একগুচ্ছ ভালোবাসা পর্ব-০৮

0
512

#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী

|৮|

–“কি হলো? ধোয়াও আঁধারের হাত।”

কথাটা বলেই তৈমুর ঠোঁট কামড়ে হাসে। আঁধার তখনো জোনাকির দিকে তাকানো। জোনাকি শক্ত কন্ঠে বলে,
–“এখানে বর স্বচ্ছ ভাইয়া, আমরা তার হাত ধুইয়েই টাকা নেবো।”

–“আঁধারের হাত ধোয়ালে তিনগুন পাবে বললামই তো। নয়তো এক টাকা’ও না। আমরা নিজেরাই নিজেদের হাত ধুয়ে নিতে পারি।”

জোনাকি স্বচ্ছ’র হাত ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
–“লাগবে না টাকা।”

জোনাকি চলে যাওয়ার জন্য দুই কদম বাড়াতেই রিমু বলে,
–“আমি ধুইয়ে দিচ্ছি হাত।”

থেমে যায় জোনাকি। রিমু কি সত্যি সত্যিই ধুয়ে দিবে হাত? স্পর্শ করবে আঁধারকে? পেছন ফিরে আবার তাকায় জোনাকি। তৈমুর মৃদু হাসে জোনাকির চাহনি দেখে। তারপর বলে,
–“উঁহু, এই চান্স শুধু জোনাকির।”

রিমু বিরক্ত হলো। যে হাত ধোয়াতে চায় না তাকে দিয়ে জোর করে কেন ধোয়াবে? ও নিজে তো চাচ্ছে ধুইয়ে দিতে, তাহলে ওকে ধোয়াতে দিবে না কেন? আশ্চর্য! মিতু এবার জোনাকি’কে জোর করতে থাকে হাত ধোয়ানোর জন্য। নাহলে একটা টাকা’ও পাবে না ওরা। মিতু’র রিকুয়েষ্ট ফেলতে পারে না জোনাকি। ফের আঁধারের মুখোমুখি গিয়ে বসে। তারপর বলে,
–“দেখি আপনার কোর্টের হাতা উপরে তুলুন।”

আঁধার বাধ্য ছেলের মতো নিজের ডান হাতের কোর্টের হাতা টেনে উপরে তোলে। জোনাকি আশ্চর্য হয়ে তাকায়। কিছুক্ষণ আগে রিমু হাত ধোয়াতে যাওয়ার সময় তো উঠে চলে যাচ্ছিলো, তাহলে জোনাকির বেলা যাচ্ছে না কেন? উলটো জোনাকি কোর্টের হাতা তুলতে বলতেই সাথে সাথে হাতা তুলে ফেলে। রিমু দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো। ব্যাপারটা ওর নিজের’ও নজর এড়ায়নি। তৈমুর তো প্রথম থেকেই মজা নিচ্ছে। জোনাকি কোনো কথা না বলে চুপচাপ আঁধারের হাতে সাবান মাখিয়ে ধুইয়ে দেয়। রিমু স্বচ্ছর হাত ধুইয়ে দেয়। মিতু বলে,
–“এবার আমাদের টাকা?”

তৈমুর পকেট থেকে টাকা বের করে জোনাকির হাতে দেয়। জোনাকি টাকা নিয়ে চলে আসতে নিলেই শাড়ির আঁচলে টান বাজে। পেছন ফিরে তাকায় জোনাকি। আঁধার জোনাকির শাড়ির আঁচল টেনে তা দিয়ে হাত মুছে বললো,
–“হাত মোছাতে ভুলে গিয়েছিলে।”

কথাটা বলে আঁধার নিজেই সেখান থেকে উঠে চলে যায়। আহাম্মক হয়ে দাঁড়িয়ে রয় জোনাকি, মুচকি হাসে তৈমুর। অন্যদিকে রাগে ফেঁটে পড়ে রিমু।

বিদায়ের বেলা ঘনিয়ে আসতেই বুক ভার হয়ে আসে জলের। জোনাকি তো অন্যঘরে বসে সে কখন থেকে কেঁদে যাচ্ছে। জল’কে নিয়ে যাওয়ার পালা এবারে। রিমু নাহার ওরা জল’কে নিয়ে ড্রয়িংরুমে আসে। আনিসুজ্জামান মেয়েকে শাহাদাত এবং স্বচ্ছ’র হাতে তুলে দেওয়ার সময় কান্নায় ভেঙে পড়ে। বাবার কান্নায় নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না জল। বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। নাহার ভেতরের ঘর থেকে জাহানারাকে জলের কাছে নিয়ে আসে। বাবাকে ছেড়ে এবার মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে জল। অনেক সময় চলে যাওয়ার পরেও জোনাকি’কে না দেখে এদিকে সেদিক খুঁজতে থাকে। রাফিন বলে,
–“তোমাদের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছে ও, আসবে না।”

জল এলোমেলো পায়ে সে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। দরজায় দাঁড়িয়ে বেশ ক’বার ডাকে। কোনো সাড়া দেয় না জোনাকি। জল এবার দরজা ধাক্কা দিয়ে বলে,
–“বের হবি না জোনাকি? চলে যাচ্ছি তো আমি, আর আগের মতো ফিরবো না এ বাড়িতে। সবসময় অতিথি হয়ে আসতে হবে। দেখ জোনাকি কাঁদছি আমি, এখনো দরজা খুলবি না তুই?”

জোনাকির কোনো সাড়া নেই। নাহার জল’কে নিয়ে চলে আসার জন্য ঘুরতেই খট করে দরজা খুলার শব্দ হয়। জল পেছনে ঘুরার আগেই জোনাকি পেছন থেকে ওকে জাপ্টে ধরে শব্দ করে কাঁদে। বলে,
–“তুই যাস না আপুই, আমার রাতে ঘুম হবে না তো। তুই জানিস না আমার একা ঘরে ঘুমাতে ভয় লাগে? আমি কাকে নিয়ে ঘুমাবো? ভয় পেলে কে আমাকে সাহস দিবে? প্লিজ আপুই তুই যাস না আমাকে ছেড়ে।”

জল কাঁদছে, কাঁদার ফলে কিছু বলতে পারছে না। এদিকে রাত হয়ে আসছে। এবার ওকে নিয়ে যাবার পালা। নিশি এসে আগলে ধরে জলকে। চলে যেতে চায় বাসা থেকে। জোনাকি সেখানেই দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকে। সিড়ি অব্দি যেতেই জ্ঞান হারায় জল। তৈমুর ইশারা করতেই স্বচ্ছ জল’কে কোলে তুলে নিয়ে নেমে যায় সিড়ি দিয়ে। জাহানারা এবং আনিসুজ্জামান দুজনেই গাড়ি অব্দি এসে মেয়েকে বিদায় দেয়।

ফুলে সজ্জিত কক্ষে বসে বসে ঘুমে ঢলছে জল। এ ঘরে ওকে বসিয়ে দিয়ে গেছে ঘন্টা দুই হবে। পুরো ঘরে মোমবাতি’র আলোয় আলোকিত। ফুলের গন্ধ মো মো করছে ঘরটা। এদিকে ঘুমে তাকাতে পারছে না জল। একপর্যায়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে।

জল ঘুমানোরও পাক্কা চল্লিশ মিনিট পর দরজা খুলে ঘরে ঢুকে স্বচ্ছ। ধীর পায়ে এগিয়ে আসে বিছানার কাছে। দেখতে পায় জল ঘুমাচ্ছে, চোখমুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। স্বচ্ছ’র ইচ্ছে করলো না জল’কে জাগাতে। তাই নিঃশব্দে নিজে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলো। নিরবে বিছানায় উঠে জলের দিলে ঝুঁকে দেখতে লাগলো অপলক। চোখমুখে গরম নিঃশ্বাস পড়ায় ঘুম ভেঙে যায় জলের। মুখের সামনে স্বচ্ছ’কে ঝুঁকে থাকতে দেখে তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে। অপ্রস্তুত হয়ে যায় স্বচ্ছ। জল আমতা আমতা করে বলে,
–“স্যরি আসলে ঘুম, ঘুম পাচ্ছিলো।”

স্বচ্ছ প্রথমেই কিছু না বলে পকেট থেকে চেন বের করে পড়িয়ে দেয় জলের গলায়। তারপর বলে,
–“সমস্যা নেই, ঘুমাও। তোমাকে দেখেই তো ক্লান্ত মনে হচ্ছে।”

জল ভয়ার্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
–“ঘুমাবো?”

–“হ্যাঁ শুয়ে পড়ো।”

জল আবার গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে। শরীর কাঁপছে ওর। স্বচ্ছ নিজেও জলের পাশে শুয়ে জল’কে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
–“এতদিন কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়েছি, এখন আস্তো একটা বউ আছে তাই রোজ বউকে জড়িয়েই ঘুমাবো।”

কথাটা বলে আলতো করে চুমু খায় জলের কপালে। লোকটার স্পর্শে কাঁপুনি শুরু হয় জলের। কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে ঠোঁটে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুমু খেয়ে জাপ্টে ধরে শুয়ে পড়ে। তারপর আবার চোখ খুলে বলে,
–“আজ ক্লান্ত তুমি, তাই আজকের দিনটা ছাড় দিলাম। এরপর আর নো ছাড়াছাড়ি। আজ রাতটা ঘুমাও কাল থেকে অনলি ভালোবাসা-বাসি।”

হাতে গোলাপি রঙের জর্জেট ওড়নার এক টুকরো ছেঁড়া অংশ নিয়ে বসে আছে আঁধার৷ জোনাকির ওড়নার অংশ এটা৷ কাল জোনাকি’কে নিয়ে একটা মিটিংয়ে গিয়েছিলো ও। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে লেট হওয়াতে নিজেই জোনাকি’কে বাসায় পৌঁছে দেয়। কেননা ওর তাড়া ছিলো বাসায় যাওয়ার। জলের হলুদ যে। তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে এই অংশটা গাড়ির দরজার সাথে আটকা পড়ে ছিঁড়ে যায়। সেখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে এটা। খুবই তুচ্ছ একটা জিনিস, কিন্তু আঁধারের কাছে বেশ মূল্যবান মনে হচ্ছে। খুব যত্নে রেখেছে এই একদিন। হুট করেই আঁধারের মনে পড়ে গেলো আজ বিকেলের ঘটনা। জোনাকির আঁচল টেনে হাত মোছাটা যেন দূর্দান্ত একটা মোমেন্ট ছিলো আঁধারের কাছে। মেয়েটা যখন ভয় ভয় চেহারা নিয়ে তাকায় ওর দিকে, তখন মেয়েটার ওই ভয়ার্ত চেহারায় হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে আঁধারের। মনে হয় অনন্তকাল এই মেয়েটার মায়ায় পড়ে কাটিয়ে দিতে পারবে ও। আঁধারের এসকল ভাবনার মাঝেই ওর পাশে এসে বসে তৈমুর। আঁধার দ্রুত ওড়নার অংশটা হাতের মুঠোয় বন্দী করে ফেলে। তা দেখে তৈমুর নিঃশব্দে হাসে। আঁধার বলে,
–“কিছু বলবে তৈমুর ভাই?”

–“রাত তো অনেক হয়েছে শালাবাবু, এখনো না ঘুমিয়ে সুইমিংপুলে বসে বসে কি এত ভাবছো?”

–“এমনি বসে আছি।”

–“স্বচ্ছ তোমার ছোট ভাই, অথচ দেখো সে ছক্কা মেরে দিয়েছে। এই মূহুর্তে বউ নিয়ে বাসর ঘরে আছে। আর তুমি বড় ভাই হয়ে একটা মেয়ের ওড়নার ছেঁড়া অংশ হাতে করে সেই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবছো?”

প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না আঁধার। তৈমুর ফের বলে,
–“মিস করে গেলে শালাবাবু, আজকে বিয়েতে মত দিলে তুমিও এখন বউ নিয়ে বাসর ঘরে থাকতে, অন্য মেয়ের চিন্তা ভাবনা মস্তিষ্কে নিয়ে সুইমিংপুলে বসে থাকতে না।”

–“সেরকম কিছু না।”

–“কেমন কিছু তাহলে?”

উত্তর করলো না আঁধার। তৈমুর ঠোঁট কামড়ে হাসে। আঁধার এই মূহুর্তে কিছু একটা বলবে সেটা সিয়র তৈমুর। তাই তো চুপচাপ পাশে বসে রইলো। কিছু মিনিট গড়াতেই আঁধার থমথমে গলায় বললো,
–“আই থিংক, আই ওয়ান্ট হার।”

কথাটা বলে আর এক মূহুর্ত বসে থাকলো না আঁধার। হনহনিয়ে চলে যায়। তৈমুর সেখানে বসেই আঁধারের চলে যাওয়া দেখে। মৃদু হাসলো তৈমুর। এই দুজনের জুটি হলে ভালোই মানাবে বলে মনে করলো তৈমুর। আঁধার জোনাকি’কে তো পাশাপাশি কাছাকাছি বেশ লাগে ওর।

চলবে~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে