#একজন রূপকথা
#পর্ব_১১
#নুশরাত জেরিন
কবিতার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। সপ্তাহখানেক পরেই বিয়ের ডেট ঠিক করা হয়েছে। রোজিনা বেগম এর মাঝে শোভনকে ডেকে বললেন,
“গয়নাগাটি কিছু দিতে হবে তো বাবা, বিয়ের খরচও আছে। এত টাকার জোগাড় করতে পারবি?”
শোভন একগাল হেসে বলল,
“চিন্তা করো না মা, অফিস থেকে লোন নিয়েছি। মেয়েটা এতদিন এ বাড়িতে ছিলো, নিজ বোনের মত ভালবেসেছিলাম একসময়, জায়গাটায় নিজ দোষে ময়লা জমিয়েছে সে, তবে জায়গা থেকে কী অত সহজে সরিয়ে ফেলা যায়? সে আমাকে যাই ভাবুক আমি তাকে ছোট্ট বোনটিই ভাবি মা।”
রোজিনা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তার ছেলেটা একসময় ছেলেমানুষী করতো, বাচ্চামো করতো। সে আজ এত বড় হয়ে গেলো? চোখের পলকেই? এই না সেদিন হাফপ্যান্ট পরে তার কাছে এটাওটার জন্য বায়না করতো?
—
কবিতা কথার কাছে এসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। বিয়ে ভাঙার কম চেষ্টা করেনি সে ।ছেলের নম্বর জোগাড় করার চেষ্টা করেছিলো, পারেনি৷ বিকেলে শোভনের ফোন চুরি করে তন্ন তন্ন করে নম্বর খুজেছে। অফিসের ম্যানেজর সে। ম্যানেজর বা রোহান নামেই তো সেভ করার কথা। কিন্তু নাহ্। এ নামের টিকিটিও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
রোজিনা বেগমকে বারবার বুঝিয়েছে, সে এত দ্রুত বিয়ে করতে চায় না, বিয়ের বয়স হয়নি। তার বন্ধু বান্ধবদের কারো এখনও বিয়ে হয়নি।
রোজিনা বেগম থমথমে গলায় বলেছেন,
“কারো হয়নি তো কী হয়েছে, তোমার হবে।
তাছাড়া বিয়ের বয়স হয়নি অথচ বোনের সংসার ভাঙার বয়স হয়ে গেছে?”
কবিতা আর কিচ্ছু বলতে পারেনি। অবশেষে বাধ্য হয়ে কথার শরণাপন্ন হয়েছে। সেদিন বিকেলের পর থেকে কথা তাকে একদম এড়িয়ে চলে৷ সামনাসামনি পড়লেও টু শব্দটি করে না।
কবিতা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমায় এত বড় শাস্তি দিস না আপা, সামান্য ভুলের এত বড় শাস্তি হয় না।”
কথা বিস্ময় নিয়ে বলল,
“সামান্য ভুল?”
“সামান্যও তো না রে আপা। আমার তো কোনো ভুলই নেই৷ দুলাভাই তোকে ভুলভাল বুঝিয়েছে। আসলে তুই একটু সেকেলে তো, অন্যরকম। তাই আরকি তোকে দিয়ে তার আর পোষাচ্ছে না, এখন আমার পেছনে….!”
কবিতা কথা শেষ করতে পারলো না। কথার রক্তচক্ষু দেখে থেমে গেলো।
কথা বলল,
“উনি তোর নামে কিচ্ছু বলেনি কবিতা, তুই এত বেয়াদবি করার পরও বলেনি। যা জানার আমি নিজে জেনেছি, নিজের চোখে দেখে জেনেছি।”
কবিতা চুপসে গেলো। মুখে আর কোনো কথা ফুটলো না, মুলত কথা খুঁজে পেলো না।
কথা আচমকা উত্তেজিত হয়ে পড়লো। বরাবরই সে শান্ত মেয়ে। মামির হাজার বকাবকি, অশ্রব্য গালাগালি শোনার পরও সে কখনও রাগ করেনি, কঠিন কঠিন কথাও সে শান্ত গলায় বলেছে। হঠাৎ শান্ত মেয়েটার এমন অশান্ত রুপ দেখে কবিতা ভয় পেয়ে গেলো।
কথা তার দুবাহু দুহাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
“কেনো করলি কবিতা, কেনো করলি এমন?
আমি তো তোর নিজের বোন বল? আপন বোন? তবে আমার সাথেই কেনো কবিতা?
এটা সেই কবিতা তো, যে মামির ভয়ে আমায় আকড়ে জড়িয়ে রাখতি, আমাকে আকাশসম ভালবাসতি? আসিফের ধোকার পর শোভনের সাথে বিয়ে হওয়ায় তুই কতটা খুশি হয়েছিলি মনে আছে তোর? তবে এসব কেনো?”
কবিতা উত্তর দেবার আগে সে আবার বলল,
“আমি জানতাম আমার বোনটা একটু লোভি, একটু বাচ্চা, বয়সের তুলনায় বুদ্ধি কম। কিন্তু আমার প্রতি তার ভালবাসাটা কম না। আমি এতটা ভুল ছিলাম কবিতা? এতটা ভুল চিনলাম তোকে? মা চলে যাবার পর তোকে আমি মানুষ করেছি, নিজের শখ আহ্লাদ পায়ে পিষে তোকে খুশি রাখবার চেষ্টা করেছি। তাহলে আমিই কেনো কবিতা?”
এতক্ষণে কবিতা মুখ খুললো,
“তুই আমার বোন আপা, তবে আমার বোন বাক্যটাতে বোনের আগে কিন্তু আমার কথাটা আসে, ভেবে দেখেছিস? মানে কী জানিস?
আগে আমি তারপর আমার বোন তুই। তাহলে আমার কথা না ভেবে আগে তোর কথা কেনো ভাববো? আমার নিজের খুশিকে কেনো প্রাধান্য দেবো না?”
কথা প্রতুত্তর করতে পারলো না। কবিতা কখনই এমন শক্ত কথা বলতে পারতো না, সে তো নরম মনের মেয়ে ছিল, একটু ধমকেই যে কেঁদে দুনিয়া ভাসাতো। তার হঠাৎ এত পরিবর্তনের কারণ কী? সময়, নাকি পরিস্থিতি? নাকি অসৎ সঙ্গ? ভার্সিটির উশৃংখল বন্ধু বান্ধবদের সাথে মিশেই কী কবিতার এই অধঃপতন?
—
বিয়েতে খুব বেশি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান না করলেও একেবারে সাদামাটাও হলো না। শোভনের আত্মীয় স্বজনরা না থাকলেও কলিগরা এসেছে। বসার রুমটা সবাই হাসি আনন্দে মুখরিত করে রেখেছে।
একজন কলিগ তো কথায় কথায় বলেই ফেলল,
“শোভন ভাইয়ের শালীকার সাথে সাথে তার নিজেরও কপাল খুলে গেলো। ম্যানেজারের সাথে আত্মীয়তা হচ্ছে, এবার প্রমোশন ঠেকায় কে?”
শোভন কথাটা আমলে না নিয়ে হেসে উড়িয়ে দিলো। কী সব উদ্ভট কথাবার্তা। আত্মীয়র ক্ষমতা থাকলেও বা কী? শোভন তো আর সুবিধাবাদী না, সে নিজের যোগ্যতায় প্রমোশন নেবে, অন্যথায় নয়।
মালোতিকে খাবার আনা নেবার কাজ দেওয়া হয়েছে। কথা এতগুলো মানুষের সামনে যেতে সাচ্ছন্দ্যবোদ করে না। রোজিনা বেগমও নিষেধ করে দিয়েছেন।
রোহান বসেছে কোনার সোফাটায়। তার মুখ জুড়ে তৃপ্তির হাসি। কবিতাকে সে কয়েকদিন আগে থেকেই নজরে রেখেছিলো। শোভন তো এর আগেও তাকে ভার্সিটি নিয়ে গেছে।
মালোতি বসার ঘরে পা রাখার সাথে সাথে উল্টো ঘুরে কিচেনে ফেরত গেলো। কথা বলল,
“কী হলো মালোতি? খাবার নিয়ে ফিরে এলে কেনো?”
মালোতি উত্তর দিলো না। তার মুখ গম্ভীর।
মিনিট দুয়েক বাদে সে গম্ভীর খোলস ছেড়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠলো।
কথা তখন হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে।
—
মালোতি মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। গ্রামের টিনের চালাওয়ালা ছোট্ট ঘরটায় সে, বাবা মা আর তার দু’ভাইয়ের সুখী সংসার ছিলো, যেখানে খাবারের অভাব হলেও সুখের অভাব ছিলো না।
তারপরও মালোতি লোভ করে ফেলেছিলো, আরেকটু ভালো থাকার লোভ, ভালবাসার মানুষের লোভ। সেই লোভের লোকটার হাত ধরে পারি জমিয়েছিলো অজানা অচেনা শহরটায়। নতুন করে সংসার পেতেছিলো। তার স্বামী তখন ভালো বেতনের চাকরী পেয়েছে, টাকা পয়সা, শাড়ি গয়নার ছড়াছড়ি। শুধু ভালবাসাটাই যেন ফিকে হয়ে গেলো। বছর খানেক যেতে না যেতে ভালবাসা শব্দটাও আর রইলো না।
লোকটা কেমন মুখের ওপর ডিভোর্স লেটার ছুড়ে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলেছিলো,
“তোমাকে আমার সাথে মানায় না মালোতি, তুমি গ্রামের অশিক্ষিত মেয়ে, আর আমি এত ভালো বেতনের মাইনে পাওয়া লোক। তোমার সাথে আমায় যায় বলো?”
মালোতি তখন কাগজটায় সই করে একটা কথাই বলেছিলো,
“আসলেই তোমার সাথে আমার যায় না, এত জঘন্য মানুষটার সাথে অন্তত আমার মত মেয়েকে মানায় না।”
কথা এসব কথা মালোতির মুখ থেকেই শুনেছে। শোভনের কলিগদের মধ্যে মালোতির স্বামীও আছে। বিয়ে করেছে সম্পৃতি, ভালো ঘরের মেয়েকে। মেয়েটা এসেছেও এ বাড়িতে। সাজ পোশাক দেখলে তাকে নির্দ্বিধায় উশৃংখল বলে আখ্যায়িত করা যায়। কথা মালোতির মাথাটা বুকে চেপে চুপচাপ বসে রইলো।
চারপাশে এত মুখোশধারী মানুষ কেনো কে যানে? তাদের বাইরেটা কত চাকচিক্যে ভরা অথচ ভেতরটায় পচন ধরা।
এই যে এই ছোট্ট মেয়েটা, তার সাথে এত খারাপ হবার কী খুব বেশি দরকার ছিলো? তার দোষটা কোথায় ছিলো, ভুল মানুষকে বিশ্বাস করা, সেই দোষেই বুঝি এখন লোকের বাড়ি কাজ করে খেতে হয়? কথা নিজেও কী ভুল করেনি? কবিতাকে বিশ্বাস করে?
কিন্তু বিশ্বাস করাটা দোষের নাকি বিশ্বাস ভাঙাটা?
বিয়ের আগমুহূর্তে বাতাসের মতো ছড়িয়ে পরলো, কনে পালিয়েছে। বিয়ে বাড়ির কোনায় কোনায় সব জায়গা খোজা শেষ, কনের হদিস পাওয়া যায়নি।
তবে কথার রুমে একটা চিঠি খুজে পাওয়া গেলো,
কবিতা লিখেছে,
“তুই সত্যি আমাকে এতদিনেও চিনিস নি আপা। আগের আমি আর এই আমির ভেতর বিস্তর তফাত। আগের কবিতা ভীতু ছিলো, এই কবিতা সাহসী। সাহসটা কে জোগান দিয়েছে জানিস? তোর প্রচন্ড কাছের কেউ!”
,
চলবে…..