একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব-৪১

0
1300

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ৪১
সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে প্রাহি।হাতে পানি বোতল।এই একটুকুতেই কেমন হাপিয়ে উঠেছে মেয়েটা।শরীরটা প্রায় সময়েই অসুস্থ থাকে ওর।একসাথে এতোগুলো ধাক্কা যে মেয়েটা কিভাবে সামলেছে তা ও নিজেই বলতে পারবে না।মায়ের মৃত্যুর পর থেকে যেন একমুহূর্তের জন্যে চোখের আড়াল হতে দেখলে ওর বুক কাঁপে।হৃদয় অস্থির হয়ে উঠে।নানান কুচিন্তা মাথায় আসে।তখন আর সামলাতে পারেনা নিজেকে।মা, বাবাকে হারিয়ে মেয়েটার মনে প্রচুর ভয় ঢুকে গিয়েছে।এখন অর্থকে নিয়ে সারাক্ষন ভয় হয় ওর।কলিজাটা যেন মনে হয় কেউ চাপ সৃষ্টি করে ওকে মেরে ফেলার তোরজোর করে।অর্থকে হারানোর ভয় হয় ওর প্রতিটা ক্ষনে ক্ষনে। একে একে সব হারিয়ে নিঃস্ব প্রাহি।এখন অর্থই ওর সব।অর্থ’র কিছু হলে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না প্রাহি। ইদানিং লোকটানে নিয়ে নানান কুচিন্তা মাথায় আসে ওর।তাই তো অর্থকে কোথায় যেতে দেয়না।প্রাহির এমন স্বভাব নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলেছে অর্থ।তিনি জানিয়েছেন,এই সময় মেয়েদের মন খুব নাজুক থাকে।তারা প্রতি ক্ষনে ক্ষনে প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্য চায়।নিজের সকল,ভালোলাগা,খারাপ লাগা সব প্রিয় মানুষটিকে ঘিরে থাকে।তাদের প্রতি অল্পতেই অভিমান জমে আবার অল্পতেই তা সরে যায়।আর প্রাহি একে একে এতো দুটো আপন মানুষের মৃত্যু দেখে ওর হৃদয় সর্বদা ভয়ে তটস্থ থাকে অর্থকে নিয়ে।আর এই সময় মুডসুয়িং হয় এটা নরমাল ব্যাপার। কখনো এই কাদঁবে তো কখনো এই হাসবে।কখনো রাগ করবে কখনো অভিমান করবে আবার কখনো বাচ্চাদের মতো আহ্লাদী হবে প্রিয় মানুষটির কাছে। এই সময়টাই এমন।যে মা হয় সেই বুঝতে পারে প্রেগন্যান্সির সময় কতোটা চেঞ্জ হয়ে যায় ক্ষনে ক্ষনে।দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রাহি।সিড়ি বেয়ে উঠে হয়রান হয়ে গিয়েছে।ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকাতেই রুমের লাইট জ্বলে উঠে।চমকে যায় প্রাহি।তৎক্ষনাৎ চাপা স্বরে হালকা আওয়াজ করে ঘুরে দাড়ায়।সাথে সাথে ভয় পেয়ে যায় প্রাহি।অর্থ ওর দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।চোখজোড়া লাল হয়ে আছে।চোয়াল শক্ত।ভীতু প্রাহি কি করবে বুঝে উঠতে পারলো নাহ।আমতা আমতা করে কিছু বলবে তার আগেই অর্থ দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে শক্ত হাতে প্রাহিকে কোলে তুলে নেয়।হালকা ব্যাথা পেয়েছে প্রাহি কোমড়ে।মুহূর্তেই আঁখিকোটরে নোনাজলেরা ভীড় জমায়।তাও মুখ দিয়ে টু পরিমান শব্দ করে না মেয়েটা।অর্থ প্রাহিকে নিয়ে বিছানায় বসালো।চোয়াল শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

-‘ বেশি বাড় বেড়েছে তোমার?পাকনামি শিখে গেছো?একা একা নিচে কেন গেলে?যদি কিছু হয়ে যেতো?কি হলো কথা বলো?’

লাস্ট বাক্যটা ধমকের সুরে বললো অর্থ।প্রাহি নাজুক হৃদয়ে আঘাত লাগে বড্ড। এইভাবে ধমকানোর কি আছে?ও তো লোকটার ভালোর জন্যেই ডাকেনি।আর ওরও কিছু হয়নি তাও এইভাবে ধমকাধমকির কোন মানে আছে?প্রাহি চোখে জল দেখে আরো রেগে গেলো অর্থ।শক্ত কন্ঠে বলে,

-‘ একফোটা অশ্রু যেন গাল গড়িয়ে না পরে।আর এইভাবে একা একা আমাকে না বলে নিচে যাওয়ার সাহস কোথায় পেলে?পানি তৃষ্ণা পেয়েছে আমায় বলতে। আমি একে দিতাম।কেন আমাকে তো জ্বালাও প্রাহি?কেন এতো অবুঝের মতো করো?’

শক্ত হয়ে বসে রইলো প্রাহি।একটু আওয়াজও করলো নাহ।অর্থকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে চুপচাপ উল্টোদিকে ফিরে সুয়ে পরলো।অর্থ বুঝলো এখন আর কথা বলবে না ওর সাথে।অর্থ চোখ বন্ধ করে লম্বা লম্বা দম নিলো।শ্বাসটা আটকে গিয়েছিলো যখন অনুভব করছিলো ওর বুকটা খালি খালি।ঘুমের ঘোরে পাশ হাতরে কাঙ্খিত মানুষটির অস্তিত্ব অনুভব করতে না পেরে।দ্রুত উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেখে কোথাও নেই প্রাহি বারান্দায়, ওয়াশরুমে না পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে যায় অর্থ’র।পাগলপ্রায় হয়ে বাহিরে বের হতে নিলেই দেখে দরজা খোলা।আরো অস্থির হয়ে যায়।একা একা কোথায় গেলো মেয়েটা।অর্থ বাহিরে বের হতে নিতেই দেখে ধীরে ধীরে সিড়ি বেয়ে উপরে আসছে প্রাহি।এইটুকুতেই কেমন হাপিয়ে উঠেছে।অর্থ প্রাহি উপরে উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো।প্রাহি উপরে আসতেই অর্থ রুমে ঢুকে লাইট নিভিয়ে দেয়।যাতে বুঝতে না পারে প্রাহি।চোখ খুললো অর্থ।সুয়ে পরলো নিস্তব্ধে প্রাহির পাশে।প্রাহি কোমড়ে আলতো হাত ছোঁয়াতেই তা ঝটকা মেরে সরিয়ে দেয় প্রাহি।হাসে অর্থ।এইবার প্রাহি সাথে আরেকটু ঘনিষ্ট হয়ে প্রাহিকে পেছন হতে জড়িয়ে ধরে একেবারে বুকের সাথে লাগিয়ে নেয়।প্রাহির কানে ফিসফিস করে অর্থ বলে,

-‘ কথা বলবে নাহ?’

প্রাহি খানিকক্ষন চুপ থাকলো তারপর অভিমানি কন্ঠে বলে,

-‘ আপনি আমাকে ধমকেছেন।আবার আমার কোমড়ে শক্ত করে ধরেছেন।আমি ব্যাথা পেয়েছি।’

প্রাহি মুখে ব্যাথার কথা শুনে আতকে উঠে অর্থ। অস্থির হয়ে দ্রুত উঠে বসে।টেবিলল্যাম্প জ্বালিয়ে জামাটা অল্প উঠিয়ে ভালোভাবে চেক করে।কিছু না দেখতে পেয়ে।অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,

-‘ কোথায় ব্যাথা লেগেছে?বেশি ব্যাথা পেয়েছো?ডাক্তারকে ফোন করবো?’

প্রাহি দ্রুত উঠে বসে। অর্থ হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,

-‘ অতোটাও ব্যাথা পায়নি।অস্থির হবেন না।তখন একটু শক্ত করে কোলে নিয়েছিলেন তাই হালকা ব্যাথা পেয়েছিলাম কোমড়ে।এখন আর নেই।সত্যি বিশ্বাস করুন।’

অর্থ প্রাহির গাল স্পর্শ করলো।সকল ভালোবাসা ঢেলে চুমু দিলো প্রাহির কপালে।ধরা কন্ঠে বলে,

-‘ আমি সরি প্রাহি তখন রাগের মাথায় তোমাকে ব্যাথা দিয়ে দিয়েছি।আমি আসলে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম ঘুম থেকে উঠে তোমাকে না দেখে।’

-‘ ইট্স ওকে।হয়েছে আর সরি বলতে হবে নাহ।আমার ঘুম পাচ্ছে ঘুমাবো।’

মুচঁকি হেসে বলে প্রাহি।অর্থ হালকা হেসে প্রাহিকে বুকে টেনে নিয়ে সুয়ে পরলো।

________________
সকাল সকাল প্রাহি ঘুম থেকে উঠেই বলছে ওর নাকি খিদে পেয়েছে।আর ও এখন ঝাল ঝাল মরিচ ভর্তা দিয়ে গরম গরম ভাত খাবে।এইটা শুনেই অর্থ’র মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।ধমকে ধামকেও মানাতে পারেনি।অগত্য হেনা বেগম এসে বুঝিয়েছেন সামান্য একটু খেলে কিছু হবে নাহ।এখন প্রাহি খাটের উপর বসে আরামসে খাচ্ছে।আর অর্থ সোফায় বসে অন্যান্য কাজ করছে আর একটু পর পর রাগি দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে প্রাহির দিকে।খাওয়া শেষে চওড়া হাসি দিলো প্রাহি।অর্থকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-‘ দেখেছেন আমি কতোগুলো ভাত খেয়েছি?অন্য সময় কি আমি এতোগুলো ভাত খাই?’

অর্থ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

-‘ হ্যা কতো মহান কাজ করেছো।আমি যেগুলো দিয়ে খাওয়াই তাতে এক দু গাল খেলেও তাতে কিছু পুষ্টি তো ছিলো।কিন্তু তুমি যা দিয়ে খেয়েছো এইগুলো দিয়ে খেলে কিছুই হবে না।এইগুলাতে আরো ক্ষতি শরীরের।’

-‘ হ্যা সবসময় তো আপনি যা করবেন তাই সঠিক।আমি কিছু করলেই দোষ।’

অর্থ কিছুই বললো না।এই মেয়েটাকে বুঝিয়ে লাভ নেই।হঠাৎ কিছুসময় যেতেই প্রাহি উঠে দৌড়ে বাথরুমে চলে যায়।অর্থও ভয় পেয়ে প্রাহির পিছন পিছন যায়।প্রাহি যা খেয়েছিলো সব উগলে দিয়েছে।অর্থ দুহাতে প্রাহির মাথা চেপে ধরে আছে।মুখ ধুয়ে প্রাহি হেলান দিয়ে দাড়ালো অর্থ’র সাথে।অর্থ অসহায় কন্ঠে বলে,

-‘ বেশি খারাপ লাগছে?আর বমি হবে?’

প্রাহি মাথা নাড়াতে দেরি।আবারও বমি করে দেয়।অর্থ প্রাহির হাত মুখ ধুইয়ে দিয়ে আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করে দিলো।প্রাহিকে কোলে নিয়ে বিছানায় গিয়ে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসলো।প্রাহি চোখ বুঝে আছে।অর্থ নরম সুরে ডাকলো,

-‘ প্রাহি!’

প্রাহির ক্লান্ত চোখজোড়া মেলে তাকায়।অর্থ বললো,

-‘ বেশি খারাপ লাগছে?’

প্রাহি জোড়পূর্বক হেসে বলে,

-‘ একটু তো খারাপ লাগবেই।ও কিছু না এটা সবারই হয়।আপনি শুধু চিন্তা করবেন নাহ!’

প্রাহির কথায় অর্থ চিন্তা কমলো নাহ একটুও।চিন্তিত স্বরে বলে,

-‘ এমনিতেও তো তোমার চেক-আপের সময় হয়ে এসেছে।এখন থাক।বিকেলে তোমায় নিয়ে একবার হাসপাতালে যাবো।চেক-আপ করিয়ে দেখি আসি সব ঠিক ঠাক আছে কিনা।’

-‘ উফ! আপনি কেন এতো ভাবেন বলুন তো?কিছু হবে নাহ।’

অর্থ প্রাহিকে বুকে টেনে নিলো।প্রাহির কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-‘ তোমাকে নিয়ে চিন্তা করবো না তো কাকে নিয়ে করবো বলো?এখন তো আরেকজন আছে।আমার দুটো ভালোবাসা।তাদের কিছু হলে আমি কিভাবে ঠিক থাকবো বলো?তাই তো সবসময় তোমাদের নিয়ে চিন্তায় থাকি।’

প্রাহি বললো,

-‘ আল্লাহ্ ভরসা কিছু হবে না দেখিয়েন।’

-‘ তাই যেন হয়।’

#চলবে__________

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে