একজন মানবসেবক বলছিল

0
707

#একজন_মানবসেবক_বলছি

(ছোটগল্প)

(অস্ট্রেলিয়ার প্রেক্ষাপটে লেখা)

নিতান্ত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে এই আমার এ দেশে নিজেকে ডাক্তার হিসাবে স্থায়ী পরিচয় পেতে পার হতে হয়েছে শত হাজার বাঁধা। ডিঙোতে হয়েছে অনেকগুলো পরীক্ষার দেয়াল। মনে করতাম নিজেই বুঝি সবচেয়ে কষ্টের জীবন কাটিয়ে এসেছি। সংসার পড়ালেখা বাচ্চা সামলাতে যেয়ে নিজের গন্ডি থেকে বের হবার সুযোগ হয়নি। কিংবা হয়তো নিজেও ততটা সপ্রতিভ ছিলামনা ভীনদেশী কারো সাথে সম্পর্কের ব্যাপারে বা তাদের সম্পর্কে জানতে। কাজের সূত্র ধরেই পরিচয় মায়ের বয়সী এক ডাক্তারের সাথে। আমি জানতামনা সে ও আমার মতোই ওভারসীজ মেডিকেল গ্রাজুয়েট। জানতে চাইলাম তাদের সময়ে এ ধরনের বাঁধা বা পরীক্ষার দেয়াল কতোটা উঁচু ছিল? কতোটা কষ্ট হয়েছে এদেশে ডাক্তার হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে। সত্যি বলতে কিউর কথা শুনে আমার মনে হয়েছে তার তুলনায় আমার জীবন সংগ্রাম একেবারেই কিছুনা। তার জবানিতেই না হয় শোনাই তার জীবনের গল্প।

‘খুব গোঁড়া ক্যাথলিক খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম আমার। জন্মগতভাবে আমি ফ্রান্সের নাগরিক। বারো ভাইবোনের মধ্যে আমার অবস্থান ছিল সাত। ঐ যে বললাম গোঁড়া পরিবার, আমার পরিবারের নিয়ম ছিল মেয়েলোক পরিশ্রম করতে হবে যতোটা বেশী সম্ভব। এমনকি ঘরের খাবার যুগিয়ে আনার দায়িত্বও মূলত মেয়েলোকেরই ছিল। আমার বাবা মা দুজনেই বেকার ছিল। মানে কেক পেস্ট্রি এসব বানানোতে দক্ষ ছিল। বুঝতেই পারছো ফ্রান্সে সাধারণ পরিবারের লোকও এ কাজে পারদর্শী ছিল। এতো বিশাল পরিবারের ভরনপোষণ তো আর চাট্টিখানি কথা না। তার ওপর আমার বাবার ছিল ঘোরার বাতিক। নানা দেশে যাওয়া তখন সময় সাপেক্ষ হলেও এতো নিয়মনীতির বালাই ছিলনা। আমরা জিপসীদের মতো কয়েক মাস এদেশে কয়েক মাস ওদেশে এমন করেই বড় হতে থাকলাম আর বছর বছর ভাইবোনের সংখ্যা বাড়তেই থাকলো।

দেশে দেশে ঘোরার আরো একটা কারণ আছে। পুরো পরিবারের খরচ চালিয়েই হাতের পয়সা শেষ হয়ে যেত বলে বাবা কোনদেশেই ট্যাক্স পে করতোনা। আর তাই পুলিশ তাড়া দেয়ার সময় এলেই আমরা পাততাড়ি গোটাতাম। কিভাবে কিভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমরা সাউথ আফ্রিকা চলে এলাম। আমার বয়স তখন আঠারো পেরিয়ে গেছে। এ বেলা বাবা মা আবারো তাড়া খেয়ে ফ্রান্স ফেরত গেলেও যাওয়ার দিন খুব ভোরে আমি বাসা থেকে পালিয়ে যাই। আমার এক বন্ধু আমাকে কাজ পেতে সাহায্য করে। পাশাপাশি ইন্টারভিউ দিয়ে আমি মেডিকেল স্কুলে চান্স পেয়ে যাই। কাজ করে পড়াশোনা আর নিজের খরচ বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিল।

মেডিকেলের মাঝামাঝি সময়ে আমার পরিবার আবার আমার খোঁজ পায়। সদলবলে হাজির হয় আমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে। কারণ তারা নতুন করে বেকহাউজ কাম ক্যাফের দোকান দিয়েছে। পারিবারিক ঐতিহ্য ও কাজের প্রয়োজনে তাদের আমাকে দরকার। এখানে একটা কথা বলে নেই, আমি যে কোন কেক পেস্ট্রি বা এ জাতীয় খাবার আমার পরিবারের আর সবার মধ্যে খুব ভালো বানাতাম। আমি ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানালে ওরা বলে তাহলে আমার রোজগারের সিংহভাগ পরিবারের খরচের জন্য দিতে হবে। তাহলে তারা আমাকে বিরক্ত করবেনা। নিজের বাবা মা এমন করতে পারে তোমার বোধহয় বিশ্বাস হচ্ছেনা। আমি তবুও রাজী হয়ে যাই। ততদিনে মেডিকেল জীবনটাকে আমি ভালবেসে ফেলেছি।

এমবিবিএস পাশ করলাম, ওখানেই ডাক্তার হিসাবে কাজ শুরু করলাম। আমারই এক রোগীর সূত্র ধরে আমার স্বামীর সাথে আমার পরিচয়। আইজ্যাক খুব ভালো ক্রাফটের কাজ জানতো আর কথা বলতো এতো দারুন করে। আমি তার কথার প্রেমে নাকি হাতের কাজের প্রেমে পরেছিলাম জানিনা শুধু দেখলাম ও আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়াতে আমি কিছুতেই না বলতে পারছিনা। আইজ্যাকের কিছু জন্মগত ত্রুটি ছিল। কিন্তু কঠিন পারিবারিক অনুশাসন থেকে মুক্তি মিলবে সাথে নিজের মনের মানুষের সাথে একটা সুখের সংসার করবো এই ভাবনায় ওসব ত্রুটি আমার কোন গাত্রদাহের কারণ হয়নি। বন্ধুবান্ধবদের উপস্থিতিতে বিয়ে করে ফেললাম পরিচয়ের তিনমাসের মাথায়। বাড়ির লোকে শুনে হাউকাউ লাগিয়ে দেয়াতে ওর পরামর্শেই এদেশে মাইগ্রেট করে চলে আসি।

এদেশে আসার পর থেকে আইজ্যাক কেমন যেন বদলে যেতে থাকে। কাজে মনোযোগ নেই, কোন উদ্যোগ নেই জীবনে কিছু করার। সারাদিন শুধু ঘরে বসে সিগারেট টানা আর টিভি দেখা ছাড়া আর কিছুতেই ওর রুচি ছিলনা। অথচ ও যদি ক্রাফটিংয়ের কাজ চালিয়ে নিতো আমরা বেশ স্বচ্ছল থাকতে পারতাম। পারিবারিক শিক্ষা আর বেঁচে থাকার নিমিত্তে আমিই কাজ করে যাচ্ছিলাম প্রানপনে। আইজ্যাক যেন দেখেও দেখতোনা। যেন ওকে পেলেপুষে রাখার দায়িত্ব আমারই। বাচ্চাকাচ্চা হলে যদি আইজ্যাকের সংসারে মন ফেরে তাই বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। এদিকে আমার বয়সও তো আর থেমে থাকছেনা। ডাক্তারের কাছে গেলাম দুজনে। বলাবাহুল্য আইজ্যাককে টেনে হিঁচড়েই নিতে হয়েছে। কিন্তু আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছিল ডাক্তারের কাছে। ওভারীর সমস্যাজনিত কারণে আমি কখনোই মা হতে পারবোনা।

এ খবরের পরে আইজ্যাক যেন আরো পেয়ে বসে আমাকে। অনেকেই আমাকে বলেছে ছেড়ে দিয়ে কেন একাকী দিন কাটাইনা। কিন্তু আজ থেকে বছর ত্রিশেক আগেও ডিভোর্স একলা থাকা এ ব্যাপারগুলো এতো সহজ ছিলনা। সামাজিক বিধি নিষেধ না থাকলে ক্যাথলিক সমাজে মেয়েলোক একলা থাকাটা খুব একটা পছন্দের ব্যাপার ছিলনা। আমি বাচ্চা খুব পছন্দ করতাম আর সৃষ্টিকর্তা তাই বুঝি আমার কোল খালি রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন।

ভীষণ ভেঙে পরেছিলাম কয়েকটা সপ্তাহ। যেতে পারিনি কাজে। আর তাতেই না খেয়ে থাকার হাল হলো বাসায়। মনে মনে ভাবলাম দত্তক নেব কোন এতিম শিশুকে। পরপর দুজনকে পেয়েও গেলাম। আমার ধারনা ছিল যথাযথ যত্ন নিলে আর সময় দিলে যে কাউকে নিজের মনের মতো করে নেয়া সম্ভব। তবে ভুলে গিয়েছিলাম জিন আর পরিবেশ এ শব্দদুটোও বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আমার বড় ছেলেটাকে স্কুল শেষের পর আর পড়াতে পারিনি। এটা ওটা টুকটাক করে হয়তো হাত খরচ চলতো নয়তো সেই আমার ওপরেই। ভাগ্যিস ছোট ছেলেটা এই কষ্টটুকু দেয়নি। ও নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অন্তত আমাকে খানিকটা সম্মান দিয়েছে।

কাজের ভেতরে ঘটে যাওয়া চড়াই উৎরাইয়ের কথা বলতে গেলে রাত ফুরোবে। তারচেয়ে বরং পরিবারের আর নিজের কথাই বলি। ঘরে বসে থেকে থেকে আইজ্যাকের শরীরের বাকী যন্ত্রপাতিতেও মরিচা পরতে লাগলো। দিনে দিনে পায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে হুইল চেয়ারে বাঁধা পরলো। আর আমি ঘরে বাইরে সামাল দিতে যেয়ে সময় পাইনি নিজের দিকে চোখ তুলে তাকানোর। তাকাতে হয়নি নিজে থেকে শরীর নিজেই জানান দিল কিছু একটা ঠিক নেই। ডাক্তারের কাছে গেলাম। ধরা পরলো কোলন ক্যান্সার। এদেশের চিকিৎসা সম্পর্কে তো জানোই। ছয় মাস হাসপাতালে ইন এন্ড আউট করিয়ে জানিয়ে দিল ক্যান্সার বিদায় নিয়েছে শরীর থেকে।

কাজে ফিরে এলাম। ভেবেছিলাম আর কাজ করবোনা। পুরোনো রোগীদের কাছ থেকে বিদায় নিতেই কয়েকদিন কাজে এলাম। বিশ্বাস করবে কি না জানিনা আমার সব রোগী যে যার পরিচিত সবাই একযোগে একদিন প্র্যাকটিসে এলো। সবার এক দাবী আমাকে কাজ করতে হবে। হোক কম সময় তবু আমি যেন তাদের ছেড়ে না যাই। তাই গত কয়েক বছরে বহুবার চাইলেও ছেড়ে যেতে পারিনি এদের। কিন্তু আমি জানি আর বেশীদিন নেই আমার হাতে। টের পাচ্ছি শরীরে কর্কট রোগ পূর্ণোদ্যমে ফিরে আসছে।’

হাত ধরে জানতে চেয়েছিলাম, রাগ হয়না জীবনের ওপর? কিছুই তো পেলেনা এক জীবনে, শুধু সবাইকে দিয়েই গেলে।

– বোকা মেয়ে, কে বলে কিছু পাইনি? ডাক্তার হিসেবে এই যে একটা জীবন এতোগুলো মানুষের ভালবাসা পেয়েছি একজীবনে এরচেয়ে বড় প্রাপ্তির আর কি আছে? যে মানুষগুলো আমার ব্যক্তিজীবনে জড়িয়ে ছিল তাদের সাথে হয়তো সুখের দিন কাটেনি কিন্তু তাই বলে থমকে তো যাইনি। এই যে জীবনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে এতোদূর পথ আসতে পেরেছি তাই বা কম কিসে?

#ডা_জান্নাতুল_ফেরদৌস

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে