একতরফা ভালোবাসা পর্ব-০১

0
1170

#একতরফা_ভালোবাসা
#পর্বঃ১
#লেখিকা_দিশা_মনি

১.
নিজের ভালোবাসার মানুষটার সাথে নিজের আপন বোনের বিয়ের কথা শুনে প্রেয়ার পুরো দুনিয়াই যেন বদলে গেল! যেই মানুষটাকে নিয়ে এতদিন নিজের মনে স্বপ্ন সাজিয়েছে তাকে কিনা নিজের বোনের স্বামী হিসেবে মানতে হবে! এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না অষ্টাদশী তরুণী। কিন্তু তার হাতেও যে কিছু নেই। শান্তশিষ্ট, চুপচাপ নম্র ভদ্র স্বভাবের এই মেয়েটি যে কারো মুখের উপর কিছু বলতে পারে না। নিজের বাবা চাচাদের সামনে তো আরোই নয়।

প্রেয়ার বাবা পিয়াল আহমেদ নিজের বড় ভাই আজহারুল আহমেদের সাথে নিজের বড় মেয়ে প্রান্তির সহিত আজহারুল আহমেদের একমাত্র ছেলে আহিলের বিয়ের কথা ঠিক করে নিলো। প্রেয়া সব কথাই শুনল। কিন্তু একবারও প্রতিবাদ জানিয়ে বলল না,”এই বিয়ে হতে পারে না৷ কারণ আমি আহিল ভাইয়াকে ভালোবাসি।”

প্রেয়ার একতরফা ভালোবাসার গল্প বাকি সময়ের মতো আজও গোপনই রয়ে গেল তার মনে। সে ছোট্ট একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল শুধু। গুটি গুটি পায়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে গিয়েই সবার প্রথমে টেবিলের উপর থেকে নিজের ডায়েরিটা হাতে নিলো। তারপর দ্রুত বেগে সেই ডায়েরিটা খুলল। শেষবারের মতো নিজের মনের অনুভূতি দিয়ে সাজানো কিছু প্রিয় শব্দ পড়ে নিলো। সেই শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সেই প্রিয় মানুষটা থেকে। যার নাম “আহিল”।

প্রেয়া ডায়েরিটা বুকে আগলে নিয়ে ছাদের দিকে রওনা দিলো৷ খুবই সন্তর্পণে ছাদে পা রাখলো। অতঃপর দিয়াশলাই কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিলো ডায়েরির মধ্যে। নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করল যথেষ্ট। তবুও চোখের কোণা দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল সব বাধা অতিক্রম করে। সেই অশ্রু জানিয়ে দিলো একতরফা ভালোবাসার লুকানো কিছু কষ্ট। আর সহ্য করতে পারলো না প্রেয়া। ছাদে পড়ে থাকা একটি পরিত্যক্ত বোতল তুলে নিয়ে টেংকি থেকে পানি নিয়ে এসে আগুন নেভানোর চেষ্টা করল। আগুনের তেজ কমলো। একসময় নিভেও গেল। আগুন নিভতেই প্রেয়া ডায়েরিটা হাতে তুলে নিলো। কিঞ্চিৎ আত্মবিশ্বাস জেগে উঠলো তার হতাশ মনে। প্রেয়া দেখল ডায়েরির উপরের মোলাটটাই শুধু পু*ড়েছে। ভেতরের লেখাগুলো এখনো অক্ষত রয়েছে। প্রেয়া সেই ডায়েরিতে হাত বুলিয়ে বলল,
” এই ডায়েরির মতো আমার অনুভূতিও গুলো এখনো অক্ষত আছে। আর এই অনুভূতি আমি মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না। মুছে ফেলতে চাইওনা। যদি প্রয়োজনে নিজের পরিবার, নিজের বোন…সবার সাথে বেঈমানি করতে হয় তো করব। তবুও নিজের একতরফা ভালোবাসার পূর্ণতার কাহিনি লিখব। সবাই তো শুধু একতরফা ভালোবাসার ব্যর্থতার গল্পই শুনে আমি নাহয় একটা সফলতার গল্প শুনবো।”

____________________________
প্রান্তি বসে আছে আপন কক্ষে। বসে বসে ফেসবুকিং করছে। এটাই তার প্রিয় কাজ। ফেসবুকে একটা পেজও রয়েছে তার। যেখানে সে নিজের থ্রিডি আর্টের ছবি শেয়ার করে সবার সাথে। থ্রিডি চিত্র অংকনে বেশ পারদর্শী সে। ভীষণ অগোছালো মেয়েটার এই একটাই গোছালো গুণ রয়েছে।

আচমকা প্রান্তির কক্ষে কারো আগমন ঘটল। প্রান্তি টের পেলো চেনা পরিচিত কারো উপস্থিতি। হালকা হেসে
বললো,”বোনু তুই এসেছিস!”

মলিন মুখে নিজের বড় বোনের দিকে তাকালো প্রেয়া। প্রান্তি চোখ তুলে তাকাতেই নিজের বোনের বিমর্ষ, মলিন মুখ দেখে বিচলিত হয়ে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বোনের কাছে এলো। কাধে হাত রেখে আলতো স্বরে শুধালো,”কি হয়েছে বোনু? তোকে এমন লাগছে কেন?”

প্রেয়ার খুব বলতে ইচ্ছা করল, “তুই আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিস আপি। আমার ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নিচ্ছিস তুই!”

কিন্তু পারল না কথাটুকু বলতে। অনেক কষ্টে নিজের মনের সব অনুভূতি লুকিয়ে বলল,”তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে আপি৷ তোকে ছাড়া থাকতে হবে এটা ভেবেই আমার কান্না পাচ্ছে।”

প্রান্তির পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল৷ হঠাৎ এভাবে বিয়ের প্রসঙ্গটা সামনে আসায় সে হতবিহ্বল, হতাশ। আপন বোন হলেও সে প্রেয়ার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রেয়া যেমন নীরব মহাসাগরের ন্যায় শান্ত প্রান্তি তেমনই চঞ্চলতায় মোড়ানো এক তরুণী। সাথে বড্ড স্বাধীনচেতা ও মুক্তমনা। নিজের মর্জিতে চলতেই পছন্দ করে সে।

তাই তার মতামত ছাড়াই এভাবে বিয়ে ঠিক করার ব্যাপারটা সহ্য হলো না। প্রান্তি উত্তেজিত স্বরে পুনরায় নিজের বোনকে শুধালো,”কে এভাবে আমার অমতে আমার বিয়ে ঠিক করল?”

প্রেয়া নিজের বোনের এই রূপ দেখে ঘাবড়ে গেল। নিজের বোন সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা আছে তার। তাই প্রান্তি এখন কি করতে পারে সেটাও সে জানে। তবে আজ নিজের বোনের এই রূপই যেন তার কাছে স্বস্তিদায়ক মনে হলো। কারণ সে যে মনেপ্রাণে চায় এই বিয়েটা না হোক। এরজন্য সে সবকিছু করতে প্রস্তুত। স্বভাবের দিক দিয়ে যতোই ভালো হোক, ভালোবাসার ক্ষেত্রে যে সে এত মহান হতে পারবে না। একটু স্বার্থপর যে হতেই হবে। তাই তো নিজের অক্ষমতার কারণে নিজের বোনকে ব্যবহার করে এই বিয়ে ভাঙার পরিকল্পনায় সাজিয়ে ফেলল সে। প্রান্তির সামনে বললো বাবা-চাচার সব পরিকল্পনার কথা।

প্রান্তি ভীষণ রেগে গেল তার অমতে তার বাবার এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা শুনে। দ্রুত ছুটে গেল বসার ঘরের দিকে। প্রান্তি চলে যেতেই প্রেয়া তৃপ্তির হাসি হেসে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে বলে,”এই বিয়েটা যেন ভেঙে যায়। আপি যেন এই বিয়েটা না করে।”

অতঃপর নিজের ফোনের গ্যালারিতে প্রবেশ করল। আহিলের সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত একটি ছবি জুম করে দেখতে থাকে। যেখানে আহিলকে ভীষণ সুদর্শন লাগছে। আলতো করে সেই ছবির উপর হাত বুলিয়ে বলে,”তোমাকে আমার হতেই হবে আহিল ভাই। সেইজন্য যদি আমায় নিজের পরিবারের সাথে লড়তে হয় তবুও লড়ব। তখন ডায়েরিটা জ্বালাতে গিয়ে আমি অনুভব করেছি তোমাকে ঠিক কতোটা ভালোবাসি। আর এই ভালোবাসা ব*লি দেওয়ার মতো মহানুভবতা আমি দেখাতে পারবো না। প্রয়োজনে স্নায়ু যুদ্ধে নামব। সরাসরি কিছু করতে না পারলেও এমন ভাবে পেছন থেকে নিজের বুদ্ধির সাহায্যে লড়ে যাব। তবে তোমাকে আমি নিজের করে পাবোই। এটাই আমার সংকল্প।”

_______________
প্রান্তি জোরে জোরে বসার ঘরে আসার সময় হঠাৎ করে হোচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয়। এমন সময় হঠাৎ করেই দুটো বলিষ্ঠ হাত আগলে নেয় তাকে। প্রান্তি সেই বলিষ্ঠ হাতের সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। উঠে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় নিজের মনের মানুষটিকে। যাকে দেখে প্রান্তির মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে যায়।

প্রান্তির দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকায় তুষার। সম্পর্কে প্রান্তির ফুফাতো ভাই সে। পেশায় একজন মনোবিজ্ঞানী। তবে প্রান্তির মনের খবর সে জানে না। বরাবরই ছোট বোনের মতো ট্রিট করে। আজও ব্যতিক্রম হলো না। তুষার প্রান্তিকে ধমকের সুরে বলল,
“তুই কবে বড় হবি প্রান্তি? সবসময় এত ছোটাছুটি করিস কেন বল তো? প্রেয়াকে দেখ না তোর ছোট বোন হয়েও কতটা বুঝদার, শান্তশিষ্ট আর তুই?! আমি তো শুধু এটাই ভাবছি বিয়ের পর তোর কি হবে। আহিলের জীবনে বেশ দুঃখ আছে বোঝাই যাচ্ছে।”

তুষারকে দেখে যতোটা না খুশি হয়েছিল তার থেকে বেশি কষ্ট প্রান্তি অনুভব করে তার মুখে নিজের আর আহিলের বিয়ের কথা শুনে। নিজের প্রণয় পুরুষের মুখে এই কথাটা শোনা যে কতটা বিষাদময় সেটা শুধু প্রান্তিই অনুভব করতে পারছে।

ভীষণ চেষ্টা করল নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার। তুষারকে কিছু না বলে সে পা বাড়ালো বসার ঘরে। আগে বাপ-চাচার ব্যবস্থা করতে হবে তারপরে বাকি কিছু।

তুষার প্রান্তির যাওয়ার দিকে তাকিয়েই থাকে। বিরক্তির শ্বাস ফেলে বলে,
“এর আবার কি হলো? এই দুইবোনের মতিগতি ঠিক বুঝি না৷ বড় জন তো সারাক্ষণ শুধু তিড়িং বিড়িং করতে আর ছটফট করতে ব্যস্ত আর ছোটজন…”

প্রেয়ার কথা মনে আসতেই তুষারের মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তির হাওয়া বয়। মনে পড়ে যায় উজ্জ্বল ফর্সা বর্ণের, হরিণী নেত্রের ঐ মায়াবী মেয়েটার কথা। যাকে দেখলেই তুষারের মনের অনুভূতিগুলো গুলিয়ে যায়। নিজের থেকে ১০ বছরের ছোট যেই মেয়েটাকে মন দিয়ে বসে আছে সে।

★★★
আহিল নিজের বাবা আজহারুল আহমেদের পাশে বসে রয়েছে। পিয়াল আহমেদ মিষ্টি হাতে নিয়ে আহিলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন,
“নে মিষ্টি মুখ করে নে। আমার বরাবরই ইচ্ছা ছিল তোকে মেয়ে জামাই করার। অবশেষে সেই ইচ্ছা পূরণ হতে চলেছে।”

আহিল মিষ্টিটা খেতে যাবে এমন সময় দৌড়ে সেখানে চলে আসে প্রান্তি। চিৎকার করে বলে ওঠে,
“দাঁড়াও।”

প্রান্তির গলার স্বর শুনে তার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকায় আহিল। নিজের হৃদয়হরিণীকে দেখতেই তার মনে লাড্ডু ফুটতে থাকে। যখনই মনে হয় এই মেয়েটা আর কিছুদিন পর তার বউ হবে তখনই তার হৃদয়ের সংকোচ, প্রসারণের মাত্রা দ্রুতবেগে বৃদ্ধি পায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨❤️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে