#একথোকা_কৃষ্ণচূড়া_এবং_আপনি
#সাদিয়া_জাহান_উম্মি
#পর্বঃ১২
‘ কবুল বলো মা!’
‘ কবুল, কবুল,কবুল!’ আস্তে ধীরে তিনবার কবুল বললো প্রাহি।অর্থ অনেক আগেই কবুল বলে বসে আছে।শুধু প্রাহির কবুল বলার জন্যেই অপেক্ষা করছিলো।প্রাহি কবুল বলাতেই সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলো।প্রাহি চোখ বুঝলো।দু চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো।ওর বিয়েটা তো এইভাবে হওয়ার কথা ছিলো না।ও তো আশা করেছিলো একপাশে ওর মা থাকবে আরেকপাশে বাবা।দুজনের হাত ধরে কবুল বলবে।বাবা,মা’র বুকে মুখ গুজে অনেক কাঁদবে।ওর বিয়ে নিয়ে ওর বাবা মা’র কতো আশা ছিলো।কিন্তু আজ সব ধোঁয়াশা।ওর জীবনটা এখন এলোমেলো বইয়ের পৃষ্টার মতো।যেই বইয়ের পৃষ্টাকে একটু আগে কবুল বলে স্বামি বলে মানা মানুষটা আদৌ কি গুছাতে পারবে কোনদিন?না-কি একদিন বিরক্ত হয়ে ওকে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে যাবে?জানে না প্রাহি জানা নেই।নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পেয়েও খুশি হতে পারছে না প্রাহি।বাবা মা’র শূন্যতায় ওর হৃদয়টা খাঁখাঁ করছে।প্রাহিকে কাঁদতে দেখে অর্থ ওর মাকে ইশারা করলো।যাতে প্রাহিকে এই মুহূর্তে সামলাতে পারে তিনি।রায়হানা এগিয়ে গিয়ে প্রাহির মাথায় হাত রাখলো।প্রাহি চোখ খুলে রায়হানা বেগমের দিকে তাকায়।তিনি বলেন,
‘ কাঁদে না মা।আমি জানি তোমার আজ অনেক কষ্ট হচ্ছে।বাবা মা আমিও হারিয়েছি তাই এটার কষ্ট ঠিক কতোটা তা আমি খুব ভালোভাবেই জানি।চিন্তা করো না মা।শুধু আল্লাহ্’র কাছে দোয়া করো তিনি যেন তোমার আব্বুকে জান্নাত নসিব করেন আর তোমার আম্মুকে জলদি সুস্থ্য করে দেন।’
প্রাহি ছলছল চোখে রায়হানা বেগমের দিকে তাকিয়ে থেকেই হুট করে রায়হানা বেগমকে জড়িয়ে ধরে উনার বুকে মাথা আওয়াজ করে কেঁদে উঠলো।কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘ আমার সাথেই কেন এমন হলো?আমি কেন আজ এতিম হলাম।এইভাবে তো আমি বিয়ে করতে চাইনি।আমার বাবা মা দুজনকেই চেয়েছিলাম তারা যেন আমার পাশে থাকে এই সময়টায়।কিন্তু আল্লাহ যে আমার থেকে সব কেরে নিলেন। আমি আজ একা। আমার কেউ নেই।’
রায়হানা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,
‘ কে বলেছে তোমার কেউ নেই?আজ থেকে তোমার দুটো মা আর দুটো বাবা।আমি আর হিয়া তোমার দুটো মা।হিয়াজ আর হিয়ান্ত ভাই তোমার দুটো বাবা।তুমি একা নও।তোমার পুরো পরিবার আছে।হেমন্ত তোমার ভাই, হিয়া তোমার বোন।আর মেয়েদের সবচেয়ে বড় শক্তি আর ভরসা হলো তাদের স্বামি।আজ থেকে তাও আছে তোমার।তুমি কেন একা হবে বোকা মেয়ে।’
প্রাহি কিছু বললো না।ওইভাবেই রায়হানা বেগমের বুকে পরে রইলো।হেমন্ত আর ইশি ওদের চোখের কোণে জমা জলটুকু মুছে নিলো।আজ থেকে আর কোন চিন্তা নেই।মেয়েটা আজ থেকে একটা পরিবার পেয়ে গিয়েছে।ওকে আগলে রাখার মানুষ পেয়েছে।আর কি চাই?তবুও বাবা মা’র শূন্যতাটা তো থেকেই যায়।কিন্তু নিয়তির লেখা তো কেউ আর বদলাতে পারে না। ভাগ্য যা লিখা থাকে তাই হয়।
——————
রহমান ভিলার গেটে তালা মেরে দিলো হেমন্ত।আজ থেকে এই বাড়িটা খালি থাকবে।একসময় হৈ-হুল্লোড় লেগে থাকা বাড়িটা একটা ঘটনার তাগিতে একদম নিস্তব্ধ হয়ে পরে আছে।দীর্ঘশ্বাস ফেললো হেমন্ত।সবার উদ্দেশ্যে বললো,
‘ বাবা,চাচ্চু,আম্মু আর কাকিমা এক গাড়িতে চলে যাও।আমি ইশিকে বাইকে করে ওদের বাসায় ড্রোপ করে দিয়ে আসি।হিয়া আরাফের সাথে চলে যাস।আর ভাই আর প্রাহি একটা গাড়িতে করে আসো।’
সবাই হেমন্ত’র করামতো চলে গেলো।হেমন্ত বাইকে উঠে বসতেই ইশিও উঠে বসলো।কিন্তু দুরুত্ব বজায় রেখে।হেমন্ত ভ্রু-কুচকালো।রাগ নিয়ে বললো,
‘ এমন ভাব করতাছোস লাগে জীবনেও আমার সাথে বাইকে বসোস নাই।আজাইরা ধং না কইরা আমারে ধরে বস।নাহলে চার চোখা তুই যেই চিকনা পিছনের থাইকা কখন বাতাসের সাথে উইড়া যাবিগা টেরই পামু না।’
ইশি ধুপ করে একটা ঘুশি মেরে দিলো হেমন্ত’র পিঠে।হেমন্ত হালকা আর্তনাদ করে বলে,
‘ উফফ মারোস কেন সকিনার মা।’
ইশি রাগে ফোঁসফোঁস করে বলে,
‘ দেখ হেমন্ত এইসব ফাউল নামে আমাকে ডাকবি না।আর এইসব আজাইরা কথাও বলবি না।তাড়াতাড়ি বাড়ি দিয়ে আয় আমায়।নাহলে আরেকটা ঘুশি খাবি।’
হেমন্তর কাঁধে আর কোমড়ে হাত রাখলো ইশি।হেনন্ত মুচঁকি হেসে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।
__________
‘ তুমি সবসময় আমার সাথে এইভাবে কথা বলো কেন?’ আরাফের প্রশ্নে হিয়া কাটকাট জবাব দেয়,
‘ জানিনা!’
‘ কেন জানোনা?’
‘ তাও জানি না!’
‘ তাহলে জানোটা কি?’
‘ আপনার মাথা!’
‘ আমার মাথা?কিন্তু আমার মাথা সম্পর্কে কি জানো?’ আরাফের এতো এতো প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হিয়া।সেই কখন থেকে পটরপটর করেই যাচ্ছে লোকটা।হিয়া বিরক্ত হয়ে বলে,
‘ এতো কথা কেন বলছেন আপনি?চুপ-চাপ বাইক চালান।মাথা খারাপ করে দিচ্ছেন পুরো।’
আরাফ বাঁকা হেসে বলে,
‘ তাহলে আমি বলবো নিজেকে তৈরি করে নেও।সারাজীবনই তোমাকে এতো এতো কথা শোনার ধৈর্য রাখতে হবে।’
হিয়া বুঝতে না পেরে বলে,
‘ মানে?’
‘ মানে কিছুনা সময়মতোই বুঝতে পারবে।’
হিয়া ভেংচি কাটলো আরাফকে।তার ঠেকা পরেছে এই লোকের এতো কথার মানে বুঝার। এদিকে আরাফ বাইকের গ্লাসে হিয়ার দিকে তাকাচ্ছে বারবার।বাতাসের কারনে মেয়েটার চুলগুলো ওর সারা চোখে মুখে এসে বারি খাচ্ছে।চাঁদের আলোয় অন্যরকম সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে।মনে মনে আরাফ বললো আর বেশিদিন না অর্থ বিয়ে করে নিয়েছে এইবার তোমার আর আমার বিয়ের পালা।তৈরি হয়ে নেও সোনা।হাসলো আরাফ কথাগুলো ভেবে।
—————–
গাড়ি ড্রাইভ করছে অর্থ ওর পাশেই চুপচাপ বসে আছে প্রাহি।জানালার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে চোখজোড়া সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।অর্থ ড্রাইভ করার ফাঁকে বারবার প্রাহির দিকে তাকাচ্ছে।লাল বেনারসি শাড়ি,মাথায় লাল ওড়না দেওয়া,হালকা পাতলা গহনা পরা,হালকা মেক-আপ এতেই যেন অপ্সরী লাগছে প্রাহিকে অর্থ’র কাছে।বউরূপে যে কাউকে এতোটা অমায়িক লাগতে পারে জানা ছিলো না অর্থ।মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।একটু ধরবে কি?যদি কিছু মনে করে প্রাহি?থাক ক’টা দিন সময় দিক মেয়েটাকে।সম্পর্কটা একটু স্বাভাবিক হোক তারপর নাহয় এইসব ভাবা যাবে।আচ্ছা,হাতটা তো ধরতে পারবে ও।এতে তো আর খারাপ ভাবার কিছু নেই।অর্থ শুকনো ঢোক গিললো। বারবার হাতটা এগিয়ে নিয়েও পিছিয়ে নিচ্ছে।হাতটা কেমন যেন কাঁপছে ওর।একটা মেয়ের সান্নিধ্যে এসে যে ওর এমন অবস্থা হবে জানা ছিলো না অর্থ’র। যতোবার মেয়েটাকে ছুঁয়েছে অর্থ।ততোবার সারাশরীরে ঝংকার তুলে দেয় এই মেয়ে।ওইযে তখন যে রাগের মাথায় প্রাহিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়েছিলো।তখন কিন্তু অর্থ’র বুক কাঁপছিলো ভীষনভাবে।শুধু নিজেকে প্রাহির কাছে দূর্বল না করার জন্যে নিজেকে সামলে রেখেছিলো অর্থ।এইসব ভাবাভাবি করতে করতে ওরা কাঙ্খিত স্থানে পৌছে গেলো।অর্থ’র আর হাত ধরা হলো না প্রাহির।দীর্ঘশ্বাস ফেললো অর্থ।আদ্র কন্ঠে ডাকলো,
‘ প্রাহি শুনছেন?আমরা পৌছে গেছি।’
অর্থ’র ডাকে হুঁশ ফিরে প্রাহির।এতোক্ষন সে অন্য ভাবনায় মশগুল ছিলো। প্রাহি তাকালো অর্থ’র দিকে।তারপর হালকা আওয়াজে বলে,
‘ আমি আপনার থেকে যথেষ্ট পরিমান ছোট।আর এখন আমি আপনার স্ত্রী তাই প্লিজ বার বার আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করার দরকার নেই।আপনি আমাকে তুমি বলতে পারেন।’
অর্থ মাথা নাড়ালো।তাদপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
‘ আচ্ছা ডাকবো।এখন নামো গাড়ি থেকে আমরা এসে পরেছি।’
প্রাহি গাড়ি থেকে নামতেই অর্থও নেমে দাড়ালো।লম্বা একটা শ্বাস ফেলে প্রাহি হাত চেপে ধরলো অর্থ।প্রাহি চমকে তাকালো অর্থ’র দিকে।পরক্ষনেই মনটা ভালো হয়ে গেলো নিমিষেই।প্রাহিও নিজের ছোট্ট হাতটা দিয়ে অর্থ’র হাতটা আকঁড়ে ধরলো।প্রাহি এইবার চারদিকে তাকালো। তারপর ধরা গলায় বলে,
‘ এটা তো বাবার কবরস্থানের যাওয়ার পথ।’
অর্থ নিষ্প্রভ চোখে তাকালো প্রাহির দিকে।বললো,
‘ হ্যা! আজ আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা দিন। বাবা’র থেকে দোয়া চাইবো না বলো?চলো দুজন মিলে তার কবরটা জিয়ারত করে আসি।’
প্রাহির চোখজোড়া ভরে এলো।কৃতজ্ঞতা জানালো অর্থকে,
‘ ধন্যবাস আপনাকে।’
‘ চলো!’
প্রাহি আর অর্থ মিলে এরশাদ সাহেবের কবর জিয়ারত করে নিলো। জিয়ারত শেষে অনেক্ষন প্রাহি কাঁদলো বাবার কবরের উপর সুয়ে সুয়ে।অর্থ কিছু বললো না প্রাহিকে। কাঁদুক মেয়েটা। কাঁদলে মনটা হালকা হয়।কিছুক্ষন প্রাহি উঠে আসলো।অর্থ যত্ন সহকারে ওর গায়ে লেগে থাকা ময়লা ঝেরে দিলো।প্রাহি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো অর্থ’র দিকে।তারপর প্রাহির হাত ধরে আবারও গাড়িতে ফিরে আসলো।গাড়ি স্টার্ট দিতেই অর্থ একপলক তাকালো প্রাহির দিকে।মেয়েটা কেমন যেন ছটফট করছে। অর্থ গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘ কিছু বলতে চাও প্রাহি?’
প্রাহি আমতা আমতা করছে,
‘ হ্যা আসলে ওই একটু……!’
অর্থ চেহারাটা আরো খানিকটা গম্ভীর করলো। গভীর ঠান্ডা গলায় বললো,
‘ আমার কাছে এতোটা আনইজি ফিল করার কিছু নেই প্রাহি।আজ থেকে আমি তোমার স্বামি।সো আমার কাছে নির্দ্বিধায় সবকিছু বলবে।আবদার করবে।এইভাবে তোতলানোর তো কোন মানে হয়না প্রাহি।আর আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছো।মা’য়ের সাথে দেখা করবে তো?তাই নাহ?আমি সেইখানেই নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে।সো এতো অস্থির হওয়ার কোন দরকার নেই।’
প্রাহি কিছু বললো না মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো অর্থ’র দিকে।লোকটা কতো সুন্দরভাবে ওকে সবটা বুঝিয়ে বললো।আর কতোটা অনায়াসে ওর মা আর বাবাকে মা, বাবা বলে ডাকছে।একটা মানুষ এতোটা ভালো কিভাবে হতে পারে।নাহ,প্রাহি কোন ভুল করেনি জীবনে নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নিতে।ও নিজের জন্যে বেষ্ট একজন মানুষকেই ভালোবেসেছে।প্রাহি জানে একদিন না একদিন এই লোকটাও ওকে ভালোবাসবে।খুব ভালোবাসবে।আর প্রাহি ওর সবটা দিয়ে চেষ্টা করবে এই লোকটার সাথে একটা হ্যাপিলি ম্যারিড লাইফ লিড করার।এই মানুষটা যেন ওর কাছ থেকে কোন প্রকার কষ্ট না পায় সেই চেষ্টা করবে।এই মানুষটা ওর দুঃখের সময় প্রতিটা পদে পদে ওর পাশে ছিলো।প্রাহিও নিজের সবটা দিয়ে চেষ্টা করবে অর্থকে আর ওর পরিবারকে সামলে রাখার।উফ ভুল বলেছে এটা তো এখন ওরও পরিবার। আর নিজের পরিবারকে কিভাবে আগলে রাখবে সেটা খুব ভালোভাবেই জানে প্রাহি। কথাগুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোণে মুচঁকি হাসি ফুটে উঠলো প্রাহির।
#চলবে____________
ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন