#একগুচ্ছ_ভালোবাসা
#অরনিশা_সাথী
|৭|
হলুদের মোটামুটি সব আয়োজন শেষ। জোনাকির দুই চাচাতো ভাই বোন রিমু, রাফিন, ফুপাতো বোন নাহার এবং তার স্বামী হাসান এবং খালাতো ভাই আশিক এবং মামাতো বোন মিতুই এদিকের হলুদের সব আয়োজন করেছে। নাহার আর আশিক জলের’ও বড়। রিমু জল সমবয়সী এবং রাফিন জোনাকি একই বয়সের, ওদের থেকে বছর দুয়েকের ছোট মিতু।
তাড়াহুড়ো করে কাঁচা হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে বের হলো জোনাকি। ওর আজ অফিস থেকে আসতে আসতে লেট হয়েছে অনেকটা। আজ হাফ ডে, সবার তাড়াতাড়ি ছুটি হলেও জোনাকি’কে ছেড়েছে দেরী করে। জোনাকি’কে সাথে নিয়ে একটা মিটিংয়ে গিয়েছিলো মূলত সেখানেই দেরী হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ভাবে না। ক্লাইন্টের জন্য ক্ষানিকটা অপেক্ষা করতে হয়েছিলো ওদের। জোনাকি চলে আসতে চেয়েছিলো আঁধারের দৃষ্টি দেখে আর কিছু বলার সাহস পায়নি।
জোনাকি বের হতে হতেই দেখা গেলো সিড়ি দিয়ে উঠছে স্বপ্ন নীড়ের সদস্যরা। নিশি, তৈমুর, রিশাদ এবং আরো দুই চারটা অপরিচিত মুখ। হলুদের ডালা নিয়ে এসেছে উনারা। আশিক এবং হাসান ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের খাতির আপ্যায়ন করতে। জোনাকি সিড়ির দিকে আরো একবার উঁকিঝুঁকি মারলো। আঁধার আসেনি? আসেনি বোধহয়। জোনাকি পাংশুটে মুখে দরজার কাছ থেকে সরে এলো। লোকটার ধমকি ধামকি যেন অভ্যাসে পরিণত হচ্ছে ওর। কখনো কখনো খুব বেশি খারাপ লাগে, আবার কখনো একটু আধটু ভালো’ও লাগে।
ড্রয়িংরুমের মধ্যেই ছোটখাটো ভাবে হলুদের জায়গা বানিয়েছে। জোনাকি ওরা কয়েকজন মিলে জলকে সেখানে এনে বসালো। স্বচ্ছ’র বাড়ি থেকে দেওয়া শাড়ি গয়না পড়ানো হয়েছে ওকে। তৈমুর আর নিশি দুজনে একসাথে গিয়ে দুইপাশে বসলো জলকে হলুদ ছোঁয়াতে। নিশি রিশাদের কাছে হলুদের বাটিটা চাইলে রিশাদ ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে,
–“ইশ! আপু আমি তো ভুলে গেছি।”
নিশি চোখ রাঙিয়ে তাকায়। তৈমুর নিশিকে বললো,
–“চিন্তা করো না, আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।”
কথাটা বলে তৈমুর ওঠে যায়। দরজার কাছাকাছি যেতেই দেখতে পেলো সিড়ি ভেঙে এই ফ্ল্যাটের দিকেই আসছে আঁধার। হাতে হলুদের বাটি। তৈমুর স্বস্তির শ্বাস নিয়ে এগিয়ে যায় আঁধারের দিকে। আঁধারের কাঁধে হাত রেখে বলে,
–“যাক বাঁচালে তুমি, আমি এক্ষুনি আবার হলুদের জন্য বাসায় যাচ্ছিলাম।”
আঁধার মৃদু হাসলো। তৈমুর আঁধারকে নিয়ে বাসায় ঢুকে বললো,
–“তোমার যে ভাইকে এত বলেও আনতে পারোনি সে ভাই এখন হলুদের বাটি নিয়ে চলে এসেছে নিশি।”
নিশি উঠে আঁধারের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
–“বেশ ভালো করেছিস তুই এসে। একেবারে জলকে হলুদ লাগিয়ে যাবি।”
–“ও আমার ছোট ভাইয়ের বউ আপু।”
এরইমাঝে আনিসুজ্জামান এসে আঁধারকে বললো,
–“তুমি তো মাত্রই আসলে, সোফায় বসো বাবা।”
আঁধার মাথা নেড়ে বসলো। খুব সাবধানতা অবলম্বন করে ভিতরের রুমের দিকেও উঁকিঝুঁকি মারলো। ফলাফল শূণ্য। পকেট থেকে ফোন বের করে তাতে মনোযোগ দেয় আঁধার। তখনই রিমু আর জোনাকি ট্রে ভরে কয়েক ধরনের নাস্তা এনে টি-টেবিলে রাখলো। আঁধার ফোন থেকে মনোযোগ সরাতেই দৃষ্টি আটকালো শাড়ি পরিহিতা জোনাকির দিকে। তৈমুর পাশে বসে গলা ঝাড়তেই আঁধার দৃষ্টি সরিয়ে আবার ফোনে মনোযোগ দেয়। জোনাকি আর রিমু খালি ট্রে গুলো নিয়ে কিচেনে যায়। যাওয়ার পথে রিমু জিজ্ঞেস করে,
–“ছেলেটা কে রে? জলের দেবর?”
জোনাকি ট্রে গুলো জায়গামতো রেখে বললো,
–“জ্বি না, ভাসুর।”
–“ওহ তার মানে তো বিবাহিত।”
–“আজ্ঞে না, উনি এখনো আনম্যারিড তকমা গলায় ঝুলিয়ে ছোট ভাইকে বিয়ে করাচ্ছে।”
–“কাহিনী কি? জানিস কিছু?”
–“নাহ।”
কথাটা বলেই ছোট পাতিলে করে পানি বসালো চুলোয়। রিমুর মনোযোগ তখন আঁধারের দিকে। ছেলেটাকে ভালো লেগেছে ওর। জলের বিয়েটা হোক তারপর ওর থেকে নাম্বার’টা নিতে হবে। মনে মনে ভাবলো রিমু।
রিমু নাস্তার প্লেট গুলি নিয়ে আসলো আঁধারের সামনে থেকে। লোকটা তো কিছুই খেলো না। কথা বলার চেষ্টা করেছিলো সেটাও বলেনি। রিমু সেগুলো কেবিনেটের উপর রেখে বললো,
–“লোকটা তো একটা নাস্তাও মুখে তুলেনি, ডায়েট টায়েট করে নাকি?”
জোনাকি কফি বানাতে বানাতে বললো,
–“কি জানি আপু, জানি না তো। তবে কফি দিলে সেটা খাবে নিশ্চয়ই, সারাদিনে তো দেখি ওই তেঁতো তেঁতো কফি’ই সাবাড় করছে মগের উপর মগ।”
কথাগুলো বলে জোনাকি একটা মগে কফি নিয়ে নিলো। রিমু ভ্রু কুঁচকে বললো,
–“তুই জানিস কেমনে?”
–“উনি আমার বস আপু, আর আমি অসহায় বালিকা ওই রাগচটা গোমড়ামুখো মানুষটার পিএ অর্থাৎ পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট।”
কথাটা বলেই প্রস্থান করলো জোনাকি। রিমুর ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। জোনাকি’র থেকেই তো তাহলে নাম্বার নেওয়া যাবে এই ভেবে।
তৈমুর আর নিশি জলকে হলুদ লাগিয়ে আঁধারের পাশে বসে আছে। জোনাকি আঁধারের দিকে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বললো,
–“আপনার কফি।”
আঁধার এক পলক তাকিয়ে কফির মগটা নিয়ে নিলো। সেদিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসলো তৈমুর। নিশিকে ইশারা করলো ওদের দুজনকে দেখতে। নিশি খেয়াল করলো দুজনকেই। প্রথমদিনের থেকে আজ অনেক পরিবর্তন দুজনের মাঝেই। যাক আঁধার যে এখন আর মেয়েটার সাথে রুড বিহেভিয়ার করে না এটাই অনেক। তৈমুর রসিকতা করে বললো,
–“বেয়াইন? আপনার এ বিয়াইয়ের জন্য কি স্পেশাল ট্রিট? না মানে সে কফি পাচ্ছে আমরা পেলাম না, সম্পর্কে বেয়াই বেয়াইন তো আমরা’ও।”
জোনাকি আমতা আমতা করে বললো,
–“না আসলে, স্যার তো কিছুই মুখে তুলেনি তাই আরকি___”
–“হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি, তোমার স্যারের জন্য স্পেশাল ট্রিট তোমার তরফ থেকে।”
জোনাকি লজ্জা পেলো। আগ বাড়িয়ে কফি দেওয়াটা কি ভুল করলো? সবাই কি উল্টাপাল্টা ভাবছে? তৈমুর আঁধারকে আলতো ভাবে ধাক্কা দিয়ে বললো,
–“কি শালাবাবু কিছু চলছে নাকি?”
আঁধার ভ্রু কুঁচকে তাকালো একবার। মুখে কিছু বললো না, চুপচাপ কফি খাচ্ছে। নিশি তৈমুরকে বললো,
–“আহহা! মেয়েটাকে লজ্জা দিচ্ছো কেন এভাবে? ভাইয়ের সাথে যারা থাকে তারা সবাই জানে ভাই কফি পছন্দ করে, দিনে পাঁচ ছয় বার কফি লাগে ওর। জোনাকি তো ওর পিএ, ও দেখেছে ভাইকে কফি খেতে তাই দিয়েছে। তুমি মেয়েটাকে ভড়কে দিচ্ছো তো একেবারে।”
নিশি ফের জোনাকিকে বললো,
–“কিছু মনে করো না, ও আসলে মজা করছিলো তোমার সাথে।”
–“না না ঠিক আছে, আপনারা বসুন আমি কফি নিয়ে আসছি।”
জোনাকি কিচেনের দিকে পা বাড়াতে গেলেই তৈমুর বলে,
–“আমরা আবার তোমার স্যারের মতো কফি পছন্দ করি না, আমাদের চা হলেই ভালো হয়।”
জোনাকি যেতে যেতে মাথা নাড়ালো। তৈমুর নিশির দিকে ঝুঁকে বললো,
–“কি বুঝলে? কিছু হওয়ার চান্স আছে এদের মাঝে?”
নিশি বেশ কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
–“হলেও হতে পারে, হলে খারাপ হবে না।”
–
পার্লার থেকে সেজে সবেই বাড়ি ফিরলো জল। সাথে রিমু গিয়েছিলো। রিমু জল’কে নিয়ে ওদের ঘরে বসালো। ক্ষানিক বাদেই স্বচ্ছ’র পরিবারের সকলে চলে আসবে। জল একপলক আয়নায় দেখলো নিজেকে। অনেক দামী শাড়ি গায়ে জড়িয়েছে সে। শাড়িটা দেখতে বেশ সুন্দর। যে-ই পছন্দ করেছে তার পছন্দ বেশ ভালো। এরইমধ্যে শোনা গেলো স্বচ্ছ’রা চলে এসেছে। রিমু মিতু নাহার ওরা সকলে গেট ধরতে চলে গেলো। জলের পাশে বসে রইলো শুধু জোনাকি। ওর ভালো লাগছে না। একপাশ থেকে জলকে জাপ্টে ধরে বসে আছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ভীষণ রকমের কষ্ট হচ্ছে। জলকে তো আর আগের মতো করে পাবে না। কে প্রতিদিন ঘুম থেকে তুলে জোর করে নাস্তা খাইয়ে তারপর অফিস পাঠাবে? কে প্রতি বৃহস্পতিবার বিকাল অব্দি বসে থাকবে জোনাকির অপেক্ষায় একসাথে দুপুরের খাওয়ার জন্য? কে প্রতি শুক্রবারে বেলা দশটা অব্দি না খেয়ে জোনাকির জন্য বসে থাকবে? কাকে জড়িয়ে ঘুমাবে জোনাকি? হঠাৎই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে। কাঁদতে চাইছে না কিন্তু কান্নাটা আটকেও রাখতে পারছে না। বোনের কান্না দেখে জল’ও নিজেকে সামলাতে পারলো না।
ক্ষানিক বাদেই নিশি রিমু আর মিতুর সাথে ঘরে এসে দেখে দুই বোনে কাঁদছে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। রিমু দ্রুত এগিয়ে যায় দুজনকেই শান্ত করে। জল নিশিকে দেখে সালাম দেয়। জোনাকি তখনো থেমে থেমে নাক টানছে। নিশি মুচকি হেসে জলের পাশে বসলো। হাতে কয়েকটা গহনার বাক্স। নিশি একে একে বাক্স গুলো থেকে সব গহনা বের করে জল’কে পড়িয়ে দেয়। রিমু, নাহার, মিতু ওরা অবাক চোখে দেখে। কোনো গহনার কমতি নেই। নাকের টানা নোলকটা অব্দি সোনা দিয়ে গড়ানো। নাহারের বিয়েতেও সোনার গহনা দিয়েই সাজিয়ে নিয়েছে। হাতে কানে গলায় মাথায় সব গহনা দিয়েছে কিন্তু জলের মত এত গহনা না। ওরা বেশ খুশি হলো মেয়েটা বেশ ভালো ঘরেই যাচ্ছে। আল্লাহ স্বামী সংসার নিয়ে ভালো রাখুক, এটাই তো সকলের চাওয়া।
রিমু মিতু একপ্রকার জোর করেই জোনাকিকে সাথে করে নিয়ে গেলো। নিশি আর নাহার আছে জলের কাছে। স্বচ্ছ’র খাওয়া শেষ, এবার হাত ধোয়ানোর পালা। হাত ধুইয়ে টাকা আদায় করতে হবে তো। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই জোনাকির সবার আগে নজর গেলো আঁধারের দিকে। ফুল ব্ল্যাক গেট আপে বেশ ভালোই লাগছে তাকে দেখতে। আঁধার সোফায় বসে ফোনে কথা বলছে। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নেয় জোনাকি। রিমু মিতু ওদের সাথে চলে যায় স্বচ্ছ’র কাছে হাত ধোয়াতে। স্বচ্ছ’র হাত ধোয়ানোর সময় এক প্রকার হইচই শুরু হয়ে গেছে। শোরগোলের শব্দ অনুসরণ করতেই আঁধারের দৃষ্টি পড়ে জোনাকির দিকে। কালো শাড়িতে মেয়েটাকে মনোমুগ্ধকর লাগছে দেখতে। আঁধার এক ভাবেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরায়।
স্বচ্ছ’র হাতে সাবান মাখিয়ে হাত ধরে বসে আছে জোনাকি। টাকা না দেওয়া অব্দি হাত ধুইয়ে দিবে না। এখন তৈমুর আর রিশাদের দাবী ওদের হাত’ও ধুইয়ে দিতে হবে নয়তো ওরা টাকা দিবে না। জোনাকি বললো,
–“অবশ্যই ধুইয়ে দেবো, তবে টাকার পরিমান ডাবল হতে হবে।”
কথাটা বলেই জোনাকি রিমু আর মিতুকে ইশারা করতেই ওরা দুজনে তৈমুর আর রিশাদের হাতে সাবান মাখানো শুরু করলো। ওরা যে সত্যি সত্যি হাত ধোয়াবে ভাবেনি তৈমুর বা রিশাদ। তাই আচমকা হাতে সাবান মাখানোতে ভড়কে যায় ওরা। তৈমুর বলে,
–“হাত না ধোয়ালে টাকা দেবো কি করে? আগে হত ধুইয়ে দেও তারপর টাকা দিচ্ছি।”
রিমু তৈমুরের হাতে পানি ঢেলে দিলো। তৈমুর ভালো করে হাত কচলে ধুইয়ে টিস্যু দিয়ে মুছে নেয়। রিশাদ বলে,
–“আমার হাত?”
মিতু বলে,
–“আপনি বসে থাকুন, টাকা না দেওয়া অব্দি আপনার হাত ধোয়া হবে না।”
তৈমুর সেখান থেকে উঠে গিয়ে আঁধারকে সাথে করে নিয়ে আসে। স্বচ্ছ’র পাশে বসায় ওকে। তারপর জোনাকিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“আঁধারের হাত ধোয়ালে তোমাদের যা ডিমান্ড তার তিনগুন পাবে।”
আঁধার জোনাকি’র চোখাচোখি হলো একবার। এই সামান্য সময়ের চোখাচোখিটাও তৈমুরের নজর এড়ালো না। জোনাকি বললো,
–“আমাদের ডিমান্ড অনুযায়ী দিলেই হবে, তিনগুন লাগবে না।”
রিমু যেন সুযোগ পেলো আঁধারকে স্পর্শ করার। ও বললো,
–“অবশ্যই তিনগুন লাগবে, আমি ধোয়াচ্ছি হাত।”
বলে আঁধারের দিকে গেলেই আঁধার উঠে যেতে নেয়। তৈমুর বসতে বললে আঁধার চোখ রাঙিয়ে তাকায়। তৈমুর মৃদু হেসে বলে,
–“জোনাকি যদি ধুইয়ে দেয় তাহলেই টাকা তিনগুন হবে তাছাড়া না।”
জোনাকি আড়চোখে আরো একবার তাকায় আঁধারের দিকে। আঁধার এবার সরাসরি দৃষ্টি ফেলেই তাকিয়েছে জোনাকির পানে।
চলবে~