#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৯
‘ইশি তুমি কি সেদিন কিছুই দেখো নি?মানে তুমিও তো ছিলে গাড়িতে তাইনা?তাহলে তুমি আগে থেকেই কি কোন আন্দাজ করতে পারো নি,বা এমন কোনকিছু মনে হয়নি যে তোমাদের আগে থেকেই কেই ফলো করছে?’ অর্থ’র প্রশ্নে ইশি না বোধক মাথা নাড়ালো।আস্তে করে বলে, ‘ আসলে ভাইয়া গাড়িতে উঠে তো আর কেউ পিছন দিকে তাকিয়ে থাকে না,তাইনা?আমার ক্ষেত্রেও তাই।তবে প্রাহি’রা যখন আমাকে আমার বাসায় ড্রোপ করে দিয়ে চলে আসছিলো।আমি ওদের গাড়ির পিছনে আমি একটা ট্রাক দেখেছিলাম।আমাদের বাড়ির রাস্তা অনেক সরু।ওখান দিয়ে ট্রাক যাওয়া আসা করে না। করলেও যদি আমাদের এলাকায় কেউ দরকারি জিনিসপত্র আনে তখন আসে।তবে ওইসময় এতো রাতে সেখানে ট্রাক আসা একটা সন্দেহের মধ্যে পড়ে।এটা আমার ব্যর্থতা যে ভাইয়া আমার মাথায় একটুও খেয়াল আসেনি যে ওই ট্রাকটাই ওদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করাতে পারে।’
অর্থ দীর্ঘশ্বাস ফেললো।ইশি বললো, ‘ ভাইয়া আমি একটু প্রাহিকে দেখি আসি।’
অর্থ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।তারপর আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ ওই ট্রাক ড্রাইভারটাকে যে করেই হোক ধরতে হবে।কোন খোঁজ পেয়েছিস ওই লোকের?’
আরাফ ব্যর্থ শ্বাস ফেললো।হতাশ কন্ঠে বলে, ‘ অনেক চেষ্টা করছি খোঁজার কিন্তু পাচ্ছি না। ওই জয়েরও কোন খোঁজ নেই।আমার মনে হয় দুটোই গা ঢাকা দিয়েছে একসাথে।নাহ এইভাবে হবে না।আমাদের আরো করাভাবে আমাদের লোকদের কাজে লাগাতে হবে।’
অর্থ রাগি কন্ঠে বলে, ‘ ঘোড়ার ঘাস কাটছে নাকি ওরা।দু’দিন যাবত খুজে চলেছে কিন্তু কোন ইনফোর্ম আমাদের জানাতে পারছে না।ড্যাম ইট!’
রাগে চেয়ারে জোড়ে একটা দেয়ালে ঘুশি মারলো অর্থ। আরাফ অর্থকে রেগে যেতে দেখে বললো, ‘ রাগিস না প্লিজ।আমরা জলদি খুজে পাবো ওদের।পুলিশও তো তাদের কাজ করছে। জলদি ওই কু’কুরের বাচ্চাদের ধরতে পারবো আমরা।’
‘হুম তাই কর।যতো দ্রুতভাবে পারিস।’ অর্থ’র কথায় আরাফ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।তারপর চলে গেলো।অর্থ তাকালো কেভিনের কাচের দরজার দিকে সেখানে দেখা যাচ্ছে প্রাহি চুপচাপ বসে আছে।আর ইশি এবং হেমন্ত ওকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছে।আজ দুদিন হয়ে গিয়েছে সেই ঘটনার।সেদিন যখন প্রাহির জ্ঞান ফিরে আসে মেয়েটা সেদিন থেকে একটা কথা অব্দি বলেনি কারো সাথে।চুপচাপ বসে থাকে নিস্তেজ মানুষদের মতো।মনে হয় মেয়েটা বেঁচে তো আছে কিন্তু ওর ভীতরে কোন রূহ নেই।কেমন নিষ্প্রান হয়ে থাকে সবসময়।প্রায় আধাঘন্টা চেষ্টার পরেও যখন প্রাহিকে কিছুই খাওয়াতে পারলো না হেমন্ত তখন কেবিন থেকে বের হয়ে আসলো।ওর সহ্য হচ্ছে না প্রাহির এই অবস্থা দেখে।হেমন্ত বাহিরে আসতেই অর্থ বললো, ‘ কিছুই খায়নি?’
হেমন্ত ছলছল চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো।ধরা গলায় বলে, ‘ এভাবে আর কতোদিন চলবে ভাই?ওকে এই অবস্থায় দেখতে যে আমার একটুও ভালো লাগে না।কিছু খায়নি দুদিন যাবত।শুধু স্যালাইন চলছে ক্যানালার মাধ্যমে।এইভাবে তো ও বেশিদিন বাঁচবে না ও।মরে যাবে ও।’
অর্থ বললো, ‘ ওকে কাঁদাতে হবে হেমন্ত।এইভাবে কষ্ট নিজের মনের মাঝে রেখে গুমড়ে গুমড়ে মারা যাবে।ওকে মেনে নেওয়া শিখাতে হবে।সত্যিটা মেনে নিতে হবে।তুই চিন্তা করিস না। আমি যাচ্ছি ভীতরে।দেখি কিছু করতে পারি কিনা!’
হেমন্ত চোখ মুছে সম্মতি জানালো।অর্থ প্রাহির কেবিনে গেলো।ইশি ইশারা করলো চলে যেতে।তাই ইশি চলে গেলো।অর্থ আস্তে করে প্রাহির পায়ের কাছে বসলো।মেয়েটা এই দুদিনেই কেমন শুকিয়ে গেছে।চোখের নিচে কালি পরেছে।চেহারার লাবন্যতা যেন হারিয়েই গিয়েছে।মাথায় ব্যান্ডেজ হাতে ক্যানোলা লাগানো। বামপা’টা ব্যান্ডেজ করা।প্রাহিকে এই অবস্থায় দেখে অর্থ’র ঠিক কতোটা কষ্ট হচ্ছে তা বলে বুঝাতে পারবে নাহ।ভীতরটা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে ওর।অর্থ আরেকটু এগিয়ে বসলো প্রাহির কাছে।শান্ত কন্ঠে বলে, ‘ কেমন আছো প্রাহি?’
প্রাহির কোন জবাব নেই।অর্থ আবারও বলে, ‘ এইভাবে আর কতোদিন মৌনতা পালন করবেন প্রাহি?এইভাবে চললে তো আপনি মরে যাবেন?আপনি মারা গেলে আপনার মায়ের কি হবে সেই কথা একবারো চিন্তা করেছেন আপনি?আপনার বাবা আর নেই। আপনি তাদের একমাত্র সন্তান।এখন আপনাকেই সবার দায়িত্ব নিতে হবে।আপনার মা’কে বাঁচাতে হবে। আপনার বাবা কি আপনার এই অবস্থা দেখে খুব খুশি হচ্ছেন আপনি মনে করছেন? না একদম ভুল ভাবছেন আপনি।আপনাকে এই অবস্থায় দেখে তিনি মরেও শান্তি পাচ্ছেন নাহ।এভাবে হার মেনে নিলেন?এইভাবে চলবে কিভাবে প্রাহি?আপনাকে যে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর সাথে লড়তে হবে।আপনার বাবার হত্যাকারিকে খুঁজে বের করতে হবে।তাকে কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে।আপনার মায়ের এই অবস্থার পিছনে যে দায়ি তাকে তার সর্বোচ্চ শাস্তি দিবেন আপনি।কিন্তু আপনার মাঝে সেরকম কোন মনোবলই আমি দেখছি না।কেমন সন্তান আপনি?আপনার বাবা মায়ের এই অবস্থার জন্যে তাকে শাস্তি না দিয়ে আপনি নিজেকে নিজে শাস্তি দিয়ে গুমড়ে মরছেন এই হাসপাতালে।এইভাবে হবে না প্রাহি আপনাকে শক্ত হতে হবে।আপনার মায়ের জন্যে আপনাকে বাঁচতে হবে।নিজের মায়ের জন্যে আজীবন লড়তে হবে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর বিরুদ্ধে।’
কথাগুলো বলে অর্থ তাকালো প্রাহির দিকে প্রাহির চোখজোড়া ছলছল করছে।অর্থ এগিয়ে গিয়ে প্রাহির বাহু ধরে ওর মুখোমুখি হলো।গম্ভীর কন্ঠে বললো, ‘ কাদুঁন প্রাহি।আজ প্রানভরে কাঁদুন।আজই যেন আপনার শেষ কান্না হয়।নিজের সবটুকু কষ্ট উজাড় করে কেঁদে ভাসিয়ে দিন।যেন আজকের পর থেকে আর কেউ আপনাকে কাঁদাতে না পারে।নিজেকে এতোটা পাথর মনে রূপান্তর করবেন।কেঁদে নিন প্রাহি।কাঁদুন আপনার বাবা আর নেই প্রাহি।আপনার মা হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন তাদের জন্যে আজ শেষ কান্না কেঁদে নিন।’
অর্থ’র কথা শেষ হতে দেরি।প্রাহির হাইমাউ করে কাঁদতে দেরি নেই।মেয়েটা পাগলের মতো কান্না করছে।অর্থ হ্যাচঁকা টানে প্রাহিকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরলো।কাঁদার জন্যে কারো ভরসা যোগ্য প্রসস্থ বুকটা পেয়ে যেন আরো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো প্রাহি।নিজের সবটুকু কষ্ট আজ কেঁদেকেটে অর্থ’র বুক ভাসিয়ে দিবে।প্রাহি কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘ আমার বাবা আর নেই।আমার বাবা।আমি এরপর থেকে কার কাছে নালিশ দিবো।কার কাছে হেমন্ত’র নামে বিচার দিবো।কে আমাকে তারপর আদুরেভাবে বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে।আমার আম্মুও তো আর কোনদিন আমাকে বকা দিবে না।কেন এমন হলো আমার সাথে?কি এমন পাপ করেছি আমি?যে আমি সব হারিয়ে শূন্যের কোঠায়।আমার বাবাকে মেরে ফেললো ওরা।আমার ভরসার জায়গাটুকু ওরা কেরে নিলো আমার কাছ থেকে।আমাকেও কেন মেরে ফেললো না ওরা।আমাকে কেন বাঁচিয়ে রাখলো।আমি আমার বাবার কাছে যাবো।আমার বাবাকে দেখবো।বাবার বুকে মাথা রাখবো।নিয়ে চলুন আমার বাবার কাছে।বাবা যাবো আমি।’
অর্থ’র চোখজোড়া লাল হয়ে আসছে।কন্ঠনালিতে কান্না আটকে রাখার জন্যে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে।এই মেয়েটার বুকফাটা আজাহারি শুনে ওর নিজের কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। অর্থ প্রাহির মাথা হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, ‘ হুস! কাঁদে না আর কাঁদেনা।নিয়ে যাবো আঙ্কেলের কাছে। একটু সুস্থ্য হয়ে উঠুন আপনি!’
প্রাহি উঠে বসলো।চিৎকার করে বলে, ‘ নাহ! আমি এখনি যাবো বাবার কাছে নিয়ে চলুন বাবার কাছে।আমি বাবার কাছে যাবো।প্লিজ নিয়ে চলুন।আমার এখানে দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমি পাগল হয়ে যাবো।’
‘ ওকে ওকে আপনি হাইপার হবেন নাহ।আমি এখনি নিয়ে যাচ্ছি।’
অর্থ কেবিনের বাহিরে এসে দেখলো ইশি আর হেমন্ত’র চোখে পানি।অর্থ ওদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘ কাঁদিস না প্লিজ তোরা।এখন গাড়ি বাহির কর।প্রাহি পাগলামি করছেন অনেক।উনাকে এখন আঙ্কেলের কবরের কাছে না নিয়ে গেলে হিতে বিপরীত হবে।উনার মাথায় আঘাত পেয়েছেন তাই উনাকে এতোটা হাইপার হতে দেওয়া ঠিক হবে না।’
হেমন্ত বলে, ‘ আচ্ছা ভাই।আমি গাড়ি বাহির করছি তুমি ওকে নিয়ে আসো। ইশি চল।’
ওরা যেতেই অর্থ আবারও প্রাহির কাছে আসলো।কোন কিছু না ভেবেই হুট করে কান্নারত প্রাহিকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিলো।প্রাহি ভয় পেলেও পরক্ষনে ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলো অর্থ’র দিকে। দুনিয়াতে এখন প্রাহি বেঁচে থাকবে চারজন মানুষের আশায় এখন প্রথম ওর মা,দ্বিতীয় অর্থ,তৃতীয় হেমন্ত আর চতুর্থ ইশি।অর্থ ওকে ভালোবাসুক আর না বাসুক প্রাহি অর্থকে চিরজীবন ভালোবেসে যাবে। প্রাহি অর্থ’র গলা জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখে ফুঁফিয়ে উঠলো। প্রাহির গরম নিঃশ্বাসগুলো অর্থ’র গলায় এসে লাগছে।অদ্ভূত ভালোলাগায় মনটা ছেঁয়ে গেলো অর্থ’র।প্রাহিকে আরেকটু ভালোভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো।মেয়েটাকে এইভাবেই আগলে রাখতে চায় নিজের বাহুডোরে অর্থ।কেন চায়?তা জানে না অর্থ।শুধু ও এটাই চায় প্রাহি ওর কাছে থাকুক। ওর সাথে থাকুক।আর ও প্রাহিকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবে।কখনও প্রাহির হাত ছাড়বে না এটা মনে মনে নিজের কাছেই নিজে ওয়াদা করলো অর্থ।যেকোন পরিস্থিতিতে প্রাহি ঢাল হয়ে থাকবে ও সারাজীবন।কোন দুঃখ কষ্ট যেন প্রাহিকে ছুতে না পারে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে ও।
#চলবে________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।