একটুখানি সুখ পর্ব-২৯+৩০

0
1189

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ২৯

বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোহ। চোখমুখের রঙ পাল্টে গেছে তার। বার বার চোখ বন্ধ করে আবার মেলছে সে এই ভেবে যে সে ভুল দেখেনি তো? কিন্তু চোখজোড়া ভুল প্রমাণিত হচ্ছে না। এতোক্ষণ হেঁসে স্বচ্ছের সঙ্গেই কথা বলছিল আয়মান। এবার চোখ সরিয়ে স্বচ্ছের বউকে দেখার উদ্দেশ্যে সোফার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই তার চোখমুখের রঙও ফ্যাকাশে বর্ণে পরিণত হয়। হাসিটুকু বিলীন হয়ে যায়। মোহের কাজল ভর্তি চোখে বার বার পানি আটকানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই অবাধ্য চোখে পানি তো মানছে না। তার কান্না পাচ্ছে ঘৃণার কারণে। সামনের বাম পাশের মানুষটা মোহের জন্য বিষাক্ত। আয়মান আগ বাড়িয়ে ডাকতে চাইলো মোহকে। কিন্তু মোহ দুপাশে মাথা নাড়ায়। আয়মান সেখানেই থামে। তিক্ততায় চোখ সরিয়ে চোখ নামিয়ে নেয় মোহ।

“ওহ মি. আয়মান! আপনি তো আমাদের অফিসে নিউ যাকে বাবা বান্দরবান পাঠিয়েছিলো। কংগ্রাচুলেশনস। বিকজ কাজগুলো আপনি নিউ হওয়া সত্ত্বেও খুব সুন্দর হ্যান্ডেল করেছেন।”

“থ্যাংক ইউ স্যার। ইউর ওয়াইফ…”

বলেই থেমে আয়মান মোহের দিকে তাকালো। মোহ আবার মাথা উঠিয়ে বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। এর মানে আয়মান এই কোম্পানিতেই চাকরি পেয়েছিল? ভেবেই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে মোহ। স্বচ্ছ স্মিত হেঁসে আচমকা মোহের পাশ ঘেঁষে বসতেই মোহের বিস্ময়ের ঘোর কাটে। খানিকটা চমকে স্বচ্ছের দিকে তাকায় সে। স্বচ্ছ হাসিটা প্রসারিত করে মোহের কাঁধে হাত রেখে মোহকে আরেকটু কাছে টেনে নেয়। বুকের সঙ্গে লাগিয়ে নেয় মোহকে আর বলে,
“ইয়াহ, হি ইজ মাই ওয়াইফ। মিসেস. মোহ। অ্যান্ড মোহ, মিট আয়মান। হি ইজ আয়মান। আমার অফিসে নিউ…”

“জানি আমি।”
দুর্বল কন্ঠে বলে ওঠে মোহ। চোখমুখ লাল হয়ে আসছে তার। দৃষ্টি একদিকে স্থির। মনটা ভালোই ছিল তার। এভাবে কাকতালীয় ভাবে হলেও আয়মানকে তার সামনে আসা কি দরকার ছিল? মনটাকে বিষিয়ে দেওয়া কি খুব জরুরি ছিল? মোহের কথায় স্বচ্ছ বেশ কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করে…
“সিরিয়াসলি? তুমি জানো? মানে তুমি মি. আয়মানকে চেনো আগে থেকে?”

“হ্যাঁ চিনি তো। খুব ভালো করে চিনি।”

“কি করে?”

স্বচ্ছের আগ্রহের সাথে আয়মানও বেশ আগ্রহী হয়ে তাকালো। মোহ হয়ত সত্যি উত্তর দেবে সেই আশায়। যদিও মোহের মুখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছেনা আয়মান। তবুও তাকিয়েছে সে। মোহ আয়মানের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল,
“আমাদের ভার্সিটিতেই পড়তেন একসময়। আমি তখন জুনিয়র ছিলাম। অনেকটা ফেমাস ছিলেন উনি। তাই আমিও চিনতাম। দ্যাটস ইট।”

“হোয়াট অ্যা কোয়েন্সিডেন্স।”

স্বচ্ছ কথাটা বলতেই আয়মান আশাহত হলো। সে আসলে একটা ইডিয়ট। বড় মানের বোকা। মোহকে অবিশ্বাস করেছিল সে। যদিও আয়মান জানতো না স্বচ্ছই ভবিষ্যতে নেহাল সাহেবের চেয়ারে বসতে চলেছে। কারণ সে জানতোই না তার স্যারের ছেলে স্বচ্ছ। প্রথমবার শুনছে এবং জানছে। আয়মান যখন জানতে পারে সব মিথ্যা ছিল তখন মোহের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল সে কিন্তু পারেনি। আয়মান ভেবেছিল মোহ অভিমান করে বসে আছে। বাড়ি ফিরতেই মোহের বাড়িতে একেবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবে। কিন্তু তার জানা ছিল না মোহ তার জন্য থেমে নেই। অনেকটা পথ এগিয়েছে। নিজের জীবনে অন্য চলার সাথী বানিয়েছে।

আচমকা সোহা সহ বেশ কয়েকটা মেয়ে এসে বলল,
“ভাবি। কয়েকটা ছবি তুলব তোমার সাথে একটু তাকাও না প্লিজ!”
আবদার ফেলতে না পেরে জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে ক্যামেরার দিকে তাকালো মোহ।

মোহ কত ভালো আছে! সংসার আর বাকিদের নিয়ে কতটা ব্যস্ত সে। এসব ভেবেই দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ল আয়মান। মাঝখানে নিজের বোকামির কারণে মোহ নামক মেয়েটিকে হারিয়ে বসল চিরতরে! অপমানবোধ আর লজ্জাবোধে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না আয়মানের। ঢক গিলে বলল,
“স…স্যার আমি আসছি। আসলে মাথাব্যথা করছিল আর শরীরটাও খারাপ লাগছে। আজকে ভোরেই লং জার্নি করে পৌঁছেছি সো একটু খারাপ লাগছে।”

স্বচ্ছ উঠে দাঁড়ায়। আয়মানের দিকে এগিয়ে এসে হালকা জোর গলায় বলে,
“অন্তত খেয়ে তো যাবেন?”

“খাওয়াদাওয়া তো অনেক হবে। পড়েই তো আছে সময়। একদিন সময় করে এসে আপনার মিসেস. এর হাতের রান্না খেয়ে যাব।”
একটা মেকি হাসি দিয়ে মোহের দিকে তাকিয়ে চলে গেল সে। আয়মানে জানে মোহ রান্নার র ও জানে না। ইচ্ছে করেই কথাটা মোহকে কটাক্ষ করে বলে গেল আয়মান। মোহ তিক্তভরা নয়নে ততক্ষণ তাকিয়ে রইল যতক্ষণ না আয়মান বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হলো। আয়মান চলে যেতেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল সে। মনে উঁকি দিচ্ছে অতীত। যেটা মধুর হবার কথা ছিল তা হয়ে উঠছে তিক্ততায় ভরা। আদোও কি তাদের মাঝে ভালোবাসা ছিল? হয়ত ছিল না। ছিল না বলেই এতো সহজে ভেঙেছে সম্পর্ক! হয়তবা সৃষ্টিকর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন।

রিসেপশন অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে প্রায় এগারোটা বেজেছে। সকলে বেশ ক্লান্ত। মিসেস. নিরা সহ তৃণা ও তিহানও এসেছিলো। সকলে নাকি আজ রাতেই চট্টগ্রাম চলে যাচ্ছে। সেখানেই তো ওদের বাড়ি। কতদিনই বা আর পড়ে থাকবে এখানে? তাদেরও তো ঘরসংসার রয়েছে। মিসেস. নিরাকে সামলাতে হবে। তাছাড়া অবশেষে মোহের জীবনে একজন আনতে পেরে বড্ড খুশি মিসেস. নিরা।

নিশুতিরাতে সকলে ঘুমে। মোহ ও স্বচ্ছের ঘরেও বিরাজ করছে নিস্তব্ধতা। মাঝেমাঝে হালকা নড়েচড়ে উঠছে মোহ। সে জেগেই আছে। বিষণ্ণ মনে ঘুম আসছে না তার। অতীত তার পেছনে ছুটছে। তাকে থামাতে পারছে না। মনকেও থামানো দায় হয়ে পড়েছে। বড্ড মন খারাপ হলেও মোহের ঘুমটাও উড়ে যায়। বেড হালকা নড়তেই চোখ মেলে স্বচ্ছের দিকে তাকায় মোহ। স্বচ্ছ মোহকে ঘুমের আবেশে জড়িয়ে ধরতে চাইতেও খানিকটা সরে যায় মোহ। কারণ সে জানে স্বচ্ছ একবার নিজের সঙ্গে ধরলে তার নড়াচড়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। আরো বেশ কিছুক্ষণ পর শুয়ে থাকতে না পেরে উঠে বসে পড়ে মোহ। কোথাও শান্তি পাচ্ছেনা সে। তার শান্তি চাই শুধু শান্তি!

বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে খোঁপা করে আবারও স্বচ্ছের দিকে চোখ বুলিয়ে নেয় মোহ। স্বচ্ছের ঘুমানোর ধরনটাও এলোমেলো। মাথার বালিশ লম্বালম্বি করে নিয়ে জড়িয়ে ধরে উপুড় হয়ে ঘুমায় সে। মাঝারি আকারের লম্বা চুলে মাঝে মাঝে চোখ ছুঁয়ে দেয় স্বচ্ছের। ঠোঁটজোড়া আলতো ফাঁকা করে ঘুমায় সে।

খোঁপা করা শেষে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মোহ। বেশ ধীরে হেঁটে গিয়ে পৌঁছায় কড়িডোরের শেষ প্রান্তে যেখানে একটা খোলা কাঁচের বারান্দা রয়েছে। সবুজের সমারোহ যেখানে। সেখানে গেলে হয়ত হালকা শ্বাস নিতে পারবে সে। বাহিরের লাইট জ্বালিয়ে দরজার থাই খুলে প্রবেশ করতেই মোহকে ছুঁইয়ে যায় শিরশিরে বাতাস। সেখানে মন খুলে বড় শ্বাস নিয়ে দুই বাহু দুই হাতে ঘষতে ঘষতে গিয়ে বসে মোহ। ওপরে হালকা লাইট জ্বলছে। পরিবেশটা সুন্দর। আশপাশটা ভালো করে দেখে নিতেই তার চোখ স্থির হয় কাঁচের দেয়ালে আটকানো এক কাগজে। মোহ ভালো করে স্পষ্ট করে দেখে নেয় লিখাগুলোর ধরন। সঙ্গে সঙ্গে পিলে চমকে যায় তার। আবারও সেই ধরনের লিখা। মোহ দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে,
“এতোদিন পর আবার ওই মি. চোরটা চিঠি পাঠিয়েছে? আহাম্মক! সামনে ধরা দেয় না। এখন চিঠি দিয়েও লাভ নেই। আমি এখন বুকড হুহ! এখন আমার আর কিচ্ছু করতে পারবে না মি. চোর। কিন্তু লিখেছে টা কি?”

উৎসুক হয়ে মোহ এগিয়ে গেল চিঠির দিকে। ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করল সে।
“তোমার মতো মোহময়ী নারীকে কখনো বিষণ্ণ মুখে মানায়?
তুমি হয়ত বিষণ্ণ মুখে থাকতে ভালোবাসো, কিন্তু আমার যে ভেতরে আগুন জ্বলে। তোমার মুখে একটু হাসি দেখার জন্য।
সেই মুক্ত ঝরানো হাসিটা কি দেবে না?
তোমার বিষণ্ণ মুখ দেখে আহত হওয়ার থেকে তোমার হাসি মুখ দেখে নিহত হতো রাজি আছি আমি। একটু হাসবে? কতক্ষণ হাসতে দেখিনা তোমায়! নিজের প্রাণ জুড়িয়ে নিতাম।”

কথাগুলোর মাঝে যেন প্রাণ ছিল! মোহ মুগ্ধ হয়েই চার বার পড়ে নিল লিখাগুলো পড়ে নিল সে। এতোটা মুগ্ধকর লিখনী কি করে লিখতে পারে একটা চোর? সে কি আশোপাশেই আছে? থাকার কথা তো! নয়ত সে কি করে জানল মোহ এখানে আসবে? নিশ্চয় লোকটা আশেপাশে আছে।

ভেবেই খুঁজতে শুরু করে মোহ। এদিকসেদিক আশেপাশে সবদিকে খুঁজে ফেলে সে। হুট করে খটমটে শব্দে পিছু ফিরে দরজার ওপাশে তাকায় সে। শব্দটা তো ওদিক থেকেই আসছে। মোহ হন্তদন্ত হয়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে করিডোরে এলো। কিন্তু করিডোর পুরো অন্ধকার। একি! মোহ আসার সময়ই তো দেখেছিল লাইট জ্বালিয়ে রাখা। কে বন্ধ করল লাইট? আশেপাশে হাতড়াতে শুরু করল মোহ। এখন কোথায় লাইট কোথায় সুইচ বুঝতেও পারছে না সে। হাতড়াতে গিয়েই তার হাত গিয়ে পড়ে এক প্রশস্ত বুকে। আচানক কাজটি ঘটাতে হাতটা সরিয়ে নেয় মোহ। তৎক্ষনাৎ আবারও আন্দাজ করে লোকটাকে ধরে ফেলে জোরে চিৎকার দিয়ে ওঠে,
“চোর!”

এমনটা শুনে সামনে থাকা আগন্তুক ব্যক্তিটিও চমকে ওঠে। নিজেকে ছাড়াতে চায় সে কোমলভাবে কিন্তু পারলে তো? আজকে মোহও যেন শপথ করে রেখেছে চোরটাকে ধরবেই ধরবে।
“চোর! সবাই আসুক চোর ধরেছি।”

“আমি চোর? আর একটা ওয়ার্ড বের করেছো তো….”
বেশ অদ্ভুত চাপা কন্ঠ বেরিয়ে এলো। মোহ থামল না তবুও। মোহের মুখ অন্যহাত দিয়ে চেপে ধরে আগন্তুকটা কৌশলে পেঁচিয়ে ধরল মোহের হাত।

“হুঁশশ… আমি এতো সোহাগ করে তোমার হাসিমুখটা দেখতে চাইলাম তুমি তার বদলে চোর প্রমাণ করতে চাইছো সবার সামনে? এর বদলে তো তোমার উল্টে আমায় আদর-সোহাগ করা উচিত!”

চলবে…

#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩০

রাগে ও লজ্জায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পরে মোহ। এই মানুষটা কে? এতো চেনা কেন? মনের কুঠুরি থেকে একটা মানুষের নামই বের হচ্ছে সেটা হলো ‘স্বচ্ছ’।কিন্তু এর আগেও মানুষটাকে স্বচ্ছই মনে হয়েছিল তবে বার বারই ভুল প্রমাণিত হয়েছে মোহ। তাই আজ এই আগন্তুক কে ধরার চিন্তাভাবনা নিয়েছে সে। লোকটার সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেও যেন কোনো কাজ হলো না। এবার তো লোকটা মুখও চেপে ধরেছে। নড়াচড়া কিছুতেই পেরে উঠছে না মোহ। অন্ধকার বাড়িতে একটু আলোর ব্যবস্থাও রাখেনি আগন্তুক লোকটি। এতোক্ষণে মোহ বুঝেছে লোকটার গায়ে চাদর জড়ানো। চাদর থেকে একটা অদ্ভুত ঘ্রাণ বের হচ্ছে যা নাকে ঠেকছে মোহের। ধীরে ধীরে শক্তি ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে সে। ছোটাছুটি কম হয়ে আসছে তার। তৎক্ষনাৎ আগন্তুক ব্যক্তিটি চাপাসুরে মোটা কন্ঠে বলল,
“তুমি যখব হাসবে আমার বিষাদময় পৃথিবীটা সৌন্দর্য ও সুখে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।
তোমার চিকন ঠোঁটে যখন এক চিলতে হাসির দেখা পাবো, তখন আমার হৃদয়ে যে মরুভূমি সৃষ্টি হয়েছে তা নিমিষেই পাল্টে গিয়ে প্রাণের সঞ্চার ঘটাবে।”

ব্যাস…এতটুকুই কানে বেজে উঠল মোহের। তারপর চারিপাশটা নিস্তব্ধ লাগলো তার। বার বার কানে বাজতে থাকল সেই নেশাভরা কন্ঠ যা বড্ড মধুর ছিল মোহের কাছে। যেন কন্ঠটা কাছের কারোর। বড্ড কাছের। চোখ আর খুলে রাখারও শক্তি পেলো না মোহ। মৃদু কেঁপে উঠে ঢলে পড়ল আগন্তুক ব্যক্তির বুকে। একজোড়া প্রশস্ত হাত বেশ যত্নের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল মোহকে। হাতজোড়ার মালিক বেশ ব্যথিত কন্ঠে বলে উঠল,
“আই এম সরি! আজকেই ধরা দিতে চেয়েছিল তোমার মি. চোর। কিন্তু পারল না। ঘরের মাঝেও তুমি সেফ নও। সেখানে ঘরের বাহিরে আমি আসতে দিতে পারব না। এই মি. চোর বড় দোটানায় পড়েছে। সে ক্লান্ত। সে #একটুখানি_সুখ চায়। তোমার কাছে হবে #একটুখানি_সুখ?

ভোরের সময়। আজান এখনো দেয়নি। প্রকৃতির রূপ বেশ নির্বিকার। গায়ে মোটা ব্ল্যাংকেট জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে এক পুরুষ আর এক রমনী। তারা আর কেউ নয় স্বচ্ছ ও মোহ। ঘুমটা ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসছে মোহের। চোখমুখ কুঁচকে কি যেন বিড়বিড় করছে সে। আচমকা মাথা উঠিয়ে সে চোখ বুঁজেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
“চোর, চোর। কেউ আছো? চোর ধরেছি!”

বার বার কথাটা বলার পর চোখ মেলে তাকানোর শক্তি পায় মোহ। সে কোনো শক্তপোক্ত জিনিসকে আঁকড়ে ধরে আছে। শুয়েও আছে তার ওপরেই। হঠাৎ এক শব্দে বাকি ঘুমটাও ছুটে গেল তার। চোখ মেলে স্পষ্ট ভাবে তাকাতেই চক্ষু চড়কগাছে পরিণত হয় তার। যার ওপর ও যাকে জড়িয়ে সে শুয়ে ছিল সে আসলে কোনো বস্তু নয় আস্ত একটা মানুষ। মানুষটির নাম স্বচ্ছ! শুধু মোহই যে স্বচ্ছকে জড়িয়ে আছে সেটা নয় স্বচ্ছও মোহকে পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে যেন নিজের সঙ্গে তাকে বেঁধেই ফেলেছে সে। তাড়াহুড়ো করে নিজেকে ছাড়াতে গেলেও কিছু একটা ভেবে থমকায় সে। আস্তে করে নিজের মাথা আবারও ঠেকিয়ে দেয় স্বচ্ছের বুকে। এখানেই তো মাথা রেখে শান্তিতে ঘুমাচ্ছিল সে। মনে ছিল প্রশান্তি। মোহের মনটা টুপ করে বলে উঠল, “আহা মোহ! কাছেই আস্ত একটা শান্তির জায়গা, শান্তির মানুষ থাকতে কেন তুই ঘর থেকে বেরিয়ে শান্তির খোঁজে ছুটছিলি? এই মানুষটাই তো তোর শান্তি!”

মুচকি হাসে মোহ। আস্তে করে বলে,
“কেন জানি না যেই মানুষটা আমার অশান্তির কারণ ছিল সেই মানুষটাই আমার প্রশান্তির কারণ হয়ে উঠেছে।”

তৎক্ষনাৎ হাসি মিইয়ে যায় মোহের রাতের কথা ভেবে। আবারও মাথা উঠিয়ে স্বচ্ছকে ভালোভাবে দেখে নেয় সে। রাতের ঘটনার পর কি ঘটেছিল তার সাথে ভাবতে চেয়েও পারে না সে। কারণ তার মনেই নেই কিছু। লোকটা কি স্বচ্ছ ছিল? কিন্তু স্বচ্ছ হলেও কেনই বা তাকে লুকিয়ে এমন কাজকর্ম করতে হবে? কি প্রয়োজন এর?

এসব ভাবতে ভাবতে বেশ ভাবনার ঘোরে ডুবে যায় মোহ। তাও যেন ভাবনার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পায় না। ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে সে হঠাৎ করে। তার মনে হলো বাহিরে জানালার ধার ঘেঁষে কারোর ছায়া! ঘাড় ঘুড়িয়ে জানালার দিকে তাকালো সে। একটা অবয়ব দ্রুত সরে গেল। তা দেখে কিছুটা আতঙ্কিত হলো মোহ। এটা কি ছিল? আর কে ছিল? হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। স্বচ্ছ তো এখানেই তার সাথে শুয়ে তাহলে ওটা কি ছিল? ওই আগন্তুক ব্যক্তি যাকে মোহ খুঁজছে?

কিছুটা বিকট শব্দে চোখ বন্ধ করে নেয় মোহ। নড়েচড়ে ওঠে স্বচ্ছ। মোহের বাঁধন আলগা করে দিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে। মোহ না পারছে স্বচ্ছকে ডাকতে আর না পারছে ভেতরে বসে থাকতে। তবুও সাহস নিয়ে মৃদু সুরে মোহ ডেকে ওঠে,
“শুনছেন? উঠবেন একটু?”

সাড়া দিল না স্বচ্ছ। সন্ধ্যা থেকে রিসেপশনের পর বেশ ক্লান্ত স্বচ্ছ। পুরো বাঁধন ছাড়িয়ে মোহ সরে এসে বসে। বেড থেকে নিচে নেমে পায়ে স্লিপার পড়ে উঠে দাঁড়িয়ে এলোমেলো পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। অনেকটা ভেবে সাহস সঞ্চয় করে দরজা খোলে মোহ। এটা তো আর অচেনা কারোর বাড়ি না। নিশ্চয় বাড়ির কেউই উঠেছে ঘুম থেকে। বাড়িতে তো অচেনা কেউ থাকে না। এসব ভেবে বাহিরে বেরিয়ে এসে দরজা হালকা করে লাগিয়ে দেয় মোহ। পুরো করিডোরে যেখানে যেখানে বড় ল্যাম্পশিট আছে সেখানেই আলো জ্বলছে। বাদ বাকি সবটা অন্ধকার। মৃদু আলোতে আশেপাশে তাকিয়ে হেঁটে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে আসে মোহ। ঢক গিলে হালকা জোরে প্রশ্ন করে,
“কে এখানে?”

কারোর সাড়া নেই। আশাহত হলো মোহ। ফিরে যাবার জন্য পিছু ফিরতেই পায়ের ধুপধাপ আওয়াজে সঞ্চয় করা সাহস যেন হাওয়াই মিলিয়ে গেল। মোহের কপালে জমতে শুরু করে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ভেতরে যেন প্রাণপাখি উড়ে যাচ্ছে। সামনে ফিরতেই করিডোরের ওপাশে একটা আবছা অবয়ব চোখে পড়ে মোহের। চোয়াল শক্ত করে ফেলে সে।
“কে ওখানে? বাবা? মা? নাকি অন্যকেউ? সাড়া দিন।”

জবাব না পেয়ে ফ্যাকাশে প্রলেপ ছড়িয়ে যায় মোহের চেহারায়। অবয়বটি ধেয়ে আসে তার দিকে বেশ দ্রুত পায়ে। যতই অবয়বটি এগিয়ে আসছে ততই মোহ দেখতে পাচ্ছে এক প্রশস্ত অবয়ব যা পুরুষের হয়। এ কোনো মহিলা নয়। এই সিঁড়ি নিচে ছাড়া ওপরে কোনো ল্যাম্পশিট নেই যে ভালোভাবে অবয়বের মুখটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠবে। সিঁড়ির দিকে পিছিয়ে যায় মোহ। ভয়ে নিঃশ্বাস প্রগাঢ় হয়ে আসে তার। অবয়বটির হাতে কাঁচের বড় টুকরো চকচক করছে। নিজের পায়ে থাকা অবশিষ্ট শক্ত হারিয়ে ফেলে মোহ। সাথে বাকশক্তিও। তবুও কন্ঠে চাপ দিয়ে বলে,
“ক…কে আপনি? এই বা…বাড়িতে আপনি কি করছেন?”

“আমি সে যাকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। তোমাকে আমার পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। এর ফল তো ভালো নয়।”

মোহ কিছু বলতে পারে না। আগন্তুকটির থেকে তার দূরত্ব মাত্র দুই হাত দূরে। কাঁচের টুকরো উঁচিয়ে রেখেছে সে। যেকোনো সময় সেটা দিয়ে আক্রমণ চালাতে প্রস্তুত সে। লোকটা আবারও আক্রোশ নিয়ে বলে,
“খুব সুখে আছো না? কিন্তু, আমাকে যে সুখে থাকতে দেয় না তাকে আমিও সুখী হতে দিই না। তুমিও পাবেনা সুখ। কেউ পাবেনা।”

বাকহারা হয়ে ব্যক্তিটির চেহারা দেখার প্রয়াস চালাচ্ছে মোহ। মাথায় ঝাঁকড়া চুল, একজোড়া হিংস্র চোখজোড়ার দেখা পেয়েছে সে। এরই মাঝে লোকটা তেড়ে আসে মোহের দিকে। মোহ আতঙ্কিত হয়ে পিছিয়ে যায় পেছনে। পেছনে সিঁড়ি। তা প্রাণ বাঁচানোর ভয়ে খেয়ালই নেই মোহের। যার কারণে পা ঠিক জায়গায় ফেলতে ব্যর্থ হয় সে। পিছলে যায় তার পা। নিজেকে সামলাতে না পেরে নিচে গড়িয়ে উপুর হয়ে পড়ে যায় সে। সঙ্গে দিয়ে ওঠে এক গগনবিদারী চিৎকার। কেন যেন মনে হয় এখানেই জীবনটা শেষ তার। ডান হাতে অনুভূত হয় অসম্ভব ব্যথা। আপনাআপনি চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তার আগে চোখে পড়ে সিঁড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা এক হিংস্র ব্যক্তিটি!

চোখ মেলতেই আলোর ঝলকানি এসে পড়ে মোহের চোখে। চোখ খিঁচে ফেলে সে। ডান হাত নাড়িয়ে মুখের ওপর রাখতে গিয়ে ব্যর্থ হয় সে। হাতে অনুভব হয় প্রচন্ড ব্যথা। মৃদু চিৎকার দিয়ে ফেলে ব্যথায়। কপালেও যেন ক্ষীণ ব্যথা হয়।
“হাত নাড়াতে যেও না মেয়ে। লাগবে হাতে।”

চোখ আবারও আস্তে করে খুলে তাকায় মোহ। সামনে বিষণ্ণ মুখে মিসেস. রেবা বসে আছে। সামনে আরেকজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। পোশাকআশাক দেখে মনে হচ্ছে ডক্টর। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্বচ্ছকে খুঁজল মোহের চোখজোড়া। কিন্তু পেলো না। তারপর নিজের হাতে চোখ বুলাতেই হতভম্ব হয় সে। ডান হাত ব্যান্ডেজ করে ঝুলিয়ে রাখা। কি হয়েছে তার ভাবতেই ডক্টরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় সে। ডক্টর নরম কন্ঠে বলে ওঠে,
“চিন্তার কারণ নেই। হাতেট হাড় ভাঙেনি। কিন্তু ইঞ্জিউরড হয়েছে ভালোই। তাই হাতটা কয়েকদিন এভাবেই রাখতে হবে। আর কপালে হালকা ব্যথা পেয়েছে সে। তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে চিন্তার কারণ নেই।”

ভোরে ঘটা ঘটনাগুলো ভাবতেই ভীত হয়ে পড়ে মোহ। জড়োসড়ো হয়ে পড়ে সে। সাহস বাড়াতে প্রয়োজন স্বচ্ছ নামক মানুষটাকে। কিন্তু সে কোথায়? ভাবতেই কোথাও থেকে হন্তদন্ত হয়ে এসে মোহের পাশে বসে শোয়া অবস্থা থেকেই জড়িয়ে ধরে মোহকে। উষ্ণ আবেশ পেতেই মোহের চিনতে দেরি হয় না মানুষটা আর কেউ নয় স্বচ্ছ। মোহের শান্তির মানুষটা।
“তুমি ঠিক আছো? ব্যথা পেয়েছো খুব? সব আমারই দোষ। এতোটা ঘুমানো উচিত ছিল না আমার। এতো বেখেয়ালি কি করে হলাম আমি? হাউ স্টুপিড আই এম!”

চলবে…

[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। এর বাস্তবে কোনো ভিত্তি নেই।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে