#একতরফা_ভালোবাসা
#পর্বঃ১০(ধামাকাদার পর্ব)
#লেখিকাঃদিশা_মনি
প্রেয়া আজ নিজেকে নিয়ে ভাবতে বসেছে। তার করা সব ন্যায় অন্যায় কর্মের হিসাব মিলাচ্ছে। তার করা ভালো কাজ বলতে বিগত ২ মাস যাবৎ আহিলের সেবা করে তাকে সুস্থ করে তোলা। আহিল এখন অনেকটাই সুস্থ। হাটাচলা করতে পারে, অফিসেও যায়। আহিলের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে প্রেয়া। আহিল আর আগের মতো তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। বরং এখন তার প্রতি অনেক নরম ব্যবহার করে। যা দেখে প্রেয়ার মনে হয় আহিল আর তার সম্পর্ক হয়তো একটা নতুন সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু এরমধ্যে তার মনে নতুন একটা চিন্তাও এসেছে। প্রেয়া জানে প্রান্তি তার জন্যই সেদিন বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়েছিল। অথচ আজও সবার কাছে প্রান্তি দোষী হয়ে আছে। প্রেয়ার বিবেকে এখন বাধছে এটা। হাজার হোক প্রান্তি তার আপন বড় বোন। তার জন্য কত সেক্রিফাইজ করেছে। এমনকি কারো সামনে সব সত্য বলছেও না হয়তো তার মুখের দিকে তাকিয়েই।
প্রেয়া ছোটবেলা থেকে অন্তর্মূখী এবং চাপা স্বভাবের হওয়ার পাশাপাশি একটু স্বার্থপর টাইপের। তবে এখনকার পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তারপক্ষে আর স্বার্থপরতা করা সম্ভব নয়। তাই প্রেয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার যাই হয়ে যাক সে আর সত্য লোকাবে না। নিজেই সবাইকে সত্যটা বলবে। এতে করে হয়তো আহিল এবং তার সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে ক্ষীণ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে তা নষ্ট হয়ে যাবে তবুও প্রেয়া এই ঝুঁকি নেবে। নিজের মনকে ধাতস্থ করল সে। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে স্বগোতক্তি করল,
“অনেক স্বার্থপরতা করেছিস তুই প্রেয়া আর না। এবার তোর আর স্বার্থপরতা করলে চলবে না। আপি আমার জন্য অনেক করেছে। নিজের স্বার্থের থেকে বেশি আমার ভালো থাকাকে বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছে। এবার আমিও তাই করব। নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে আপির সত্যটা সবার সামনে আনব।”
★★★
প্রেয়া, প্রান্তির বাপের বাড়ি আজ উপস্থিত তিন পরিবারের সবাই। পিয়াল আহমেদ, আজহারুল আহমেদ, রাহেলা বেগম, তাহেরা বেগম, তুলি, প্রান্তি, তুষার সবাই। সকলে এভাবে একত্রে হয়েছে মূলত প্রেয়ার কথায়। প্রেয়া কিছু বিশেষ কথা বলার জন্যই এখানে সবাইকে ডেকেছে।
সবাই খুব কৌতুহলী হয়ে জানার অপেক্ষায় আছে কি সেই কথা। তবে প্রান্তির মুখে খুশির ঝলক লক্ষ্যণীয়। কারণ সে খুব ভালো করেই জানে প্রেয়া আসলে কেন তাদের সবাইকে ডেকেছে। এতদিন তার ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা যে বিফলে যায়নি তা আজ আবার প্রমাণিত। প্রেয়া তার ভরসার মর্যাদা রেখেছে। প্রসন্ন চিত্তে তুষারের দিকে তাকায় প্রান্তি। তুষারও তার দিকে মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। আহিলের নজর এড়ায় না সেই দৃশ্য। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে দুজন যুগলকে এভাবে হাসতে দেখে তার রাগ বা ঘৃণা কোনটাই হয়না। বরং ভীষণ আফসোস হয়। নিজের আর প্রেয়ার সম্পর্কের প্রতি। তার বারংবার মনে হয় তুষার যদি প্রেয়াকে ভালোবাসার পরেও প্রান্তিকে বিয়ে করে এভাবে মুভ অন করতে পারে তাহলে সে কেন অতীত আকড়ে পড়ে থাকবে? আজকাল কার যুগে কেউ তো আর অতীত নিয়ে পড়ে থেকে বর্তমানটাকে নষ্ট করে না। তাছাড়া প্রেয়া এই দুমাস যেভাবে শত খারাপ ব্যবহারের পরেও তার খেয়াল রেখেছে তাতে প্রেয়ার প্রতি সফট কর্নার তৈরি হয়েছে তার মনে। তাই আহিলও এখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তাদের সম্পর্কটাকে একটা সুযোগ দেবে।
পিয়াল আহমেদ থমথমে মুখ করে বসে আছেন৷ তার প্রান্তির উপস্থিতি নিয়েই মূলত সমস্যা হচ্ছে। এতগুলো দিন কে-*টে গেলেও সেদিনের ঐ ঘটনার পর তিনি এখনো মন থেকে প্রান্তিকে মেনে নিতে পারেন নি।
অন্যদিকে রাহেলা বেগম বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করছেন,
“না জানি এই নাটকবাজ মেয়েটা নতুন কোন নাটক করার জন্য আমাদের সবাইকে এখানে ডেকেছে।”
তার বিড়বিড় করে বলা কথাটুকু শুনে নেন আজহারুল আহমেদ। নিজের স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বলেন,
“এসব নেগেটিভ চিন্তা বাদ দাও। প্রেয়া তোমার ছেলের জন্য কত কিছু করল সেটা তো তুমি নিজের চোখে দেখেছ। তবুও ওর প্রতি এমন ধারণা রাখো কিভাবে?”
রাহেলা বেগম মুখ বাকান। আসলে তিনি খুবই ইগো নিয়ে চলেন। প্রান্তি তার যোগ্য ছেলে তার অহংকার আহিলকে রিজেক্ট করে চলে যাওয়ায় তার ইগো হার্ট হয়েছে। তারপর আবার তারই ছোট বোন আহিলকে বিয়ে করায় এটা কোনভাবেই মানতে পারছেন না তিনি।
প্রেয়া হঠাৎ সবার সামনে উপস্থিত হয়। সবার নজর তার দিকেই যায়। প্রেয়া সকলের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“তোমরা সবাই যে আজ আমার ডাকে এখানে এসেছ তাই তোমাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ। আজ তোমাদের সবার সাথে কিছু কথা শেয়ার করব আমি। যাতে করে তোমাদের অনেক ভুল বোঝাবুঝি মিটে যাবে।”
বলেই একবার আহিলের দিকে তাকায় প্রেয়া। আহিলের দিকে তাকাতেই তার বুকের বা পাশে ব্যাথা অনুভূত হয়। সে যা বলতে চলেছে তা বলার পর হয়তো আহিলকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে৷ তবুও সে নিজেকে ধাতস্থ করল। আজ আর দূর্বল হলে চলবে না। শক্ত থেকেই তাকে সব সত্য বলতে হবে। প্রেয়া বলেই ফেলে,
“তোমরা সবাই যে কারণে প্রান্তি আপিকে এতদিন ধরে ভুল বুঝছ তার পেছনের সত্যটা আজ আমার থেকে শোনো। সেদিন আপি নিজের কোন স্বার্থের জন্য পালায় নি। পালিয়েছিল আমার জন্য।”
প্রেয়ার কথা শুনে সকলেই হতবাক হয়ে যায়। পিয়াল আহমেদ বলে ওঠেন,
“এসব কি বলছ তুমি প্রেয়া? প্রান্তির পালিয়ে যাওয়ার সাথে তোমার কি সম্পর্ক?”
“সম্পর্ক আছে আব্বু। আপি সেদিন পালিয়েছিল কারণ…”
প্রেয়া সবার সামনে সেদিনের সব কথা বলে। সে কিভাবে আত্ম***হ*- ত্যার চেষ্টা করেছিল, কিরকম পাগলামী করছিল সব। আহিলের প্রতি তার একতরফা অনুভূতির কথাও সবাইকে খুলে বলে প্রেয়া। সব শুনে সবাই হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পিয়াল আহমেদ ধুপ করে সোফায় পড়েন।
রাহেলা বেগম নিজের স্বামীর বলে ওঠেন,
“দেখলে তো তোমার আদরের ভাইঝিদের কারিশ্মা। এরা দুই বোন নিজেদের সুখের জন্য আমাদের ছেলের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে।”
“আহ, রাহেলা। চুপ করো তো তুমি। আমাকে কথা বলতে দাও।”
আজহারুল আহমেদ এগিয়ে গিয়ে প্রান্তির পাশে দাঁড়ান। তার উদ্দ্যেশ্যে প্রশ্ন ছু//ড়ে দেন,
“প্রেয়া যা সব বলছে তা কি সত্যি প্রান্তি?”
প্রান্তি মাথা নাড়ায়। তিনি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,
“পরিস্থিতি যেমনই হোক তোমার এমন হটকারী সিদ্ধান্ত কোনভাবেই জাস্টিফায়েড করার সুযোগ নেই। তুমি চাইলেই আমাদের বড়দের সাথে আলোচনা করে এই ব্যাপারটার একটা সুন্দর সমাধান করতে পারতে। তা না করে তুমি ব্যাপারটাকে এতটা কমপ্লিকেটেড করে তুললে। যাতে তোমাদের দুই বোনকেই সাফার করতে হলো। এমনকি আমাদেরও।”
প্রান্তি বলল,
“আমি সত্যি ভীষণ লজ্জিত। আসলেই আমার ঠান্ডা মাথায় সব ভাবা উচিৎ ছিল। কিন্তু সত্যি বলতে সেই সময় আমি এত কিছু ভাবার মতো অবস্থায় ছিলাম না। আমার মনে হয়েছিল যদি সব বলার পরেও তোমরা সবাই পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে আমার সাথে আহিলের বিয়েটা দাও!”
পিয়াল আহমেদ হঠাৎ করে রাগী গলায় বলে উঠলেন,
“এই জন্যই তুমি পরিবারের সম্মান ডুবিয়ে বাইরে গেলে তাই তো? নিজের বোনের কথা ভাবতে গিয়ে পরিবারের মুখে চুনকালি দিলে?”
প্রান্তি মাথা নিচু করে রইল। সে জানে পিয়াল আহমেদের এই রাগ যৌক্তিক। কারণ তার পালিয়ে যাওয়ার কারণে এই মানুষটাকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। পিয়াল আহমেদ এরপর উঠে গিয়ে প্রেয়ার গালেও ঠা**স করে থা**প্পড় মা**রলেন। যেই বাবা কোনদিন গায়ে ফুলের টোকা পর্যন্ত লাগতে দেয়নি তার হাতে মা**র খেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল প্রেয়া। পিয়াল আহমেদ শাসিয়ে বললেন,
“চুপ একদম চুপ। এই দিন দেখার জন্য তোর মায়ের মৃত্যুর পর তোকে এত কষ্টে মানুষ করেছিলাম? অন্য একজনের ভালোবাসায় এত পাগল হয়ে গেলি যে ম*রতে চলে গেলি।”
এরপর ব্যাথাতুর স্বরে বললেন,
“হয়তো আমিই বাবা হিসেবে ব্যর্থ। লোকে হয়তো ঠিকই বলে। মা না থাকলে হয়তো সন্তানদের সঠিক ভাবে মানুষ করা যায়না।”
আচমকা প্রেয়া ও প্রান্তি তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“তুমি একজন যোগ্য পিতা আব্বু। আমরাই তোমার যোগ্য সন্তান হতে পারিনি।”
পুরো বাড়িতে এক আবেগঘন মুহুর্তের তৈরি হয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ ❤️