#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৩৪
#Saji_Afroz
ছয় মাস পার হয়ে যায়। এই ক’টা দিনেই ওদের জীবনযাত্রা বদলে যায়। এই তো নাবীহা! আগের চেয়ে অনেকটা ভালো আছে সে। ইনতিসারের অফিসে অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করে। আর হিসাবের কাজটা ভালোই সামলে নিচ্ছে সে। তার কাজে শুধু ইনতিসার নয়, বাকি কর্মচারীরাও বেশ মুগ্ধ।
অফিস শেষে বাড়িতে ফেরার জন্য বের হয়েই গাড়ি ঠিক করতে যায় নাবীহা। প্রতিবারের মতন তাকে ইনতিসার থামিয়ে বলল, উহু নাবীহা! একই কাজ প্রতিদিন কেন করো বলো তো? বলেছি আমিই ড্রপ করে দেব তোমাকে।
নাবীহা মুচকি হেসে বলল, তাই বলে প্রতিদিন?
-আন্টিকে কথা দিয়েছিলাম তোমাকে কষ্ট পেতে দেব না। গাড়ি ঠিক করাটাও একটা কষ্টের কাজ।
-আর আপনি যে প্রতিদিন আমাকে নামিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে পেইন নিচ্ছেন?
-একই পথেই তো। কোনো কষ্ট না। আসো তো তুমি।
প্রতিবারের মতো আজও নাবীহা ইনতিসারের গাড়িতে উঠে বসলো।
তাকে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয় ইনতিসার।
.
.
-ভালো ডাক্তার দেখিয়েছেন বুঝলাম। দেশের বাইরে গিয়েও তো চিকিৎসা করা যায়?
প্রতিবেশী আনিলা শেখের কথা শুনে ইলারা জামান বললেন-
যেসব ডাক্তার দেখাচ্ছি তারা দেশের বাইরে গিয়েও চিকিৎসা করিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের বেস্ট ডাক্তারই দেখিয়েছি আমরা। আজরা বা ইনতিসারের কোনো সমস্যাই তারা পেল না তারা। বলল সময় নিতে। এমনটা অনেকের হয়ে থাকে। চেষ্টা চালিয়ে যেতে, এক সময় সফল হবে।
-আর যদি না হয়?
ইলারা জামান ভ্রু কুচকে তাকালেন তার দিকে। তিনি বললেন, এমনেই জিজ্ঞাসা করলাম! একমাত্র ছেলে আপনার। চিন্তা হয় না?
-আল্লাহ এর উপরে সম্পূর্ণ ভরসা আছে আমার। তিনি আমাদের নিরাশ করবেন না। ওদের বিয়ে হয়েছেই বা কতদিন হচ্ছে!
আড়াল থেকে এসব শুনে হতাশ হয় আজরা। এখন থেকেই লোকজন এসব বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছে। তাদের থেকেও বাচ্চা নিয়ে যেন অন্যদের চিন্তা বেশি! ইনতিসার কেও কী এসব নিয়ে লোকে কথা শোনায়?
.
.
.
সকালে নাস্তা করতে বসেছে আরশান, মালিহা ও আশফাকুল। আরশানের পাশে মানতাশাকে না দেখে মালিহা বললেন, মানতাশা কোথায়?
-উঠেনি এখনো।
হালকা কেশে তিনি বললেন, এখনো কী সে নতুন বউ? বেলা বারোটার পর ঘুম ভাঙে তার।
-কী বলছ?
-হু। তার কী কোনো দায়িত্ব নেই? আমাকেই দেখো! তোমার ভাই অফিসে যাবে বলে প্রতিদিনই আমি তাড়াতাড়ি উঠে যাই। এবং সেটা বিয়ের প্রথম দিন থেকেই। ঘরের কাজ আমি করতে বলছি না। নিজের স্বামীর দেখভাল কী করতে হবে না?
আরশান মাথা নিচু করে রইলো।
মালিহা আরও বললেন-
ওকে আমি স্বাধীনতা দিয়েছিলাম। কিন্তু ও কী করলো? অপব্যবহার করেছে সেই স্বাধীনতার। ইচ্ছে মতো টাকা উড়িয়েছে। বাইরে ঘুরাঘুরি, শপিং, পার্টি করা, রাতে দেরী করে বাসায় ফেরা, টাকা উড়ানো ছাড়া কিইবা করলো সে?
আশফাকুল বললেন, আহ থামো মালিহা!
-থেমেই ছিলাম তোমার কথা শুনে। এতটা মাস চুপ ছিলাম। কিন্তু লাভ কী হলো? আমি যেটা ভয় পেয়েছিলাম সেটাই হলো। আর কত বেহায়াপনা সহ্য করব বলো তো?
আরশান দাঁড়িয়ে পড়লো। আশফাকুল বললেন, উঠে পড়লি কেন? নাস্তা সেরে নে।
-অফিসে করে নেব।
এই বলে আরশান নিজের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। মালিহার উদ্দেশ্যে আশফাকুল বললেন, এসব না করলে হত না?
-তোমার কথা শুনে এতদিন চুপ ছিলাম। নাহয় আগেই সোজা করে ফেলতাম ওই মেয়েকে। অভিজ্ঞতা কম হয়নি জীবনে। মানুষ দেখলেই বুঝি কে কেমন। ওকে দেখেই মনে হয়েছিল লোভী একটা মেয়ে।
আশফাকুল দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে খাওয়াতে মনোযোগ দিলেন।
এদিকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মানতাশা। হঠাৎ কারো হ্যাচকা টানে শোয়া থেকে উঠে বসতে হলো তাকে। চোখ খোলার আগেই ডান গালে কেউ সজোরে চড় মেরেছে। ব্যথায় শব্দ করে উঠে চোখ জোড়া খুলে আরশানকে দেখতে পায় মানতাশা। অবাক হয়ে সে আরশানের দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন বোবা হয়ে গেছে!
আরশান বলল-
আজরার কাছ থেকে শুনে তোমার হানিমুনে মালয়েশিয়া যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। সেই ইচ্ছেও আমি পূরণ করলাম। ইনতিসারদের সাথে মালয়েশিয়া ঘুরে আসলাম। যখন যা মনে চায় করতে দিয়েছি তোমাকে। হাত ভর্তি টাকা দিয়েছি। কোথায় কী খরচা করছ জিজ্ঞাসাও করিনি কেউ। কিন্তু তুমি কী করছ এসব?
মানতাশা বলল, কী করছি আমি?
-আমার কোনো কেয়ার তুমি নাও? এই যে সকালে উঠে অফিস যাই সেই খবর তোমার আছে?
-ঘরে কাজের মেয়ে আছে কিসের জন্যে?
-কাজের মেয়েকে দিয়ে সব হলে তো কাজের মেয়েই বিয়ে করে নিতাম।
-সেটাই তো করতে চাইছ। বিয়ে করে কাজের মেয়ে বানিয়ে নিতে চাইছ।
-আরেকটা বাজে কথা বললে..
-কী করবে তুমি? আমার গায়ে হাত তুলে কী পুরুষত্ব প্রমাণ করতে চাইছ?
মানতাশার চ্যাঁচিয়ে কথা বলা শুনে আরও খেপে যায় আরশান। সে বলল, আরও কীভাবে পুরুষত্ব প্রমাণ করা যায় দেখাব তোমাকে।
-মানে!
-দেখতে থাকো।
এই বলে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায় আরশান। মানতাশা রাগান্বিত হয়ে চেয়ে রইলো তার পথের দিকে। আরশানের সাহস কীভাবে হয় ওর গায়ে হাত তোলার!
.
.
.
নাস্তা করতে টেবিলে আসলো নাবীহা। চেয়ার টেনে মাত্র বসলো সে। নায়লা খাতুন বললেন, হ্যাঁ রে মা? একটা কথা ছিল।
-হু বলো?
-আছিয়া আপা আবার এসেছিলেন তার ছেলের জন্য প্রস্তাব নিয়ে।
নাবীহা একটু থেমে বলল, না করোনি? না করতে বলেছিলাম তোমাকে।
-আমার তো ভালোই লাগে ওদের। ছেলে ব্যবসা করে, খারাপ কী!
-ব্যবসাটা চালের।
-খারাপ কী? তাছাড়া স্থানীয় তারা।
-এমন কাউকে বিয়ে করার কী প্রয়োজন মা? আমি তো জব করছি। ভালোই আছি আমরা। জহিরও ভালো কলেজে পড়ছে। সবই ঠিকঠাক চলছে।
-মেয়ে হয়ে জন্মেছিস বিয়ে করতে হবে না?
-করব না বলিনি। মনের মতো কাউকে পেলে ঠিকই করে নেব।
এই বলে উঠে পড়ে নাবীহা। আর কোনো কথা না বলে বেরিয়ে যায় সে। নায়লা খাতুন বিড়বিড়িয়ে বললেন, আজরা আর মানতাশার মতো তোর কপাল কী হবে? কিসের আশায় বসে রয়েছিস জানিনা।
.
.
.
অফিসের উদ্দেশ্যে বেরুচ্ছে ইনতিসার। আজরা এসে বলল, আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরবে?
-কেন?
-অনেকদিন কোথাও যাইনা।
একটু ভেবে ইনতিসার বলল, আচ্ছা আসব। কোথায় যাবে ঠিক করো।
আজরা তার দিকে একটি হট বাক্স এগিয়ে দিয়ে বলল, আজ আমি আপনার জন্যে স্পেশাল রান্না করেছি সেই সকালে উঠেই।
-কষ্ট করতে গেলে কেন?
-আমার রান্না আপনার ভালো লাগে তাই।
ইনতিসার হেসে বাক্স নিয়ে
অফিসের উদ্দেশ্যে বেরুলো।
এদিকে আজরা বেশ খুশি। আজকে কোথায় যাবে এই নিয়ে ভাবতে থাকে সে।
.
.
.
গত কালকের হিসাব দেখার জন্যে নাবীহাকে ডাকে ইনতিসার। তার মলীন মুখটা দেখে সে বলল, কোনো সমস্যা?
-নাহ।
সে ফাইলটি এগিয়ে দেয়। ইনতিসার তা একপাশে রেখে বলল, আচ্ছা কাজ পরে হবে। চলো লাঞ্চ সেরে আসি।
নাবীহা আমতাআমতা করে বলল, আমি করে নেব।
-আজ আমার সাথেই করো!
ইনতিসারের জোরাজোরিতে তার সঙ্গে অফিসের পাশের রেস্টুরেন্টে যায় নাবীহা। এদিকে অফিসের কর্নারে থাকা টেবিলে পড়ে আছে আজরার দেওয়া খাবার।
.
চলবে
.
#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৩৫
#Saji_Afroz
দুপুরের খাবার খেয়ে নাবীহা ও ইনতিসার অফিসে ফিরে আসলেও বিকালের পরে তারা আবারো বের হয়। এবারও ইনতিসারের জোরাজোরিতে বেরুতে বাধ্য হয় নাবীহা৷ ইনতিসার নাছোড়বান্দা। তার মুখ কেন মলীন এই নিয়েই পড়ে আছে ইনতিসার। সে নাবীহাকে নিয়ে শপিংমল এ চলে আসে।
নাবীহাকে বলল সে, কেনাকাটা করলে মেয়েদের মন ভালো হয়ে যায়। তাই এখানে নিয়ে এলাম তোমাকে। ইচ্ছে মতো নাও যা খুশি।
-আমার মন খারাপ আপনাকে কে বলেছে?
-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বিষয়টা কী বলো তো?
একটু থেমে নাবীহা বলল-
এত পড়ালেখা করে ভালো একটা চাকরি করছি কী যাকে তাকে বিয়ে করার জন্যে? প্রায় বিয়ের প্রস্তাব আসে। কিন্তু আমার মনমতো হয় না। একটার জন্য মা বড্ড জোরাজোরি করছেন। মায়েরও বয়স হয়েছে। চিন্তা তো হবেই। ভাবছি বিয়েটা করে নেব।
-মায়ের পছন্দের ছেলেকে?
-তাকে নয়।
-তবে?
-এরমধ্যে ভালো কাউকে পেলে।
এই বলে থামলো নাবীহা। ইনতিসার বলল, আমি খুঁজতে সহায়তা করব?
এমনকিছুরই যেন অপেক্ষা করছিল সে৷ ইনতিসারের কাছে নিশ্চয় ভালো পাত্রের সন্ধ্যান পাবে। ভালোবাসার পেছনে তো অনেক ছুটেছে। এইবার একটু ভালো থাকতে চায় নাবীহাও।
.
.
.
শাড়ির কুচি ঠিক করাও শেষ। এইবার কপালে ছোট্ট একটা টিপ দেয় আজরা। নিজেকে আয়নায় দেখে মুচকি হাসলো সে। অনেক দিন পর শাড়ি পরেছে। ডাক্তার ডাক্তার করতে করতে সাজগোছও যেন ভুলতে বসেছিল আজরা। বিয়ে হয়েছে এক বছরও হয়নি তাদের। তবুও চেষ্টা করার পরেও যখন বাচ্চা হচ্ছে না, সেদিন থেকেই অজানা এক ভয় জন্ম নিয়েছে তার মনে। বছরের পর বছর গেলেও যদি সে মা হতে না পারে!
মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে আজরা৷ ইনতিসার তাকে কতটা ভালোবাসে! এটা উপলব্ধি করতে পারে সে। তবুও কেন যে এসব ভাবতে যায়! এই ভেবে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকায় সে। সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে। এখনো ইনতিসার এলো না। তবে কী সে ভুলে গেল? নাকি কাজে আঁটকে গেল?
ফোন হাতে নিয়ে ইনতিসারকে কল করে সে। বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পরেও সে রিসিভ না করলে চিন্তিত হয় আজরা। এমন তো ইনতিসার করে না কখনো। ব্যস্ত হলেও ফোনের লাইন কেটে মেসেজ পাঠিয়ে দেয় সে।
আজরা উঠে পড়ে৷ পায়চারি করতে থাকে সারারুমে। তার মাঝে অজানা এক আতঙ্ক নিয়ে অস্থিরতা শুরু হয়েছে।
.
.
.
এদিকে অনেকখানি শপিং শেষে ইনতিসারের সাথে নাস্তা করতে বসে নাবীহা। শুধু আজ নয়। প্রায়ই ইনতিসার তাকে শপিং করাতে আনে। ইনতিসারের একটাই কথা। তার উপরে শালিকারও পূর্ণ অধিকার আছে। আর সেই অধিকারের জোরেই নাবীহা যা খুশি চাইতে পারে ইনতিসারের কাছে।
প্রথম প্রথম এসবে সাই দিতো না নাবীহা। কিন্তু এখন ভালোই লাগে। পছন্দের যেসব জিনিস টাকার অভাবে আগে নিতে পারতো না, সেসব হাতের নাগালে পেয়ে হাত ছাড়া করতে ইচ্ছে করে না। তাছাড়া এই একাকীত্বের জীবনে কারো সঙ্গটাও বেশ উপভোগ করছে সে।
নাবীহার ফোন বেজে উঠে। ইনতিসার খাবার আনতে গেছে। এই রেস্টুরেন্টে এমনই নিয়ম। যা খাবে তা নিজেরই নিয়ে আসতে হয়।
আজরার ফোন এসেছে। সে রিসিভ করতেই আজরা বলল, ব্যস্ত আছিস?
-না তো৷ বল না?
-ইনতিসার কোথায়? আসলে আমার ফোন রিসিভ করছে না সে।
-হয়তো মিটিং এ।
-কিন্তু আজ তো কোনো মিটিং নেই।
নাবীহা আমতাআমতা করে বলল, হুট করে ফিক্সড হয়েছে।
-ওহ তাই বল! কাজের প্রেসারে নিশ্চয় বলতে ভুলে গেছে।
-হয়তোবা। কোনো দরকার?
আজ যে বেরুনোর কথা ছিল তা আর নাবীহাকে বলে নিজেকে ছোটো করলো না আজরা। কোনো কারণ নেই বলে ফোন রাখলো সে।
ইনতিসার খাবার নিয়ে আসলে নাবীহা বলল, আজরা ফোন করেছিল আমায়।
একথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে নাবীহার দিকে তাকায় ইনতিসার। নাবীহা বলল, চিন্তা করছিল আপনাকে নিয়ে। বলেছি মিটিং এ আছেন।
মুচকি হেসে ইনতিসার তার দিকে একটি প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল, খেয়ে নাও।
আজ প্রথমবার নিজের সুবিধার জন্য আজরাকে মিথ্যে বলেছে নাবীহা। মনের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে নাবীহার। এমনটা কেন করলো সে! কেন সে সত্যিটা বলতে পারেনি? বলতে পারার মতো কাজ সে করছে না। তাই হয়তো।
.
.
.
মানতাশাকে বেরুতে দেখে মালিহা বলল, এই সন্ধ্যায় কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
মানতাশা থেমে বলল, আপনাকে বলতে হবে সেটা?
-আরশান তখন এত রাগারাগি করেছে, এরপরেও শিক্ষা হয়নি তোমার?
-এটা আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়।
-ব্যক্তিগত হলে তো আর আমি জানতাম না।
মানতাশা একটু থেমে বলল, মেজাজ খারাপ করতে চাচ্ছি না এখন।
এই বলে হনহনিয়ে বেরুলো সে। কিন্তু কোনো ড্রাইভার তাকে নিয়ে বের হতে রাজি হয় না। সবার একটাই কথা, “স্যার নিষেধ করছে আপনাকে নিয়ে কোথাও যেতে।”
এদিকে আরশান ড্রয়ার থেকে ক্রেডিট কার্ডটাও নিয়ে গেছে। কোনো টাকাও রাখেনি। ড্রাইভারদের হুমকিধামকি দিয়েও কাজ না হলে সি.এন.জি ঠিক করে নেয় মানতাশা। কিছু টাকা রয়েছে তার কাছে।
গাড়ি ঠিক করে চলে যায় সে সদ্য হওয়া বান্ধবী লিনার কাছে।
লিনার সাথে ফেইসবুকে পরিচয় হয়েছে তার। যদিও অনেক আগে থেকেই তাকে ফলো করতো মানতাশা। একটি মেয়েদের গ্রুপে লিনার পোস্ট দেখে তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল সে৷ লিনার দৈনন্দিন জীবনে কী কী করে সবই ফেইসবুকে শেয়ার করতো। এসব দেখে ওর মতো একটা জীবন কামনা করতো মানতাশা। আরশানকে বিয়ে করার পর লিনাকে নক দেয় সে। কারণ এখন লিনার সামনে দাঁড় করানোর মতো যোগ্য সে নিজেকে মনে করে। সেই থেকেই তাদের মধ্যে কথোপকথন, পরবর্তীতে হয় বন্ধুত্ব।
আজ মানতাশার কাছে এসব শুনে অবাক হয়ে লিনা বলল, সিরিয়াসলি? আরশান তোমার গায়ে হাত তুলেছে?
হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়লো মানতাশা। লিনা বলল, এসব মোটেও প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না।
-কী করব আমি?
-কী করবে মানে! ওকে হুমকি দেবে। ওর নামে থানায় মামলা করবে বলবে।
এমন আরও অনেক কথাবার্তা বলে মানতাশাকে উত্তেজিত করলো লিনা। এবং মানতাশাও আজ আরশানকে এসব বলবে বলে মনস্থির করে নিলো।
.
.
.
রাত ন’টার সময় বাসায় ফিরলো ইনতিসার। রুমে এসে দেখলো, আজরা কার্টুন দেখছে। পরণে তার শাড়ি। সাজসজ্জাও রয়েছে।
ওহহো! আজ তো আজরাকে নিয়ে বের হওয়ার কথা ছিল তার। একদমই মাথা থেকে ছুটে গেছে বিষয়টি।
ইনতিসার এসে আজরাকে মিথ্যে মিটিং এর বাহানা দিলো। আর সাথে এটাও বলল যে, মিটিং টা একটা সমস্যার জন্য হুট করেই করা হয়েছে। তাই আজরাকেও জানানো হয়নি।
আজরা হেসে বলল, উহু! আমি কিছু মনে করিনি।
-তুমি এত সুন্দর করে তৈরী হয়েছ…
ইনতিসারকে থামিয়ে আজরা বলল, তাইতো শাড়ি খুলিনি। ভাবলাম তৈরী হলাম যখন আপনাকে না দেখিয়ে সাজ নষ্ট করব না।
ইনতিসার তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, খুবই ভালো করেছ।
পরম আবেশে ইনতিসার কেও জড়িয়ে ধরে আজরা। এদিকে ইনতিসার একটি লম্বা নি:শ্বাস ফেললো। আর আপনমনে ভাবলো, নাবীহার জন্য কেন আমি মিথ্যে বলছি আজরাকে! এটা কী ঠিক হচ্ছে?
.
.
.
মানতাশা রাত করে বাসায় ফেরে। আরশান রুমেই আছে। মানতাশাকে দেখে তার কাছে এসে আরশান বলল, ফোন কেন রিসিভ করোনি?
-তোমার সাথে কথা বলতে রুচিতে বাঁধা দিচ্ছে আমার।
-রাতে বাইরে টো টো করা খুব রুচির কাজ তাইনা?
-কথা সুন্দরভাবে বলো।
-না বললে?
একটু থেমে মানতাশা বলল, জেলের ভাত খাওয়াব তোমাকে। বউ নির্যাতন করার জন্য মামলা করব তোমার নামে। সাথে…
আর কিছু বলার আগেই মানতাশার গালে চড় বসিয়ে দেয় আরশান। মানতাশা চিৎকার করে বলল, তুমি আবারও আমার গায়ে হাত তুললে?
-তুললাম! কী করতে পারো করো দেখি?
এই বলে আরশান রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মানতাশা চ্যাঁচিয়ে বলতে থাকলো, এইবার আমি কী করি দেখতে থাকো তুমি। তোমাকে তো শাস্তি দিবই সাথে আমিও আমার অধিকার আদায় করে নেব।
.
চলবে
#একদিন_কাঁদবে_তুমিও
#পর্ব_৩৬
#Saji_Afroz
লিনার সাথে থানায় এসেছে মানতাশা। উদ্দেশ্য আরশানের নামে মামলা করার। করেছেও সে। সাথে দিয়েছে মালিহার নাম। মানতাশার মতে মালিহার জন্যই তার জীবনে যত অশান্তি। তাই তাকেও সে শান্তি পেতে দেবে না।
থানা থেকে বের হওয়ার সময় লিনাকে সে বলল, আমার কী যে শান্তি লাগছে বলে বোঝাতে পারব না। এখন থেকে আমি মুক্ত। যা খুশি করতে পারব। আমার ভয়ে ওরা থরথর করে কাঁপবে। এটা ভাবতেই অন্যরকম শান্তি পাচ্ছি। সবটাই সম্ভব হয়েছে তোমার জন্যে।
-কী যে বলোনা মানতাশা! তুমি আমার ফ্রেন্ড৷ এতটুক ভালো বুদ্ধি তোমাকে দিতেই পারি আমি। আসো এইবার। ড্রপ করে দিই তোমাকে বাসায়।
মানতাশা হেসে বলল, হ্যাঁ চলো!
.
.
.
অফিসের কাজে ব্যস্ত নাবীহা। হিসাবের কাজে দক্ষ হলেও এসব সামলাতে অনেকটা সময় দিতে হয়। যদিও ইনতিসার কাজের চাপ দেয় না তাকে। তবু্ও এখানে কাজ করছে, একটা দায়িত্ব তো থাকেই!
-আসব?
রাদিদ নামের সিনিয়র অফিসারকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো নাবীহা। সে বলল, আপনি?
-একটা বিষয়ে আপনার সাথে আলোচনা করার ছিল, তাই এলাম।
-বসুন না প্লিজ!
অফিসের কাজকর্ম নিয়েই সে আলোচনা করছে। মাঝেমধ্যে যে আড়চোখে নাবীহাকে দেখছে তা ভালোই বুঝতে পারছে সে।
রাদিদ ছেলেটা দেখতে শুনতে খারাপ নয়। শুনেছে পরিবারের অবস্থানও ভালো। আর অফিসেও সবার কাছে বেশ প্রশংসার পাত্র সে।
-তা মিস নাবীহা, হিসাবের কাজ তো দেখি ভালোই করছেন।
-তাই তো এই পদে আছি আমি।
এই বলে মুচকি হাসলো সে। রাদিদ একটু থেমে বলল, দুপুরে ফ্রি তো না কী?
-অফিসে আর ফ্রি কীভাবে থাকি?
-অফিস শেষে?
-কেন বলুন তো?
-আমার সাথে এক কাপ কফি খেতেন?
-আসলে…
-প্লিজ না করবেন না!
একটু ভেবে নাবীহা বলল, ঠিক আছে।
যথারীতি অফিস শেষে গেইটের পাশে এসে দাঁড়ায় নাবীহা। আজ আর ইনতিসারের জন্য অপেক্ষা করলো না সে। রাদিদ একটি গাড়ি ঠিক করে নেয়। সেখানে উঠে বসে নাবীহা।
দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে ইনতিসার। রাদিদের সাথে নাবীহা! কোথায় যাচ্ছে তারা?
ইনতিসার বাসায় ফিরে আসে। মাথায় তার একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। রাদিদের সাথে নাবীহা গেল কোথায়? কখন থেকে তাদের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে?
-আপনার চা।
আজরা যে তার দিকে চা এর কাপ এগিয়ে দিলো তা টেরই পাইনি ইনতিসার। ঘোর কাটে তার আজরার আঙুলে তুড়ি বাজানোর শব্দে। সে অন্যমনস্ক হয়ে কাপটা নিতে গিয়ে মেঝেতে পড়ে যায়। ব্যস্ত হয়ে ইনতিসার দাঁড়িয়ে বলল, সরি সরি!
-ব্যাপার না।
ইনতিসার রুম থেকে চলে যেতে চাইলে আজরা বলল, চিন্তিত মনে হচ্ছে আপনাকে। কোনো সমস্যা?
আমতাআমতা করে ইনতিসার বলল, নাহ! কী সমস্যা হবে?
-মনে হচ্ছে।
কোনো জবাব না দিয়ে সোজা স্টাডি রুমের দিকে এগিয়ে যায় ইনতিসার। আজরা বুঝে উঠতে পারছে না ইনতিসারের হঠাৎ কী হলো?
স্টাডি রুমে এসে কিছুক্ষণ সারা রুমে পায়চারি করলো ইনতিসার। এরপর ইজি চেয়ারে এসে হেলান দিয়ে বসলো সে। নাবীহা রাদিদের সাথে। সেই দৃশ্য চোখ থেকে সরাতেই পারছে না সে।
.
.
-আপনি কিন্তু কিছুই খেলেন না?
রাদিদের কথা শুনে নাবীহা বলল, কফি খাওয়ার কথা ছিল।
-তাই বলে শুধু কফিই খাবেন?
নাবীহা হাসলো। রাদিদ বলল, আর কী পছন্দ বলুন?
-আসলেই অন্যকিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।
-হুম বুঝলাম।
-কী?
-আপনি সহজে বলবেন না। তবে আমার পছন্দের কিছুই খান!
এই বলে ওয়েটারকে ডাকলো রাদিদ। খাবার অর্ডার করে সে। নাবীহা মুচকি হেসে বলল, দরকার ছিল না এসবের।
-খুব আছে।
এই বলে রাদিদও হাসলো। নাবীহা তার হাসির মানে খুঁজে পায় না। হঠাৎ রাদিদ কেন তার সাথে এমন আচরণ করছে?
.
.
.
গুনগুন করে গান গেয়ে চুল আঁচড়াতে ব্যস্ত মানতাশা। হঠাৎ আগমন ঘটে আরশানের। এসেই তার দিকে একটি কাগজ ছুড়ে মেরে বলল, এসব কী?
মানতাশা ভাবলো, মামলার কথা সে জেনেছে। নিশ্চয় পুলিশের কাছ থেকে কথা শুনেছে। তাই তার মাথা গরম হয়ে আছে।
সে বলল, কী?
-আমার নামে মামলা করেছ?
-নোটিশ পেয়ে গেছ?
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আরশান বলল, মামলার পেপার টাই পেয়েছি।
-বুঝলাম না।
-যার কাছে মামলা করতে গেছ সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তোমার মামলা সে নিলেও সিনিয়রের কাছে তা পৌঁছায়নি।
কথাটি শুনে গলা শুকিয়ে যায় মানতাশার। সে আমতাআমতা করে বলল, কী বলছ?
-আমি অবাক হচ্ছি তোমার সাহস দেখে। আমার খেয়ে, আমার টাকায় চলে আমার নামেই এসব করতে গেলে?
এইবার একটু কর্কশ কণ্ঠে মানতাশা বলল, হ্যাঁ করেছি। বেশ করেছি। ও তোমার বন্ধু হয়েছে কী হয়েছে! অন্য কোথাও গিয়ে করব আমি।
প্যান্টের বেল্ট খুলতে খুলতে আরশান বলল, কী বললে? আবার বলো তো?
-অন্য কোথাও গিয়ে আবার করব মামলা।
-তোমার যাওয়ার অবস্থা থাকে কিনা সেটাই দেখো।
মালিহা এদিকে এসেছিল মানতাশার সাথে কথা বলতে। কেননা মামলার বিষয়টা তারও কানে এসেছে। কিন্তু এসেই দরজা বন্ধ দেখতে পায় সে। ভেতর থেকে মানতাশার চিৎকার শোনা যাচ্ছে।
মালিহা তাকে সাহায্য করতে চাইলেও করলো না। একটা শিক্ষা তার হওয়া উচিত। আজ মামলা করেছে। পরবর্তীতে অন্য কিছু ঘটাবে। খারাপ কিছু হওয়ার থেকে মার খেয়েই নাহয় শুধরে যাক।
রাত বাড়তে থাকে। ব্যথায় ছটফট করছে মানতাশা। আরশান তার বেল্ট দিয়ে ওর সারা শরীরে আঘাত করেছে। বিয়ের আগে কখনো কী ভেবেছিল, এমন কিছু তার সাথে ঘটবে!
.
.
.
আজ অফিসেও মন নেই ইনতিসারের। কালকের বিষয়টা নিয়ে কেন সে অস্থির হয়ে আছে নিজেও বুঝছে না। মাথা থেকে ঝাড়তে চেয়েও বিষয়টি ফেলতে পারছে না ইনতিসার।
-আসব?
নাবীহাকে দেখে ভেতরে আসতে বলল সে। নাবীহা কিছু ফাইল তার দিকে এগিয়ে দেয়। ইনতিসার সেসব দেখতে দেখতে বলল, কাল আমার জন্য ওয়েট করলে না?
-আসলে কাল বাসায় যাইনি। তাই দাঁড়ানো হয়নি।
-ও আচ্ছা। কোথায় যাওয়া হয়েছে?
-রাদিদ সাহেব কফির অফার দিয়েছিলেন।
-হঠাৎ?
-কোনো কারণ ছাড়াই। হয়তো কলিগ আমরা। তাই!
-হুম। ওকে আমি ফাইলগুলো চেক করছি। তুমি এই ফাইলের কাজ গুলো সেরে আসো।
এই বলে আরেকটি ফাইল নাবীহার দিকে এগিয়ে দিলো ইনতিসার। নাবীহা তা নিয়ে নিজের কেবিনে আসলো। সেখানে রাদিদকে উপস্থিত দেখে বলল, আপনি?
-আপনার পারমিশন ছাড়াই একটা কাজ করে ফেলেছি।
-কী?
-ড্রয়ার খুললেই বুঝবেন।
এই বলে তাড়াহুড়ো করে বেরুতে যায় রাদিদ। দরজা খুলতেই ইনতিসারের সাথে ধাক্কা লাগে তার।
নাবীহাকে আরেকটি ফাইল দিতে এসেছে সে। রাদিদকে দেখে মেজাজটা খারাপ হলো তার। কিন্তু কিছু বলল না।
“সরি স্যার”
এই বলে রাদিদ চলে যায়। ইনতিসার বলল, উনি কেন এসেছেন?
নাবীহা কী বলবে খুঁজে পায় না। ইনতিসার তার অবস্থা বুঝতে পেরে বলল, আরেকটি ফাইল দেওয়ার ছিল।
নাবীহাকে ফাইলটি দিয়ে বেরুলো সে। নাবীহা তাড়াহুড়ো করে ড্রয়ার খুললো। একটা গিফট পেপার মোড়ানো বাক্স দেখতে পায় সে। সেটি হাতে নিতেই আবারো ইনতিসারের আগমন ঘটে। নাবীহার হাতে বাক্সটি দেখেই ইনতিসার বুঝতে পারলো, এটি রাদিদ দিয়ে গেছে।
নাবীহা সেটি ড্রয়ারে রেখেই ইনতিসারকে বলল, কিছু বলবেন?
-ফাইল দুটির কাজ লাঞ্চের আগেই শেষ করতে হবে। এটি বলতে এসেছি।
-জি, হয়ে যাবে।
ইনতিসার বেরুলো। নিজের কেবিনে আসে। খানিকবাদে রাদিদ আসলো পরবর্তী মিটিং এর কাগজপত্র নিয়ে। ইনতিসার সেসবে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, রাদিদ সাহেব? আজকাল অফিসের কাজের চেয়েও অন্যদিকে মন দিচ্ছেন মনে হচ্ছে?
রাদিদ হালকা কেশে বলল, বুঝলাম না স্যার?
-ঠিকই বুঝেছেন। একটা কথা বলে রাখি, অফিস টাইমে কাজের প্রতি অবহেলার কারণে না আবার জব হাত ছাড়া হয়ে যায়।
রাদিদ মাথা নিচু করে রাখলো। ইনতিসার বলল, আসতে পারেন এখন।
এদিকে নাবীহা বাক্সটি খুলে অবাক হয়ে যায়। তাতে রয়েছে এক জোড়া রূপার নুপুর। যা সে একটি পেইজে দেখে দাম কমেন্টে জানতে চেয়েছিল৷ রাদিদ নিশ্চয় সেই কমেন্ট দেখেই বুঝেছে, এই নুপুর জোড়া তার পছন্দ।
“রাদিদ আমাকে এভাবে ফলো করছে!”
এই ভেবে মৃদু হাসলো নাবীহা।
.
চলবে