একজন রূপকথা পর্ব – ০৬

0
1024

#একজন রূপকথা
#পর্ব_৬
#নুশরাত জেরিন

কবিতা এসেছে আজ সপ্তাহ খানেক হলো। আসার পর থেকে সে মন খারাপ করে বসে থাকে। ঘর ছেড়ে বের হয় না, কথার সাথেও আগের মতো বকবক করে বেড়ায় না। ছোটবেলা থেকে বেড়ে ওঠা বাড়ি, ঘর পরিবেশ ছেড়ে বোনের বাড়িতে এসে সে মানিয়ে নিতে পারছে না৷ অথচ আগে সে সারা বাড়িময় দৌড়ে বেড়াতো, সারাদিন হাসতো, খেলতো। মামির শত বকার মাঝেও কথার আড়ালে নিজের আনন্দ খুজে নিতো। কথা নিজেও বোনের এমন অবস্থা মেনে নিতে পারছে না। সে একটু পর পর কবিতার ঘরে উঁকি মারছে। কবিতা বেলকনিতে দাড়িয়ে আনমনা হয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সে থাকছে রোজিনা বেগমের সাথে তার ঘরে। এ বাসায় দুটো মাত্র বেডরুম।
রোজিনা বেগমকে যখন বলা হলো কবিতা তার রুমে, তার সাথে থাকবে তখন তিনি টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি। মুখ দেখেও মনোভাব বোঝা সম্ভব হয়নি। কথা প্রথম প্রথম ভয়ে ছিল, কবিতাকে দেখে তিনি আবার রাগারাগি না করে বসেন, তবে সেসব না হওয়ায় একটু স্বস্তি হয়েছে বৈকি।
কথা পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো। কবিতা খানিকটা চমকে উঠলো। বলল,
“কখন এলি আপা?”

“কিছুক্ষণ হলো, একা একা কী করছিস?”

“রাস্তায় চলাচলরত মানুষ দেখি রে আপা, তাদের জীবনে আমাদের মত দুঃখ নেই বল?”

“উহু, প্রত্যেকের জীবনেই দুঃখ আছে, কষ্ট আছে। তবে একেকজনের দুঃখ একেকরকম। প্রত্যেকে ভাবে তারাই বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষ।”

কবিতা মলিন কন্ঠে বলল,
“তোর কষ্টগুলো আমার থেকেও বেশি, তাইনা আপা?”

কথা হেসে ফেললো,
“ধুর, আমার আবার কষ্ট কিসের? আগে মনে হতো জানিস, নিজেকে রোবট রোবট লাগতো। এখন আর তেমন মনে হয় না। নিজেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়।”

“ভাইয়া তোকে খুব ভালবাসে?”

“সে আর বলতে!”

—-

শোভনের আজকাল কাজের খুব চাপ যাচ্ছে। অফিসের বস ত্যাড়া গোছের লোক, একই ফাইল দশবার চেক করায়। ভুল পেলে তো কথাই নেই, ধমকে একেবারে ধুয়ে মুছে দেয়। কাল শোভনকেও খুব ঝাঝালো স্বরে ধমকেছে। তার কলিগ আসিফ সাহেব টিটকারি করে বলেই ফেলেছেন, “কী ভাই, মন কোথায় থাকে? নতুন বিয়ে করেছেন শুনলাম?”
কথাটা সত্য বটে। বিয়ের পর থেকে তার সমস্ত ধ্যান ধারণা কথার উপরই ছিলো, কাজে মন বসাতে পারেনি। শোভন মনস্থির করেছে আবার আগের মত কাজে মন দেবে।
বাড়ি ফিরে খাওয়া দাওয়ার শেষে কথার সাথে রাত জেগে গল্প না করে আগের মতো ল্যাপটপ নিয়ে বসবে। তাছাড়া রাত জাগার ফলে সকালে উঠতেও দেরি হয়, ফলস্রুতিতে অফিসে লেট।
কথা চা হাতে ঘরে ঢুকলো।
শোভন এখনও অফিসের ঘামে ভেজা জামা কাপড় বদলায়নি, বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে।
কথা বলল,
“জামা না পাল্টে এভাবে বসেছেন কেনো? ছিহ! ঘামে ভেজা জামা গায়ে রাখতে ভালো লাগছে?”

মুলত কথা অগোছালো থাকাটা একেবারেই পছন্দ করে না। একটু পর পর ঘরদোর পরিস্কার করে, বিছানায় ভেজা তোয়ালে রাখলেও চেচিয়ে ওঠে। এদিকে শোভন একেবারেই গোছালো নয়। জামা কাপড় বেশিরভাগ সময়ই সে এদিক ওদিক ছড়িয়ে রাখে, একটা জামা খুজতে গেলে আলমারি দফা রফা করে ছাড়ে। যদিও এ নিয়ে কথার সাথে এ’কদিনে কথা কাটাকাটি হয়নি। কথাই সে সুযোগ দেয় না।

শোভন সোজা হয়ে বসে মুখ থেকে বিরক্তিকর শব্দ বের করলো। বলল,
“সবসময় এমন নিয়ম মাফিক চলা যায়? মানুষ আমি, রোবট তো না।”

কথা মিষ্টি হাসলো।
“বা রে, সে কথা কখন বললাম!”

শোভন উত্তর না দিয়ে আবারও চোখ বুজলো। কথা পাশের টেবিলে চায়ের কাপ রেখে শোভনের কপালে হাত রাখলো। শোভন বলল,
“বিরক্ত করছো কেনো?”

“মন খারাপ? নাকি শরীর?”

“মন!”

“ভালো করে দেই?”

শোভন চোখ খুললো।
“কিভাবে?”

“সিনেমা দেখে আসি? আপনার পছন্দের রোমান্টিক সিনেমা?”

শোভন মাথা নাড়লো।
“উহু, কাজের অনেক চাপ। ক’দিন কাজে গাফলতি গেছে, আর এমনটা করা যাবে না।”

“তবে আপনার পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করি?”

শোভনের মুখে হাসি ফুটলো। মেয়েটা তাকে খুশি করার কত চেষ্টাই না করছে। অথচ আগে নাকি সে আর কবিতা ছাড়া আর কারো কথা ভাবতোই না।
সে বলল,
“এত কষ্ট করতে হবে না, এমনিতেই মন ভালো হয়ে গেছে।”

“সত্যি? ”

শোভন এক হাতে কথাকে জাপটে ধরলো। মেয়েটার শরীরে কী মিষ্টি ঘ্রান। সে লম্বা শ্বাস টানলো।
“তিন সত্যি।”

হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় চটজলদি বলল,
“এই! কবিতাকে ভার্সিটি ভর্তি করার কথা ছিলো না? ”

“হুম।”

“কবে যেতে হবে?”

“আপনার নাকি কাজের চাপ?”

“কাজের মাঝেও সময় বের করতে হবে, মেয়েটার দায়িত্ব যখন নিয়েছি, পালন করব না!”

কথা মুগ্ধ চোখে তাকালো। লোকটা এত ভালো! নিজের অজান্তেই কখন যে তার মায়ায় আটকে গেছে।

কবিতার ভার্সিটিতে ভর্তি করার জন্য শোভন আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। সকাল সকাল বেরোনোর পর কবিতাকে বাইকে উঠতে বলে নিজে বাইক চালু করলো। মেয়েটা পড়াশোনায় খুব ভালো, খুব ভালো মার্কস পেয়ে এইএসসি পাশ করেছে। কথার মেধাও ভালো ছিল। তবে টিউশনি করে, বাড়ির কাজ সেরে পড়াশোনা করার মত খুব একটা সময় পেতো না। ফলে যেমন তেমন নম্বর নিয়ে পাশ করতো সে। আর এ বাড়িতে আসার পর তো পড়াশোনাটাও বন্ধ হয়ে গেলো। রোজিনা বেগম সাফ বলে দিয়েছেন,
“এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছো যখন তখন সংসারে মন দাও, পড়াশোনা করে আর কী হবে?”

শোভন কথাটা শুনে গাই গুই করলেও কথা মেনে নিয়েছে। সত্যি তো, তার নিজের একটা বাড়ি, সংসার এসবেরই তো শখ ছিলো।

রাস্তায় বাঁকের কাছে এসে শোভন বলল,
“শক্ত করে ধরে বসো, পরে যেও না। তোমার কিছু হলে তোমার বোন আমায় কাঁচা চিবিয়ে খাবে।”

কবিতা খিলখিলিয়ে হাসলো,
“দেখেছেন ভাইয়া, আপা আমায় কত ভালবাসে? ”

“হুম দেখলাম তো।”

কবিতা কিছুটা দুষ্টুমি করে বলল,
“আপনাকে যতটা ভালবাসে তার থেকেও বেশি কিন্তু! ”

“তোমার বোন আমায় ভালবাসে বুঝি! কখনও তো বলল না।”

“সবসময় মুখেই কেনো প্রকাশ করতে হবে? ব্যবহারে বোঝেন না?”

শোভন হেসে ফেলল,
“বাহ্ তুমি তো খুব বুদ্ধিমতি দেখছি! আমি ভেবেছিলাম তুমি কিচ্ছু বোঝো না, বাচ্চা মানুষ।”

“ভার্সিটি ভর্তি হতে যাচ্ছি! বাচ্চা কোথায়!”

শোভন আবারও হাসলো। মেয়েটা এত কথা বলতে পারে। বিয়ের দিন তো মাথা খেয়ে ফেলছিলো। অথচ কথা পুরোপুরি উল্টো। একই মায়ের পেটের দু’বোন, কিন্তু কত আলাদা।
সে বলল,
“তাহলে তো ভার্সিটি ভর্তি হবার খুশিতে ট্রিট দিতেই হয়। কি খাবে বলো, ফুচকা, আইসক্রিম নাকি চকোলেট? ”

কবিতা উচ্ছাসিত গলায় বলল,
“সব সব সওওওব। এগুলো সব আমার পছন্দের। ”

“এদিকে তোমার বোনের কিন্তু এসব কিচ্ছু পছন্দ না। ফুচকা দেখলে তার গা ঘিনঘিন করে, আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লাগে, চকোলেটের স্বাদ মনে হয় তিতা।”

কথাটা বলে শোভনের মন খারাপ হয়ে গেলো। কিছুদিন আগে অফিস থেকে ফেরার পথে এসব নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সে, ভেবেছিল কথা খুশি হবে। অথচ খুশি হওয়া দুরের কথা, আজেবাজে খরচ করার জন্য একচোট বকলো। পরে অবশ্য শোভনকে খুশি করার জন্য একটু আধটু মুখে তুলেছিলো।
কবিতা বলল,
“আমার আপাটা একটু আলাদা, অন্যরকম, কিন্তু পৃথিবীর সবথেকে ভালো। আপনি কিন্তু ভাগ্য করে আমার আপাকে পেয়েছেন!”

শোভন উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসলো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে