একতরফা ভালোবাসা পর্ব-১২

0
672

#একতরফা_ভালোবাসা
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃদিশা_মনি

প্রেয়াকে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে দেখে উৎকন্ঠা কাজ করছে সকলের মাঝে। প্রান্তি, তুলি দুজনে দরজা ধাক্কাচ্ছে। কিন্তু ভিতর থেকে কোন সাড়া আসছে না। পিয়াল আহমেদকে কবরে শায়িত করে সব ছেলেরাও ফিরে আসল। আহিল যখন শুনল প্রেয়া ঘরের ভেতর প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে রেখেছে তখন সে আর বিন্দু মাত্র কালক্ষেপন না করে ছুটে আসে দরজার কাছে। বারকয়েক ধাক্কানোর পরও যখন কোন সাড়া আসে না তখন সে আর তুষার মিলে দরজা ভাঙার প্রয়াস করে। দুজনে মিলে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতেই থমকে দেয়। প্রেয়ার রক্তাক্ত দেহ দেখে আতকে ওঠে প্রত্যেকেই। আহিল প্রেয়ার নাম ধরে এক গগণবিদারী চিৎকার দেয়। অতঃপর ছুটে গিয়ে তাকে কোলে তুলে নেয়। নিঃশ্বাস চেক করে দেখে এখনো শ্বাস পড়ছে কিন্তু গতি ক্রমশ কমে আসছে। আহিল প্রেয়ার মুখে আলতো করে স্পর্শ করে বলে,
“চোখ খোলো প্রেয়া। তোমার কিছু হবে না৷ লুক এট মি।”

কিন্তু প্রেয়ার দিক থেকে কোন প্রতিক্রিয়া আসে না। প্রান্তি কান্নায় ভেঙে পড়ে। আহিল বুঝে উঠতে পারে না কি করবে। তুষার আহিলের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আর সময় নষ্ট করা যাবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে নিয়ে হাসপাতালে চল। নাহলে বড় কোন ক্ষতি হয়ে যাবে।”

★★★
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় প্রেয়া। চোখ খুলতেই নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করে। তার বুক চিরে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে৷ এত চেষ্টার পরেও তাহলে সে মুক্তি পেল না! প্রেয়া অনুভূতিহীনতার সাথে নির্জীব হয়েই রইল। একজন নার্স তার দিকে খেয়াল করে ডাক্তারের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“ডাক্তার খান, পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।”

সহসাই নিজের মুখের মাস্কটা খুলে প্রেয়ার দিকে তাকান ডাক্তার আহরাম খান। চল্লিশ বছর বয়সী এই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই প্রেয়ার চিকিৎসা করে তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। প্রেয়াকে দেখে তিনি বিস্ময় নিয়ে বলে ওঠেন,
“দুজন মানুষের মধ্যে এত মিল থাকতে পারে!”

এরমধ্যে আহিল প্রেয়ার জ্ঞান ফেরার কথা শুনে ছুটে চলে আসে। প্রেয়াকে দেখে তার মনে শান্তি নেমে আসে। সৃষ্টিকর্তার কাছে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে প্রেয়াকে সহি সালামত রাখার জন্য। অতঃপর খানিকটা ধমকের সুরেই বলেন,
“তুই এরকমটা কিভাবে করতে পারলি প্রেয়া? মরে যাওয়া এতই সোজা। ইচ্ছে করছে তোকে..”

ডাক্তার আহরাম খান আহিলকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
“এরকম পেশেন্টকে মানসিক স্ট্রেস দেওয়া উচিৎ নয়। নাহলে এনারা আবার কোন ভুলভাল ডিশিসন নিতে পারেন। তাই আপনি ওনার সাথে প্লিজ এমনভাবে কথা বলবেন না।”

আহিল দমে যায়। প্রেয়ার দিকে তাকিয়ে অসহায় ভাবে কাতর কন্ঠে বলে,
“তুই শুধু সুস্থ হয়ে ওঠ প্রেয়া। এখন এটাই আমার একমাত্র চাওয়া।”

প্রেয়া কোন প্রতিক্রিয়াই দেখায় না। হাসপাতালে কিছুদিন অবস্থান করে সে। এরমধ্যে ডাক্তার আকরাম খানের সাথে তার বেশ সখ্যতা গড়ে ওঠে। প্রেয়া তার কাছ থেকে শোনে আকরাম খানেরও নাকি একটা মেয়ে ছিল। গতবছর ১৫ বছর বয়সে মেয়েটি হঠাৎ করে রোড এক্সিডেন্ট করে মারা গেছে। তারপর থেকে নাকি ওনার স্ত্রীর মানসিক অবস্থার অবনতি হয়েছে। সব শুনে ডাক্তার আকরাম খানের জন্য খুব খারাপ লাগে তার।

কয়েকটা দিন হাসপাতালে কা*টানোর পর অবশেষে প্রেয়ার বিদায়ের সময় এসে উপস্থিত হয়। হাসপাতাল থেকে সে নিজের বাসাতেই যেতে চেয়েছিল কিন্তু আহিল তখন আপত্তি জানায়৷ সে জানায় সে প্রেয়াকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। কারণ পিয়াল আহমেদের মৃত্যুর পর ঐখানে প্রেয়ার খেয়াল রাখার মতো কেউ নেই। প্রান্তিও নিজের সংসারে ব্যস্ত। তাই সে প্রেয়াকে নিজের সাথেই নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। যাতে সবাই সায় দেয়। যদিও প্রেয়ার একেবারেই ইচ্ছা ছিল না আহিলের সাথে যাওয়ার৷ কিন্তু সবার জোরাজুরিতে সে একপ্রকার বাধ্য হয়েই সে আহিলের সাথে চলে আসে।

আহিলের সাথে বাসায় আসার পরই সে আহিলের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করে। আহিল তার ভীষণ ভাবে যত্ন নেয়। তবে এসব কিছু আর প্রেয়াকে কোনভাবেই আকৃষ্ট করে না। নিজের বাবাকে হারানোর পর তার মন থেকে সব ধরনের অনুভূতি যেন মুছে গেছে। একদম নির্জীব পাথরের মতোই সে পড়ে আছে।

আজ আহিল যখন প্রেয়ার রুমে তার জন্য খাবার নিয়ে আসে তখন প্রেয়া তাকে বলে,
“তুমি কেন আমায় এখানে নিয়ে এসেছ আহিল ভাই?”

আহিল কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“কারণ এটা তোর শ্বশুর বাড়ি। আর তোকে এখানেই থাকতে হবে।”

প্রেয়া তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
“যেখানে তুমি মন থেকে আমাকে স্ত্রী হিসেবেই মেনে নিতে পারো নি সেখানে এই কথাটা হাস্যকর।”

“কে বলল আমি তোকে মেনে নেই নি? আমি আহিল আহমেদ আজ তোকে বলছি আমি সম্পূর্ণ মন প্রাণ থেকে তোকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিয়েছি।”

প্রেয়া কঠোরতা বজায় রেখে বলে,
“আমার উপর দয়া করছ তাই তো? কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার এই দয়ার কোন প্রয়োজন নেই আমার।”

“তুই ভুল বুঝছিস।”

“আমি একদম ঠিক বুঝছি। তুমি এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও। আমার তোমাকে সহ্য হচ্ছে না। কেন দয়া দেখাচ্ছ আমায়? কে চেয়েছে তোমার দয়া? ভালোবাসতে যদি না-ই পারো তাহলে অন্তত দয়া দেখিও না।”

“প্রেয়া তুই শান্ত হ..”

“আমি শান্ত হতে পারছি না। তোমার দয়ার পাত্রী আমি হতে চাইনা। একসময় তুমি আমার কাছ থেকে মুক্তি চেয়েছিলে না। আজ আমি তোমার কাঁ থেকে মুক্তি চাইছি। প্লিজ আমায় মুক্তি দাও আহিল ভাই। আমি সারাজীবন একা থাকতে পারব। কিন্তু তোমার দয়া নিয়ে থাকতে পারবো না। এতটাও আত্মসম্মানহীন নই আমি।”

আহিল বুঝতে পারে এই মুহুর্তে প্রেয়াকে কিছু বোঝাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। সেই সে আর কথা বাড়ালো। প্রেয়াকে খাবার খেয়ে নিতে বলে চলে গেল।

আহিল চলে যাবার পর প্রেয়া বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
“আমি কি এতটাই অবলা যে আমায় দয়া দেখাবে? আমার জীবন কি এতটাই ফেলনা যে অন্যের দয়া নিয়ে বাঁচব?”

প্রেয়ার এমন ভাবনার মাঝেই তার রুমে প্রবেশ করেন রাহেলা বেগম। প্রেয়ার কথা তিনি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছেন। তাই তো তিনি বলে ওঠেন,
“একদম ঠিক বলেছ তুমি প্রেয়া। কেউ তোমাকে ভালোবাসে না। সবাই শুধু তোমার উপর দয়াই দেখায়। এমনকি আমারো তোমার উপর এখন দয়া হয়।”

এটুকু কথা বলে তিনি কিছুটা দম নিয়ে বলেন,
“আমার আহিল এমনিতেই একটু বেশি দয়ালু। তোমার এইরকম অবস্থা দেখে তাই ও আরো বেশি করে দয়া দেখাচ্ছে। ওর এই দয়াগুলোকে আবার ভালোবাসা ভেবে ভুল করো না। আমার ছেলেটা কখনো তোমায় ভালোবাসতে পারবে না। যদি এখন ও তোমায় এসে বলে যে, তোমার সাথে সংসার করতে চায়, তাহলে সেটাও ওর দয়া ভালোবাসা নয়। আচ্ছা তুমিই ভেবে বলো তো, তুমি কি আজীবন কারো দয়ার পাত্রী হয়ে থাকতে চাও? একটুও কি আত্মসম্মান নেই তোমার মধ্যে?”

প্রেয়া সাথে সাথেই বলে,
“না…আমি কারো দয়ার পাত্রী হয়ে থাকতে চাই না।”

“কিন্তু এখানে থাকলে তো তোমাকে আহিলের দয়া নিয়ে থাকতে হবে।”

থেমে…

“এখন তুমিই ভেবে দেখো কি করবে। তবে তোমার যায়গায় আমি থাকলে যেদিকে দুচোখ যায় সেদিকে চলে যেতাম তবুও এভাবে ভালোবাসাহীন দয়ার উপর নির্ভর করা একটি সংসার বেছে নিতাম না।”

বলেই রাহেলা বেগম বাইরে বেরিয়ে আসেন। বাইরে এসে পৈশাচিক হাসি দিয়ে বলেন,
“কাজ মনে হয় হয়ে গেছে। এবার নিশ্চয়ই ঐ অপ*য়া প্রেয়া আমার আহিলের জীবন থেকে চিরকালের মতো দূরে সরে যাবে।”

★★★
প্রেয়া একটি চিঠি লিখে রাখে আহিলের উদ্দ্যেশ্যে। সেই চিঠি ডেস্কের উপর রেখে সবার অগোচরে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। গন্তব্যহীন ভাবে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে বলে,
“তোমার দয়া নিয়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয় আহিল ভাই। তাই আমি তোমাকে মুক্তি দিলাম সব দায়ভার থেকে। আমি নিজেও মুক্তি পেলাম এক আত্মসম্মানহীন জীবন থেকে। এখন আমি বাকি জীবনটা যেখানেই থাকি, যেমনই থাকি না কেন আত্মসম্মান নিয়ে থাকব। একতরফা ভালোবাসার গ্লানি নিয়ে নয়, নিজেকে ভালোবাসার মধ্য দিয়েই আমি বাকি জীবনটা সুন্দরভাবে কাটিয়ে দেব। যে নিজেকে ভালোবাসতে পারে, নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখতে পারে সেই যে প্রকৃত সুখী।”

চলবে ইনশাআল্লাহ ❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে