একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব-৪৫ এবং শেষ পর্ব

0
1984

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#শেষ_পর্ব

অর্থ এলোপাথারি মারছে ফিহাদকে।কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না ওকে।ফিহাদের অবস্থা খুবই বাজে।পুলিশ অফিসার’রাও আটকাতে পারছে না ওকে।অবস্থা বেগতিক দেখে আরাফ আর হেমন্ত দ্রুত টেনে অর্থ’কে সরিয়ে আনলো।আরাফ বলছে,

-‘ থাম অর্থ।আরেকটু হলে ও মরে যাবে।থেমে যা। এমনিতেও একটা পাগল।সাইকো এই ফিহাদ।ছেড়ে দে।হয়েছে তো।বাকিটা পুলিশকে সামলাতে দে।’

অর্থ রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলে,

-‘ আমাকে আটকালি কেন তোরা?আজ ওকে আমি মেরেই শান্ত হবো।ওর সাহস কি করে হলো আমার প্রাহির সাথে এমন করার।আমার প্রাহি এখন কতোটা অসুস্থ হয়ে পরেছে ওর কারনে।বাকি ক’টা মাস আমার প্রাহি যন্ত্রানার মাঝে থাকবে।শুধু মাত্র ওর কারনে।’

-‘ আমরা জানি অর্থ।এইটা আমাদের ভাগ্যে লিখা ছিলো।প্লিজ থেমে যা।ও আইন নিজের হাতে নিস নাহ।’

আরাফ আর হেমন্ত অর্থকে টেনে নিয়ে গাড়িতে বসালো।অর্থ চোখ বন্ধ করে বড়বড় নিশ্বাস নিচ্ছে।ধরা গলায় বলে,

-‘ আমি যদি এই লোকেশন ট্রেকারটা আমার লকেটে সেট না করতাম আর সেই সম্পর্কে তোদের যদি না জানাতাম।তাহলে কি হতো ভাবতেই আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়।তোরা আর একটু পরে আসলেই আমার প্রাহি……!’

থেমে যায় অর্থ।তারপর আবার বলে,

-‘তোদের অনেক অনেক ধন্যবাদ ইয়ার।তোরা না থাকলে যে আজ কি হতো।ভাবতেই আমার নিশ্বাস আটকে আসছে।’

হেমন্ত ভাইয়ের কাধে হাত দিয়ে বলে,

-‘ চিন্তা করো না ভাই।এখন সব ঠিক আছে।এখন থেকে প্রাহির দিকে একটু বেশি বেশি খেয়াল রাখবে।তাহলে হবে।দেখবে বাচ্চা আর প্রাহির কিছু হবে নাহ।’

অর্থ হেমন্ত’র কথায় সম্মতি জানালো।তারপর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।প্রাহিকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে।মেয়েটা হাসপাতালে থেকে আরো অস্থির হয়ে গিয়েছে।হাসপাতালের ভ্যাপসা গন্ধে কিছুই খেতে পারছে না।দু বার বমি করেছে।প্রাহির অবস্থা দেখে ডাক্তার ওকে ডিসচার্জ করে দিয়েছে।
———-
প্রাহি চোখ বুজে ছিলো এমন সময় মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে চোখ খুললো।অর্থকে দেখে বললো,

-‘ কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?’

অর্থ প্রাহির কপালে ঠোঁট ছুইয়ে দিয়ে বলে,

-‘ জরুরি কাজ ছিলো একটা।সে বাদ দেও।এখন বলো তোমার কেমন লাগছে?পেটে ব্যাথা করে এখনো?’

প্রাহি জবাবে বলে,

-‘ আমি এখন ঠিক আছি।পেটে ব্যাথাও নেই।আর বাড়িতে যাবো আমি।বাড়িতে গেলে আমি আরো ঠিক হয়ে যাবো।’

-‘ আচ্ছা,যাবো।দেখি কোলে আসো।এখনি যাবো আমরা।ডিসচার্জ হয়ে গিয়েছে তোমার।’

প্রাহিকে ধরে উঠিয়ে বসাতেই প্রাহি দুহাত বাড়িয়ে দিলো অর্থ’র দিকে।অর্থও খুব সাবধানে প্রাহিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। তারপর সবাই বাড়িতে চলে গেলো।
____________
দেখতে দেখতে কেটে গেলো কয়েক মাস।এর মাঝে হিয়া আর আরাফেরও বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।ওরা এখন সাউথ কোরিয়াতে আছে।হানিমুনে গিয়েছে আবার বলা যায় আরাফের বাবার সাথে হিয়াকে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছে।আরাফের বাবা কাজের কারনে ছেলের বিয়েতে আসতে পারেননি তাই। ইশি আর হেমন্ত মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। বেশ ভালোই কাটছে ওদের দাম্পত্য জীবন। যেহেতু আরাফ নেই আর হেমন্ত এখন পড়াশোনায় খুব ব্যস্ত তাই এখন বাধ্য হয়েই অর্থকে অফিসে যেতে হচ্ছে।নাহলে প্রাহিকে রেখে কোথায় যেতো না।
রাত দশটা অফিস থেকে ফিরেছে অর্থ।রুমে এসে দেখলো প্রাহি খাটের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে।ন’মাস চলছে প্রাহির।পেটটা এখন অনেক বড় হয়েছে।অর্থ ডাকলো না প্রাহিকে।আগে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসলো।ফোন করে রুমে খাবার দিয়ে যেতে বললো সার্ভেন্ট’কে। অর্থ পাশে গিয়ে বসলো প্রাহির। আস্তে করে ডাকলো,

-‘ প্রাহি?’

এক ডাকেই চোখ খুললো প্রাহিকে।অর্থকে দেখে সোজা হয়ে বসলো।বললো,

-‘ কখন ফিরেছেন?’

-‘ এইতো কিছুক্ষন হবে।খাবার খেয়ে নেও।’

প্রাহিকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলো অর্থ।তারপর প্রাহিকে সুইয়ে দিয়ে অফিসের ফাইলগুলো গুছিয়ে রাখছিলো অর্থ।হঠাৎ প্রাহির আর্তনাদে কেঁপে উঠলো অর্থ।হন্তদন্ত হয়ে প্রাহির কাছে আসতেই।প্রাহি দূর্বল কন্ঠে বলে,

-‘ আপনার বাচ্চা আমাকে কিক মারছে।দেখুন কি পাজি আপনার বাচ্চা!’

অর্থ প্রাহিকে বুকে চেপে ধরে বলে,

-‘ তোমার অনেক কষ্ট হয় তাই নাহ প্রাহি?’

-‘ দূর আপনি এসব কি বলছেন?এটা কষ্ট কিসের এইটাই তো মা হওয়ার অনুভূতি।আওওওও!’

অর্থ ঘাবড়ে গিয়ে বললো,

-‘ আবার কি হলো?’

-‘ আবারও লাথি দিচ্ছে!’

অর্থকে প্রাহিকে সুইয়ে দিলো।প্রাহির জামাটা উঠিয়ে ওর পেটে চুমু খেয়ে বলে,

-‘ বাবা মা’কে এতো কষ্ট দিও না।মা কষ্ট পায়তো।’

হঠাৎ আবারও লাথি দিলো বাচ্চাটা।অর্থ আর প্রাহি দুজনেই চিৎকার করে উঠলো।না কোন ব্যাথার কারনে নাহ।অর্থ আর প্রাহি দুজনেই স্পষ্ট বাচ্চার পায়ের ছাপ দেখেছে পেটে।অর্থ’র চোখজোড়া ছলছল করে উঠলো।বললো,

-‘ দেখলে প্রাহি?আমাদের সোনা বাচ্চার পা দেখেছো তুমি?’

প্রাহি কেঁদেই দিলো।বললো,

-‘ হ্যা দেখেছি অর্থ, দেখেছি। কবে যে আসবে ও আমাদের কোলে।আমার যে আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছে না।’

-‘ শীঘ্রই আসবে।আর মাত্র কয়েকটা দিন।’

অর্থকে জড়িয়ে ধরলো প্রাহি।অর্থ নিজেও প্রাহিকে আকড়ে ধরলো নিবিড়ভাবে।
______________

সকাল হতে পেটে চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে প্রাহির।আজ শুক্রবার অর্থ’র অফিস নেই।তাই অর্থ বাসায় বসেই কাজ করছে।প্রাহি এইবার সহ্য করতে না পেরে কেঁদে দিলো।চিৎকার করে বললো,

-‘ অর্থ আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলুন।বেবি আসার সময় হয়ে গেছে।’

অর্থ প্রাহির কথাটা শোনা মাত্রই প্রাহির কাছে এসে ওকে কোলে তুলে নিলো।অস্থির হয়ে বলে,

-‘ কখন থেকে হচ্ছে এসব আমাকে আগে বলবে নাহ?একটু সহ্য করো।আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।কাঁদেনা তো।’

অর্থ চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো বাড়ির সকলে হন্তদন্ত হয়ে এসে দেখে প্রাহির পেইন উঠেছে অর্থ দ্রুত প্রাহিকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।সারাটা রাস্তা অর্থ প্রাহিকে বুকে চেপে ধরে রেখেছিলো।প্রাহি আর্তনাদ কান্নায় অর্থ নিজের কেমন যেন নিস্তেজ মনে হতে লাগলো।হাসপাতালে পৌছাতেই প্রাহিকে স্ট্রেকচারে সুইয়ে দিলো অর্থ।প্রাহি অর্থ’র হাত ধরে বলে,

-‘ একদম চিন্তা করবেন নাহ।আমাদের কিছু হবে না।আমি আর আমাদের বাচ্চা সহি সালামত আপনার কাছে ফিরে আসবো।প্রমিস করলাম।’

অর্থ প্রাহির কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-‘ তাই যেন হয়।আমি অপেক্ষা করবো।’

প্রাহিকে ওটিতে নেওয়া হলো।অর্থ অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।আর বারবার ও’টির দরজার দিকে তাকাচ্ছে।প্রাহির জন্যে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।মেয়েটার একেকটা চিৎকার যেন ওর বুকে তীরের মতো আঘাত করছে।অবশেষে দুঘন্টা পর ও’টির লাইট নিভলো। নার্স সাদা তোয়ালে মুরিয়ে বাচ্চা কোলে নিয়ে আসলো অর্থ’র সামনে।হাসি মুখে বলে,

-‘ অভিনন্দন ছেলে হয়েছে আপনাদের।মিষ্টি মুখ করান জলদি!’

সবাই আলহামদুলিল্লাহ বললো।বাড়ির সকলে প্রচন্ড খুশি।অর্থ সেদিকে ধ্যান দিলো না।ডাক্তারের কাছে এসে প্রশ্ন করলো,

-‘ আমার ওয়াইফ কেমন আছে?ঠিক আছে তো ও?’

-‘ সি’ইজ ফাইন।জ্ঞান নেই উনার।তবে আধাঘন্টা পরেই জ্ঞান ফিরে আসবে।টেন্সন করিয়েন নাহ। আপনার ওয়াইফ একদম ঠিক আছে।’

অর্থ সস্থির নিশ্বাস ফেললো।ইশি এইবার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অর্থ সামনে এসে বলে,

-‘ ভাইয়া কোলে নিবেন নাহ আপনার ছেলেকে?’

অর্থ কাঁপা কাঁপা হাতে ছেলেকে কোলে তুলে নিলো।বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে।অর্থ চুমু খেলো বাচ্চার কপালে।কি সুন্দর! অর্থর হৃদয়টা প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো।বাবার হওয়ার অনুভুতি কি তবে এটাই।অর্থ’র চোখের কোনবেয়ে এক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো।
—————–

বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে আছে প্রাহি। ছেলেকে চুমু খেতে খেতে শেষ।বার বার বলছে,

-‘ দেখো দেখো?একেবারে আমার আব্বুর মতো হয়েছে তাই নাহ?বলো?’

আসলেই একেবারে এরশাদ রহমানের মতো হয়েছে দেখতে।সবাই একে একে প্রাহির সাথে দেখা করলো।তারপর অর্থ’র ছটফটানি দেখে সবাই বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।সবাই বেড়িয়ে যেতেই অর্থ দৌড়ি যায় প্রাহির কাছে।প্রাহি সারা মুখশ্রীতে চুমু খেয়ে।ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো।পরম আবেশে একহাতে অর্থকে আকড়ে ধরলো প্রাহি।বেশ কিছু ক্ষন পর সরে আসে অর্থ।প্রাহির কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে ধীর কন্ঠে আওড়ালো,

-‘ ধন্যবাদ বউ।আমাকে এতো সুন্দর একটা উপহার দেওয়ার জন্যে।এতো কষ্ট সহ্য করে আমার বাবা হওয়ার সুখ অনুভব করতে দেওয়ার জন্যে।তোমায় আমি কি দিবো প্রাহি এর বিনিময়ে?বলো প্রাহি? আমার জানটা দিয়ে দিলেও কম হয়ে যাবে। কি চাই তোমার?’

প্রাহি মুচঁকি হেসে অর্থ’র কপালে চুমু খেলো।তারপর অর্থ’র বুকে নিজের মাথাটা দিয়ে বলে উঠলো,

-‘ বেশি কিছু না শুধু #একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি হলেই চলবে।’

হাসলো অর্থ প্রাহির কথায়।নিজের বাচ্চাকে আর প্রাহিকে দুহাতে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে।মৃত্যু ছাড়া আর কেউ ওদের আলাদা করতে পারবে না কোনদিন।বেচে থাকুক এই ভালোবাসা।ভালোবাসা সুন্দর।

_____________সমাপ্ত____________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে