#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী
|১৪|
বিছানা ঘেঁষে ফ্লোরে হাটুতে মুখ গুজে কাঁদছে জোনাকি। এমন হলো কেন ওর জীবনটা? বাবা মাকে হারালো, যাকে ভালোবেসেছে তাকে ভুলে অন্য একজনের বাগদত্তা হলো। এখন সে মানুষটা বলছে এই বিয়েটা করা সম্ভব না? জীবন কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে ওকে? চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো ভীষণ। কিন্তু চিৎকার করতে পারলো না। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে শুধু। আঁধারকে বলবে সব? আঁধার তো চায় ওকে। এসব ভেবে ফোন হাতে নিলো। পরক্ষণেই মনে হলো এ কয়দিন আঁধার ওকে রিকুয়েষ্ট করেছে, বুঝিয়েছে কিন্তু ও বোঝেনি। বিয়ে ভাঙেনি। এখন মিহাদের থেকে রিজেক্ট হয়ে আঁধারের কাছে ফিরলে হাসির পাত্র হবে না সবার কাছে? ফোনটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিলো জোনাকি। কাউকে দরকার নেই। যেখানে নিজের বাবা মা একা করে ছেড়ে গেছে সেখানে পরের ছেলের কোনো দরকার নাই। কথাগুলো ভেবে চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায়। রাতের রান্না বসাতে হবে। সকালে খেয়েছিলো, দুপুরে রেস্তোরাঁ থেকে ফিরে আর খাওয়ার রুচি হয়নি যার কারণে রান্না’ও করা হয়নি।
ফ্রিজে কালকের রান্না করা মাংসের তরকারি ওভাবেই পড়ে আছে, কাল দুপুরে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছিলো, রাতেও খায়নি বিধায় তরকারিটা ধরা’ই ছিলো। মাংস এবং সেই সাথে কিছু আচার দিয়েই শর্টকাটে আচারি খিচুড়ি রান্না করে ফেললো জোনাকি। আজ রাত এবং কাল সকালে খেয়েও ঢেড় বেশি হবে এই খিচুড়ি। চাল মাপার সময় অন্যমনস্ক থাকায় পরিমানের চেয়েও বেশি পরিমান চাল ডাল দিয়ে ফেলেছিলো, রান্নার সময় পানি দিতে গিয়ে চাল দেখে মাথায় হাত জোনাকির। সেসময়ে আর কিছু করার ছিলো না তাই রান্না করে ফেলে। সবকিছু গোছগাছ করে, খিচুড়ি আর শসা লেবু কেটে টেবিলে রাখলো। সাথে রাখলো আচারের বয়াম। খেতে ইচ্ছে হলে খাবে৷ ধোয়া উঠা গরম গরম খিচুড়ি প্লেটে বেড়ে এক লোকমা মুখে দিতেই কলিংবেল বেজে উঠলো। কে হতে পারে এ সময়ে জানা নেই জোনাকির। খাবার চিবুতে চিবুতে এঁটো হাতেই উঠে গেলো দরজা খুলতে। ওপাশে আঁধারকে দেখতে পেয়ে ক্ষানিকটা চমকে উঠে জোনাকি। এই মূহুর্তে এই লোকটাকে তো ও কল্পনাতেও আশা করেনি। আঁধার ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“এভাবে হা করে তাকিয়ে আছেন কেন? ভিতরে যেতে বলবেন না?”
জোনাকি লজ্জা পেয়ে গেলো। দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। নিচু কন্ঠে বলে,
–“হ্যাঁ ভেতরে আসুন।”
আঁধার ভিতরে গিয়ে সোফায় বসে। জোনাকি দরজা আটকাতে গেলে আঁদবার সেদিকে না তাকিয়েই বলে,
–“দরজা খোলা রাখুন, স্বপ্ন নীড়ের সকল সদস্যরা আসছে।”
এবার ভ্রু কুঁচকে আসে জোনাকির। বিস্মিত স্বরে বলে,
–“সবাই আসছে?”
–“হ্যাঁ সবাই।”
–“আপুই স্বচ্ছ ভাইয়া কেউ তো কিছু বললো না আমাকে।”
–“প্রি প্ল্যান ছিলো না। তাই জানায়নি।”
জোনাকি কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আঁধার জোনাকির এঁটো হাতের দিকে তাকিয়ে ফের বললো,
–“আপনি বোধহয় খেতে বসেছিলেন? খাওয়া শেষ করুন আগে।”
–“আপনিও আসু____”
আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“খেয়ে নিন, পরে কিন্তু কাহ্বার সুযোগ না’ও পেতে পারেন।”
আঁধারের কোনো কথার’ই আগামাথা বুঝতে পারছে না জোনাকি। তাই সেসব কথার অর্থ খুঁজতে না গিয়ে পুনরায় টেবিলে গিয়ে বসলো জোনাকি। দুই লোকমা খেতেই সবাই এসে হাজির হয়। দরজা থেকেই স্বচ্ছ বলে,
–“আচারি খিচুড়ির ঘ্রাণ নাকে এসে বারি খাচ্ছে মনে হয়? ঠিক সময়েই আসলাম তাহলে।”
জোনাকি ফের খাওয়া বাদ দিয়ে দরজার কাছে যায় সবাইকে ভেতরে আনতে। সবাইকে সালাম জানিয়ে ভিতরে এসে বসতে বলে। তৈমুর আঁধারের পাশে বসে বললো,
–“কি শালা বাবু? দেরী সহ্য হচ্ছে না? আগে ভাগে এসেই বসে আছো দেখছি।”
–“আমি ঠিক টাইমে এসেছি, তোমরা লেট করেছো।”
তৈমুর আর কিছু বললো না। স্বচ্ছ চেয়ার টেনে টেবিলে বসলো। খিচুড়ির ঘ্রাণ নিয়ে বললো,
–“তোমার হাতের আচারি খিচুড়ি জোশ হয় জোনাকি। সার্ভ করো ফাস্ট, হবে তো আমাদের?”
জোনাকি হেসে মাথা নাড়ায়। স্বচ্ছ আঁধার আর তৈমুরকে ডাকে খাওয়ার জন্য। আঁদজার যেতে না চাইলে তৈমুর জোর করে নিয়ে টেবিলে বসায়। জল প্লেট নিয়ে আসে কিচেন থেকে। জোনাকি প্লেটে খিচুড়ি তুলে তিনজনের সামনে দেয়। জল শাহাদাত রেজওয়ানকে বলে,
–“বাবা আপনাকেও দেই?”
–“না মা, আমি এক ক্লাইন্টের সাথে বাইরে থেকেই ডিনার করে নিয়েছি।”
জল আমিনা বেগমকে জিজ্ঞেস করেন, তিনিও খাবেন না জানায়। জোনাকি এবার আর একটা প্লেটে খিচুড়ি তুলে রাজিয়াকে দেন খাওয়ার জন্য। রাজিয়াও হাসিমুখে প্লেট নিয়ে টেবিলে বসে পড়ে। এবার রইলো জোনাকির প্লেট। জোনাকি আরো কিছু খিচুড়ি তুলে নিয়ে আমিনা বেগমের কাছে গিয়ে জোর করে দুও লোকমা খাইয়ে দেন উনাকে। তারপর একে একে নিশি আর জল’কে খাওয়ায়। সবাই অল্প সল্প করেই ভাগাভাগি করে খেয়ে নেয় খিচুড়ি।জোনাকির হাতের আচারি খিচুড়ি স্বচ্ছ আর জল বাদে বাকী সবাই প্রথম খেলো। সবার এত্ত এত্ত প্রসংশায় লজ্জা পায় জোনাকি।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সবাই সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। জোনাকি সবার জন্য চা কফি করে আনলো। যার যেটা পছন্দ তার হাতে সেটাই তুলে দিলো ও। সকলের এখানে আসার কারণ’টা জোনাকির কাছে এখনো অস্পষ্ট। জোনাকি জল’কে টেনে নিয়ে কিচেনে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,
–“জানিয়ে আসবি না আপুই? আমি আগে থেকে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে রাখতাম।”
–“কিচ্ছু করতে হবে না তোর, সব ঠিক সময়ে হয়ে যাবে।”
–“হঠাৎ করে না জানিয়েই এভাবে আসলি কোনো কারণ আছে?”
জল একপাশ থেকে বোনকে জড়িয়ে ধরে বললো,
–“হ্যাঁ তা তো একটা কারণ আছেই। একটু অপেক্ষা কর সব বুঝতে পারবি।”
জল চলে গেলো সবার কাছে। স্বচ্ছকে কিছু বলতেই স্বচ্ছ আর তৈমুর বেরিয়ে গেলো। জোনাকি নিশির পাশে বসে গল্প জুড়ে দিলো। বেশ কিছুক্ষণ পর নিশির ফোন বেজে উঠে। নিশি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তৈমুর বলে,
–“রওয়ানা দিয়েছি আমরা, রেডি করো ওকে।”
–“আচ্ছা।”
নিশি ফোন পাশে রেখে জলকে ইশারা করে। জল জোনাকিকে নিয়ে নিজের ঘরে যায়। নিশিও যায় সাথে। নিশির হাতে বেশ ক’টা শপিং ব্যাগ। ঘরে গিয়ে নিশি ব্যাগ থেকে শাড়ি পড়ার প্রয়োজনীয় জিনিস বের করে জোনাকির হাতের দিয়ে বললো,
–“পড়ে এসো।”
–“কিন্তু কেন? এসব পড়বো কেন? তোমরা কেউ কিছু ক্লিয়ার করছো না কেন আমার কাছে?”
–“আগে পড়ে এসো তারপর বলছি।”
জোনাকি মনে হাজারটা প্রশ্ন নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। মিনিট পাঁচেক বাদে বের হতেই নিশি আর জল দুজনে মিলে জোনাকিকে সিঁদুর লাল রঙের জামদানি শাড়ি পড়িয়ে দেয়। খোপায় টকটকে লাল গোলাপ গেঁথে দেয় বেশ কয়েকটা। হাত ভর্তি চুড়ি, গলায় কানে মাথায় গোল্ড অর্নামেন্টস। জোনাকি অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছিলো সবকিছু। পরিশেষে লাল দোপাট্টা দিয়ে দেয় জোনাকির মাথায়। জোনকি বিস্ময় নিয়ে নিজেকে দেখছে আয়নায়। একদম বউ বউ লাগছে। নিশি জোনাকি’কে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
–“বউ বউ লাগছে না?”
জোনাকি মাথা নাড়ায়। নিশি ফের বলে,
–“এখন তো শুধু বউ বউ লাগছে, আর কিছু মূহুর্ত পরেই আঁধার রেজওয়ান এর বউ লাগবে। মিস জোনাকি থেকে মিসেস আঁধার রেজওয়ান হবে।”
জোনাকি স্তব্ধ হয়। কি শুনলো ও এটা? সত্যি কিনা আবার জিজ্ঞেস করতেই নিশি হেসে বললো,
–“হ্যাঁ আমাদের স্বপ্ন নীড়ের বড় নাতবউ হবে তুমি।”
চলবে~