#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী
|অন্তিম পর্ব|
টকটকে লাল এবং সাদা গোলাপের সংমিশ্রণে আঁধারের পুরো ঘরটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। সুন্দর ভাবে সাজানো সেই কক্ষটি’র বিছানার ঠিক মাঝ খানটায় বসে আছে জোনাকি। আজ থেকে আরো একজন মানুষের আনাগোনা বাড়বে এই ঘরে। যে ঘর শুধুমাত্র আঁধার রেজওয়ান এর অধীনে ছিলো, যার অনুমতি ছাড়া এই ঘরে কেউ উপস্থিত হতো না, সেই ঘরের আরো একজন মালিক আজ থেকে জোনাকি।
ঘন্টা খানেক ধরে একা এই ঘরে বসে আছে জোনাকি। সেই যে সবাই বসিয়ে রেখেছে আর কারো আসার নাম নেই। বসে থাকতে থাকতে যেন কোমড় ধরে যাচ্ছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেয়াল ঘড়ি খুঁজলো। সময় দেখলো রাতের সাড়ে বারোটা বাজে। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। চেঞ্জ করা’ও দরকার। জোনাকি উঠে দাঁড়ায়। পুরো ঘরে কোথাও ওর লাগেজটা দেখতে পাচ্ছে না। ঘরের মাঝখানে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মূহুর্তে খট করে দরজা খোলার শব্দ হয়। পরমূহুর্তে দরজা লাগানোর শব্দ’টাও কানে আসে। পায়ের শব্দ যতটা নিকটে এগিয়ে আসছে জোনাকির বুকের ধুকপুকানির শব্দটা ক্রমশ বাড়ছে। শাড়ি খামচে ধরলো। খুব কাছে এসে দাঁড়ায় আঁধার। জোনাকির বুকের ভেতর কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে। থমথমে গলায় প্রশ্ন আঁধারের,
–“রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কি করছো?”
চকিত আঁধারের দিকে তাকায় জোনাকি। মানুষটা তুমি করে বললো ওকে? এটা কি ভুল শুনলো? উঁহু ভুল শোনেনি তো, ঠিকই তো শুনেছে মনে হলো। আঁধার ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করে,
–“ওভাবে তাকাচ্ছো কেন? ঠিকই শুনেছো, তুমি করেই বলেছি।”
জোনাকি দ্রুত দৃষ্টি সরালো। আঁধার আর একটু কাছে গিয়ে বললো,
–“আগে থেকেই ইচ্ছে ছিলো, নিজের বিয়ে করা বউ ব্যাতিত অন্য কোনো মেয়েকে তুমি করে বলবো না। আর এখন তো তুমি আমার বিয়ে করা বউ।”
–“আপুই আমার লাগেজ আনেনি? চেঞ্জ করবো আমি।”
আঁধার জোনাকির দুই বাহু ধরে বিছানায় বসিয়ে বললো,
–“তার আগে তোমাকে ভালোভাবে বউ সাজে একটু দেখি আমি?”
গলা শুকিয়ে আসছে জোনাকির। লোকটার এরকম কথাবার্তায় অভ্যস্ত না ও তাই কেমন কেমন লাগছে। তার উপর আবার লোকটা এখন ওর স্বামী। আজকে ওদের ফার্স্ট নাইট আরো নার্ভাস হয়ে আছে ও। চুপচাপ অন্যদিকে মুখ করে বসে রইলো জোনাকি। আঁধার দুই আঙুলের সাহায্যে জোনাকির থুতনি ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
–“আঁধারের জীবনে জোনাকি হয়ে আসার তোমাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা, উঁহু #একগুচ্ছ_ভালোবাসা। এক আকাশ সম পরিমান ভালোবাসা, আমার জীবনের যত ভালোবাসা আছে সেসকল ভালোবাসা তোমার।”
লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায় জোনাকি। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয়। বুক ঢিপঢিপ করছে। লোকটা এরকম কথা’ও কি বলতে পারে? আঁধার বুঝলো মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে। তাই প্রসঙ্গ পালটে বললো,
–“আলমারির ডান পাশের ডোর খুললেই ওখানে তোমার সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পেয়ে যাবে।”
জোনাকি দু দন্ড বসলো না। দ্রুত উঠে গেলো আলমারি খুলতে। আলমারি খুলেই হা হয়ে গেলো ও। আলমারির এই পার্ট মেয়েদের শাড়ি জামা দিয়ে ভর্তি। কিন্তু একটাও জোনাকির আগের জামা না। জোনাকি সরু চোখে তাকালো আঁধারের দিকে। আঁধার মুচকি হেসে উঠে আসে। বেছে বেছে কালো রঙের একটা শাড়ি জোনাকির হাতে দিয়ে বললো,
–“আজকে সন্ধ্যায়’ই সব কিনে আলমারি লোড করেছি।”
–“চুড়িদারও আছে দেখছি, মাপ জানলেন কি করে?”
আঁধার আগাগোড়া জোনাকিকে দেখে বললো,
–“তোমার যা বডি, মাপ জানা এতটাও টাফ ছিলো না আমার জন্য। চোখের অনুমান___”
জোনাকি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
–“কি?”
আঁধার মুচকি হাসলো। বললো,
–“রিল্যাক্স ম্যাডাম, জলের থেকে জেনেছি আমি।”
জোনাকি শান্ত হলো। তারপর দ্রুত চলে গেলো ফ্রেস হতে। ফ্রেস হয়ে দুজনে একসাথে নামায আদায় করে। আঁধার দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করে, সোনার লকেট সহ চেন পড়িয়ে দিয়ে বলে,
–“ড্রেসিংটেবিলের ড্রয়ারে একটা বক্সে গোল্ডের চিকন চুড়ি, দুটো রিং, আর সিম্পল একজোড়া দুল আছে সবসময় পড়ে থাকার জন্য। সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পড়ে বের হবা।”
জোনাকি বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে। জোনাকি আঙুলে শাড়ির আঁচল পেচাচ্ছে বারবার। ওর কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। গভীর রাত, পুরো ঘরে ওরা দুজন ব্যাতীত অন্যকেউ নেই। তাছাড়া সম্পর্ক বদলেছে দুজনের। বস পিএ, বেয়াই বেয়ান থেকে এখন স্বামী স্ত্রী দুজনে। জোনাকি বিছানায় উঠে বসলো। খাটের যে পাশ দেয়ালের সাথে লাগানো সে পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আঁধার ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“শুয়ে পড়লে?”
–“আ্ আমি, না, আসলে কি করবো তাহলে? ঘুম আ্ আসছে আমার।”
আঁধার জোনাকির দিকে ঝুঁকে গিয়ে বললো,
–“তোমার কি আইডিয়া? আজকে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ার জন্য ঘরটা এভাবে সাজিয়েছে সবাই? আজকের রাতটা কি ঘুমানোর?”
জোনাকি সারা ঘরে চোখ বুলালো। গোলাপের সুঘ্রাণ এখনো নাকে এসে বারি খাচ্ছে। জোনাকি সব দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে সরাসরি আঁধারের দিকে তাকালো। আঁধারের চোখ দেখেই বুক ধক করে উঠে জোনাকির। চোখের মধ্যে ব্যাকুলতা স্পষ্ট। তবুও জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“তাহলে কিসের?”
আঁধার জোনাকির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
–“জোনাকি’কে আঁধারের সম্পূর্ণ রুপে নিজের করে নেওয়ার রাত, ভালোবাসাকে ভালোবাসার রাত।”
কথাগুলো বলেই জোনাকির কপালের একপাশে গাঢ় চুমু খায় আঁধার। পবিত্র স্নিগ্ধ ভালোবাসাময় স্পর্শ পেয়ে জোনাকির হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে যায়। চোখ খুলে রাখা যেন দায় হয়ে পড়ে।
–
খুব ভোরবেলা নিজেকে আঁধারের বাহুডোরে ক্ষানিকটা এলোমেলো অবস্থায় দেখে লজ্জায় হাঁসফাঁস করে জোনাকি। রাতের কথা মাথায় আসতে লজ্জা যেন আরো বেড়ে যায়। দূর থেকে আজানের ধ্বনি কানে আসছে। জোনাকি আঁধারের থেকে নিজেকে ছাঁড়ালো বহু কষ্টে। গোসল সেরে একেবারে পরিপাটি হয়ে এসে আঁধারকে ডাকতে লাগলো। কয়েক ডাকেই ঘুম ভাঙে আঁধারের। জোনাকিকে একটানে নিজের বুকের উপর ফেলে কপালে চুমু খায়। তারপর গালে চুমু দিয়ে বলে,
–“এত সকালে ডাকছো কেন? আদর লাগবে?”
আঁধারের কথা শুনে লজ্জায় জোনাকির গলা দিয়ে যেন শব্দ বের হচ্ছে না কোনো। আঁধার ফের ভ্রু নাচালো। জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“জ্বি না, উঠুন। ফজরের আজান দিচ্ছে নামাজ পড়বো একসাথে।”
আঁধার আর কোনো কথা ব্যয় না করে উঠে দাঁড়ালো। জোনাকির ঠোঁটে আলতো চুমু এঁকে এগিয়ে গেলো শাওয়ার নেওয়ার জন্য। ওয়াশরুমেই ফ্রেস হওয়ার পর পড়ার জন্য টি-শার্ট টাওজার আগেই দিয়ে রেখেছে জোনাকি।
–
নামায আদায় করে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে আঁধার। ডাকে জোনাকি’কেও। জোনাকি কাছে যায় না আর। বলে,
–“আপনি ঘুমান, আমি কিচেনে যাচ্ছি।”
কথাটা বলে দ্রুত দরজা খুলে বেরিয়ে যায়। আঁধার সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। মেয়েটা পালালো ওর থেকে। মিহাদের সাথে একদিন দেখা করতে হবে, লোকটা না চাইলে জোনাকি ওর হতো না।
কিচেনে এসে একা একাই রান্নার জোগাড় করতে শুরু করে জোনাকি। এ বাড়ির মোটামুটি সবার পছন্দের খাবার সম্পর্কে ধারণা আছে ওর। তাই সুবিধা’ই হলো সকালের নাস্তা বানাতে। নাস্তা বানানোর শেষ পর্যায়ে রেহানা রান্নাঘরে এসে বললো,
–“আয় হায় বড় ভাবী আপনে রান্না ঘরে ক্যান আইছেন? দাদীজান আর নিশি আপা আমারে দেখলে কথা হুনাইবো। সরেন দেহি আমারে নাস্তা বানাইতে দ্যান।”
–“আর একটু বাকী আছে তাহলেই তো শেষ, আপনি বরং এঁটো বাসনগুলো একটু ধুয়ে দিন, অনেক কিছু নোংরা করে ফেলেছি আমি নাস্তা বানাতে এসে।”
রেহানা সম্মতি জানিয়ে বাসন ধোয়ায় মনোযোগ দেয়। আমিনা বেগম রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,
–“বড় নাতবউ? তুমি এখানে কেন? রেহানা? নাতবউ রান্না করতেছে কেন?”
জোনাকি চুলো বন্ধ করে আমিনা বেগমের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
–“আমিই এসেছি দাদু, রেহানা আপা আমাকে বারণ করেছিলো বারবার।”
–“ঘরে যাও তুমি, নতুন বিয়ে হইছে এখন আমার দাদুভাইকে সময় দিবে বেশি বেশি রান্নাঘরে আসার প্রয়োজন নেই। রান্না করার সময় অনেক পড়ে আছে, বিয়ের পর এই যে নতুন এই সময়টা যাচ্ছে এটা আর আসবে না ফিরে।”
–“টেবিলে নাস্তা দিয়ে তারপর___”
–“কাল সবাই অনেক রাত করে ঘুমিয়েছে নয়টার আগে তো কেউ উঠবেই না, বাড়ির ছেলেদের অফিস বন্ধ আজ। কোনো চিন্তা নাই, যে যখন উঠবে নাস্তা করে নিবে। তুমি গিয়ে ঘুমাও কেউ ডাকবে না তোমাদের। রাত্রে তো ঘুম হয় নাই ভালো করে, আঁধার দাদু ভাই ঘুমাতে দেয় নাই নিশ্চয়ই?”
শেষ কথাগুলো আমিনা বেগম নিচু স্বরে রসিকতা করেই বললো। জোনাকি লজ্জা পেয়ে মাথা নামায়। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় ঘরের দিকে।
–
ঘরের দরজা আটকে আবার বিছানায় গিয়ে আঁধারের পাশে শুয়ে পড়লো জোনাকি। আঁধার ঘুমিয়েছে ভেবে জোনাকি কাঁপা হাতে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আঁধারকে। সেই মূহুতেই আঁধার জোনাকির দিকে ঘুরে শক্ত করে বুকে আগলে নেয়। নাকে নাক ঘঁষে বললো,
–“এতক্ষণে আসলে? অপেক্ষা করছিলাম।”
–“অপেক্ষা কেন? আমি তো না’ও আসতে পারতাম।”
–“আমি জানতাম বাসার যে-ই তোমাকে দেখবে সেই ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিবে। তাই তো অপেক্ষা করছিলাম।”
জোনাকি কিছু বললো না। আঁধার বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
–“মিহাদকে বিয়ে করার তো খুব ইচ্ছে ছিলো, তাহলে সেই ছেলে বিয়ে ভাঙলো যে?”
জোনাকি গোমড়ামুখে সবটা বলে আঁধারকে। সব শুনে আঁধার বলে,
–“কিছু কথা বলবো, রেগে যাবে না তো?”
জোনাকি সরাসরি আঁধারের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“কি কথা?”
–“মিহাদের সাথে দেখা করেছিলাম আমি।”
জোনাকি সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
–“কি বলেছেন ওকে?”
–“বেশি কিছু না, শুধু বলেছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো, এখন আমার উপর রাগ করেই ওর সাথে বিয়েতে হ্যাঁ বলেছো। আমারও তোমাকে ছাড়া একদমই চলবে না, তাই মিহাদ যেন এই বিয়েটা না করে।”
–“আপনিইই____”
আঁধার আর কিছু বলতে না দিয়ে জোনাকি’কে নিজের সাথে জাপ্টে নিয়ে বললো,
–“সব কথা পরে হবে। রাতে ঘুমাইনি ভালো ভাবে, এখন ঘুমাবো। তুমিও ঘুমাবে, চোখ বন্ধ করো।”
মনে মনে মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করলো জোনাকি। লোকটা আসলেই পাগল। বড্ড বেশিই ভালোবাসে ওকে। শেষমেশ একটা গোমড়ামুখোকে ভালোবেসেছিলো ও। জোনাকি নিজেও তো চাইতো এই গোমড়ামুখো মানুষটাই যেন ওকে ভালোবাসে, ওর হয়। উপরওয়ালা ওদের দুজনের মনের কথা’ই শুনেছে। ওদের ভালোবাসাকে কবুল করেছে। এখন বাকীটা জীবন এভাবেই কাটিয়ে দিতে চায় দুজনে একসাথে। ব্যাস! আর কি লাগে এক জীবনে?
|সমাপ্ত|