#একতরফা_ভালোবাসা
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা_মনি
“আমি এই বিয়ে করব না। আমার মতের বিরুদ্ধে তোমরা আমার বিয়ে ঠিক করতে পারো না।”
প্রান্তির সোজা সাপ্টা জবাব। যা শুনে তার বাবা পিয়াল আহমেদ রেগে বললেন,
“এসব কি কথা প্রান্তি? আমরা গুরুজনেরা বসে যখন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা নিশ্চয়ই ভালোর জন্যই নিয়েছি। আমাদের অভিজ্ঞতা বেশি তাই অবশ্যই আমরা ভালোটা বুঝব। তুমি কোন সাহসে আমাদের মুখের উপর এসে এমন কথা বলছ? আমি কি তোমাকে এই শিক্ষা দিয়েছি?”
প্রান্তি দমল না। বরং নিজের তেজ বজায় রেখে বলল,
“আমি কোন রোবট নই আব্বু যে তুমি নিজের মতো আমাকে চালনা করতে পারবে। আমি একজন রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। আমার নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধি, পছন্দ-অপছন্দ আছে। আমার উপর জোর করে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইলে আমি তো সেটা মানব না।”
একটু দূরে দাঁড়িয়ে প্রান্তির এই কথা শুনে যাচ্ছিল দুজন। তাদের দুজনের মনে এখন দুরকম অনুভূতি খেলা করছে। একদিকে প্রেয়া তার বোনের এভাবে বিয়েতে অমত দেওয়ায় খুব খুশি। কারণ এর ফলে আহিলকে নিজের করে পাওয়ার তার আশা পূরণ হবে। অন্যদিকে, তুষার দাঁড়িয়ে প্রান্তির কথা শুনে আফসোস করছে। কেননা, সে অপেক্ষায় ছিল যে প্রান্তির সাথে আহিলের বিয়েটা হতেই সে তার মাকে বলবে মামার সাথে কথা বলে প্রেয়ার সাথে নিজের বিয়ের কথা বলবে। আর কতদিনই বা নিজের ভালোবাসা লুকিয়ে রাখবে? বাসা থেকে বিয়ের চাপ শুরু হয়ে গেছে, প্রেয়ারও ১৮ বছর পূর্ণ হয়েছে। তুষারের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে নিজের মনের অনুভূতি গুলো আর বেশিদিন লুকিয়ে রাখা। তাই সে চায় যত দ্রুত সম্ভব আহিল প্রান্তির বিয়ে হোক। যাতে করে তার রাস্তাটা ক্লিয়ার হয়।
★★★
বসার ঘরে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রান্তি এভাবে মুখের উপর না বলে দেওয়ায় বেশ চটেছেন আজহারুল আহমেদ। তার ছেলে আহিল কিসে কম? বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে। ভালো একটা জব করছে। তার জন্য কত ভালো ভালো মেয়ের প্রস্তাব আসে প্রতিদিন। তিনি নিজের ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করতে এবং নিজের ছেলের পছন্দের কারণেই প্রান্তির সাথে বিয়ে ঠিক করতে এসেছিলেন। কিন্তু এখন প্রান্তির এমন রুঢ় আচরণ তাকে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে পুনরায় ভাবতে বাধ্য করছে।
পরিস্থিতির অবনতি বুঝতে পেরে আহিল প্রান্তির উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“প্রান্তি একটু বেলকনিতে চলো তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।”
প্রান্তি কটমট দৃষ্টিতে তাকায়। ছোটবেলা থেকেই আহিলকে তার খুব একটা ভালো লাগে না। কারণ আহিল প্রচণ্ড মেধাবী ছিল। ছোটবেলা থেকে পিয়াল আহমেদ আহিলকে নিয়ে তার সামনে তুলনা দিত যে, আহিল ক্লাসে ফাস্ট হয়, খেলাধুলাতেও চ্যাম্পিয়ন, নাচ-গান সবেতেই সেরা। আর তুই সারাদিন কি এসব ফালতু আর্ট নিয়ে পড়ে থাকিস।
এই ধরনের কথাবার্তাই তার মনে আহিল সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করেছে। তাই এই লোকটার প্রতি একটা চাপা ক্ষোভ তো আছেই। এখন যখন সে তার ভালোবাসার পথে বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছে তখন সেই ক্ষোভ আরো বাড়ল। প্রান্তি বেশ শক্ত গলায় জবাব দিল,
“আমি তোমার সাথে আলাদাভাবে কথা বলব না। কিছু বলার থাকলে এখানে সবার সামনেই বলো। ”
পিয়াল আহমেদ সাথে সাথেই ধমক দিয়ে বললেন,
“আহিল যা বলছে তাই করো প্রান্তি। এটা আমার আদেশ।”
প্রান্তি আর কিছু বলতে গেলে পিয়াল আহমেদ চোখ রাঙান। বুঝিয়ে দেন তার কথা না শুনলে খুব খারাপ কিছু হয়ে যাবে। অগত্যা প্রান্তিকে নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও যেতে হয় আহিলের সাথে।
এইদিকে প্রেয়ার মনে অজানা ভয় দানা বাঁধে। তার মনে হতে থাকে আহিল প্রান্তির সাথে কথা বলে যদি তাকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়ে ফেলে তখন কি হবে। এমন ভাবনা থেকে প্রেয়া নিজের রুমে যায়। অতঃপর ভাবে এমন কিছু করবে যাতে আহিল প্রান্তির সাথে কথা বলার সুযোগটাও না পায়। যেই ভাবা সেই কাজ।
চুপি চুপি রান্নাঘরে গিয়ে একমুঠো বাদাম তুলে নিলো৷ ছোটবেলা থেকেই বাদামে তার এলার্জি। বাদাম খেলেই গায়ে প্রচণ্ড জ্বালা হয়, একবার তো হাসপাতালে এডমিট হতে হয়েছিল। তবে আজ নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাকে এই বাদাম খেতে হবে। কাঁ/টা দিয়েই কাঁ/টা তুলতে হবে।
★★★
প্রান্তি ও আহিল বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ সময় নীরব থেকে আহিল বলতে শুরু করে,
“আমাকে বিয়ে করতে তোমার কি অসুবিধা প্রান্তি? আমি কি পাত্র হিসেবে খুব খারাপ?”
প্রান্তি হচকচিয়ে যায়। হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনবে ভাবতে পারে নি সে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলে,
“তুমি পাত্র হিসেবে খারাপ না অনেক ভালো। কিন্তু আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।”
“কেন তোমার কি অন্য কাউকে পছন্দ?”
প্রান্তি ঠিক করে নিলো তুষারের প্রতি তার ভালোবাসার কথাটা আহিলকে বলবে। কিন্তু কোন কিছু বলার আগেই প্রেয়ার চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে এলো। দুজনেই দৌড়ে ছুট দিলো কি হয়েছে দেখার জন্য।
বসার ঘরের মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে প্রেয়া। এলার্জিতে তার পুরো শরীর লাল হয়ে উঠেছে। পিয়াল আহমেদ নিজের মা মরা মেয়েটাকে আগলে নিয়ে সামলানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। আজহারুল আহমেদ তার চেনা পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করছেন। প্রান্তি উদ্বিগ্নতার সাথে নিজের বোনের কাছে এসে বসলো। সামলানোর চেষ্টা করল নিজের ছোট বোনটাকে।
★★★
“উনি বোধহয় এলার্জির কিছু অনেক বেশি মাত্রায় খেয়েছিলেন। তাই এই অবস্থা। তবে চিন্তার কোন ব্যাপার নেই। আমি ওষুধ দিয়ে দিয়েছি। আশা করি শীঘ্রই সুস্থ হয়ে উঠবেন।”
ডাক্তারের অভয় দানে শান্ত হতে পারলেন না পিয়াল আহমেদ। নিজের ছোট মেয়েটাকে যে তিনি বড্ড ভালোবাসেন। কারণ এই মেয়ের জন্মের সময়ই যে তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। যার কারণে মেয়েটা মায়ের ভালোবাসা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত হয়ে বড় হয়েছে। তাই নিজের ভালোবাসা দিয়ে সবসময় আগলে রাখার চেষ্টা করেন।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর তুষার সবার উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“তোমরা সবাই এখন যাও। ওর রেস্টের প্রয়োজন। আমি এখানে আছি ওর কোন প্রয়োজন হলে আমি থাকব।”
পিয়াল আহমেদ বলেন,
“আমি ওকে ছেড়ে যাবো না।”
তুষার আর জোর করল না। পিয়াল আহমেদ বাদে বাকি সবাই চলে গেলেন। সবাই যাওয়ার পর তুষার প্রেয়াকে প্রশ্ন করল,
“আচ্ছা প্রেয়া তুই কি এমন খেয়েছিস যে তোর এমন এলার্জি হলো? তুই তো জানিস তোর কিসে এলার্জি।”
প্রেয়া আমতাআমতা করে বলল,
“চানাচুর খেয়েছিলাম। সেখানে হয়তো কোনভাবে বাদাম পেটে চলে গেছে।”
“কিন্তু চানাচুরের সামান্য ক’টা বাদামে তো এই অবস্থা হওয়ার কথা না।”
পিয়াল আহমেদ প্রেয়াকে ধমক দিয়ে বলেন,
“তোমাকে না কতবার আমি বলেছি সাবধান থাকবে। চানাচুরে বাদাম থাকতে পারে এই নিয়ে তোমার সাবধান থাকা উচিৎ ছিল।”
“সরি আব্বু। এরপর থেকে খেয়াল রাখব।”
★★★
সন্ধ্যার দিকে প্রান্তি প্রেয়াকে দেখার জন্য তার রুমের দিকে যাচ্ছিল৷ প্রেয়ার রুমের বাইরে গিয়ে সে থেমে যায়৷ তুষার ও আহিল নিজেদের মধ্যে কি নিয়ে যেন কথা বলছিল। যদিওবা প্রান্তির স্বভাব না অন্যের কথায় আড়ি পাতা কিন্তু তাদের আলোচনার মধ্যে নিজের নাম শুনে তার বেশ আগ্রহ হয় কি বলছে তা শোনার।
তুষার আহিলের উদ্দ্যেশ্যে কাতর স্ব্রে বলে,
“তাহলে কি প্রান্তি তোকে বিয়ে করতে রাজি নয়?”
“সেটাই তো মনে হলো। হয়তোবা ও অন্য কাউকে পছন্দ করে।”
“তুই আগে শিওর হয়ে নে। এমন তো হতে পারে অন্য কারণ। সে যাইহোক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে বিয়েটা করে নে। তুই তো জানিস যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রান্তির বিয়ে হবে ততদিন আমি প্রেয়াকে নিয়ে কিছু বলতে পারব না। এদিকে আম্মু বিয়ের জন্য প্রেশার দেওয়া শুরু করেছে। তার ভাষ্যমতে আমি নিজের পায়ে দাড়িয়েছি এখন বিয়ে করতে হবে। কিন্তু তাকে নিজের কথা কিভাবে বোঝাই। যে আমি আগে থেকে প্রেয়াকে মন দিয়ে বসে আছি।”
“আচ্ছা আমি দেখছি।”
এদিকে তুষারের কথা শুনে বড় ঝটকা খায় প্রান্তি। সে দ্রুত নিজের রুমে যায়। দরজা লাগিয়ে হু হু করে কাঁদতে থাকে। কোন মেয়ের পক্ষেই এটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয় যে তার ভালোবাসার মানুষ অন্য কাউকে চায়। প্রান্তি কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলে। তারপর অনেক ভেবে একটা কঠিন সিদ্ধান্তে পৌঁছায়।
“তুষার ভাই যখন আমাকে চায়না তখন আমি তার আশায় বসে থাকবো না। তার থেকে ভালো আমি আহিলকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাই। এতে পরিবারের সবাই খুশি। তুষার ভাই অনেক ভালো মানুষ। তিনি যখন আমার বোনটাকে ভালোবাসেন তখন নিশ্চয়ই ওকেও অনেক ভালো রাখবেন
সবার ভালোর জন্য নাহয় আমি নিজের ভালো থাকাকে বলিদান দিলাম। বলি দিলাম নিজের একতরফা ভালোবাসাকে।”
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨❤️