#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৭
প্রাহি ভয়ে মুখ কাচুমাচু করে রেখেছে।আর অর্থ গভীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এখনো ওর দিকে তাকিয়ে আছে।প্রাহি অর্থ’র এমন ভয়ানক দৃষ্টি দেখে ওর গলা শুকিয়ে আসছে বারবার।তাও মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে বললো,
‘ এইভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? হ্যা?’
অর্থ নিজের স্থান বজায় রেখে বলে,
‘ কিভাবে?’
প্রাহি মুখটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে কোনরকম বলে,
‘ মনে হচ্ছে আমাকে খেয়ে ফেলবেন এমন দৃষ্টি দিচ্ছেন!’
অর্থ ঝুকে এলো প্রাহির দিকে।প্রাহি ভড়কালো,থমকালো। দৃষ্টি হলো এলোমেলো।অর্থ প্রগাঢ় কন্ঠে আওড়ালো,
‘ পারলে তোমাকে খেয়েই নিতাম।তাহলে মনে মনে শান্তি তো পেতাম যে তুমি আমার ভীতরে আছো।কিন্তু আমি তো তা করতে পারছি না।এখন তোমায় নিয়া আমার মাথায় একগাদা টেন্সন সবসময় ভর করে থাকে।অসহ্য,কেয়ারলেস একটা মেয়ে!’
প্রাহি খারাপ লাগলো অর্থ’র কথায়।অর্থ’ প্রতি একবুক অভিমান নিয়ে ভালো হাতটি দিয়ে অর্থকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে দিতে চাইলো।অর্থ বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলে,
‘ কি সমস্যা এমন করছো কেন?’
‘ সরুন!’ প্রাহি কন্ঠে কান্নার আভাস স্পষ্ট টের পেলো অর্থ।চোখ বুজে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরে গেলো অর্থ।যা মন চায় করুক।আর কিছু বলবে না অর্থ।কিছু বললেই হলো কেঁদেকেটে সমুদ্র বানিয়ে ফেলে।আর সেই কান্না দেখে অর্থ’র বুকে ব্যাথা উঠে।তাই অর্থ ওকে আর কিছু বলবে না।যা মন চায় করুক প্রাহি। ও শুধু তামাশা দেখবে মেয়েটার।যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে অর্থ এইবার আর নিজেকে থামিয়ে রাখবে না।কষে চড় মেরে দিবে।অনেক বার বেড়েছে মেয়েটা!
অর্থ টানটান হয়ে সুয়ে চোখের উপর হাত দিয়ে সুয়ে পরলো।প্রাহির অভিমান আরো একধাপ বারলো।প্রাহি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতে করতে নিশব্দে বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো।কথা বলবে না প্রাহি আর লোকটার সাথে।কিভাবে ওকে ছাড়াই ঘুমিয়ে পরলো।প্রাহি আজ যাবেই না বিছানায় ঘুমোতে।ও বারান্দার ফ্লোরে পাতানো বিছানায় গিয়ে বসলো।অভিমানি দৃষ্টি নিয়ে তাকালো নীকষ কালো আসমানের পানে।কিযে হয় প্রাহির প্রাহি নিজেও বুঝে না।এই লোকটার সামনেই কেন এতো কান্না পায় প্রাহির?কেন এতো দূর্বল হয়ে পরে?লোকটা সামনে থাকলে প্রাহি কেমন যেন অনেক আহ্লাদি হয়ে যায়।বাচ্চাদের মতো করে কেমন সবসময়।ভালোবাসলে কি তাহলে মানুষ তবে নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে?হয়তো! তাইতো প্রাহির সাথেই এসব হচ্ছে।প্রাহি আকাশের দিকে একমনে তাকিয়েই মনে মনে বলে,
‘ আচ্ছা অর্থ আপনি কি এই দুমাসেও কি আমায় ভালোবাসতে পারেননি?ভালোবাসেন না আমায়?
আপনি কি মোহ পড়ে আমায় বিয়ে করেছেন?মোহ কেটে গেলে তো আমারও কোন দাম থাকবে না আপনার জীবনে।তখন হয়তো নিশ্চয়ই ছুড়ে ফেলে দিবেন আমায়।কিন্তু আমি? আমি কিভাবে থাকবো আপনাকে ছাড়া?আমি তো নিঃস্ব অর্থ।আমার যে কেউ নেই! আমি বড্ড ভালোবাসার কাঙ্গাল অর্থ।আপনার ভালোবাসার কাঙ্গাল।’
প্রাহির গাল বেয়ে চোখের পানি গড়িয়ে পরলো।বাবার কথা মনে পরছে খুব করে।প্রাহি বিরবির করে বলে,
‘ বাবা,আমি তোমায় বড্ড মিস করছি। তুমি আমাকে কেন এইভাবে ফেলে চলে গেলে বাবা।তোমার প্রিন্সেসের কথা কি তোমার আর মনে পরে না বাবা?আমার তো তোমার কথা খুব করে মনে পরে।আমি ব্যর্থ সন্তান বাবা।আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি।না পারছি তোমার খুনিকে শাস্তি দিতে।আমি যে কোন পথ দেখছি না বাবা।আমি যে বড্ড দূর্বল।আমি কিভাবে সবকিছু সামলাবো বাবা।তুমি থাকলে ভালোবেসে মাথায় হাত রাখো না বাবা।তুমি থাকলে আমার কোন কিছুই কঠিন মনে হয়না।কিন্তু তুমি তো আসো না বাবা।আমি তোমায় এতো ডাকি তাও তুমি আসো না।’
প্রাহি চোখের জলগুলো মুছে নিলো। টেবিলের ড্রয়ারের লক খুলে ডায়রীটা হাতে নিলো।আজ ও আর ঘুমাবে না।আজ নিজের জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো পড়বে আর তা কল্পনা করে রাত কাটিয়ে দিবে প্রাহি।সেই সাথে ওদের ফ্যামিলি এলবামটাও নিলো।তারপর চুপিসারে আবারও বারান্দায় চলে গেলো।প্রাহি রুম থেকে যেতেই অর্থ চোখ মেলে তাকায়।অর্থ সজাগই ছিলো। প্রাহিকে বুকে না নিয়ে কি ওর ঘুম আসবে?উহুঁ কখনো না।সারারাত তাহলে ছটফট করে কাটাতে হবে ওকে।অর্থ কোন আওয়াজ না করে চুপিসারে বারান্দার দরজার সামনে আড়াল করে দাড়িয়ে রইলো।আর একদৃষ্টিতে নিজের উদাসিন স্ত্রীকে দেখতে থাকলো।এভাবে কেটে গেলো প্রায় একঘন্টা।প্রাহি ওর ডায়রী আর ফ্যামিলি এলবাম দেখতে দেখতেই ঘুমিয়ে পরেছে।অর্থ দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো।প্রাহির ঘুমানোর অপেক্ষা করতে করতে অর্থ’র পা দুটো ঝিম ধরে গিয়েছে।অর্থ প্রাহির কাছে বসে ওকে নিস্তব্ধে কোলে তুলে নিলো।খুব সাবধানে সুইয়ে দিয়ে আবারও বারান্দায় চলে এলো।ডায়রী আর এলবামটা গুছিয়ে রাখতে হবে। এলবামটা হাতে নিয়ে যখন ডায়রীটা হাতে নেয় অর্থ।ভ্রু-কুচকে যায় ডায়রীর প্রথম লিখাটা পরে।ডায়রীর উপরে সুন্দরভাবে লিখা ”My Family,Happinesses And My Love!’।অর্থ ডায়রীটা হাতে নিয়েই একপলক তাকায় ঘুমন্ত প্রাহির দিকে। My Love লিখাটা ভাবাচ্ছে অর্থকে।কে প্রাহির ভালোবাসা?ডায়রীটা অনেক পুরনো প্রায় সাত বছর আগের তারিখ দেওয়া আছে তা দেখেই বুঝেছে অর্থ।কিন্তু সাতবছর যাবত কাকে ভালোবাসে প্রাহি?অর্থ কি একবার ডায়রীটা খুলে দেখবে?কিন্তু কেমন যেন বিবেগ ওকে বাধা দিচ্ছে।এইভাবে কারো পার্সোনাল জিনিসে হস্তক্ষেপ করা অর্থ পছন্দ করে না।কিন্তু আজ কেমন যেন মন চাচ্ছে ডায়রীটা খুলে পড়তে।প্রাহির মনের কথাগুলো তো এই ডায়রীতেই লিখা তা নিজেও পড়ে অনুভব করতে চাইছে অর্থ।প্রাহি তো ওর স্ত্রী।স্ত্রীর সবকিছুতে ওর অধিকার আছে।পড়তেই পারে অর্থ ডায়রীটা।যেউ ভাবা সেই কাজ।এলবামটা জায়গা মতো রেখে দিলো অর্থ।ডায়রীটা নিয়ে বিছানায় সুয়ে টেবিলল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিলো।হঠাৎ প্রাহি একদম অর্থ’র কাছে এসে ওর সাথে লেপ্টে গুটিশুটি মেরে সুয়ে পড়লো।অর্থ নিশব্দে হাসলো।আধশোয়া হয়ে প্রাহিকে নিজের বুকে অতি সাবধানে আগলে নিলো।যাতে মেয়েটা ব্যথা না পায়। প্রাহিও অর্থ’র বুকের উষ্মতা পেয়ে আরো গুটিয়ে গেলো অর্থ’র বুকে।অর্থ প্রাহির এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে ওর কপালে সময় নিয়ে দীর্ঘ এক ভালোবাসার স্পর্শ দিলো।ঘুমের ঘোরেই প্রাহির ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো।একহাতে প্রাহিকে জড়িয়ে নিয়ে আরেকহাতে ডায়রী খুলে পড়া শুরু করে দিলো অর্থ।কিন্তু যতো পড়ছে ততোই অবাক হচ্ছে অর্থ।জীবনে মনে হয় এতোবড় ঝটকা ও কখনো পাইনি।বারবার বিষ্ময় নিয়ে প্রাহির দিকে তাকাচ্ছে অর্থ।পুরো ডায়রীটা পড়া শেষে অদ্ভূত হাসি ফুটে উঠলো অর্থ’র অধর কোণে।ডায়রীটা সন্তর্পনে বিছানার সাথে এটাচ্ড টেবিলের ড্রয়ারে তালা মেরে রেখে দিলো।তারপর এসে প্রাহিকে ভালোভাবে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বুজে বিরবির করলো,
‘তোমার জন্যে অনেক বড় সার্প্রাইজ আছে জান।শুধু তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও।আমি যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না।এ কি করলে তুমি আমার।আমার বুকের তোলপাড়গুলো কিভাবে থামাবো আমি প্রাহি? তোমার ছোট্ট মনে যে এতোকিছু ছিলো তা এইভাবে আমার থেকে লুকিয়ে ভালো করোনি জান। এরজন্যে তোমাকে কিযে করতে মন চাইছে।শুধু অসুস্থ তাই কিছু বললাম নাহ।জলদি সুস্থ হয়ে যাও।’
___________________
বিছানার এককোনায় বসে পা দুলিয়ে একের-পর এক চকলেট খাচ্ছে ইশি।আর ওর দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে আছে হেমন্ত।ইশি যে ওকে ইচ্ছে করে জ্বালাচ্ছে তা বেশভ ভালোভাবে বুঝতে পারছে হেমন্ত।একঘন্টা লাগিয়ে এই রাতে গোসল করেছে ইশি।সেই সাথে হেমন্ত’কেও ঠেলেঠুলে গোসল করার জন্যে বাধ্য করেছে।আর এখন এই একঘন্টা ধরে মনের সুখে চকলেট খাচ্ছে।হেমন্ত এইবার ধুপ-ধাপ পা ফেলে ইশির কাছে গেলো।ইশি দেখেও না দেখার ভান ধরে রইলো।হেমন্ত দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
‘ তুই কি এইভাবেই রাতটা পার করে দিতে চাইছিস?’
‘ ঘরটা অনেক সুন্দর করে সাজিয়েছে তাই নাহ?তোর আরো দশহাজার টাকা বেশি দেওয়া উচিত ছিলো। ‘ ইশির এমন খাপখেয়ালি কথা শুনে হেমন্ত’র মন চাচ্ছে ইশিকে বারান্দা থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে।কিন্তু নিজের একমাত্র বউ বলে কিছু করছে না হেমন্ত!রাগ নিয়ে হেমন্ত বললো,
‘ আমাকে রাগাস না ইশি।মেজাজ কিন্তু পুরাই ফোরটি নাইন হয়ে আছে।’
ইশি চকলেটে লাস্ট বাইট দিয়ে বিছানা থেকে উঠে যেতে নিলেই এইবার হেমন্ত ইশির হাত ধরে একটানে ওকে নিজের বুকে নিয়ে আসে।ইশি হকচকিয়ে যায় হেমন্ত’র কান্ডে।ইশি কিছু বলবে তার আগেই হেমন্ত ইশির ঠোঁটের চারপাশে লেগে থাকা চকলেটগুলোর দিকে নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজের জিহ্বা দ্বারা লেহন দিয়ে তা খেয়ে নিলো।ইশি কেঁপে উঠে হেমন্ত কাধ খামছে ধরে।সারাশরীর ভুমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠে।হেমন্ত ইশির লজ্জা মিশ্রিত মুখপানে চেয়ে নিজের মুখ এগিয়ে নিলো ইশির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে,
‘ ইশি আই নিড ইউ।আই নিড ইউ ফুললি।প্লিজ ইশি।তুই আমার অনেক প্রতিক্ষা,অপেক্ষার ফল।তুই আমার ভালোবাসা ইশি।ভালোবাসি তোকেপ।আজ তোকে পুরোপুরি নিজের করে চাই তোকে ইশি।দিবি সেই অনুমতি?’
ইশি কি বলবে লজ্জায় ওর কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে।বারবার শুকনো ঢোক গিলছে ইশি।হেমন্ত ইশির কোন রেস্পন্স না পেয়ে বুঝলো ইশি রাজি না।তাই ইশিকে ছেড়ে দিয়ে সরে আসতে নিতেই।ইশি চট করে চোখ মেলে তাকালো।আৎকে উঠে হেমন্ত’র কলার চেপে ধরলো।হেমন্ত ঘুরে ইশির দিকে তাকাতেই ইশি মুখশ্রী নিচু করে ফেললো।হেমন্ত ব্যগ্র কন্ঠে বললো,
‘ অনেক রাত হয়েছে ঘুমোতে চল ইশি।’
ইশি সাথে সাথে চোখ তুলে তাকায় হেমন্ত’র দিকে।ওর চোখে চোখ রেগে খানিক তাকিয়ে থেকে।হুট করে জড়িয়ে ধরে হেমন্তকে।লজ্জায় আড়ষ্ট কন্ঠে বলে,
‘ ভালোবাসবি না আমায় হেমন্ত?’
ইশির এটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো হেমন্ত’র জন্যে।ঠোঁটের কোনে প্রাপ্তির হাসি ফুটে উঠে ওর।সাথে সাথে ইশিকে কোলে তুলে নিলো। দুষ্টু হেসে বলে,
‘ আজ তো তুমি শেষ সুন্দরী!’
হেমন্ত’র মুখে তুমি ডাক শুনে মনে মনে শীতল স্রোত বয়ে গেলো ইশির।পরক্ষনে হেমন্ত’র বলা কথাটা স্মরন হতেই লজ্জায় মুখ লুকায় হেমন্ত’র বুকে।ইশিকে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে।হেমন্ত ইশির মায়াবী মুখশ্রীর দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।তারপর ইশির শরীরে নিজের শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে ইশির কপালে,গালে,নাকে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে ইশির ঠোঁটজোড়া নিজের ঠোঁটের ভাজে নিয়ে নিলো। আজ সম্পূর্ণভাবে পূর্ণতা পেলো ওদের ভালোবাসা।একে-অপরের অস্তিত্বে মিশে গেলো প্রগাঢ়ভাবে।ভালোবাসার এক অন্য জগতে হারিয়ে গেলো দুজন মানব-মানবী।
#চলবে__________
#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ২৮
সকালের নাস্তা করছে ইয়ং’রা। আজ তাদের ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে সবার।তাই তাদের দেরি হয়েছে ব্রেকফাস্ট করতে।বড়দের সবার ব্রেকফাস্ট শেষ।এদিকে প্রাহি বারবার ইশি আর হেমন্ত’র দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিচ্ছে।হেমন্ত’র তাতে কিছু যায় আসে না অবশ্য।কিন্তু ইশি ঠিকভাবে খাবারটাও খেতে পারছে না।প্রাহিকে খাবার খেয়ে এইভাবে দুষ্টুমি করতে দেখে চোখ অর্থ ওর দিকে না তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘ কেউ যদি এখানে খাবার না খেয়ে এইভাবে অন্যদের ডিস্টার্ব করতে চায় তাহলে সে যেন উঠে চলে যায়।অযথা খাবার কেন নষ্ট করছে বসে বসে?’
অর্থ’র এমন খোঁচা মারা কথায় মুহূর্তেই মুখটা কালো হয়ে গেলো প্রাহির। লোকটা সকাল থেকে এমন তেতো মুখে কথা বলছে।কি হয়েছে?কি করেছে প্রাহি? প্রাহি আর কোনকিছু বললো না চুপচাপ খাবার খেতে লাগলো।খাবার খাওয়া শেষে অর্থ ধুপ করে ওর প্লেটের কিনারে ওষুধগুলো দিয়ে উঠে চলে গেলো।প্রাহি অর্থ’র যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।চোখ ভরে আসতে চাইলেও নিজেকে সামলে নিলো প্রাহি।চুপ-চাপ ওষুধ খেয়ে নিলো।উঠে গিয়ে টিভি ছেড়ে সোফায় বসে পরলো প্রাহি।এদিকে আরাফ,হিয়া,হেমন্ত,ইশি সবাই তৈরি হয়েই নেমেছে।ওদের খাওয়া শেষে হিয়া চলে গেলো নিজের স্কুটি নিয়ে।অবশ্য আরাফ ফিসফিসিয়ে বলেছিলো ওকে আরাফের সাথে যেতে।কিন্তু হিয়া জেদ দেখিয়ে একাই চলে গিয়ে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।হিয়া আর হেমন্ত প্রাহির সাথে টুকাটাকি কথা বলে তারাও রওনা দিলো ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।প্রাহি সুস্থ্য হতে আরো একসপ্তাহের মতো লাগবে।তাই সে আপাততো যাচ্ছে না ভার্সিটি।হিয়া আর হেমন্ত ওকে সব পড়া নোট করে এনে দেয়।আর অর্থ ওকে পড়ায় বাসায়।এদিকে আরাফ অপেক্ষা করছে অর্থ’র জন্যে।আরাফ আর অর্থ দুজন মিলে একসাথে একটা ফ্যাশন হাইজ দিয়েছে।দুজনে এখন একসাথে এখন এই ব্যবসাটা সামলাবে।অবশ্য বিদেশেও ওদের ভিন্ন ভিন্ন বিজন্যাস আছে।আরাফের বাবা এতে ছেলের প্রতি অনেক ক্ষিপ্ত হয়ে আছে।তাতে অবশ্য আরাফের কিছু যায় আসে না। ব্যবসাটাও ভালোই চলছে।আরাফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দু-চারদিনের মাঝে একটা ফ্লাট কিনে সেখানে গিয়ে উঠবে।বন্ধুর বাড়িতে আর কয়দিন পরে থাকবে।নিজের কাছেই কেমন যেন দৃষ্টিকটু লাগে বিষয়টা আরাফের।তাছাড়া কয়দিন পর তো এমনিতেও এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে জামাই হবে আরাফ।তখন নাহয় ইচ্ছেমতো বেড়ানো যাবে।আপাততো সেকয়দিনের জন্যে একা একটু কষ্ট করে থাকতে হবে।এদিকে প্রাহি বারবার সিড়ির দিকে তাকাচ্ছে। অর্থ আসলে অর্থকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবে। ইলফাকে অর্থ কি করেছে?কোথায় রেখেছে?তা প্রাহি জানেনা। তাই সেই বিষয়েই জিজ্ঞেস করবে ভেবেছে।এই ক’দিনের ঝামেলায় জিজ্ঞেস করতে মনে নেই কিছু।কিয়ৎক্ষন বাদেই অর্থ নিচে নেমে আসে।আসতেই আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।একটা ইম্পোর্টেন্ট মিটিং আছে দেরি করা যাবে না।’
আরাফ মাথা ঝাকিয়ে চলে গেলো বাহিরে।প্রাহি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো।অর্থকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই অর্থ চিল্লিয়ে রায়হানা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,
‘ মা আমি চলে যাচ্ছি।তুমি একটু খেয়াল রেখো একজনের প্রতি।সে যেন দুপুরে খাবার খেয়ে ওষুধটাও সময় মতো খেয়ে নেয়।আমি দুপুরে আসতে পারবো না।মিটিং আছে একটা।আসছি!’
অর্থ প্রাহিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গটগট পায়ে বাহিরে চলে গেলো।এদিকে প্রাহি বিমুঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অর্থ’র যাওয়ার পানে।অর্থ কি রাগ করেছে প্রাহির উপর?এরকম ইগনোর করছে কেন প্রাহিকে?তবে কি কাল উনার কথা না শোনার কারনেই উনি এমন করছে?এটাই হবে।নাহলে তো অর্থ কখনই এমন করে না প্রাহির সাথে।প্রাহির কান্না পাচ্ছে ভীষনভাবে।তাই চুপচাপ নিজের শরীর ভালো লাগছে না বাহানা দিয়ে রুমে চলে গেলো। রুমে এসেও কি করবে ভেবে পাচ্ছে না প্রাহি।ওর কিছুই ভালো লাগছে।হঠাৎ টেবিলের উপর চোখ গেলো অর্থ’র ল্যাপটপ রাখা।লোকটার মিটিং আছে বললো তাহলে এইভাবে ল্যাপটপ রেখে যাওয়ার মানে কি?প্রাহির চিন্তা হলো লোকটা যদি ভুলে ল্যাপটপটা রেখে যায় তাহলে মিটিংটা করবে কিভাবে?প্রাহি চিন্তিত হয়ে অর্থকে তৎক্ষনাৎ ফোন করলো।কিন্তু ফোনটা রিসিভ হলো না।প্রাহি আবারো ট্রায় করলো একবার দুবার।কিন্তু কলটা ধরলো না অর্থ।৩য় বার কল করার পর বুঝতে পারলো অর্থ ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে।প্রাহির বুক ভার হয়ে আসলো কষ্টে।দুচোখ বেয়ে দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। প্রাহি নিজেকে সামলে নিয়ে টেবিল থেকে ল্যাপটপটা হাতে নিলো।সাথে সাথে ল্যাপটপের নিচে একটা চিরকুট পেলো।প্রাহি কৌতুহল নিয়ে চিরকুট খুলেই দেখতে পেলো গুটিগুটি অক্ষরের কিছু লিখা,
‘ খামোখা টেন্সন করে লাভ নেই।আমি ইচ্ছে করে ল্যাপটপ রেখে গিয়েছে।যাতে কেউ একজন বোর ফিল না করে।’
প্রাহি জানে এটা অর্থ’র লিখা।প্রাহি মুখ ভেংচি মারলো।ও শুধু শুধুই টেন্সন করছিলো বজ্জাত লোকটার জন্যে।প্রাহি ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় আরাম করে বসলো।নেটফ্লিক্স এপে ঢুকে কিছু হরর মুভি দেখতে লাগলো।মুভিটা পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগে আবারও উঠে গিয়ে কয়েকপ্যাকেট চিপ্স আর চকলেট নিয়ে এসে বসলো।এগুলো অর্থই এনে দেয় ওকে।প্রাহি প্রায় দু দুটো ডিব্বা পুরো ভরে রাখে এইগুলা দিয়ে।শেষ হওয়ার আগেই আবারও অর্থ এনে দেয়।এইভাবে মুভি দেখতে দেখতে কখন যে দুপুর হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারেনি প্রাহি।আজানের ধ্বনি শুনে দ্রুত উঠে বসে।এখন আরেকটা মুভি চলছে।সে পওস করে উঠে গোসল করে নামাজ পরে নিলো।নিচ থেকে রায়হানা বেগম ডাকছন দুপুরের খাবারের জন্যে।প্রাহি দ্রুত নিচে আসলো।নিচে এসে দেখে ইশি আর হেমন্ত ভার্সিটি থেকে এসে পরেছে।প্রাহি চেয়ারে বসতে বসতে বলে,
‘ কখন আসলি?’
হেমন্ত পানি খাচ্ছিলো। ইশিই জবাব দিলো,
‘ এইতো একটু আগেই।ফ্রেস হয়েই এখানে আসলাম খেতে মা আর বড় মা ডাকছিলেন।’
হেমন্ত পানি খাওয়া শেষ বলে,
‘ আমি তোকে একটু পর নোট্সগুলো দিয়ে যাবোনে।এখন ভালোভাবে খেয়ে নেয়।’
খাওয়া দাওয়া হলো।প্রাহি বেশি না কোনরকম দুতিন লোকমা খেলো।হেমন্ত চোখ রাঙ্গিয়ে বলে,
‘ এইটাকে খাওয়া বলে?তোর থেকে পাশের বাড়ির আন্টির ছয়বছরের ছেলেটাও বেশি খায়।’
প্রাহি রাগি চোখে তাকালো হেমন্ত দিকে।তেজি কন্ঠে বলে,
‘ একদম বাজে কথা বলবি নাহ।আমার পেট এমনিতেই অনেক ভড়া ছিলো।তাই খেতে পারিনি!’
‘ কেন কি খেয়েছিস?যে ভাত খেতে পারলি নাহ?’
‘ আসলে মুভি দেখতে দেখতে অনেকগুলো চিপ্স আর চকলেট খেয়েছি তাই আর ক্ষিদে নেই।’
হেমন্ত দাঁতেদাঁত চিপে বলে,
‘ খুব ভালো করেছিস।এখন ওষুধ খেয়ে নেহ।তোকে তো থাপড়ানো উচিত দিনরাত।ভাইয়া যে কি করে?তোকে প্রতিদিন তিনবেলা ভাতের বদলে থাপ্পড় খেতে দিতে পারে নাহ?’
প্রাহির মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।ও তেড়ে গিয়ে ওর ভালো হাত দিয়ে হেমন্ত’র চুল টেনে ধরলো,
‘ আমার সাথে না লাগলে তোর ভালো লাগে না তাই নাহ?তুই শুধু শুধু কেন লাগতে আসিস আমার সাথে?আমার একহাতে ব্যাথা তো কি হয়েছে?আমার আরেক হাত তো ভালো আছে তোর মাথার সব চুল ছিড়ে ফেলবো শয়তান ছেলে।’
এদিকে ব্যাথায় হেমন্ত চেঁচিয়ে উঠলো,
‘ মা, বড়মা তোমাদের রাক্ষসী বউমা আমার সব চুল ছিড়ে ফেললো বাচাও গো।’
রায়হানা বেগম আর হেনা বেগম এসে ছেলেমেয়েদের এমন বাচ্চামো কান্ড দেখে হেসে দিলেন।ইশি এককোনায় দাঁড়িয়ে হাসছিলো।তারা ইশিকে কারন জিজ্ঞেস করতেই ইশি সব বলায় তারাও ইশির সাথে তাল মিলিয়ে হেসে দেয়।ইশিকে এমনভাবে হাসতে দেখে হেমন্ত রাগি গলায় বলে,
‘ তোর মতো শাকচুন্নি বউ থাকলে শত্রুর কোন প্রয়োজন নেই পেত্নি একটা। স্বামির এমন কষ্ট দেখেও কিছু করছে না।নিষ্ঠুর মেয়ে!’
ইশি রাগি চোখে তাকালো হেমন্ত’র দিকে। বললো,
‘ ইশি আরো জোড়ে মার।আমার পক্ষ থেকেও দুটো বোনাস দে।আমাকে বলে আমি নাকি শাকচুন্নি আর পেত্নি।কতো বড় সাহস।নেহাতি আমি ভালো মেয়ে তাই প্রাহিকে দিয়ে তোকে মার খাওয়াচ্ছি।নাহলে নিজে এসেই মারতাম।’
হেমন্ত অসহায়ভাবে একবার ভাবিরূপে নিজের একবন্ধুকে দেখছে আরেকজন বন্ধুকে বউরূপে দেখছে।এ কাদের পাল্লায় পরলো হেমন্ত।অবশেষে উপায় না পেয়ে অনেক আকুতি মিনুতি করে প্রাহির থেকে ছাড়া পায় হেমন্ত।ছাড়া পেতেই একদৌড়ে ও পগাঢ়পাড়। ওর এমন অবস্থা দেখে ইশি আর প্রাহি হাসতে হাসতে শেষ।ইশিও চলে গেলো ওর রুমে।প্রাহিও নিজের রুমে চলে গেলো।তার এখনো মুভিটা দেখা বাকি।এখনো মুভির পুরো টুইস্ট বাকি আছে।প্রাহি গিয়ে আবারও মুভি দেখায় মনোযোগ দিলো।সারাদিন ও সুয়ে বসে মুভি দেখেই পার করেছে।বিকেলে শুধু উঠে হালকা নাস্তা খেয়েছে।আর ইশি আত হেমন্ত এবং হিয়ার সাথে ছাদে একঘন্টার মতো আড্ডা দিয়েছে।তারপর হেমন্তর থেকে নোট্সগুলো নিয়ে দুঘন্টা পড়েছেও।পড়া শেষে আবারও মুভি দেখতে বসেছে।নয়টা বাজলে রায়হানা বেগম খেতে ডাকলে বলে দিয়েছে, আপনার ছেলে আসলে খাবো মা প্লিজ। রায়হানা বেগম আর জোড় করেননি।প্রাহি অর্থ’র জন্যে অপেক্ষা করতে করতে দেখে সারে এগারোটা বাজে।লোকটার তো কোনদিন এতো দেরি হয়নি।তবে আজ কেন এতো দেরি হচ্ছে।লোকটা ইচ্ছে করে এসব করছে যাতে ওকে ফেস করতে নাহয়?প্রাহি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো।বিছানায় উপর হয়ে সুয়ে কাঁদতে লাগলো।হাতে ব্যাথাও পেলো একটু কিন্তু তাতে ভ্রুক্ষেপ করলো। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে প্রাহি তা নিজেও জানলো না।
#চলবে_________
ভুলগুলো ক্ষমা করবেন।