সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমি একজন আপাত ব্যর্থ মানুষ। সেই ব্যাখ্যায় পরে যাই। তারচেয়ে বরং দেখি সফলতা বলতে আমরা আসলে কি বুঝি?
আমাদের বাবা মায়েরা সফলতা বলতে মনে করেন আমরা আমাদের শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পাঠ্য বইয়ের মাঝে মুখ ডুবিয়ে কাটিয়ে দেব একটা ভালো রেজাল্টের আশায়, তারপর একটা ভালো চাকুরী, ভালো বিয়ে, দারুন দুটো বাচ্চা কাচ্চা হবে, সাথে সংসার জুড়ে থাকবে শুধু সুখ আর সুখ। আমাদের সমবয়সীরা সফলতা বলতে মনে করেন একটা ভালো বেতনের চাকুরী, স্মার্ট যোগ্য জীবনসঙ্গী, কিউট রোবটিক একটা বা দুটো বাচ্চা যারা বাবা মায়ের করে দেয়া প্রোগ্রামে চলবে, ফি বছর ইউরোপ আমেরিকা ট্যুর, ফেসবুকে দারুন দারুন ছবি আপলোড দেয়া; মোদ্দাকথা বিয়ের পর থেকেই হ্যাপিলি এভার আফটার জীবন। বৃদ্ধরা মানে নানী দাদীরা নিজেদের অবস্থান টেকানোর হিসেব নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, সফলতার সংজ্ঞা খোঁজার সময় কই? আর শিশু কিশোরদের গোনার বাইরে রাখি কারণ তাদের স্বপ্নের জগত বড়দের থেকে দারুন ভিন্ন।
তো যা বলছিলাম, সব বয়সের সফলতার স্কেলে আমার অবস্থান আদতে একেবারে নিচের দিকে। ছোটবেলা থেকেই আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগেনা। স্কুলের সবচেয়ে শেষের বেঞ্চে বসতাম যেন নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে পরা যায় ক্লাসের সময়। বাসায় ও বই খুলে বসে থাকতাম ঠিকই কিন্তু পড়াগুলো আমার মাথায় ঢুকতো কমই। বলতে দ্বিধা নেই বই খুলে বসে বসে ঘুমিয়ে পরার এক অদ্ভুত কৌশল আমি ছোটবেলাতেই অর্জন করেছিলাম। আমার মন পরে থাকতে কখন খেলতে যাবো, কখন গাছে উঠে ফল পাকুড় পেড়ে খাবো। ডাঙ্গুলী, বউচি থেকে শুরু করে হালের ক্রেজ ক্রিকেট কোন খেলাতেই আমার অরুচি ছিলনা। কি ছেলে কি মেয়ে, খেলার সাথী পেলেই হলো। ক্লাসের ভালো ছাত্রীগুলোকে আমি সন্তর্পনে এড়িয়ে চলতাম পাছে পড়াশোনা নিয়ে কথায় জড়িয়ে পরতে হয়। ছোটবেলা থেকেই আমার প্রচুর বন্ধু ছিল। আমি মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনতাম বলে নাকি আমার সাথে থাকলে দুষ্টমির নানা সঙ্গত পাওয়া যাবে বলে সেটা আমার কাছে ঠিক পরিস্কার না।
একটু বড় হলাম। মেয়ে বলে বাইরে খেলাধুলার ওপর নিষেধাজ্ঞা এলো, সাথে বাড়লো পড়ার চাপ। ফাঁকি দেয়ার নিত্য নতুন কৌশলে কিছু ধরা খেয়ে কিছু না ধরা খেয়ে টেনেটুনে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়ে স্কুলের গন্ডি পেরুলাম। ‘পড়াশোনা না করলে রিকশাওয়ালার সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে’, আম্মার এরকম হুমকী আর খুব অল্প সময়ে অনেক পড়ার চাপে ডুবে যেতে যেতে একদম তলানীর দিকের নাম্বার নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশনেই কলেজের গন্ডি পার হই। এই ফলাফলে কোথাও চান্স পাবোনা কাজেই বাড়ির পাশের ডিগ্রী কলেজ আর ডিগ্রী পাসের সাথে সাথেই বিয়ে এই আশাতেই দিন কাটতে লাগলো আমার। এরকম বেশ কিছু উদাহরণ দেখেছি বলেই অন্য কোন চিন্তা মাথায় আসেনি।
পুরো পরিবার তথা নিজেকেই নিজে অবাক করে দিয়ে আমি চান্স পেয়ে যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার জীবনের প্রথম সফলতা। তাও আবার ফার্মাসীর মতো কঠিন এক বিষয়ে। সবাই যখন খুশীতে আমাকে অভিনন্দন জানায় আমি তখন পারলে কেঁদে দেই, আমার মতো ফাঁকিবাজ পড়াশোনায় লাড্ডু মেয়ে কিভাবে অনার্স পাস করবো? সেমিস্টার শেষের পরীক্ষাগুলোর আগে নাকের জলে চোখের জলে বুক ভিজিয়ে কিভাবে যে পাস করতাম সে বর্ণনায় গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে।
পড়াশোনায় ডাব্বা হলে কি হবে প্রেমে কিন্তু আমি অনার্স ছিলাম। ভাবছেন অনেকগুলো প্রেম করেছি? ঠিক তা না একটাই প্রেম এবং বাড়ির অমতে বিয়ে করে প্রেমের সফল পরিণতি টেনেছিলাম। ইয়ে মানে এখনো টানছি। এই দুটোই সাকুল্যে আমার সফলতার ঝোলায় আছে।
বিয়ের পরপরই আমার স্বামী নয়ন কিভাবে কিভাবে যেন অস্ট্রেলিয়া চলে আসে। তার পিছু পিছু পড়া শেষ করে আমিও। আমাদের গ্রামের ভাষায় একটা কথা আছে, যেমন বেগা তার তেমন বেগী, মানে স্বামী স্ত্রী দুজনেই এক টাইপ। এদেশে ফার্মাসিস্ট হিসেবে ক্যারিয়ার করবো কি করবো না এই চিন্তা করেই আমি প্রায় বছর দুয়েক পার করে দিলাম। আমার স্বামীও একই কাতারের হওয়ায় ওর সময়টাও এভাবেই চলে গেলো। কামলা দিয়েই দিন কাটিয়ে যেতে লাগলাম। লোকের নানা কথায় ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে বছরে দুয়েক পরে পড়তে বসলাম। কিন্তু একি, এসব পড়া যেন আমি জীবনেও পড়িনি। তারপরও ঠেলা ধাক্কা দিয়ে এক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিয়েই ফেললাম। ফলাফল ডাহা ফেইল। মনটাই ভেঙে গেলো। তারপরও নয়নের জোরাজুরিতে আরো একবার পরীক্ষা দেই। কিন্তু পাসের দেখা মেলেনা। আজীবন ফাঁকি দিয়ে আসা এই আমার কাছে এদেশে ফার্মাসিস্ট হওয়া তাই অধরাই থেকে যায়।
ভাবলাম ড্রাইভিং শিখে রাখি কাজে দেবে। লারনার পরীক্ষা একেবারে পাস করে গেলেও গাড়ি একা চালানোর পরীক্ষায় পাস করতে আমার সাতবার সময় লাগে। পাস করে লাইসেন্সখানা আপটুডেট হলেও মনের ভীতির কাছে পরাজিত আমি সাহস করে একা একা গাড়ি বের করেছি বোধহয় হাতে গোনা কয়েকদিন।
এদেশে লোকে বাসায় দাওয়াত দিলে কত পদ যে রেঁধে খাওয়ায়। আর আমার রান্নার কথা কি বলবো? এক পদের বেশী দুপদ রাঁধতে আমার কাল ঘাম ছুটে যায়। তারপরেও যেদিন দাওয়াত দিয়ে দুয়ের অধিক পদ রাঁধি সেদিন হয় কোনটার মাংস কম সেদ্ধ হয় নয়তো পোলাও জাও হয়ে যায়। কি যে একটা অবস্থা হয় লোকের সামনে কি বলবো?
আমার ছেলেটা হওয়ার সময় আমার মা বিদেশে আসে আমাকে সাহায্য করতে নয়তো আমি বোধহয় বাচ্চা সংসার একদিকে ফেলে হাঁটাই দিতাম। মা কি সুন্দর আমার অগোছালো সংসারে প্রাণ ফিরিয়ে আনে এক সপ্তাহের মাঝেই। আমাকে কোন কাজতো করতেই দিতোনা বরং অল্প সময়ে সব কাজ গুছিয়ে বিকেলে নিজে নিজে হাঁটতে যেতো। আর আমি সারাদিনে এক বাচ্চার ন্যাপী, খাওয়া, ঘুম নিয়ে পর্যুদস্ত। নিজেকে মনে হতো পুরোপুরি ব্যর্থ একজন মা।
মা চলে যাবার আগেরদিন অনেক রাত পর্যন্ত গল্প হয় আমাদের মা মেয়ের।
– মা, তুমি চলে গেলে আমি কিভাবে যে আয়ানকে সামলে সংসার চালাবো? আমি কেন সহজে কোন কিছু পারিনা বলতো? জীবনে কিছুই তো করতে পারলামনা। নিজেকে বড় ব্যর্থ মানুষ মনে হয়, মা।
আমার মনে হয়েছে তুমি আসলে কোন ব্যাপারে ফোকাসড না তমা। আমারও কিছু ভুল ছিল মা হিসেবে নিশ্চয়ই, নয়তো এই ঘরকন্নার ব্যাপারে তুমি হয়তো এতোটা আনাড়ি হতে না। সে যাই হোক একটা কথা বলি শোন, প্রথমদিন তোমার সংসারে এসে আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। সবকিছু এতো এলোমেলো, অগোছালো। নিজের ওপরই রাগ লাগতো, তোমাকে কিছুই শেখাতে পারিনি বলে। কিন্তু দিন যত গিয়েছে আমার ধারনা পাল্টেছে। আমি তোমাকে ছাড়াও অনেকদিন একা একা পার্কে হাঁটতে যেতাম। তুমি কি জানো, তোমার আশেপাশের লোক তোমাকে নিয়ে কি বলে? ওপর তলার মেয়েটার বাচ্চা হওয়ার আগে প্রায়দিন তুমি খাবার রেঁধে দিয়ে আসতে যাই পারতে। তার বাচ্চা হওয়ার সময়ে কেউ আসতে পারেনি তুমি তার বড় বাচ্চাকে রাতে তোমার কাছে রেখেছো। পাশের বাসার কার কার যখনই সমস্যা হয়েছে তুমি তোমার সাধ্যমত সাহায্য করেছো। সবচেয়ে অবাক হয়েছি শুনে পাশের বাসার ইটালিয়ান বুড়ি মহিলাকে নাকি তুমি একদিন হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছো ও অসুস্থ ছিল বলে। তুমি একা একা গাড়ি চালাও না তবু অন্যের বিপদে সেই সাহসিকতাটুকু দেখিয়েছো।
একটা ব্যাপার কি জানো, লোকে মারা গেলে আমরা তাদের নিয়ে ভালো ভালো কথা বলি। কারণ হাদিসে নাকি বলে, একজন মানুষকে যদি দশজন ভালো বলে তবে আল্লাহ ও তাকে ভালো বলে। দুনিয়ার জীবনে ক্যারিয়ার, টাকা পয়সার হিসেবে তুমি হয়তো সফল মানুষ না কিন্তু মানুষের মনে এভাবে যে জায়গা করে নিতে পারে তাকে আমি ব্যর্থ মানুষ বলি কি করে?
মায়ের সেদিনের কথায় নিজের মনে খানিক উৎসাহ পেয়েছি। এবার চুপে চুপে একটা কথা বলি, আমি কিন্তু আবার পড়তে বসেছি। দেখিনা কতদূর যেতে পারি?
ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস