#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ০৩
ব্যস্ত নগরী দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহরের একটা ষাট তলা ভবনের চল্লিশ তলা ফ্লোরটি পুরোটা একটা অফিস। অফিসের একটা রুমে মিটিং এ ব্যস্ত কয়েকজন লোক।তাদের মাঝে সবার মধ্যাকর্ষন হলো অর্থ।পুরো নাম অর্থ শিকদার।দ্যা ওউনার ওফ শিকদার এম্পায়ার।যে খুব দক্ষতার সাথে মিটিং করতে ব্যস্ত।প্রায় আধাঘন্টা পর মিটিং শেষ হতেই।মিটিং রুম থেকে একে একে বের হয়ে গেলো সকলে।রয়ে গেলো শুধু অর্থ।অর্থ এক কাপ কফি বানিয়ে নিলো।তারপর কফি হাতে সে বিশাল কাচের দেয়ালটার সামনে দাঁড়িয়ে সিউলের রাতের শহর উপভোগ করতে লাগলো।আকাশে আজ সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে।চাঁদের পাশে মিটিমিটি জ্বলছে তারাগুলো।থেকে থেকে কোথা যেন কারা আকাশে আতশবাজি ফুটাচ্ছে।চমৎকার সুন্দর দেখাচ্ছে। সুদর্শন,সুঠাম দেহি,চমৎকার গড়নের গম্ভীর মুখশ্রী, ব্রাউন রঙের চোখের অধিকারি এই ব্যাক্তিকে যেকোন মেয়ে তাদের জীবনসঙ্গী বানাতে একপায়ে প্রস্তুত।তবে আদৌ কি এই পুরুষটি তার মনের মতো জীবনসঙ্গী পাবে?বয়স তো কম হলো না।ত্রিশ পার হয়ে একত্রিশে পরলো।এই একত্রিশ বছর জীবনে আজও কাউকে নিজের মনের মতো পেলো না।ফ্যামিলি থেকে দেশে গিয়ে বিয়ে করার চাপ দিচ্ছে ক্রমাগত তাকে।কিন্তু অর্থ তাদের কিভাব বুঝাবে?অর্থ যেমন ভালোবাসার মানুষটি চাইছে তা তো সে পাচ্ছে না।তাহলে কিভাবে কাউকে সে নিজের জীবনে জড়াবে।আর অর্থ জানেও তার মতো এমন রষকষহীন গাম্ভীর্য পূর্ণ ব্যাক্তিকে কেউ ভালোবাসতে পারবে না।সবাই তো শুধু ওর বাহ্যিক সৌন্দর্য দেখে ওর কাছে আসে।মন থেকে ভালোবেসে কাছে আসে না কেউই।তাই অর্থও চায়না কাউকে নিজের জীবনে জড়াতে।সে একাই বেশ ভালো আছে। কফি শেষ হতেই ভাবনাও শেষ হয়।সব কিছু গুছিয়ে অফিস থেকে যেতে হবে।এই বিল্ডিংয়েরই ৫২ তলা ফ্লোরে ওর ফ্লাট।সেখানেই ও থাকে। কাজের মাঝে হঠাৎ একটা মেয়ের কন্ঠে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে অর্থ।
-‘ ওহ বেবি আই মিস্ড ইউ সো ব্যাডলি। নট আ ড্যে ওয়েন্ট বায় দ্যাট আই ডিডন্ট থিং এব্যাউট ইউ।’
ইলফা ন্যাকা কন্ঠে কথাগুলো বলে অর্থর কাছে আসতে নিলেই অর্থ।ঠান্ডা অথচ গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
-‘ হুয়াই? কুডন্ট ইউর লাভার্স মেক ইউ হ্যাপি ইন বেড?দ্যাট্স হুয়াই আই রিমেমভার ইউ?দ্যেন লিসেন টু মি, ডু ওয়ান থিংক গো টু আ ব্রোথেল হেয়ার টু সেটিস্ফাই দ্যা ডিজায়ার্স ওফ দ্যা বডি।ইট উইল ডু টু থিংক্স এট দ্যা সেম টাইম উইল সেটিস্ফাই দ্যা ডিজায়ার্স ওফ দ্যা বডি এন্ড উইল ওলসো গেট এক্সট্রা মানি।’
শান্ত কন্ঠের অর্থর এরকম অপমানজনক কথায় মুখটা চুপসে একটুখানি হয়ে যায় ইলফার।অর্থ রাগি চোখে এক পলক ইলফার দিকে তাকিয়ে গটগট পায়ে চলে গেলো অফিস থেকে।যাওয়ার আগে ওর গার্ড্সদের বলে গেলো।ইলফাকে যেন ওর অফিস থেকে বের করে দিতে।
—————–
রুমে এসে রাগে ওর গায়ের কোটটা সোফায় ছুড়ে মারলো অর্থ।এই মেয়েটাকে একদম সহ্য হয়না অর্থ’র।এতো অপমান করে এইটাকে অর্থ তাও বারবার চলে আসে মুখ উঠিয়ে।এদিকে অর্থ’র দিকে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে আছে ওর বেস্টফ্রেন্ড আরাফ।আরাফ ফোনে গেম্স খেলায় ব্যস্ত ছিলো।অর্থকে এমন রাগে জোয়ালামুখী হয়ে আসতে দেখে ভ্রু-কুচকে এতোক্ষন বুঝার চেষ্টা করছিলো হয়েছেটা কি?এইবার না পেরে প্রশ্ন করেই ফেললো আরাফ,
-‘ কিরে কি হয়েছে?এমন রাগে ফোসফোস করছিস কেন?’
অর্থ রাগি চোখে আরাফের দিকে তাকালো।শক্ত কন্ঠে বললো,
-‘ দ্যাট স্টুপিড গার্ল।আই জাস্ট হেট হার।এতো অপমান করি তাও বার বার চলে আসে।কবে জানি আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওকে গলা টিপে মেরে ফেলি।শুধু মাত্র তোর কাজিন দেখে কিছু বলিনা।ও যদি আমার বোন হতো এতোক্ষনে থাপড়ে সোজা করে ফেলতাম।’
আরাফ করুন চোখে তাকালো।বন্ধুর এতোটা রেগে যাওয়ার কারন এইবার বুঝতে পারলো ও।ও নিজেও বেশ বিরক্ত ইলফার উপর।মেয়েটাকে যে ধমকে ধামকে অথবা থাপড় মেরে কিছু বলবে তারও কোন উপায় নেই।কিছু থেকে কিছু হলেই এই মেয়ে ন্যাকা কান্না কেঁদেকেটে ওর বাবার কাছে বিচার দেয়।বাবা মরা মেয়েকে আরাফের বাবা অনেক স্নেহ করেন তাই শুধু ইলফার কথা শুনেই আরাফকে ওর বাবাকে রাগারাগি করে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো আরাফ। বললো,
-‘ রাগিস না অর্থ।ও একটু এমনি।শাষন তো করতেই চাই।কিন্তু বাবার জন্যে পারি না।আমার সমস্যাটা একটু বুঝ।তুই একটু শান্ত হো।’
-‘ গো টু হেল উইথ ইউর প্রোবলেম।’
রাগে কিরমির করতে করতে ওয়াশরুমে চলে গেলো অর্থ।আরাফ ভাবে এই মানুষটার যে কেন এতো রাগ?কে যে অর্থকে সামলাতে পারবে।এমন কি কেউ নেই?যে ভালোবাসা দিয়ে অর্থকে আগলে রাখবে? ফোনের রিংটোনে ধ্যানভঙ্গ হয় আরাফের।দেখে অর্থ’র ফোন বাজছে।আরাফ চেঁচিয়ে বলে উঠে,
-‘ অর্থ তোর ফোন এসেছে।’
অর্থ’র জবাব শোনা যায়,
-‘ আসছি।’
মিনিট দুয়েক পরেই বের হয়ে আসে অর্থ।ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ওর মা রায়হানা বেগম কল করেছেন বাংলাদেশ থেকে।অর্থ চোখ বুজে নিজেকে ঠান্ডা করে ওর মাকে কল ব্যাক করে,
-‘ হ্যালো মা আসসালামু আলাইকুম! ‘
রায়হানা বেগম কাঁদো কন্ঠে বলে,
-‘ আলাইকুমুস সালাম! কেমন আছিস বাবা?’
-‘ ভালো তুমি কেমন আছো?’
-‘ তোকে ছাড়া কিভাবে ভালো থাকি বাবা?জলদি চলে আয় না আমার কাছে।আর কতো পরের দেশে পরে থাকবি?মা’র কথা কি মনে পরে না একটুও?’
বলতে বলতে রায়হানা বেগম কেঁদে দিলেন।অর্থ বিরক্ত হলো বেশ।ওর এইসব কান্নাকাটি একদম ভালো লাগে না।তারপরেও গলার স্বর যথাসম্ভব নরম করে বলে,
-‘ মা স্টোপ ক্রায়িং।এভাবে কাঁদলে হবে?ওকে ফাইন আমি আর দু’দিন পরেই আসছি।নাও হ্যাপি?’
রায়হানা বেগম ছেলের মুখে ‘ দু দিন পর আসবে!’ শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে গেলেন।উচ্ছাসিত কন্ঠে বলেন,
-‘ সত্যি বাবা?সত্যি তুই আসবি?আমি এখনি সবাইকে বলে আসি হ্যা?ইসস আমার কতো আনন্দ লাগছে।’
রায়হানা বেগম ফোন রেখেই ছুটে গেলেন সবাইকে জানাতে তার ছেলে আসবে দেশে।এদিকে অর্থ’র ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।মা’কে এতো খুশি দেখে ওর নিজেরও ভালো লাগছে।ওর মা এই বয়সে এসেও কেমন বাচ্চামো করেন।ছোট ছোট বিষয়েই বাচ্চাদের মতো খুশি হয়ে যান।এইযে দেখো এখনই খুশির চোটে কলটাও কাটতে ভুলে গিয়েছে।অর্থ নিজেই ফোনটা কাটতে নিলে ফোনের স্ক্রিনে কিছু একটা দেখে থমকে যায়।রায়হানা বেগম ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে কথা বলছিলেন। উনি যেখানে বসেছিলেন ঠিক তার পিছনেই দোতলার সিড়ি।সেখানেই দেখা যাচ্ছে দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে তার মধ্যে একজন মেয়ে হেমন্তকে মারছে আর একজন ওদের থামানোর চেষ্টা করছে।মেয়েটার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।কোমড় সমান চুলগুলো এলোমেলো হয়ে চেহারাটা প্রায় ঢেকে দিয়েছে।তাও কেন যেন অর্থ’র সেটা দেখতে ভালো লাগছে।বুকের কোথায় যেন একটা কিছু প্রচন্ড হাঁসফাস করতে লাগলো শুধু একটি পলক মেয়েটাকে দেখার জন্যে।
-‘ কিরে?কি দেখছিস ওমন করে?বাহিরে যাবি নাহ?আজ তো একটা পার্টি আছে।’
আরাফের কথায় ছিটকে চোখ সরিয়ে নিলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে।এতোক্ষন সে কি করছিলো? একটা অচেনা মেয়েকে দেখার জন্যে ওর এতো ব্যাকুলতা কিসের?কেন এতো অস্থির লাগছিলো?নাহ এইসব উল্টাপাল্টা ভাবা যাবে না।রাগে মাথাটা থপ করে উঠে।সাথে সাথে কলটা কেটে দেয় অর্থ।আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-‘ আমি রেডি হয়ে আসছি।তুই গাড়ি বের কর।’
বলেই নিজের রুমে চলে গেলো অর্থ।মনে মনে ভাবলো আজ দিনটাই কেমন যেম এলোমেলো গেলো ওর।
—————-
রায়হানা বেগমের মুখে অর্থ দুদিন পর আসবে শুনে।খুশিতে বাকহারা হয়ে গিয়েছে প্রাহি।আনন্দে ওর চোখে অস্রুরা এসে ভীর জমিয়েছে।চোখ জোড়া জলে টইটুম্বুর! তা দেখে ইশি বলে,
-‘ কিরে কাঁদছিস কেন?’
প্রাহি যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিলো। বললো,
-‘ ওই হেমন্ত মারার সময় চোখে কিছু একটা গিয়েছে বোধহয়।বাদ দে।তবে আর কতোক্ষন থাকবো বাড়িতে যাবি না।হেমন্তকে বলে আসি চল বাড়ি যাবো।’
ইশিও সম্মতি জানালো।অবশেষে হেমন্তকে বলে ওরা যার যার বাড়ি চলে গেলো।আসলে এখন প্রাহি নিজের বাড়িতে গিয়ে দরজা আটকে কান্না করবে।ওর আনন্দটা আজ হিসেব ছাড়া।ঠিক কতোটা খুশি ও আজ তা ওর চোখের অস্রুদানা গুলোই বলে দিচ্ছে।অবশেষে! অবশেষে ওর ভালোবাসার মানুষটি আসতে চলেছে।এইবার আসলে আর তাকে যেতে দিবে না প্রাহি।একেবারে নিজের বাহুডোরে আটকে রাখবে।ভাবতে ভাবতে অস্রুচোখেও হেসে ফেললো প্রাহি।
#চলবে_______
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।