#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী
|১৩|
স্বপ্ন নীড়ের সকল সদস্য’রা ভাবুক মুখে সোফায় বসে আছে। আঁধারের বলে যাওয়া কথাগুলো ভীষণ ভাবাচ্ছে সকলকে। বিয়ের আসর থেকে যদি সত্যি সত্যিই জোনাকিকে তুলে এনে বিয়ে করে তখন কি মান সম্মান কিছু অবশিষ্ট থাকবে? সেটাই ভাবছে সকলে। সে সময়ে লাগেজ টেনে ভেতরে ঢুকলো তৈমুর। অফিস থেকে কয়েকদিন ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলো বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে। সেখান থেকেই সবে ফিরলো। সবাইকে এমন ভার মুখে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,
–“কি ব্যাপার? সবাই এরকম বাংলার পাঁচের মতো মুখ করে রেখেছো কেন?”
নিশি উঠে তৈমুরের সামনে দাঁড়ালো। ধীরে ধীরে ক্ষানিক আগে ঘটে যাওয়া সকল তান্ডবের কথা জানালো। সব শুনে তৈমুরের মাথায় হাত। ইশ্! কি বিচ্ছিরি কান্ড। ও তো খুব শীঘ্রই আঁধার আর জোনাকির বিয়ের কথা বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু জরুরী কাজে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ায় আর বলে যেতে পারেনি কাউকে। তৈমুর আমতা আমতা করে বললো,
–“বড় শালাবাবু কোথায় এখন?”
–“নিজের ঘরেই আছে দরজা বন্ধ করে।”
রাজিয়ার কথায় তৈমুর বললো,
–“আসলে আমারই ভুল, আমি ভেবেছিলাম ওদের বিয়ের কথা বলবো কিন্তু তাড়াহুড়ো করে গ্রামে চলে যাওয়াতে___যাই হোক সেসব কথা বাদ, আগে জোনাকির বিয়ে ভাঙতে হবে নয়তো আঁধার বাবুর রাগ এত সহজে গলে পানি হবে বলে আমার মনে হচ্ছে না।”
–“মান সম্মানের একটা ব্যাপার আছে নাতজামাই। জোনাকির বিয়ে ভাঙলে লোকে ওকে নিয়ে চারটে কথা বলবে। ওর মৃত বাবা মা তুলেও কথা হবে আমি চাই না আমার নাতির জন্য এরকম কিছু হোক।”
আমিনা বেগমের কথা শেষ হতেই স্বচ্ছ বললো,
–“কিন্তু দাদু, ভাইয়া যদি জোনাকিকে তুলে এনে বিয়ে করে তখন কি করবে? তখন মান সম্মান থাকবে তো?”
জল আফসোসের স্বরে বললো,
–“ইশ্! ভাইয়া যদি আগে বলতো তাহলে আজ এমন কিছু হতো না। জোনাকি’কেও আমার থেকে দূরে যেতে হতো না। কিন্তু এখন তো___”
–“এখনো আহামরি তেমন কোনো দেরী হয়নি জল। জোনাকি এ বাড়ির বউ হয়েই আসবে। এটা আমার না আমাদের আঁধার বাবুর কথা। সে যেহেতু একবার বলেছে তাহলে হান্ড্রেড পার্সেন্ট জোনাকিকে বিয়ে করেই ছাড়বে। সুতরাং সে আরো বাড়াবাড়ি রকমের রেগে যাওয়ার আগে আমাদের উচিত জোনাকির বিয়ে ভাঙা।”
তৈমুরের কথায় নিশি সহমত জানিয়ে বললো,
–“আমিও এটাই চাচ্ছি। আমার ভাইয়ের খুশি সবার আগে।”
আমিনা বেগম প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“আর জোনাকির? ও রাজি হবে কিনা আঁধারকে বিয়ে করতে, ও সুখি হবে কিনা আঁধারের সাথে এটা ভাবছো না কেউ?”
ক্ষানিক সময় ভাবলো সকলে। তারপর বললো,
–“সে দেখা যাবে। আগে একদিক তো ম্যানেজ করি।”
–
আজকে জোনাকি’কে অফিস নামিয়ে দিতে মিহাদ এসেছে। এ.আর. গ্রুপের সামনে এসে মিহাদ গাড়ি থামাতেই জোনাকি নেমে যায়। মিহাদ’ও বেরিয়ে আসে। একই সময়ে আঁধারের গাড়ি ঢুকে। গাড়ি পার্ক করে একবার রাগান্বিত চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে যায় সে। জোনাকি ভয়ে শুকনো ঢোক গিলে। মিহাদের থেকে বিদায় নিয়ে দ্রুত নিজেও চলে যায় অফিসে।
নিজের কেবিনে বসে মনে মনে দুয়া দুরুদ পড়ছে জোনাকি। লোকটা না জানি কখন ওকে ডেকে পাঠায়। ভাবতে না ভাবতেই জোনাকির ডাক পড়লো আঁধারের কেবিনে। শুকনো ঢোক গিলে এগিয়ে যায় সেদিকে। কেবিনের দরজা খোলা’ই ছিলো। জোনাকি ভেতরে যেতেই আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“দরজা লক করুন মিস জোনাকি।”
–“মা্ মানে? দরজা ল্ লক করবো কেন?”
–“যা বলেছি চুপচাপ তাই করুন, নয়তো এখানে এখন যা যা হবে পুরো অফিস দেখবে সেগুলো।”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলে আঁধার। ওদিকে ভয়ে জোনাকির অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে। কি বলে লোকটা? কি করতে চাইছে সে?জোনাকি কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইলে আঁধার এসে জোনাকির হাত চেপে ধরে। একহাতে শক্ত করে জোনাকির কবজি ধরে রেখে অন্যহাতে দরজা লক করে। শান্ত চোখে জোনাকির দিকে তাকিয়ে নিষ্প্রাণ কন্ঠে বলে,
–“কিছুদিন আগে আপনিই বলেছিলেন আমাকে নিয়ে আপনার ভয় নেই। সেদিন ঝড় বৃষ্টির রাতে ফাঁকা একটা ফ্ল্যাটে শুধু আপনি আর আমি ছিলাম। তখন ভয় কাজ করেনি আর আজকে অফিস ভর্তি লোকজনের সামনে ভয় পাচ্ছেন আপনি আমাকে নিয়ে। অন্য পুরুষের বাগদত্তা হতে না হতেই আঁধার রেজওয়ানের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেলো? ভয় পেতে শুরু করলেন তাকে?”
কি জবাব দিবে ভেবে পেলো না জোনাকি। তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলো। আঁধার জোনাকি’কে টেনে নিজের কাছে এনে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আমি বলেছিলাম এই বিয়ে হবে না। তারপরেও আপনি ওই ছেলের সাথে মেলামেশা করছেন কেন? সে কেন আপনাকে অফিসে ড্রপ করতে আসে মিস জোনাকি?”
–“আমি তার বাগদত্তা, কিছুদিনের মধ্যেই বিয়ে হবে আমাদের। তার এইটুকুন অধিকারবোধ নিশ্চয়ই আছে আমার উপর? সে পারে আমাকে অফিসে ড্রপ করতে আসতে। আমার তো কোনো সমস্যা হচ্ছে না, তাহলে আপনি কেন রেগে যাচ্ছেন?”
আঁধার জোনাকির দুই গাল চেপে ধরে মৃদু চিৎকার করে বললো,
–“আমি রেগে যাচ্ছি কারণ আপনার পাশে অন্য পুরুষের আনাগোনা সহ্য হয় না আমার। আপনার চারিপাশে শুধু মাত্র আমিই বিচরণ করবো। আপনি কেবলই আমার মিস জোনাকি।”
প্রথম কথাগুলো রাগের স্বরে বললেও শেষ কথাগুলো অত্যান্ত নরম স্বরে বললো আঁধার। নিশ্চুপ হয়ে যায় জোনাকি। আঁধার ফের বলে,
–“আপনি এই বিয়েটা করবেন না মিস জোনাকি। না করে দিন সবাইকে। আমি আপনাকে অনেক ভালো রাখবো, আই প্রমিসড ইউ।”
চোখ বন্ধ করে ফেললো জোনাকি। ওর কি যেন একটা হলো। ইচ্ছে করলো আঁধারকে বলতে,
–“আপনি আমার প্রথম অনুভূতি আঁধার স্যার। আপনার হাত ধরেই আমার এই নতুন অজানা অনুভূতির জগতে পদচারণ করা।”
মনে মনে কথা গুলো বললেও মুখে কথাগুলো বলতে পারে না জোনাকি। চোখ মেলে তাকায়। চোখমুখ যথাসাধ্য শক্ত করে কাটকাট কন্ঠে বলে,
–“এটা আর সম্ভব না আঁধার স্যার, আপনি বড্ড দেরী করে ফেলেছেন। আপনাকে খুশি করতে গিয়ে আর একটা নিরপরাধ ছেলেকে এতটা কষ্ট দিতে পারি না আমি।”
কথাগুলো বলে আঁধারের কাছ থেকে দূরে সরে দাঁড়ায় জোনাকি। বেরিয়ে যেতে নিলেই আঁধার পেছন থেকে বলে,
–“মানছেন না তো? ঠিক আছে। আমিও দেখি আপনি আমি আঁধার রেজওয়ান ছাড়া অন্য একজন পুরুষকে কবুল বলে নিজের স্বামী হিসেবে মানেন কিভাবে।”
কথাটা শোনার পর কোনো প্রত্যুত্তর করলো না জোনাকি। দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে যায় সে।
–
একটা ক্যাফেতে বসে আছে মিহাদ আর জোনাকি। মিহাদ’ই ডেকেছে আজ৷ মিহাদের চোখমুখে গাম্ভীর্যের ছাপ। পাশাপাশি লোকটাকে বেশ ভাবুক’ও মনে হচ্ছে। নিরবতা ভেঙে জোনাকি নিজেই বললো,
–“কেন ডেকেছেন? কিছু বলছেন না যে?”
–“আসলে জোনাকি কিভাবে বলবো তোমাকে কথাটা___”
–“কিছু হয়েছে? আপনার পরিবারের সকলে ঠিক আছে?”
–“হ্যাঁ সেসব ঠিক আছে। কথাটা আসলে অন্য___”
–“কি কথা? আপনি নির্ভয়ে বলুন।”
–“আমার বাবা মা এখন চাচ্ছে আমি আমার চাচাতো বোন রিয়াকে বিয়ে করি।”
থমকালো জোনাকি। কয়েকদিন বাদেই বিয়ে আর এই লোক আজকে এসব বলছে? জোনাকি কোনোমতে বললো,
–“সব তো ঠিক ছিলো তাহলে হঠাৎ করে___”
–“কিছুই ঠিক ছিলো না জোনাকি। বাবা শুরু থেকেই রাজি ছিলো না। সেদিন এক প্রকার জোর করেই উনাকে এনেছিলাম তোমাদের বাসায়। তার উপর তোমার সাথে এনগেজমেন্ট হওয়ার পর বাসায় ফিরে দেখি রিয়া কান্নাকাটি করছে। ও আমাকে ভালোবাসে। অনেক আগে থেকেই। আমিই পাত্তা দেইনি কখনো। সেদিন আমার হাতে পায়ে ধরে অনেক কান্নাকাটি করে। মানতে চায়নি আমি। এক পর্যায়ে ও সুইসাইড করতে যায়। দুদিন হসপিটালে ভর্তি ছিলো, এই যাত্রায় বেঁচে গেছে। কিন্তু মেয়েটার পাগলামি কমছে না, দিনকে দিন বেড়েই চলছে। এখন বাবা তো আরো চাইছে না আমি রিয়াকে রেখে তোমাকে বিয়েটা করি, মা’ও আমতা আমতা করছে। আমি আসলে___”
সবকিছু শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো জোনাকি। প্রশ্ন ছুঁড়লো,
–“আপনি কি চান সেটা বলুন?”
–“আমি আসলে___আমার তোমাকে ভীষণ পছন্দ, ওদিকে রিয়াটা’ও পাগলামি করছে আমি বুঝতে পারছি না কি করবো।”
–“বুঝাবুঝির কিছু নেই, আপনি রিয়াকে বিয়ে করুন। এনগেজমেন্টের কথা শুনেই সে সুইসাইড করতে গিয়েছিলো, বিয়ে হলে তো নির্ঘাত বাঁচানো যাবে না তাকে। জান বাঁচানো ফরজ। আপনি উনাকেই বিয়ে করুন, আমাদের বাসার দিকটা আমি ম্যানেজ করবো।”
কথাগুলো বলে আর এক দন্ড দাঁড়ালো না জোনাকি। পার্স হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো ক্যাফে থেকে। মিহাদ নিষ্প্রাণ চোখে নিজের পছন্দের মানুষটাকে দূরে মিলিয়ে যেতে দেখলো শুধু।
চলবে~