একটা পরীর গল্প পর্ব-০১

0
2969

একটা_পরীর_গল্প
#সাদিয়া_আহমেদ_রোজ
#সূচনা_পর্ব

কিছুক্ষণ পরেই আমার বিবাহ। খুব ধুমধাম করে আমার বাবা-মা আমার বিবাহ দিচ্ছেন এক ৩৩ বছর বয়সী বুড়োর সঙ্গে।

বিবাহের আয়োজন দেখে আমার সারা শরীর ঘিনঘিন করছে। বুড়োর চৌদ্দগুষ্টির মানুষ এসে গিজগিজ করছে আমার চারপাশে। একে তো গ্রীষ্মের তীব্র তাপ অপরদিকে ঘরভর্তি মানুষের ভিড়ে, তপ্ততায় সিদ্ধ হবার মতো অবস্থা আমার। ভারি কাতানের শাড়ির এক কোনা উঁচু করে নিজেই নিজের মুখে হাওয়া দিচ্ছি। সারা শরীর ঘেমে চপচপ করছে। এমন বিরক্তিকর অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে যে আমিও পড়তে পারি সেটা কল্পনাও করতে পারিনি। এক মহিলা এসে আমার পাশ থেকে বুড়োর বোনকে ডেকে নিয়ে গেলো। হঠাৎ করেই যেন ধীরে ধীরে ঘর ফাঁকা হতে থাকে। আমি বিষ্মিত হবার ভান করে গম্ভির মুখে বসে থাকি। আসলে খুশিই হয়েছিলাম। অসহ্য লাগছিলো সবটা, কিন্তু মুখে সে কথা বলার জো কোথায়? কিছুক্ষণ পর আমার বোন দীপ্তি এসে আমাকে খবর দিলো।

– ” আপু, আপু তোর বর নাকি পালিয়ে গিয়েছে। কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। বেশ হয়েছে বুইড়া ব্যাটার শখ দেখে বাঁচি না। ”

আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক বিয়েটা তাহলে হবে না। কিন্তু পরক্ষনেই এক অজানা চিন্তা ঝেকে বসলো মাথায়। বিয়ে যদি না হয় তাহলে তো আমার বদনাম হয়ে যাবে। পরে তো কেউ বিয়ে করবে না আমাকে। তারপর ভাবলাম, বিয়ে না করে না করুক। তাতে আমার কি? কিন্তু চিন্তার বিষয় এটাই যে, যে বুড়োটা টানা একমাস ধরে ঘুরলো আমার বাবার পেছনে, শুধুমাত্র আমাকে বিয়ে করার জন্য বাবার জমিগুলোও অন্যায়ভাবে দখল করলো সেই চেয়ারম্যানের ছেলে বিয়ের দিনই হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলো কিভাবে? কোথাও তো গন্ডগোল আছেই। আমি দীপ্তিকে বাইরে পাঠিয়ে দিলাম খবর আনার জন্য। কিছুক্ষণ পর দীপ্তি হন্তদন্ত হয়ে কোথা থেকে যেন ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে আছি। দীপ্তি মধুর সুরে বললো।

– ” বর এসে গেছে আপু। এবার বিয়েটা হবে। ”

কথাটা আমার কর্ণগোচর হতেই আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। এমন একটা সাংঘাতিক, মারাত্মক খারাপ, বাজে খবর দিতে গিয়ে দীপ্তির এতো উল্লাস দেখে আমার গা জ্বলে গেলো। তেতে উঠে বললাম।

– ” আমার কপাল পুড়লো আর তোর আমোদ হচ্ছে? ”

দীপ্তি আমার গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদি কন্ঠে বলে উঠলো।
– ” আরে ওই বুড়োর সাথে নয় তোর বিয়ে তো অভীক ভাইয়ার সাথে হবে আপু। ”

‘ তোর বিয়ে তো অভীক ভাইয়ার সাথে হবে ‘ কথাটা আমার কর্ণধারে পৌছাতেই আমি লাফিয়ে উঠি। অভীক ভাই মানে আব্বুর সেই শহুরে বন্ধুর গম্ভির ছেলে। যে মিনিটে মিনিটে আমার খুঁত ধরে, আমাকে বিনা কারনে ঝারে, প্রত্যেকটা কাজ তিনবারের নিচে করায় না, মাসে একবার কথা বললেও তার মুখে সবসময় নিমপাতার তেতো রসের মতো বুলি থাকে। কয়েকবার তো আমার চুল ধরে টেনেছে, এমনকি বাবার কাছে মিথ্যা বলে আমাকে মারও খাইয়েছে। সেই অভীক ভাইকে বিয়ে করতে হবে? এর থেকে তো বুড়োটাই ভালো ছিলো। দীপ্তি আবার বলে উঠলো।

– ” জানিস আপু ভাইয়া তো কিছুতেই বিয়ে করবে না। বলে কিনা গ্রামের গাইয়া মেয়ে, খ্যাত, আনস্মার্ট মেয়েকে কখনই নিজের বউ বলে মানবে না। কিন্তু চাচ্চু যে ধমক দিলো, উনি ভয়েই সুড়সুড় করে রাজি হয়ে গেলো। ”

আমি অবাক হলাম দীপ্তির কথা শুনে। উনি আর ভয়? হঠাৎ বিপরীত মেরু পরস্পরকে আকর্ষন করলো কিভাবে বোধগম্য হলো না আমার। আমি নির্ভীক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম জানালাই বাহিরের পানে। উঠানে কয়েকটা রাজহাঁস ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আধাঘন্টার মধ্যে যেন পুরো গ্রাম খালি হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে পুরো বাড়িটা। দীপ্তি আবার কোথা থেকে ছুটে এসে আমার মাথায় ঘোমটা টেনে দিলো।

– ” আপু কাজীসাহেব আসছেন। ভাইয়া কবুল বলে দিয়েছে। এবার তোর পালা। দেখ একদম ত্যাড়ামি করবি না ঝটপট কবুল বলে দিবি। নাহলে কিন্তু পরে খুব মারবো তোকে ”

কাজী সাহেব আসলেন। যথারীতি তার বক্তব্য শেষ করলেন। আমার স্থির চাহুনি আমার শাড়ির ওপর থাকা একটা আংটিতে। অভীক ভাইয়ার আংটি যেটা গত পাঁচবছর আগে আমার জন্মদিনের উপহার হিসাবে আমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সোনার আংটির উপর সাদা পাথরটা চিকচিক করছে। কানে ভেসে আসলো কাজীসাহেবের কর্কশ ধ্বনি ‘ বলো মা কবুল ‘। আমি নিজের অজান্তেই চটজলদি বলে দিলাম কবুল। সবাই আমার ব্যবহারে মুখ টিপে হাসলো। নিজের কাজে নিজেই হকচকিয়ে যাই। যাকে পছন্দ করিনা তাকে বিয়ে করার সময় এমন অকপটে কবুল বললাম? আমার ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে দাদি বলে উঠলেন।

– ” এই দীপ্তি বাইরে যাইয়্যা তোর আব্বারে ক পরী কবুল কইছে। ”

দীপ্তি খুশিতে নাচতে নাচতে বাইরে চলে যায়। একে একে সবাই চলে গেলো। কেন গেলো বুঝলাম না। ঠিক এই মুহূর্তে আমাকে একা রেখে বাইরে যাওয়ার কোনো উপযুক্ত কারন খুজে পেলাম না আমি। কিন্তু হঠাৎ একজনের আগমনে, বিষ্ময়ে আমার চোখ চড়কগাছ। অভীক ভাইয়া এসেছেন। সারা শরীর ঘেমে একাকার। পাঞ্জাবি ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু মুক্তার ন্যায় ঘামগুলো উনি দ্রুততার সাথে রুমাল দিয়ে মুছে ফেললেন। তারপর দ্রুতগতিতে এসে আমার পাশে রাখা জগ থেকে ঢকঢক করে পানি গিলে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। আমার হাত-পা কাঁপছে ভয়ে। এখুনি বুঝি উনি আমাকে ঝারি দিবে, বলবে ‘ তোর জন্য আমার জীবন শেষ হয়ে গেলো, তোর মতো মেয়েকে বিয়ে করতে হলো আমাকে, তোর বর চলে গিয়েছে বলে সবাই আমাকে ধরে বেধে বিয়ে দিয়ে দিলো, আমার অন্য গার্লফ্রেন্ড আছে ব্লা ব্লা ব্লা। ‘ কিন্তু উনি কিছুই বললো না। শীতল চোখে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। এখনও আমার মুখের সামনে একহাত ঘোমটা। আমি ঘোমটার আড়াল থেকেই ওনাকে দেখছি। উনি থমথমে গলায় বললেন।

– ” ঘোমটার নিচ থেকে আমাকে দেখার প্রয়োজন নেই। গলায় তো ঝুলে পড়েছিস এখন আর এতো আদিক্ষেতার কি প্রয়োজন। ঘোমটা খুলেই দেখ তোর জন্য আমার কেমন নাজেহাল অবস্থা হয়েছে। ”

ওনার কথায় আমার গা-পিত্তি জ্বলে গেলো। আবুল্লারে কি আমি বলছিলাম আমাকে বিয়ে কর? বিয়ে করে উদ্ধার কর? বাপের ভয়ে নিজেই সুড়সুড় করে বিয়ে করে এসে এখন আমাকে কথা শোনাচ্ছে? এতো বড় সাহস। কিন্তু উনি তো একদিক থেকে আমাকে সাহায্যই করেছেন। সুতরাং এখন যা বলছেন বলুক। এইটুকু হক তো উনি নিজেই আদায় করেছেন। আমাকে কিছু বলতে না দেখে উনি নিজেই আমার ঘোমটা উঁচু করে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে দরজায় দ্রিম করে আওয়াজ হলো। দীপ্তির উচ্চহাসির শব্দ ভেসে আসছে কানে। অভীক ভাইয়া ভ্রু কুচকে তাকালেন দরজার দিকে। বিরক্তির সুর টেনে বললেন।

– ” তোর বোন দরজা আটকালো কেন? খোলাই থাকতো। লোকে এসে দেখতো আমার মতো নিষ্পাপ সুদর্শন যুবককে কোন পেতনির গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বস্তুত একটা প্রবাদ আছে না? বাঁদরের গলায় মুক্তার মালা? ”

আমি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম। উনি অপ্রত্যক্ষ ভাবে আমাকে বাঁদর বলছেন? তবুও চুপ করে বসে রইলাম। উনি এবার ধপ করে আমার পাশে শুয়ে পড়েন। আমি কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলাম। কিন্তু পরক্ষনেই উনি চট করে উঠে বসলেন। গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে, জানালা বন্ধ করে দিলেন। আমি বিষ্মিত চোখে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। কি করতে চাচ্ছেন উনি? উনি ম্লান মুখে বললেন।

– ” এই তোর ঘরে বডি স্প্রে বা পার্ফিউম আছে? তোর গায়ের বিশ্রি ঘামের গন্ধে বমি আসছে আমার। কিছু ব্যবহার করিস না নাকি? তোকে, তোর এই অবস্থা নিয়ে নাকি আমাকে সারাজীবন কাটাতে হবে। এটা ভেবেই তো গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করছে। ”

এবার রাগে ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থা আমার। আমি উঠে গিয়ে শো-কেস থেকে পার্ফিউম এনে ওনার হাতে দিলাম। মুখে বললাম।

– ” সেইম টু ইউ। ”

উনি আমার কথায় ফোস করে উঠলেন। তাতে আমার কি? তখন থেকে আমাকে যা নয় তা বলছেন। আমি কি সেধে সেধে গিয়েছিলাম ওনাকে বিয়ে করতে? কাল রাতেও তো উনি জানিয়েছেন আমার মতো কালা মাইয়্যার বিয়েতে নাকি উনি আসবেন না। আমার শরীরে যে বাতাসের ছোঁয়া লাগবে সেটার ছোঁয়া ওনার শরীরে লাগলেই নাকি উনি কালো হয়ে যাবেন। কিন্তু দেখ সকালেই ড্যাংড্যাং করতে করতে চলে এসেছেন। উনি বিছানার ওপর বসে আমার দিকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। এরপর সটান বিছানায় শুয়ে পড়লেন। ক্লান্ত স্বরে বললেন।

– ” আমার পা টা টিপে দে তো। তোর বিয়েতে খাঁটতে গিয়ে পা’টা ব্যাথায় ঝিম ধরে আছে। তোর বরকে খুজতে খুজতে গিয়ে এই দিগন্তের ঝলসানো রোদে পুড়ে কয়লা হতে হতে বেঁচে গিয়েছি। ”

আমি সরু চোখে তাকালাম ওনার দিকে। উনি পাঞ্জাবি খুলে পাশে রাখছেন। ওনার গলার দিকে তাকাবো ঠিক এমন মুহূর্তে উনি বলে উঠলেন।

– ” এই আমার বুক, গলা, মুখ এগুলোর দিকে নজর দিস না। তাহলে আমিও তোর মতো কালো ভুত হয়ে যাবো। তুই বরং পায়ের কাছে গিয়ে বস। আমার পা ব্যাথা করছে অনেক। পা টিপে দে। ”

আমি ঠোট উল্টিয়ে উত্তর দিলাম।
– ” আপনার গলা ব্যাথা করে না? ”

উনি বিস্ফোরিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। পরক্ষনেই বললেন।

– ” অনেক কিছুই তো ব্যাথা করে। তোকে কি আর সবটা বলা যায়? এই মনে কর তোর বাপে ধরে বেধে আমাকে মেয়েদের মতো স্যালোয়ার টাইপ কি একটা পায়জামা পড়িয়ে দিয়েছে পাঞ্জাবির সাথে ম্যাচিং করে তাতে ভেতরের অনেক কিছুতেই টান লাগছে। ব্যাথার কথা নাহয় বাদই দিলাম। কিন্তু তোকে এগুলো বলে কি লাভ? ”

আমি কিছুক্ষণ ওনার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ভাবলেশহীন চেহারা, শুভ্র মুখশ্রীর আড়ালে একটা নির্লজ্জ, বেহায়া, অসভ্য টাইপের ছেলের নাম কি করে ‘জুহায়ের মাহতাব অভীক’ রেখেছেন চাচ্চু ভেবে পাইনা। ছোটবেলায় ওনার চরিত্রের কোনো নমুনাই কি কারোর চোখে পড়েনি? পড়বেই বা কি করে? এখন অবধি তারা কেউ জানেনই না যে তাদের ছেলের এই হাল। পরিবারের সামনে এতোটা ভদ্র সেজে ঘোরেন আর বাইরে? এমন দুমুখো মানুষরূপী কালনাগ’ই আমার কপালে ছিলো? ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেলি ওনার আড়ালে, নীরবে, খুবই সন্তর্পণে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে