#একজন রূপকথা
#পর্ব_৫
#নুশরাত জেরিন
কথা আর শোভনের আজ সিনেমা দেখতে যাবার কথা। শোভন বেশ কদিন যাবত বলছিলো, কথা রাজি হয়নি৷ বিয়ের পর পরই শশুড় বাড়িতে মন না দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালে শাশুড়ী নিশ্চয়ই মনে মনে নাখোশ হবেন, তাছাড়া এমনিতেও তিনি কথাকে মেনে নিতে পারেননি। এ নিয়ে শোভন একটু মন খারাপ করে বলল,
“তুমি সবসময় আমার কথার বিপরীতে কেনো যাও কথা?”
কথা বলল,
“আশ্চর্য, বিপরীতে কোথায় গেলাম? আমি তো আপনাকে বোঝাচ্ছি।
” কী বোঝাচ্ছো শুনি? আর আমিই বা কেনো বুঝবো? আমাকে তুমি বুঝেছো? আমাদের বিয়ে হয়েছে এক সপ্তাহ অথচ এই একটা সপ্তাহে তুমি একটাবারও আমায় বোঝার চেষ্টা করেছো?”
শোভনের চোখে চাহনি অন্যরকম৷ কথা ফট করে বুঝে ফেললো। তার নিজেরই কেমন খারাপ লাগতে শুরু করলো। আসলেই তো, লোকটা তার স্বামী, তারও তো বউ নিয়ে কিছু ইচ্ছা অনিচ্ছা, শখ আহ্লাদ থাকতে পারে। তাছাড়া এতগুলো দিন লোকটা তাকে সময় দিয়েছে, মানিয়ে নেবার। আর কত? দিনশেষে সেও তো একজন পুরুষ।
সে বলল,
“আমি কিন্তু আপনাকে মোটেও নিষেধ করিনি।”
শোভন চমকে উঠলো,
“কিসে নিষেধ করোনি?”
পরক্ষনেই মৃদু চিৎকার করলো,
“তুমি যেসব ভাবছো সেসব একদমই মিন করিনি আমি, এতটাও তাড়াহুড়ো নেই আমার। তুমি কিন্তু ভুল ভাবছো কথা।”
কথা হেসে ফেললো,
“আচ্ছা? তবে ভুল থেকেই নাহয় নতুন শুরু হোক, ক্ষতি আছে?”
শোভন মাথা চুলকে ভ্যবলা হাসলো।
“দরজাটা বন্ধ করে আসি?”
“কেনো?”
শোভন এবার বেশ লজ্জা পেলো। অথচ কথা কেমন হাসছে! লজ্জাবতী বউ বোধহয় আর পাওয়া হলো না।
কথা বলল,
“ছেলেরা যে এত লজ্জা পায় আপনাকে না দেখলো বুঝতামই না।”
“তুমি মেয়ে হয়েও তো পাও না।”
কথা হেসে উঠলো। তার হাসি সুন্দর। হাসলে তাকে দেখায় রূপকথার রাজকন্যার মতো। শৌভন ফিসফিস গলায় বলল,
“লাইটটা বন্ধ করে ফেলি?”
—-
সকাল সকাল কবিতা কল দিয়ে কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছে। মামি তাকে আজ খুব বকেছে। তাও আবার সামান্য কারনে।
মামির বিকেলে নাকি মাথা ব্যাথা করছিলো, কবিতাকে ডেকে বলেছেন মাথা টিপে দিতে। কবিতাও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা টিপে দিয়েছে, তার শরীরটা যথেষ্ট খারাপ ছিল, নিজেরও মাথায় যন্ত্রনা করছিলো, তবুও মামির কথার প্রতিবাদ করেনি। মিনিট খানিক পেরোতেই মামির কী চিল্লা চিল্লি। কবিতা নাকি ইচ্ছে করে মাথা টেপার নাম করে তাকে ব্যাথা দিয়েছে।
ফলস্বরূপ রাতে খাবারও জোটেনি।
কবিতার কান্না শুনে কথার মন খারাপ হয়ে গেলো। সে নিজেই আছে পরের বাড়িতে। শাশুড়ী এখনও তাকে সহ্য করতে পারে না, এরমধ্যে বোনটাকে কী করে এখানে নিয়ে আসবে?
শোভন অফিস যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল। কথার মন খারাপ লক্ষ্য করে সে পেছন থেকে জাপটে ধরলো। কথা নিজেও কোনো প্রতুত্তর করলো না।
শোভনের স্পর্শ তার ভালো লাগে, ভালবাসাময় এমন ছোঁয়াই তো সে চেয়েছিল এতদিন ।
শোভন বলল,
“মন খারাপ কেনো বউ?”
“এমনিতেই।”
“বলবে না?”
কথা ইতস্তত করলো।
“আসলে কবিতা কল করেছিলো, আপনি তো জানেনই মামির স্বভাব। কবিতা একা একা.. আমি থাকতে ওকে আমিই প্রটেক্ট করতাম! কিন্তু এখন…
” এরজন্য এত দুশ্চিন্তা করতে হয়? ওকে এখানে নিয়ে আসলেই তো পারো।”
“কিন্তু মা?”
“সে আমি দেখে নেবো, তোমার বোন তো আমারও বোন হয় নাকি? আমার বোনের কষ্ট আমি সহ্য করবো ভেবেছো?”
কথা আনন্দে শোভনের শার্ট খামচে বুকে মাথা রাখলো। লোকটা এত ভালো কেন কে জানে! কথার আজকাল সব স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে! জীবনে যা কল্পনা করতেও বুক কাপতো আজ সেসব সে পেয়ে গেছে।এখন শুধু শাশুড়ীর মন জয় করার পালা।
—
সিনেমা শেষ হয়ে হল ছেড়ে বেরোতে বেরোতে দশটা বেজে গেলো। রোমান্টিক ধাঁচের সিনেমা, শোভনের নাকি ফেবারিট সিনেমা এটা অথচ কথার একটুও ভালো লাগেনি। নায়ক নায়িকার অতিরিক্ত ন্যাকামি, ঢলাঢলি দেখলে তার গা গুলায়, অসহ্য লাগে। তবু শোভনের কথা ভেবে চুপচাপ দেখেছে। দুজন মানুষের পছন্দ অপছন্দ আলাদা হতেই পারে, সব যে মিলে যাবে এমন তো না।
শুনশান রাস্তায় রিকশা সিএনজি কিচ্ছু নেই, হেঁটে হেঁটে বাড়ি অবদি পৌছানো সম্ভব নয়, অনেকটা পথ। জায়গাটা নিরিবিলি, শুনশান। শোভন বলল,
“ভয় লাগছে? এতটুকু রাস্তা হেঁটে সামনে চলো, সেখানে ফুটপাতে বাজার বসে। অনেক মানুষজনের আনাগোনা, এখানকার মতো নয়। সেখানে গেলেই ভয় কেটে যাবে।”
কথা শাড়ির আচল গায়ে মুড়িয়ে নিলো। বলল,
“ভয় পাবো কেনো, আমি কী ভিতু নাকি?”
“কী বলো? এত শুনশান জায়গা তবু ভয় পাচ্ছো না?”
“উহু, বরং অন্ধকার, নিঃশব্দতা আমার পছন্দ। ”
“বিরহী প্রেমিকার মত কথাবার্তা, মনে হচ্ছে প্রেমিকের ধোঁকা খেয়ে বিরহ পালন করছো।”
শোভন উচ্চস্বরে হাসলো যেন কোনো মজার কথা বলে ফেলেছে।
কথা গম্ভীর গলায় বলল,
“অন্ধকার আমার ছোটবেলা থেকেই পছন্দ এর জন্য বিরহী প্রেমিকা হতে হয় না৷ তবে কেউ একজন কিন্তু সত্যি আমায় ধোঁকা দিয়েছিলো!”
শোভন হাসি থামিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকালো।
কথা বলল,
“কিন্তু সে আমার অতীত, আমার সাথে তার একযুগের প্রেমিক প্রেমিকাদের মত ঐ ধরনের সম্পর্ক ছিল না। ঐতো দু’দিন অন্তর একবার ফোনে দু’চার মিনিট কথা হতো, আর মাসে একবার সাক্ষাৎ, ব্যাস। কথা ছিল বিয়ে করে তারপর দুজনে প্রেমের সম্পর্ক গড়বো। কিন্তু…! ”
শোভন মুখ খুললো,
“তাকে ভালবাসো?”
কথা হেসে ফেললো,
“দুর, ভালবাসলে বুঝি আপনাকে এত সহজে মেনে নিতে পারতাম? আসলে সে ছিল মামির হাত থেকে বাঁচার এক উপায় মাত্র। ভেবেছিলাম বিয়ে করে মামা বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসবো। নিজের বাড়ি হবে, সংসার হবে।”
“এখন হয়নি?”
“অস্বীকার করলাম কোথায়?”
—
আরেকটু সামনে এগোতেই কিছু ছোটখাটো দোকানপাট চোখে পড়লো।ফুটপাতে টুকিটাকি জিনিস সাজিয়ে বসেছে, দেখতে বেশ লাগছে। সামনে সিএনজিও আছে। কথা হাফ ছাড়লো। বেশ খানিকটা পথ হাটতে হয়েছে তাদের। পা দু’টো ব্যাথা হয়ে গেছে। শোভন বার বার অপরাধীর মত মুখ করে ক্ষমা চাচ্ছিলো। লোকটা এত পাগল! সিএনজি না পেলে তার কী দোষ!
এক মহিলা চুড়ির ডালা নিয়ে বসে আছে। রং বেরঙের কাঁচের চুড়ি। ক্রেতা নেই বললেই চলে। এত রাতেও এখানে বসে আছে কেনো কে জানে।
কথার ভাবনার মাঝে শোভন একপ্রকার টেনে তাকে মহিলার সামনে দাড় করালো।
কথাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কোনগুলো নেবে?”
কথা বলল,
“এসব আবার কেনো? বাসায় ফিরবেন না??”
“ফিরবো তো, তার আগে তোমার শখ পূরণ করি।”
“চুড়ি দিয়ে?”
শোভন বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লো। মেয়েদের কাচের চুড়ি পছন্দ একথা সে জানে। তার দুই বন্ধুর মধ্যে একজনের নাম আরমান। আরমানের গার্লফ্রেন্ড কাচের চুড়ি দেখলেই লাফিয়ে উঠতো, কিনে দিলে কী যে খুশি হতো। যদিও আরমানের সাথে তার সম্পর্কটা বেশিদিন টেকেনি। মেয়েটা একই সাথে অন্য একজনের সাথে রিলেশনে জড়িয়ে পড়েছিলো। তার শোকেই তো আরমান দেশ ছাড়লো।
শোভন বলল,
“হু, কেনো চুড়ি পছন্দ না?”
“উহু, চুড়ি, পায়েল এগুলো আমার প্রচন্ড অপছন্দের। পরলেই কেমন ঝুনঝুন শব্দ তোলে। আপনাকে তো বললাম আমার নিঃশব্দতা পছন্দ। ”
শোভনের মন খারাপ হয়ে গেলো। সে ভেবেছিল কথা খুশি হবে। তাছাড়া নিজ হাতে কথার হাতে চুড়ি পরিয়ে দিতে চেয়েছিলো।
শোভনের গোমড়া মুখ দেখে কথা এক ডজন নীল কাচের চুড়ি তুলে নিলো৷
বলল,
“এইগুলো নিলাম, কোনো একদিন পরে আপনাকে দেখাবো।”
শোভন হাসার চেষ্টা করলো। তার হাসি পাচ্ছে না। প্রতিদিন রাস্তায় দাড়িয়ে সে শুধু কথাকে দেখেই গেছে, তার সম্পর্কে খোজ খবর নেইনি কখনও।
নিলে হয়তো বুঝতো, কথা আলাদা, সে যেরকম মেয়ে পছন্দ করে তার থেকে তো পুরোপুরি আলাদা। শোভনের মনে হলো সে শুধু কথার চেহারাকে ভালবেসেছে, স্বভাবকে নয়।
,
চলবে…..