#একতরফা_ভালোবাসা
#পর্বঃ১১
#লেখিকাঃদিশা_মনি
প্রেয়া উৎসুক হয়ে তাকালো আহিলের দিকে। তার সব স্বীকারোক্তির পর থেকে সবাই নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও আহিল নিশ্চুপ। প্রেয়ার ভীষণ ইচ্ছা করছে আহিলের মনের কথা জানতে। আহিলের মনের কথা জানার ব্যাকুলতা দেখা যাচ্ছে তার মনে।
আহিল প্রেয়ার এই ব্যাকুলতাকে পাত্তা না দিয়ে কোন কথা না বলে চুপচাপ তাদের বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। প্রেয়া আশাহত হলো। তার মনে হলো আহিল বোধহয় মৌন থেকে তার ক্ষোভই প্রকাশ করল। তাদের সম্পর্কের পরিণতির একটা শেষ আশাও বোধহয় শেষ হয়ে গেল।
আহিল বেরিয়ে যাবার পর রাহেলা বেগম কাতর গলায় প্রেয়ার উদ্দ্যেশ্যে বললেন,
“এবার দয়া করে আমার ছেলেটাকে মুক্তি দাও। তোমার জন্য অনেক ভুগেছে আমার ছেলেটা। আমার ছেলের এই অবস্থা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। মুক্তি দাও ওকে।”
প্রেয়ার এবার ভীষণই খারাপ লাগল। বারবার মনে হতে লাগল সে বোধহয় জোরপূর্বক আহিলের জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। আহিল চায়না তাকে। এই ভাবনা থেকেই সে মলিন হেসে রাহেলা বেগমের হাত ধরে অভয় দিয়ে বলে,
“তুমি চিন্তা করো না চাচি। তোমার ছেলেকে আমি অবশ্যই এই মিথ্যা সম্পর্ক থেকে মুক্তি দেব।”
★★★
প্রান্তির মনটা আজ কেমন জানি করছে। তার বারবার মনে হচ্ছে আজ খারাপ কিছু হতে চলেছে। ও বাড়ি থেকে আসার সময় প্রেয়ার সাথে তার কথা হয়। প্রেয়াকে প্রান্তি বলেছিল আহিলের সাথে কথা বলতে। তখন প্রেয়া বলে,
“সব কথা শেষ হয়ে গেছে আপি। আমি আর কিছু বলতে চাই না। আমার আর কাউকে কিছু বলার মতো নেই।”
প্রান্তির এখন তার ছোট বোনের জন্য সত্যি ভীষণ দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে। মেয়েটার মতিগতি বোঝা সত্যি ভীষণ দায়। চাপা স্বভাবের হওয়ায় তার মনের কথা কেউ সহজে ধরতেও পারবে না।
প্রান্তির ভাবনার মধ্যেই তুষারের আগমন ঘটে তার রুমে। তুষার প্রান্তিকে অন্যমনস্ক দেখে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে। প্রান্তি সহজেই বুঝতে পারে তুষারের স্পর্শ। স্মিত হেসে বলে,
“আমাকে হুটহাট চমকে দেওয়ার স্বভাব আর তোমার গেল না তুষার ভাই!”
“সত্যি বলতে আমার তোকে এভাবে চমকে দিতে ভীষণ ভালো লাগে।”
“তাই বুঝি?”
“হুম।”
বলেই প্রান্তিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় তুষার। প্রান্তির গালে প্রেমের পরশ একে দেয়৷ অতঃপর প্রান্তির অধরে নিজের অধর স্পর্শ করায়। ভালোবাসায় মেতে ওঠে দুজন। এভাবেই একসময় তারা একে অপরের মাঝে হারিয়ে যায়। এসবের মধ্যে প্রান্তির নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী বলে মনে হয়। যাকে একতরফা ভালোবেসেছে তাকে আজ নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে তার উপর তারা আজ এত খুশি। সত্যিই এমন মানুষ খুবই ভাগ্যবান যাদের একতরফা ভালোবাসা পূর্ণতা পায়।
★★★
প্রেয়া আজ খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। সময় গুলো যেতে চাইছিল না জন্য সে প্রথমে রান্নাঘরে গিয়ে কফি বানায়। নিজের জন্য এক কাপ কফি নেওয়ার পর সে ভাবে তার বাবার জন্যেও এক কাপ নেবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সে তার বাবার জন্যেও অন্য একটা মগে কফি নিয়ে নেয়। অতঃপর কফি নিয়ে রওনা দেয় পিয়াল আহমেদের রুমের দিকে। তার বাবার রুমের সামনে উপস্থিত হয়ে যারপরনাই অবাক হয়ে যায় সে। প্রেয়ার জানামতে তার বাবা তো খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠেন। সকাল সকাল নামাজ আদায় করে তারপর যাবতীয় কাজ করেন। কিন্তু আজ এত সময় চলে যাওয়ার পরও তিনি ওঠেন নি দেখে প্রেয়ার মনে খটকা লাগে। রুমের দরজায় লক না থাকায় সে সহজেই রুমের ভিতর প্রবেশ করল। রুমে প্রবেশ করতেই বুঝল পিয়াল আহমেদ এখনো ঘুম থেকে ওঠেন নি। তাই সে পিয়াল আহমেদের পাশে গিয়ে তাকে ডেকে বলল,
“আব্বু উঠে পড়ো, সকাল হয়ে গেছে। এই দেখ আমি তোমার জন্য কফি বানিয়েছি। জানো আমি এখন অনেক রান্নাই শিখে গেছি। কফিও খুব ভালো বানাতে পারি। একটু খেয়ে দেখো তো কেমন হয়েছে।”
পিয়াল আহমেদ কোন সাড়া দিলেন না। প্রেয়া কোন সাড়া না পেয়ে তার বাবার হাত স্পর্শ করল। হাতটা জমে একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই প্রেয়ার বুকটা ধ্বক করে উঠল। অজানা আশংকায় কেপে উঠল বুক। প্রেয়া কাপা কাপা হাতে পিয়াল আহমেদের শ্বাস প্রশ্বাস চেক করতে লাগল। নিঃশ্বাস পড়ছে না দেখে প্রেয়া বুঝতে পারল তার বাবা আর নেই। সহসাই পাথর হয়ে গেল আস্ত এক মানবী। তার মধ্যে কোন অনুভূতি লক্ষ্য করা গেল না। নিজেকে ধাতস্থ করতে সময় নিলো কিছুক্ষণ। এরপর হঠাৎ করেই নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগল,
“আব্বু তুমি এভাবে চলে যেতে পারো না? তুমি ছাড়া আমার কে আছে বলো? প্লিজ আমাকে এভাবে একা করে দিয়ে যেও না আব্বু। ও আব্বু…তোমার মেয়ে প্রথমবারের মতো তোমার জন্য কফি বানালো..একটু খেয়ে দেখবে না?”
প্রেয়ার আর্তনাদ বাড়তে লাগল।
★★★
পুরো বাড়ি আত্মীয়-স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভীড়ে পরিপূর্ণ। পিয়াল আহমেদ একজন সজ্জন ব্যবসায়ী ছিলেন। এলাকায় তার অনেক নামডাক। একজন উদারপন্থী মানুষ হিসেবে সকলের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন তিনি। তাই তার মৃত্যুর খবরে অনেকেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। একটু আগেই পিয়াল আহমেদকে দাফন করার জন্য কবরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রান্তি নিজের বাবার মৃত্যুটা মেনে নিতে না পেরে ডুকরে কাঁদছে। তাহেরা বেগম নিজের ভাইয়ের মৃত্যুতে নিজেই ভেঙে পড়েছেন। তবুও নিজের পুত্রবধূকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। তুষার যে যাওয়ার আগে তাকে বলে গেছে প্রান্তিকে সামলাতে।
অন্যদিকে ঘরের এককোণে নির্জীব হয়ে বসে আছে প্রেয়া। তার চোখের জলগুলোও শুকিয়ে গেছে। কোন অভিব্যক্তি ব্যক্ত করতে পারছে না সে।একদম পাথরের মতো হয়ে আছে। তুলি এসে বসলো তার পাশে। প্রেয়ার কাধে হাত রেখে তার নাম ধরে বারকয়েক ডাক দিলো। কিন্তু প্রেয়া কোন সাড়া দিলো না। এবার তুলি চিৎকার করে বলল,
“চুপ করে থাকিস না প্রেয়া কথা বল? ছোট মামা আর নেই। তোর বাবা মারা গেছেন৷ এভাবে থাকলে তো তুই পাগল হয়ে যাবি। নিজের ভেতরে কষ্ট জমিয়ে রাখিস না। নিজের অনুভূতিগুলো প্রকাশ কর। প্লিজ কিছু বল।”
এমন সময় হঠাৎ করেই রাহেলা বেগম সেখানে চলে আসেন। প্রেয়ার দিকে তাচ্ছিল্য ভরা চোখে তাকিয়ে বলেন,
“ও আর কি বলবে? কিছু বলার মুখ আছে নাকি ওর? পিয়ালের মৃত্যুর জন্য তো ওরা দুইবোনই দায়ী। বিশেষ করে এই মেয়ের দায় তো সবথেকে বেশি। দুজন মিলে লোকটাকে এত কষ্ট দিল যে সেটা সইতে না পেরে…আর আমার তো মনে হয় এই মেয়েটাই অপয়া। জন্ম নিতেই নিজের মাকে খে*-য়েছে আর এখন নিজের বাবাকেও খেয়ে নিলো। না জানি পরে এর জন্য আর কার জীবনে কি অন্ধকার নেমে আসছে। এই মেয়েটাকে আমার আহিলের জীবনেও আমি আর কোনমতে রাখতে চাই না।”
তুলি রাহেলা বেগমকে তীব্র ভৎসর্না করে বলে,
“এসব কি ধরনের কথা মামি? মেয়েটা সদ্য তার বাবাকে হারিয়েছে। তার সামনে এসে এমন কথা বলতে কি তোমার বিবেকে বাধল না?”
“স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই তুলি। আমি যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি। এতে যার যা ভাবার ভাবুক।”
তুলি প্রতিবাদ করে আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রেয়া তুলির হাত ধরে ফেলে। নির্জীব কন্ঠে বলে,
“চাচি তো ঠিক কথাই বলেছে তুলি। সত্যিই হয়তো আমি অপ*য়া। তাই তো আমার সব কাছের মানুষ এক এক করে হারিয়ে যায়। আচ্ছা আমি কেন মরে যাচ্ছি না বলতে পারিস?”
“প্রেয়া!! একদম চুপ। এমন কথা মুখেও আনবি না। মামির কথা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কোন মানুষ অপয়া হয় না।”
“হয়, হয়। এই আমাকে দেখ না। জন্মের পরই নিজের মায়ের মৃত্যুর সাক্ষী হলাম, আজ নিজের বাবার। আমি অপয়া নই তো কি? আমি অপয়া। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি অপয়া।”
বলেই প্রেয়া উঠে দাঁড়ালো। নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। তুলিও তার পিছনে ছুটল। দরজা ধাক্কাতে বলল,
“দরজা খোল প্রেয়া। কোন ভুলভাল কাজ করিস না।”
প্রেয়া ততক্ষণে একটা ব্লেট নিজের হাতে নিয়ে বলে,
“এই অপয়া জীবন আমি আর রাখবো না। আজই আমি সবাইকে চিরতরে মুক্তি দেব।”
বলেই ব্লেট দিয়ে নিজের হা**ত কা* টে সে। গলগল করে তরল রক্তের স্রোত বের হয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রেয়া মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। ততক্ষণে রক্তের স্রোত বয়ে যেতে থাকে। প্রেয়ার চোখ ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে। ধরে আসা গলায় সে বলে ওঠে,
“ভালো থেকো আহিল ভাই। তোমাকে আমি চিরমুক্তি দিলাম।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ❤️