বামীর তেমন আপনার বাবার। বরং আপনার অধিকার বেশি।
ইনতিসার বলল, আমি দেখছি বিষয়টা।
এই বলে সে মা এর কাছে আসলো। ইনতিসার বলল, তুমি কী চাও?
-এখনো বুঝতে পারছিস না?
-নাহ!
-আমি চাই তুই নাবীহাকে ছেড়ে দিবি। নতুবা এই বাড়ি!
-এসব করলে আজরা কী আমায় মেনে নেবে?
-সেটা আমি চাইও না।
-তবে?
– পরবর্তীতে কী হবে আমি জানিনা। কিন্তু আমি চাইনা না নাবীহার সঙ্গে তুই থাকিস। আর যদি থাকিস..
-কী?
-এই বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। আর এটাই আমার শেষ কথা। তুই তোর সিদ্ধান্ত আমার জানিয়ে দিস।
ইনতিসার নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। প্রয়োজনে সব ত্যাগ করতে প্রস্তুত সে। কিন্তু নাবীহা! সেও কী তার সঙ্গে এভাবে পথ চলতে রাজি হবে!
এদিকে সাদ ইলারা জামানকে বলল, এটা কিভাবে সম্ভব হলো খালামনি? না মানে ইনতিসার ভাই কোনো কথাই বলল না!
মুচকি হেসে তিনি বললেন-
এসব সব আমার আগের স্বামীর। যখন ক্যান্সার ধরা পড়ে তার তখনি সব আমার নামে করে দেন তিনি। কারণ তার মা বাবার আচরণ আমার প্রতি ভালো ছিল না। উনাদের সম্পদ কম ছিল না! সেইজন্য তিনি আমার চিন্তাই করেছেন। এদিকে ইনতিসারের বাবা একজন শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে আমার ব্যবসা সামলান। যদিও এসব বড়ো হওয়ার পেছনে তার অবদান আছে। কিন্তু সবই আমার নামে আছে এখনো। ভেবেছিলাম সব ইনতিসারের হবে। কিন্তু ইনতিসার কী করলো! ওর কর্মের ফল ওকে ভোগ করতে হবে। আর সেটা আমিই করাব।
-আপনি এত ভালোবাসেন আজরাকে?
-ও সেটার প্রাপ্য। তাছাড়া আমার কোনো শশুর শাশুরীর আচরণ আমার প্রতি ভালো ছিল না। তাই আমি সবসময় ভাবতাম, পুত্রবধূকে নিজের মেয়ের মতন দেখব। আর আজরা আমার মেয়ের মতোই চলেছে। এতকিছুর পরেও বাচ্চাটিকে পৃথিবীতে আনবে বলেছে। আর সেইজন্য পুরষ্কার সরূপ আমার সবকিছু হবে আজরার!
আজরা সম্পর্কে সব শুনে তার ছবি দেখতে চাইলো সাদ। আজরার ছবি দেখে আপনমনে বলল সে-
কী মায়াবী মেয়েটা! আর কত ভালোও। এমন কাউকে কিভাবে ভালো না বেসে থাকলো ইনতিসার ভাই!
.
চলবে