একটি পানকৌড়ির গল্প….. পর্ব – ৬

0
5444
 একটি পানকৌড়ির গল্প…..
পর্ব – ৬

ভোরের দিকে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সাদা বক, পানকৌড়ির দেখা পাওয়া যায়। ফারিয়া মনযোগ দিয়ে এদের উড়াল দেয়া, মাছ স্বীকার করা দেখে। পানকৌড়ি ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ পর্যন্ত পানিতে ডুবে থাকতে পারে। এক ডুবে বেশ খানিক নদী পথও অতিক্রম করে।
ফারিয়া অবশ্য কতটা পথ এক ডুবে অতিক্রম করে সেটা মেপে বের করতে পারেনি। প্রায়ই ইচ্ছা হয় মেপে দেখার কিন্তু সে তো সাঁতার জানেনা। পানকৌড়ির মাছ স্বীকার করা, ডুব দিয়ে অনেকক্ষণ পর উঠে আসাকে সে একটা নাম দিয়েছে।খুব সাধারণ একটা নাম – খেলা। পানকৌড়ির খেলা দেখার সময় ফারিয়া তার কষ্ট গুলো বেমালুম ভুলে যায়। তখন নিজেকে তার খুব সুখী মনে হয়। তার মনেই থাকেনা কী ভয়ংকর স্বপ্ন তার চারপাশে ঘিরে আছে!
মনেই থাকেনা এখনো নাকে সেই গন্ধটার তার পেটের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে যায়।
এই একটা সময়, কিছু মুহূর্ত তাকে সুখী করে তোলে! অসহ্য হয়ে ওঠে যখন এই একঘেয়েমি জীবন তখন চোখ বুঝে সকালের এই নদীর পাড়ের দৃশ্য তাকে স্বস্তি দেয়। কেনো এতো ভালো লাগে, তার জানা নেই! কখনো জানতেও চায়নি সে।
ফারিয়া জানে তার মা জানার জন্য অধীর হয়ে থাকে, কেনো ভালো লাগে? তার মায়ের সব বিষয়ে কৌতুহল ! ডাক্তার সাহেবকে নিয়েও! রশীদ আলম কে কেনো ডাক্তার বাসায় ডেকেছেন এর উত্তর অনেক বার শুনেছে তারপরও তার কৌতুহল কমেনি।
ফারিয়া কখনো চায়না তার মা – বাবা, ফাহাদ তাকে নিয়ে চিন্তা করুক। কিন্তু তারা করে। ছোট্ট ফাহাদও বড় আপুকে কানে কানে জিজ্ঞেস করে
– তুমি সুস্থ হবে কবে?
ফারিয়া হেসে বলে
– আমি তো সুস্থ!
– কই? দাদী বলে তুমি সুস্থ হবে না।
– মা বলে হবো।
– সত্যি মা বলেছে?
– হ্যাঁ রে!
এখন প্রায়ই নিজের মাকে দেখার স্বাদ জাগে! তার মা কি দেখতে তার মতোই ছিলো? বাবার সাথে ফারিয়ার তেমন মিল নেই। তাই সে ধরেই নিয়েছে, মায়ের সাথে তার মিল বেশি।
এইযে মাঝেমধ্যে আমি মায়ের কথা মনে করি, আমার মাও কি তাই করে? তারও আমাকে দেখতে ইচ্ছে করে?
যখনই ফারিয়া নিজের মাকে নিয়ে ভাবতে থাকে তখনই লিমা তার ঘরে আসে গল্প করতে।
নিজের মায়ের বদলে তখন এই মাটাকে নিয়ে সে ভাবতে থাকে। এই মা কতো ভালো! কতো না ভালোবাসে তাকে। এই লিমা মায়ের সাথে যদি তার মিল থাকতো!
এই মায়ের ডান গালে বেশ বড় একটা তিল আছে। যখন হাসে সেই তিল টা আরো বেশি সুন্দর লাগে!
ইশ, যদি এরকমই একটা তিল তার বাম গালে থাকতো! মাকে জোর করে আয়নার সামনে নিয়ে বলতাম
– দেখো মা, তোমার মতো আমারও তিল আছে!
মা হেসে বলতেন
– কী যে বলিস! আমার মতো হবে কেনো? তোর মতোই হয়েছে।
ফারিয়া মনে মনে ভাবে তখন সে মন খারাপ করে বসে বসে কাঁদার ভান করবে। মা অস্থির হয়ে পড়বেন, কীভাবে কান্না থামানো যায়। তখন স্বীকার করে নিবেন
– তুই ঠিকই বলেছিস তোর আর আমার তিলটা পুরোপুরি এক। ফটোকপি। আজকাল চোখে একটু কম দেখিতো তাই হুট করে কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা।
ফারিয়া শুনে মুচকি হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে। তার মা খুব ভালো মিথ্যা বলতে জানেনা। মা জাতটাই অদ্ভুত !
যখন তার শারীরিক কষ্টটা বাড়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে তার মাও কষ্ট পাচ্ছেন। আসলে তিনিই আমাকে শুধু পেটেই রাখেননি তাছাড়া সে আমার সবকিছু, সবকিছু।

রশীদ আলম ভরদুপুরে ডাক্তারের ফোন পেয়ে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন
– জি, আমি ফারিয়ার বাবা।
– ভালো আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?
– এইতো আছি। আপনার সাথে আমার একটু দেখা করা দরকার। আর ফারিয়ার সাথেও।
– তাহলে কটায় আসবো আপনার চেম্বারে?
– আমি আপনার বাসায় আসবো আমার স্ত্রীও সাথে থাকবে। সন্ধ্যার দিকে। আপনার বাসার পরিবেশ টাও আমার দেখা দরকার। বুঝতেই পারছেন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা দ্রুত চালাচ্ছি।
– আচ্ছা আসুন।
– বাসার ঠিকানা টা বলুন। আমার স্ত্রীকে সাথে নেয়ার কারণটা আপনাকে বলি। রেহানা আমাকে দীর্ঘ ক্ষণ না দেখে থাকতে পারেনা। আপনার বাসায় আমার অনেক সময় ব্যয় হবার সম্ভাবনা আছে তাই আমার স্ত্রীকে সাথে নিয়ে আসছি।
– আচ্ছা আপনারা আসুন।
রশীদ আলম বিপদে পড়ে গেলেন। তার মা জানেন না যে মেয়েকে ডাক্তার দেখানো হচ্ছে। জানতে পারলে কী হবে তার জানা নেই!
জানুক তো, সত্যি কথা সে বলে দেবে।
রশীদ আলম মায়ের ঘরে গিয়ে বিছানার পাশে চেয়ারে বসলেন। দুপুরে তার মা ঘুমান। কিন্তু আজকে ঘুমান নি। বিছানায় শুয়ে আছেন আর পান চিবাচ্ছেন।
রশীদ আলম সাহস করে বললেন
– মা, আজকে বাসায় সন্ধ্যায় দু’জন মেহমান আসবে।
– কে কে আসবে? তোর বন্ধুরা?
– নাহ, আফতাব হোসেন আর তার স্ত্রী।
– ইনি আবার কে রে রশীদ?
– ফারিয়ার ডাক্তার।
রশীদ আলমের মা কঠিন স্বরে বললেন
– যা ইচ্ছা হয় করো। আমার কাছে জিজ্ঞেস করতে আসবা না। ডাক্তার দেখানোর আগে তো জিজ্ঞেস করতে আসো নাই। আজকে ক্যান আসছো? টাকা লাগবে এই আমার কাছে?
– না। বললাম যাতে তুমি তাদের সাথে ঝামেলা না করো।
– আমিই তো ঝামেলা করি। আর ওই নবাবজাদি তো বসে বসে গুদাম ভরছে।
রশীদ আলম সাহেব মায়ের ঘর ছেড়ে বের হয়ে বাথরুমে গিয়ে দরজা আটকে পানির ট্যাব ছেড়ে দিলেন। তারপর জোরে জোরে কাঁদতে লাগলেন।
জীবন টা তার কাছে খুব অসহ্য হয়ে উঠছে দিন দিন।মরে যেতে ইচ্ছে করে। বড় বড় ট্রাক যখন দ্রুতগতিতে ছুটে যায় তখন তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেই হয়। মেয়েটা আর ছেলেটার জন্য চিন্তা হয়। লিমার জন্যও হয়। খুব অসহ্য সময় চলছে তার। হয়তোবা খুব দূরেই এই সময়ের সমাপ্তি ঘটবে।
রেহানা বেগম বেঁকে বসেছেন। রশীদ আলমের বাসায় তিনি যাবেন না। ওই বাড়ি তিনি পা রাখতেই নাকি অশুভশক্তি তাকে গ্রাস করবে। রেহানা এরকম কথাবার্তা কখনোই বলেন না। কুসংস্কার কে তিনি তার মনে কখনো স্থান দেননি। রশীদ আলমের কথাবার্তায় তার মনে হুট করে কুসংস্কার বিঁধে গেছে। কিছুতেই তিনি উপরে ফেলতে পারছেন না। আফতাব হোসেন ও বেশ ঝামেলায় পড়েছেন। ওই বাড়ি দীর্ঘক্ষণ থাকতে হতে পারে। এই সময়ের মধ্যে তার স্ত্রী ভয়ংকর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। খুব বেশি ভালোবাসলেও সমস্যা আবার খুব কম ভালোবাসলেও সমস্যা। একটা মধ্য পর্যায়ে থাকলেই ভালো। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় খুব বেশি আর কম ভালোবাসাটাই মানুষের মধ্যে থাকে। স্বাভাবিক মাত্রার ভালোবাসা পাওয়া ভার।
আফতাব হোসেনের মনে হলো, সে নিজেই স্বাভাবিক মাত্রায় ভালোবাসতে পছন্দ করেন। স্ত্রীকে কি আগের মতো ভালোবাসেন? প্রশ্ন টার উত্তর হবে না। ভালোবাসা আগের মতো নেই। বদলে গেছে। বদলে যাওয়ার কারণ সে নিজেই। সেই স্ত্রীকে বিভিন্ন অজুহাতে সময় দেন নি। যেকোনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে, সময় ব্যয় করতে হয়। সময়ের অভাবে কতো সম্পর্ক যে নষ্ট হয় তার পরিসংখ্যান ব্যুরোর লোকেরা দেখলে ভয় পেয়ে যেতেন। এইজন্য এই পরিসংখ্যান করা হয়না। রেহানা যেতে না চাওয়াতেই ভালো হয়েছে। সবসময় স্ত্রী সাথে থাকতে হবে এমন কেনো হবে? নিজেরও তো জীবন আছে। আনন্দ আছে, সুখ আছে। আফতাব হোসেন মন খারাপের ভান করে স্ত্রীকে বললেন
– আচ্ছা, তুমি যেহেতু যেতে চাচ্ছো না সেহেতু বাসায় থাকো। আমিই যাই। যাওয়াটা জরুরি, আমার কিছু তথ্যের খুব প্রয়োজন।
রেহানা বললেন
– অনেক রাত হবে?
– তা তো হতেও পারে।

চলবে……….!

© Maria Kabir

 

https://golpopoka-4ad355.ingress-bonde.easywp.com/boro-golpo/%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%95%E0%A7%8C%E0%A7%9C%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%AA-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC/

https://golpopoka-4ad355.ingress-bonde.easywp.com/boro-golpo/%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%9f%e0%a6%bf-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%95%e0%a7%8c%e0%a7%9c%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-2/

https://golpopoka-4ad355.ingress-bonde.easywp.com/boro-golpo/%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%9f%e0%a6%bf-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%95%e0%a7%8c%e0%a7%9c%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d/

https://golpopoka-4ad355.ingress-bonde.easywp.com/boro-golpo/%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%9f%e0%a6%bf-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%95%e0%a7%8c%e0%a7%9c%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-3/

https://golpopoka-4ad355.ingress-bonde.easywp.com/boro-golpo/%e0%a6%8f%e0%a6%95%e0%a6%9f%e0%a6%bf-%e0%a6%aa%e0%a6%be%e0%a6%a8%e0%a6%95%e0%a7%8c%e0%a7%9c%e0%a6%bf%e0%a6%b0-%e0%a6%97%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%aa-%e0%a6%aa%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ac-%e0%a7%ab/

https://golpopoka-4ad355.ingress-bonde.easywp.com/?p=8178&preview=true

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে