একথোকা কৃষ্ণচূড়া এবং আপনি পর্ব-১৫+১৬

0
1569

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৫
‘ কি করেছো আজ সারাদিন?হ্যা?ভার্সিটিতে গিয়েও তোমায় পায়নি।এইভাবে আমাকে ইগনোর করার মানে কি প্রাহি?’
অর্থ’র রাগি কন্ঠের প্রশ্ন শুনেও কোন ভ্রু-ক্ষেপ করলো না প্রাহি।নির্বিকার ভঙ্গিতে ও কাঁথা মুরি দিয়ে সুয়ে আছে।অর্থ’র রাগ যেন এইবার আকাশ ছুলো।এই মেয়েটার টেন্সনে ও সারাদিন অস্থির হয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়েছে।কোথায় কোথায় খুজে নি ওকে? বাসায় এসে জানতে পারে প্রাহি নাকি অনেক্ষন আগেই এসেছে বাড়িতে এসেই রুমে গিয়ে ডুকেছে আর নিচে আসেনি।খাবারের জন্যে ডাকলেও খেতে আসেনি।অর্থ সব শুনে দেখে এই মেয়ে ভর সন্ধ্যেবেলা কাথা মুরি দিয়ে সুয়ে আছে।কিছু জিজ্ঞেস করলেও জবাব দিচ্ছে না।অর্থ প্রাহির এমন মৌনতা সহ্য করতে পারলো না।প্রাহির কাথা সরিয়ে এক ঝটকায় প্রাহিকে উঠিয়ে বসিয়ে দিলো।তারপর দাঁতেদাত চিপে বলে,
‘ সারাদিন আমাকে পাগল বানিয়ে এখন অভিনয় করা হচ্ছে।সারাদিনে কতোবার ফোন দিয়েছি আমি হ্যা?একটা কল তো রিসিভ করবে?না তা করোনি।কি সমস্যা হ্যা তোমার?’
প্রাহি তাকালো না পর্যন্ত অর্থ’র দিকে।মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে।অর্থ এইবার রাগ সামলাতে না পেরে প্রাহির মুখ চেপে ধরে ওকে নিজের দিকে ঘুরালো। দাঁত খিচিয়ে বলে,
‘ প্রাহি ভালো হবে না কিন্তু এরকম করলে।কথার জবাব দেও।’
প্রাহি ব্যাথা পাচ্ছিলো গালে।তাই ও রেগে গিয়ে অর্থ’র হাত একঝটাকায় সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে,
‘ কেন জবাব দিবো আপনার কথার?কিসের কৈফিয়ত দিবো? হ্যা?’
অর্থ’র রাগি কন্ঠে,
‘ আমি তোমার হাজবেন্ড প্রাহি।’
প্রাহিও সমানতালে জেদ নিয়ে বলে,
‘ ওহ হ্যা! এখন তো আপনি আমার হাজবেন্ড।আর সকালবেলা কি অন্যকারো হাজবেন্ড ছিলেন?হ্যা?আপনি আমার হাজবেন্ড হলে আপনাকে অন্য মেয়ে কেন জড়িয়ে ধরবে হ্যা?কেন জড়িয়ে ধরবে?খুব ভালো লাগছিলো বুঝি ওই মেয়ের জড়িয়ে ধরা?’
অর্থ প্রাহির এইসব কথায় ভয়ংকর পরিমানে রেগে গেলো।ধাক্কা দিয়ে প্রাহিকে বিছানায় সুইয়ে দিয়ে নিজেও ঝুকে গিয়ে প্রাহির অধরে অধর মিলিয়ে দিলো।আকস্মিক এমন করায় প্রাহি কি রিয়েকশন দিবে ভুলে গেছে।মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।শরীর কাঁপছে ভীষনভাবে।হৃদস্পন্দন থেমে গিয়েছে।মনে হচ্ছে এখনি ও মারা যাবে।এটা কি করলো অর্থ?এইদিকে প্রথমে রাগের মাথায় চুমু খেলেও এখন সেটা ভালোবাসাময় স্পর্শ রূপান্তরিত হয়েছে।অর্থ চোখ বুঝে প্রাহিকে নিজের মনের মতো ভালোবাসছে।প্রাহি নিজের চোখ বন্ধ করে ফেললো।বন্ধ চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পরলো তপ্ত একফোটা জল।কিছুক্ষন বাদে অর্থ সরে আসলো।নেশাক্ত দৃষ্টিতে তাকালো প্রাহির মুখশ্রীর দিকে।মেয়েটা চোখ বন্ধ করে আছে।অর্থ প্রাহির পাশে সুয়ে প্রাহিকে নিজের বুকে টেনে নিলো।রাগ এখন অনেকটা কমে গিয়েছে ওর।অর্থ প্রাহির মাথায় আদুরে স্পর্শ করতে করতে নরম কন্ঠে বলে,
‘ তাকাও প্রাহি আমার দিকে।’
প্রাহি নিশ্চুপ।অর্থ আবারও বলে,
‘ তাকাবে নাহ?কেন আমাকে রাগাও প্রাহি?তুমি জানো রাগের মাথায় আমি অনেক উল্টাপাল্টা কাজ করে ফেলি।এইযে তোমাকে কতোটা হার্ট করে ফেললাম।চোখ খুলো প্রাহি।আচ্ছা আমি সরি।এইবার তাকাও প্রাহি।’
প্রাহির কোন সারাশব্দ পাওয়া গেলো না।কিন্তু কিয়ৎক্ষন বাদে বুকের উপর পানির স্পর্শ পেয়ে।প্রাহিকে বুকে নিয়েই তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো অর্থ।প্রাহির মুখটা দুহাতের আজলে নিয়ে দেখে প্রাহির কান্না করছে নিস্তব্ধে।এতে অস্থির হয়ে উঠলো অর্থ।প্রাহিকে বুকে জড়িয়ে ধরে অস্থির হয়ে বলে,
‘ হেই প্রাহি কাঁদছো কেন? আমি সরি প্রাহি।প্লিজ কেঁদো না প্লিজ প্রাহি।’
প্রাহি দুহাতে অর্থ’র পিঠ আকড়ে ধরলো।প্রাহি আরো মিশে গেলো অর্থ’র বুকের মাঝে।কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,
‘ আপনি সরি বলছেন কেন?প্লিজ অস্থির হবেন নাহ।আমি আপনার কারনে একটুও কষ্ট পাইনি।’
অর্থ প্রাহিকে আরো ভালোভাবে আকঁড়ে ধরলো।নরম গলায় বলে,
‘ কিন্তু আমি তো এটা ভালো করেনি।আমি তোমার অনুমতি ছাড়া তোমার সাথে…..।আমি সরি প্রাহি।’
প্রাহি মাথা উঠিয়ে তাকালো অর্থ’র দিকে।মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থেকে বলে,
‘ আমি আপনার স্ত্রী।আমাকে ছোঁয়ার অধিকার আপনার আছে।এতে এতোটা গিলটি ফিল করার কিছু হয়নি।এইভাবে বার বার সরি বলে আমাকে ছোট করবেন না প্লিজ।’
অর্থ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো প্রাহির দিকে।মেয়েটা কি সুন্দরভাবে সবটা সামলে নিলো।অর্থ এইবার সিরিয়াস হয়ে বললো,
‘ প্রাহি একটা কথা শুনে রাখো।আমার রাগটা না বড্ড খারাপ।আমার রাগ উঠলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।এইযে সকাল বেলা তুমি আমাকে কিছু না বলেই চলে গেলে এটা কি তুমি ঠিক করেছিলে?আমার ফোনটাও রিসিভ করোনি।আমার কতোটা টেন্সন হচ্ছিলো জানো তুমি?’
প্রাহি করূন গলায় বলে,
‘সরি আর এমন করবো না।আসলে সকালে আপনাকে আর ওই মেয়েটাকে ওই অবস্থায় দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।রাগ উঠেছিলো অনেক।তাইতো জলদি চলে গেলাম।নাহলে তখন রাগের মাথায় কিছু একটা করে ফেলতাম।তাই হেমন্তকে নিয়ে তাড়াতাড়ি সরে আসলাম ওখান থেকে।কারন আমি জানি আপনি ইচ্ছে করে ওই মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরেনি।ওই মেয়েটাই চিপকে ছিলো আপনার সাথে।’
প্রাহি কথায় অর্থ বাঁকা হাসলো।দুষ্টু কন্ঠে বলে,
‘ সকালে তাহলে কি তুমি জেলাস ফিল করেছিলে?’
প্রাহি থতমত খেয়ে গেলো অর্থ’র কথায়।আমতা আমতা করে বলে,
‘ আমি কেন জ্বেলার হবো আজব?’
‘তাহলে রাগ কেন লেগেছিলো?বলো বলো বলো?’
অর্থ’র খোচাখুচিতে প্রাহি রাগ নিয়ে স্বিকার করলো,
‘ হ্যা হয়েছি জ্বেলাস।জ্বেলাস কেন হবো না হ্যা?আমার সামনে আমার হাজবেন্ডকে অন্য একটা মেয়ে জড়িয়ে ধরবে আমার কি এটা দেখে তাহলে ড্যান্স করার দরকার ছিলো?’
অর্থ হাসলো প্রাহির কথায়।বলে,
‘ ড্যান্স করা লাগবে না।আপাততো খাবার খেলেই হবে।দুপুরে তুমি খাওনি।তোমার চক্করে আমিও খাইনি।চলো।না-কি আমাকে অন্য কিছু খাইয়ে পেট ভরিয়ে দিবে?ওইযে একটু আগে যেটা খেলাম।অবশ্য এতে আমার কোন সমস্যা নেই।আমি ওটা পেলে তো আরো খুশি হবো।’
অর্থ’র কথায় প্রাহির লজ্জায় লাল হয়ে আসলো।লজ্জায় এদিক ওদিক তাকিয়ে একদৌড়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে।অর্থ হেসে দিলো প্রাহির কান্ডে।উঠে গিয়ে নিচ থেকে খাবার নিয়ে আসলো।এসে দেখে প্রাহি এখনও বের হয়নি।অর্থ ওয়াশরুমে দরজা নক করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘ প্রাহি লজ্জা পরে পেয়েও।এখন বেরেও।ক্ষুদা পেয়েছে আমার।এসো একসাথে খেয়ে নেই।’
অর্থ’র কথায় ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো প্রাহি।এখনো মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে।লজ্জায় তাকাতে পারছে না অর্থ’র দিকে।বারবার অর্থ ওকে কিস করেছে সেটা চোখের সামনে ভেসে উঠছে।অর্থ প্রাহির হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসালো।এরপর দুজনে একসাথে খাবার খেয়ে নিলো।
____________
সকাল থেকে অস্থির হয়ে আছে হিয়ার মন।মনটা বড্ড ছটফট করছে।সকালের ঘটনার পর ও যখন ওর মা আর কাকিকে ডাকতে গিয়েছিলো এসে দেখে আরাফ আর ইলফা কেউ নেই।অর্থও নেই।হিয়া যে অর্থকে ফোন করে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে।কিন্তু জড়তা আর ভয়ের কারনে আরাফের কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারেনি।এতে অবশ্য অর্থই ওকে বলেছে যে আরাফ ইলফাকে নিয়ে ওদের বাড়িতে চলে গিয়েছে।সেই থেকে হিয়ার এই অবস্থা।মনটা বড্ড খারাপ ওর।সকালে দুজন একসাথে ঝগরা করলো।আর এখন কিনা সে নেই।বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে হিয়ার কাছে।কিন্তু কেন এমন লাগছে জানে না ও।আরাফের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে ওর।হিয়া দ্রুত পায়ে হেটে গেলো ওর মার কাছে। মার ফোন থেকে আরাফের নাম্বারটা নিয়ে আসলো।ওর মার কাছে আরাফের নাম্বার আছে।মাঝে মাঝে অর্থকে না পেলে ওর মা আরাফকে ফোন দিতো।বাংলাদেশ আর কোরিয়া দুটো নাম্বারই আছে।হিয়া বাংলাদেশি নাম্বারটা নিজের ফোনে উঠিয়ে ওর রুমে চলে আসলো।কিন্তু ফোন দিতে গিয়েও দিচ্ছে।বিরবির করে বললো,
‘ উফফ! কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।ফোন কি দেবো? না-কি দেবো নাহ?দুরু দিয়েই দেই।কি আর হবে খেয়ে তো ফেলবে না আমাকে তাই নাহ?’
যেই ভাবা সেই কাজ হিয়া আরাফকে ফোন করলো।প্রথমবার রিসিভ হলো না।কিন্তু দ্বিতীয়বার ফোনটা কেটে দিলো।হিয়ার এতে রাগ লাগলো।ও আবারও নাম্বারটায় কল দিতে যাবে।দেখে ওই নাম্বারটার থেকেই ওর ফোনে রিটার্ন কল আসছে।হিয়া কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করতেই অপাশ থেকে আরাফের কন্ঠ,
‘ তা ম্যাডামের এখন আমার কথা মনে হলো?’
হিয়া চমকে গেলো।আতঙ্কিত গলায় বলে,
‘ আপনি জানলেন কিভাবে এটা আমি?’
আরাফ হাসলো।দুষ্টুমি করে বলে,
‘ ইট্স ম্যাজিক।তা বলুন ম্যাডাম কি বলবেন?’
হিয়ার মন খারাপ হয়ে গেলো সকালের কথা মনে পরায়।ও অভিমানি কন্ঠে বলে,
‘ আপনি আমাকে না জানিয়ে চলে গেলেন কেন?’
আরাফ মুঁচকি হাসলো।অবশেষে কি ও পেরেছে হিয়ার মনে অনুভূতি সৃষ্টি করতে?আরাফ বললো,
‘ এই জন্যে বুঝি অভিমান হয়েছে?’
‘ নাহ আসলে ওই….’
হিয়াকে বলতে না দিয়ে আরাফ আবার বললো,
‘ ইলফাকে নিয়ে চলে এসেছি।কারন ওকে নিয়ে চলে না আসলে অর্থ রাগের মাথায় আরো কিছু করে ফেলতো।সরি তোমাকে না বলে চলে আসার জন্যে।’
‘ ইট্স ওকে।’
‘ খেয়েছো?’
‘ হ্যা! আপনি?’
‘ আমিও!’

এইভাবেই ওদের কথা চলতে লাগলো।কিছু নতুন অনুভুতি সৃষ্টি।একটু ভালোবাসা হলো।আর কিছু মিষ্টি স্মৃতি।এইভাবেই হয় প্রেমের সূচনা।তবে কি ওরাও প্রেমে পড়েছে?
#চলবে________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।

#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১৬
অর্থ কাউচে বসে বসে ল্যাপটপে নিজের অফিসের কাজ করছে।প্রাহি স্টাডি টেবিলে পড়ছে। পড়ার মাঝে মাঝেও আঁড়চোখে অর্থ’র দিকে তাকাতে ভুলছে না ও।কি করে এতো লোকটা ল্যাপটপ নিয়ে।আজ দু’দিন যাবত দেখছে সারাদিন কি যেন করে ল্যাপটপ নিয়ে।ভালো লাগে না প্রাহির এসব আর।দু’দিন যাবত ভালোভাবে কথাও বলে না অর্থ ওর সাথে।মন খারাপ হলো প্রচুর প্রাহির।এই মন খারাপের কারনে আর পড়ায় মন বসলো না ওর।বই খাতা গুছিয়ে রেখে উঠে চলে গেলো বারান্দায়।প্রাহিকে এইভাবে পড়া রেখে উঠে বারান্দায় যেতে দেখে ভ্রু-কুচকে তাকালো অর্থ।হলো কি আবার এই মেয়ের?এমন মুখ গোমড়া করে রেখেছে কেন আশ্চর্য! অর্থ ভাবলো হাতের কাজটা শেষ করেই নাহয় প্রাহির কাছে যাওয়া যাবে।তাই আবারও কাজে মনোযোগ দিলো ও।
অর্থ’র বারান্দাটায় হাফ রেলিং দেওয়া।বাকিটা স্লাইডিং গ্লাস।প্রাহি স্লাইডিং গ্লাসগুলো একটানে খুলে দিলো।স্নিগ্ধ দমকা হাওয়ায় প্রান জুড়িয়ে গেলো ওর।প্রাহি আকাশের দিকে তাকালো।আজ আকাশে চাঁদ তারা কিছুই নেই।আকাশে কালো মেঘের ছড়াছড়ি।থেকে হালকা আওয়াজে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।এই একটু পরেই বোধহয় অঝোরে নামছে বৃষ্টিধারা এই ধরনীতে।এই বৃষ্টির দিনে এরশাদ সাহেব আর প্রাহি কতো বৃষ্টিতে ভিজতো লুকিয়ে লুকিয়ে।আর রাবেয়া বেগম কতো চিল্লাচিল্লি করতেন।তবে স্বামি আর মেয়ের পছন্দমতো ভুনা খিচুরি, নানান পদের ভর্তা আর কষা মাংস করতে ভুলতেন না।সেই দিনগুলোর কথা মনে পরতেই চোখ ভরে এলো প্রাহির।আজ সকালেই মাকে আর বাবার কবরটা দেখে এসেছে ও।মা’কে প্রতিদিন দুবেলা দেখতে যায় ভার্সিটি যাওয়া আসার পথে।আর বাবার কবরটা দু’দিন পর পর যায় দেখতে।উনাদের না দেখলে যে প্রাহির মন ভালো থাকে না।তবে প্রাহি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।ওর মা বাবার এই করুন পরিনতি করার পিছনে যেই থাকুক তাকে কঠোর শাস্তি দিবে প্রাহি।পুলিশ তো এটা এক্সিডেন্ট কেস বলে ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছে।কিন্তু প্রাহি আসল সত্যিটা টেনেহিছড়ে বের করে আনবে সবার সামনে।এতে ওর যা করার লাগে ও করবে।শুধু সময়ের অপেক্ষা।ভাবনার মাঝেই হুট করে প্রাহির ফোনে একটা ম্যাসেজ আসলো।প্রাহির ম্যাসেজের আওয়াজ পেয়ে সেটা ওপেন করতেই যেন হাজার বোল্ডের ঝটকা খেলো।
‘ সেদিন আমাকে অপমান করার শাস্তিটা কেমন হলো জান?আমার স্পর্শ ভালোলাগে না তাই নাহ?অথচ একই সাথে আপন দুইভাইয়ের সাথে তো ঠিকই ফষ্টিনষ্টি করতে পারিস।সেদিন আমাকে এইভাবে সবার সামনে অপমান করার শাস্তি হিসেবে তুই হারিয়েছিস তোর বাবাকে হারিয়েছিস।মা’ও একপ্রকার থেকেও নেই।এইবার ওই শিকদার বাড়ির লোকেদের পালা।তিলে তিলে মারবো এক একটাকে।পারলে আমাকে আটকে দেখা।আমি নিজেই সব স্বিকার করলাম।দেখি তুই কি করতে পারিস।শুনলাম বিয়েও না-কি করে ফেলেছিস?তা কি শুধু ওই অর্থ’র সাথেই সাথে সুয়েছিস? না-কি হেমন্ত’,র কাছেও গিয়েছিস?শোননা আমার কাছে একরাত কাটাছে চলে আসিস।আমি কিন্তু খুব ভালোভাবে সেটিস্ফাইড করবো তোকে।বি রেডি প্রাহি।বি রেডি।”

ম্যাসেজটা পরেই প্রাহির সারাশরীর ভয়ে কাঁপতে লাগলো।জয়ের এতো নোংরা কথা শুনে গা গুলিয়ে আসলো প্রাহির।নিজের আপন ভাইয়ের থেকে বেশি হেমন্তকে নিয়ে এইসব বাজে কথা আর সহ্য করতে পারলো না।মুখে হাত চেপে একদৌড়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে।বেসিনের সামনে যেতেই বমি করে দিলো প্রাহি।শেষ হতেই চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে সেখানেই বসে পরলো প্রাহি।হাতের চাপ লেগে ঝর্না চালু হয়ে ভিজিয়ে দিলো ওর সারা শরীর।কি করলো এটা জয়? তার মানে এইসব কিছুর পিছনে ওই জয় ছিলো।সেদিনের অপমানের কারনে শয়তানটা ওর পুরো পৃথিবী কেড়ে নিলো।এখন যখন আবার একটু সুখের খোঁজ করতে নেমেছে প্রাহি।কুকুরটা সেখানেও ওর নজর দিয়ে ফেলেছে।নাহ,প্রাহি আর কাউকে হারাতে পারবে না। ওই জয়কে এর প্রাপ্য শাস্তি পেতেই হবে। কুকুরের থেকেই নিকৃষ্ট ওই লোকটার বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই।

এদিকে প্রাহিকে বারান্দা হতে ওইভাবে দৌড়ে ওয়াশরুমে ছুটে যেতে দেখেই ভয় পেয়ে যায় অর্থ।প্রাহির পিছু যেতে নিলেই প্রাহি ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।ভেতর থেকে বমি করার শব্দ পেতেই যেন ভয়টা আরো কয়েকশোগুন বেরে গেলো ওর।ওয়াশরুমের দরজা বার বার ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলছে,
‘ প্রাহি? কি হয়েছে তোমার?দরজা খুলো প্রাহি।আমি কিন্তু নাহলে দরজা ভেঙ্গে ফেলবো। প্রাহি শুনছো তুমি?’
প্রাহির গায়ে একফোটা শক্তি নেই যে ও উঠে দরজাটা খুলে দিবে।শরীরের সমস্ত শক্তি যেন কেউ শুষে নিয়েছে।প্রাহি খানিকটা জোড় প্রয়োগ করেই বললো,
‘ ভেঙ্গে ফেলুন।’
প্রাহির জবাব শুনে ভ্রু-কুচকে ফেললো অর্থ।তবে আর বেশিক্ষন সময় নষ্ট না করে ড্র‍য়ার হতে দরজার চাবিটা এনে দরজা খুলে ফেললো।দরজা খুলতেই অর্থ অবাক।ঝর্নার পানিতে প্রাহির শরীর ভিজে একাকার।মেয়েটা নিভুনিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অর্থ’র দিকে।অর্থ তাড়াতাড়ি ঝর্নাটা ওফ করে দিয়ে প্রাহির কাছে গেলো।তারপর একটানে প্রাহিকে বুকে জড়িয়ে নিলো।প্রাহি ধীর কন্ঠে বলে,
‘ আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন অর্থ।আমার প্রচুর শীত করছে।’
অর্থ আর এক মিনিট অপেক্ষা করলো না কথাটা শোনার সাথে সাথে প্রাহিকে কোলে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসলো।প্রাহিকে বিছানায় সুইয়ে দিলো।মেয়েটাকে শুকনো কাপড় পরাতে হবে। কিন্তু কিভাবে?এতোরাতে কেউ তো সজাগ নেই।হিয়াকে ডাকলে পাবে বোধহয়।ওতো অনেক রাত পর্যন্ত স্টাডি করে।অর্থ প্রাহির নিস্তেজ শরীরটার দিকে তাকালো।নরম কন্ঠে বলে,
‘ তুমি একটু অপেক্ষা করো আমি হিয়াকে ডেকে নিয়ে আসছি।তোমাকে শুকনো কাপড় পরাতে হবে।’
অর্থ যেতে নিলেই প্রাহি অর্থ’র হাত ধরে আটকে দিলো।দূর্বল কন্ঠে বলে,
‘ ওকে ডাকার দরকার নেই।আপনি আমার কাপড়গুলো এনে দিন আমি নিজেই চেঞ্জ করে নিতে পারবো।’
অর্থ চিন্তিত স্বরে বলে,
‘ কিন্তু তুমি তো সামান্য উঠতেও পারছো না। তোমার শরীরটা দূর্বল প্রাহি।আমি হিয়াকে ডেকে নিয়ে আসছি।কিছু হবে না।’
‘ লাগবে না বললাম না।আপনি এনে দিন আমি পারবো।’
প্রাহির জেদের কাছে হার মেনে প্রাহির কাপড়গুলো এনে দিলো ওকে। প্রাহির গালে হাত রেখে বললো,
‘ তুমি চেঞ্জ করে নেও।আমি গিয়ে তোমার জন্যে একটু গরম গরম স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসি ওকে?’
প্রাহি ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত বারোটা বাজে।এতো রাতে অর্থ ওর জন্যে কিচেনে যাবে? নাহ এটা হবে না।প্রাহি দূর্বল হাসলো।বলে,
‘ তার দরকার নেই।একটু ঘুমালেই আমি ঠিক হয়ে যাবে।আপনি শুধু শুধু কষ্ট কেন করবেন?’
অর্থ রেগে গেলো প্রাহির কথায় ধমকে বলে,
‘ সেটা তোমার থেকে জিজ্ঞেস করে নিবো না নিশ্চয়ই?আমাকে জ্ঞান দিতে আসবে না।আমি ভালোমন্দ তোমার থেকে ভালো বুঝি।চুপচাপ চেঞ্জ করে নেও।আমাকে রাগিও না।’
অর্থ ধুপধাপ শব্দ করে চলে গেলো।প্রাহি মলিন হাসলো।তারপর জামাকাপড় চেঞ্জ করে নিয়ে কম্বল মুরি দিয়ে সুয়ে পরলো।এতো রাতে ভেজার কারনে জ্বর আসছে বোধহয় ওর।প্রচন্ড শীত করছে।আরেকটা কম্বল হলে ভালো ছিলো।কিন্তু উঠে দাড়ানোর শক্তি নেই ওর মাঝে।অনেক কষ্ট কাপড়গুলো চেঞ্জ করেছে ও।
এদিকে অর্থ স্যুপ বানিয়ে নিয়ে এসে দেখে প্রাহি কম্বল মুরি দিয়ে সুয়ে আছে।বিছানার কিনারে ফ্লোরে ওর জামা কাপড় পরে আছে।অর্থ স্যুপটা টি-টেবিলে রেখে জামাকাপড়গুলো উঠিয়ে বাস্কেটে রেখে দিলো।তারপর প্রাহির কাছে বসে।ওর গা থেকে কম্বল সরাতেই প্রাহি কেঁপে উঠলো।সাথে সাথে কম্বল টেনে ধরে আবারও গায়ে দেয়ার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো।শীতে ওর কান্না চলে আসছে।এমনিতেই মন ভালো না ওর।প্রাহি ক্রোদন স্বরে বলে,
‘ শীত করছে কম্বলটা ছাড়ুন প্লিজ।’
প্রাহি কথায় অর্থ ভ্রু-কুচকালো।প্রাহির কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কপালে হাত রাখলো।যা ভাবছে তাই।এতো রাতে ভেজার কারনে জ্বর এসে পরেছে।কিন্তু অতোটাও না হালকা গরম শরীরটা।অর্থ প্রাহিকে ভালোভাবে কম্বল পেচিয়ে দিয়ে খাটের সাথে হেলাম দিয়ে বসালো।তারপর যত্নসহকারে স্যুপ খাইয়ে দিলো।খাওয়া শেষে মেডিসিন দিতেও ভুললো।প্রাহি খাওয়া শেষ করে ধুপ করে সুয়ে পরলো।অর্থ উঠে গিয়ে ফ্রেস হয়ে রুমের লাইট নিভিয়ে নিজেও প্রাহির পাশে এসে সুয়ে পরলো।প্রাহির শরীরের সাথে হাত লাগতেই বুঝতে পারে প্রাহি কাঁপছে।অর্থ ডাকলো,
‘ প্রাহি ঘুমিয়েছো?’
প্রাহি অর্থ’র দিক ফিরলো।নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে থেকে বুঝালো যে ও এখনো জেগে আছে।
অর্থ দুহাত মেলে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,
‘ শীত করছে তোমার অনেক। আমার বুকে এসে সুয়ে পরো।শীত কম লাগবে।’
কথাটা বলতে দেরি প্রাহির অর্থ’র বুকে ঝাপিয়ে পরতে দেরি নেই।অর্থ’র শরীরের উষ্মতা পেয়ে প্রাহি একেবারে অর্থ’র বুকের মাঝে বিড়ালছানার মতো লেপ্টে রইলো।অর্থ হাসলো।আদুরেভাবে প্রাহির মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।কিছুক্ষনের মাঝে প্রাহির ঘুমিয়ে পরলেও।অর্থ’র চোখে ঘুম নেই।প্রাহির জন্যে ওর চিন্তা হচ্ছে।মেয়েটা তো ঠিকই ছিলো।হঠাৎ এমন কি হলো যে ও এতোটা অসুস্থ হয়ে পরলো?না এভাবে ভাবলে হবে না।কাল সকালে প্রাহি ঘুম থেকে উঠতেই ওকে সবটা জিজ্ঞেস করতে হবে।নাহলে ওর শান্তি নেই।
অর্থ তাকালো আবারও প্রাহির দিকে।মায়াবি এইমুখটার দিকে একবার তাকালে শুধু তাকিয়েই থাকতে মনচায়।অর্থ প্রাহির গালে আর কপালে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে।নিজেও প্রাহিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর চেষ্টায় লেগে পরলো।

#চলবে________
কেমন হয়েছে জানাবেন।ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে